মাও এর সবচেয়ে বড়ো ভুল

 


১৯৪৯ সালে মাও সে তুঙ চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটালেন। এই ঘটনা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আতঙ্কের সৃষ্টি করে। স্নায়ুযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ছড়ানো মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, চীনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আর কূটনৈতিক নীরবতা তো ছিলই। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধি চীনের মাটিতে পা রাখেনি। ১৯৭১ সাল নাগাদ চীনের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কে চিড় ধরে।

https://www.history.com/news/ping-pong-diplomacy

এই অবস্থায় মাও ভাবতে শুরু করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করলে সোভিয়েতদের উচিত শিক্ষা দেয়া যাবেরিচার্ড নিক্সনও তার প্রশাসনে চীনের সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগানোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। ১৯৬৭ সালে নিক্সন লিখেছিলেন-

"আমাদের পক্ষে চিরদিন চীনকে রাষ্ট্র-পরিবারের বাইরে রাখা একেবারেই সম্ভব নয়।"

দুই দেশের কূটনীতিকরা গোপনে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন।

সেসময় জাপানের নাগোয়াতে ১৯৭১ বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ চলছে। একদিন চীনা জাতীয় দলকে বহনকারী শাটল বাসে ১৯ বছর বয়সী মার্কিন খেলোয়াড় গ্লেন কোয়ান উঠে বসলে তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকেন চীনের খেলোয়াড়রা। কেবল ঝুয়াং সে তুঙ সহাস্যে এগিয়ে যান কোয়ানের দিকে। দোভাষীর মাধ্যমে তার সাথে কথা বলেন এবং উপহারস্বরূপ তাকে চীনের হুয়াংশান পর্বতমালার একটি সিল্ক স্ক্রিন ছবি দেন। কোয়ান পরের দিন ঝুয়াংকে একটি টি-শার্ট উপহার দেন।

https://www.bbc.co.uk/news/av/magazine-25836922

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দুই খেলোয়াড়ের মধ্যকার এই ছবি ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলে আলোকচিত্রীরা। চীন তাদের খেলোয়াড়দের সাবধান করে দিয়েছিল যেন তারা কোনো মার্কিনীর সাথে কথা না বলেন। কিন্তু কোয়ান ও ঝুয়াংয়ের মধ্যকার পুরস্কার আদান-প্রদানের ব্যাপারে জানার পর মাও বিবৃতি দিলেন-

"ঝুয়াং সে তুঙ কেবল একজন ভালো টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ই নন, তিনি দারুণ একজন কূটনীতিকও বটে।"

প্রতিযোগিতা শেষে যুক্তরাষ্ট্র দলের নাগোয়া ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়ার সময় মাও যুক্তরাষ্ট্র দলকে আমন্ত্রণ জানালেন চীন সফরের এবং সেই সফরের যাবতীয় খরচ তিনি নিজেই বহন করবেন বলে জানান।

যুক্তরাষ্ট্র দল সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিজেদের দূতাবাসে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে সবুজ সংকেত পাওয়া গেলো। পরবর্তীতে নিক্সন তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছিলেন-

"আমি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি একটি পিংপং দলের রূপে চীনের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে।"

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ১৫ জন আমেরিকান টেবিল টেনিস খেলোয়াড়, টিম অফিসিয়াল ও খেলোয়াড়দের স্ত্রীরা হংকং-চীন সেতু অতিক্রম করেন। যুক্তরাষ্ট্র দলটিতে ছিলেন গ্লেন কোয়ানের মতো ভবঘুরে, এক কলেজের অধ্যাপক, গায়ানার এক অভিবাসী, হাই স্কুল পড়ুয়া দুই কিশোরীও। যুক্তরাষ্ট্র পুরুষ দল ঐসময় অবস্থান করছিল র‍্যাংকিংয়ের ২৪ নম্বরে। কোনো খেলোয়াড়ের আর্থিক অবস্থা তেমন সুবিধাজনক ছিল না। একঝাঁক পশ্চিমা সাংবাদিক তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছিলেন। কয়েকজন খেলোয়াড়কে মার্কিন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনগুলো তাদের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। দশদিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্র দল গুয়ানঝৌ, বেইজিং ও সাংহাইয়ের নয়নাভিরাম স্থানগুলো ঘুরে বেড়ায়। চীনের মহাপ্রাচীর, সামার প্যালেস এবং বিপ্লবী থিমের অপেরা দেখা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা বেশ কিছু প্রদর্শনী পিংপং ম্যাচে অংশ নেয়। চীনের খেলোয়াড়রা সিংহভাগ ম্যাচ তারা হেসেখেলে জিতে গেলেও কয়েকটি ম্যাচ যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের ছেড়ে দিতে ভোলেনি ইচ্ছাকৃতভাবে! বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে প্রধানমন্ত্রী ঝৌ এন  লাই মার্কিন খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। গ্লেন কোয়ান চীনা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন আমেরিকান হিপি আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কী মতামত! ঝৌ বলেন-

"তরুণেরা সবসময়ই সত্যের সন্ধান করে এবং এই সন্ধান নানা সময়ে নানা রূপে আবির্ভূত হয়। আমাদের যখন বয়স কম ছিল, আমরাও এগুলো করেছি।"

একই দিনে নিক্সন ঘোষণা দেন চীনের উপর থেকে ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার। কিছুদিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সরকার পারস্পরিক যোগাযোগ শুরু করে। জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বেইজিংয়ে গোপন সফরে যান। পরের বছর চীন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের টেবিল টেনিস দল পাঠায়। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিচার্ড নিক্সন চীন ভ্রমণ করেন। এই সফরে তিনি ঝৌ এন লাই ও মাও এর সাথে দেখা করেন।

পিংপং ডিপ্লোম্যাসির ফলে-

#১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল চীনের উপর ২০ বছর ধরে থাকা ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

#১৯৭১ সালের অক্টোবরে ভোটের মাধ্যমে জাতিসংঘে বৈধ পদ লাভ করে চীন। পাশাপাশি তারা অল্প সময়ের মধ্যে অন্যান্য দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সক্ষম হয়।

#১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফর সমাপ্ত হয় 'সাংহাই কম্যুনিক' এর মাধ্যমে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। এই চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট দুই দেশের সার্বভৌমত্ব ও আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, জনগণের মধ্যে যোগাযোগের পথ সুগম এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে সর্বোচ্চ লাভজনক পন্থা বেছে নেয়ার ব্যাপারে উল্লেখ ছিল।

#১৯৭৩ সালের মে মাসে উভয় দেশের রাজধানীতে লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনের মাধ্যমে পারস্পরিক রাজনৈতিক আলোচনার পথ সুগম করা হয়।

#১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে স্বীকৃতি দেয়।

#চীনের সমর্থন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হেলে পড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হওয়ার দৌড়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।









Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]