তথাকথিত সমাজতন্ত্রের আড়ালে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ (পর্ব-দুই)

 

কিরগিজস্তানের পূর্বদিকে চীনের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। চীনের সঙ্গে কিরগিজস্তানের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১,০৬৩ কি.মি.। অর্থনীতির মাধ‍্যমে চীন কিরগিজস্তান এবং সমগ্র মধ‍্য এশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। এই উদ্দেশ্যে চীন কিরগিজস্তানের অর্থনীতিকে চীনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে বহুলাংশে সফল হয়েছে। কারণ বেইজিং ভালো করেই জানে, একটি রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের হাতে চলে আসবে কিরগিজস্তানের অর্থনীতি ক্রমশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। চীন কিরগিজস্তানের আমদানির বৃহত্তম উৎস এবং কিরগিজস্তানের মোট আমদানির প্রায় ৩৩.৪% আসে চীন থেকে। এর বিপরীতে চীন কিরগিজস্তান থেকে খুব কম পণ‍্য আমদানি করে; কিরগিজস্তান যেসব রাষ্ট্রে পণ‍্য রপ্তানি করে সেই তালিকায় চীনের অবস্থান শীর্ষ পাঁচের মধ‍্যে নেই। কিরগিজস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৮.১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৪১% চীন থেকে নেয়া। কিরগিজস্তানের মোট জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণই ৮.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! চীনের ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ব‍্যাঙ্কের কাছে ২০০৯ সালে কিরগিজস্তানের ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর পরবর্তী ১০ বছরে এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে! চীন যেভাবে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও কেনিয়াকে ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলেছে, কিরগিজস্তানকে একইভাবে ঋণের ফাঁদে ফেলবে এবং অন‍্যায় সুবিধা আদায় করে নেবে। চীনের বেল্ট অ‍্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কিরগিজস্তান অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিআরআই প্রকল্পে যে ৬টি করিডোর সৃষ্টির উদ‍্যোগ নেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে চীন-মধ‍্য এশিয়া-পশ্চিম এশিয়া করিডোর, যেটি চীনকে সড়ক ও রেলপথে ভূমধ‍্যসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।

https://foreignpolicy.com/2019/03/31/963451-kyrgyz-xinjiang-students-camps/

করিডোরটি কিরগিজস্তানসহ মধ‍্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ‍্য দিয়ে ইরান হয়ে তুরস্কে গিয়ে শেষ হবে। বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবে চীন কিরগিজস্তানে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে এবং বর্তমানে কিরগিজস্তানে শীর্ষ বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র হচ্ছে চীন। কিরগিজস্তানের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে চীন এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কিরগিজস্তানের বাৎসরিক বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কিরগিজস্তানের অবকাঠামো খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করলেও চীনা প্রযুক্তি ও লোকবল ব‍্যবহার করে নির্মিত অবকাঠামোর গুণগত মান নিম্ন।

https://www.nytimes.com/2019/07/06/world/asia/china-russia-central-asia.html

২০১৩ সালে বিশকেক শহরের সোভিয়েত আমলে নির্মিত বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটি সংস্কার করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। রুশ কোম্পানি ইন্তের আরএও এবং চীনা কোম্পানি টিবিইএ উভয়ে কাজটি পাওয়ার প্রচেষ্টা চালায়।

https://www.interrao.ru/en/

রুশ কোম্পানিটি বিশকেকে একটি নতুন বিদ‍্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেয় এবং এজন‍্য ৫১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন বলে জানায়। অন‍্যদিকে চীনা কোম্পানিটি ৩৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পুরাতন বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটির সংস্কার করে দেবে বলে জানায়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/TBEA#Construction_engineering

চীনা কোম্পানিটি তুলনামূলক সস্তায় কাজটি করে দেবে বলে কিছু কিরগিজ বিশেষজ্ঞ কাজটি চীনা কোম্পানিকে দেয়ার প্রস্তাব করেন। চীনা কোম্পানিটির বিদ‍্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও রুশ কোম্পানিটি এই কাজে অভিজ্ঞ বিধায় অন‍্য একদল কিরগিজ বিশেষজ্ঞ কাজটি রুশ কোম্পানিটিকে দিতে চেয়েছিলেন।

https://thediplomat.com/2019/10/why-is-anti-chinese-sentiment-on-the-rise-in-central-asia/

কিন্তু চীনা সরকারের প্রবল চাপের মুখে বিশকেক এই কাজটি চীনা কোম্পানিটিকে দিতে বাধ‍্য হয়। বিদ‍্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের জন্য যে ৩৮ কোটি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলারের প্রয়োজন, সেটি কিরগিজস্তানকে চীন থেকে ঋণ নিতে হয়, সুদসহ যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! সংস্কারের এক বছরের মাথায় ২০১৮ সালে বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে এবং শূন‍্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রার মধ‍্যে বিশকেক শহরের অধিবাসীরা বিদ‍্যুৎ ও তাপবিহীন হয়ে পড়ে। অথচ রুশ কোম্পানিটি বিশকেকে নতুন একটি বিদ‍্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে দিতে চেয়েছিল। কিরগিজস্তানকে ঋণ দেয়ার পরিবর্তে তারা নিজেদের অর্থে বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি করতে চেয়েছিল, বিনিময়ে তারা চেয়েছিল বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটির আংশিক মালিকানা ও বছরপ্রতি বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটি থেকে প্রাপ‍্য রাজস্বের অংশবিশেষ। বিদ‍্যুৎকেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ার পর কিরগিজস্তানের সরকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সাপার ইসাকভসহ বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sapar_Isakov

ইসাকভের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি চীনা সরকারের চাপে কোম্পানিটিকে কাজটি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন! কিরগিজস্তানে চীন যেসব প্রকল্প নিয়েছে, সেই প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় কিরগিজদের কাজ না দিয়ে চীনাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

https://www.rferl.org/amp/kyrgyz-authorities-cancel-chinese-investment-project-amid-protests/30441324.html

কিরগিজস্তানে বিভিন্ন চীনা প্রকল্পে কাজের জন‍্য এবং অন্যান্য কারণে বহু সংখ্যক চীনা নাগরিক বসতি স্থাপন করছে। ২০১৮ সালে প্রায় ৩০ হাজার চীনা কিরগিজস্তানে এসেছে। এদের মধ‍্যে অনেকে স্থানীয় কিরগিজ মেয়েদের বিয়ে করছে। চীনা সরকার কিরগিজস্তানে বেশ কয়েকটি 'কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট' স্থাপন করেছে, যার উদ্দেশ্য কিরগিজদের মধ‍্যে চীনপন্থী মনোভাব সৃষ্টি করা।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Confucius_Institute

২০১৯ সালের ১ অক্টোবর কিরগিজস্তানের বিভিন্ন শহরে চীনারা তাদের জাতীয় দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন করেছে। কিরগিজস্তানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত সমস্যা ছিল। কিরগিজস্তান যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তখন কিরগিজস্তানের ভূমি দখল করার সাহস চীনের ছিল না। কিন্তু স্বাধীন কিরগিজস্তানের সামরিক বাহিনী দুর্বল হওয়ার কারণে ১৯৯০ এর দশকে কিরগিজস্তান চীনের নিকট সীমান্তবর্তী ১,২৫০ কি.মি. ভূমি হস্তান্তর করতে বাধ‍্য হয়। চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে প্রায় ২ লক্ষ কিরগিজ বসবাস করে এবং এদের সঙ্গে কিরগিজস্তানের কিরগিজদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। চীন ২০১৭ সাল থেকে জিনজিয়াং অঞ্চলের যেসব মুসলিমকে পুন:শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে বন্দি করে রেখেছে, তাদের মধ‍্যে কমপক্ষে ২২ হাজার কিরগিজ রয়েছে। অধিকাংশই চীনের নাগরিক হলেও এদের মধ‍্যে বেশ কিছু কিরগিজস্তানের নাগরিক ছিল। কিরগিজস্তানের জনসাধারণ এজন্য চীনবিরোধী প্রতিবাদ মিছিল করে। যদিও কিরগিজস্তানের সরকার জিনজিয়াং ইস‍্যুতে মৌনতা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কিরগিজস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সুরুনবে জিনবেকভ জানান, তারা কূটনীতির মাধ‍্যমে বন্দি কিরগিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন এবং চীনের অভ‍্যন্তরীণ ব‍্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে তারা অপারগ।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sooronbay_Jeenbekov

২০১৮ সালের জুনে কিরগিজস্তান চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে 'ব‍্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বে'র পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এর ফলে কিরগিজস্তান ও চীনের মধ‍্যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চীনা সৈন‍্যরা কিরগিজস্তানের মাটিতে কিরগিজ সৈন‍্যদের সঙ্গে সামরিক মহড়া করেছে।

http://www.xinhuanet.com/english/2019-06/13/c_138141034.htm

কিরগিজদের জাতীয় মহাকাব‍্য 'মানাসের মহাকাব‍্যে' কিরগিজ মহাবীর মানাস যেসব শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তাদের একটি হলো চীন। 'মানাস মহাকাব‍্য' বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম মহাকাব্য।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Epic_of_Manas

চীনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশকেক মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। কিরগিজস্তান মস্কো নিয়ন্ত্রিত 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ', 'ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন' এবং 'যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা'র সদস‍্য।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Commonwealth_of_Independent_States

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eurasian_Economic_Union

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Collective_Security_Treaty_Organization

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কিরগিজস্তানের বিভিন্ন শহরে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিরগিজরা চীনাদের কিরগিজস্তানের কাজ করার অনুমতিপত্র প্রদান বন্ধ, চীনের নিকট কিরগিজস্তানের ঋণ হ্রাস এবং কিরগিজ মেয়েদের সঙ্গে চীনাদের বিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিরগিজ পুলিশ বহুসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কিরগিজস্তানের পূর্বাঞ্চলের নারিন শহরে চীন ২৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব‍্যয়ে একটি সরবরাহ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প নিলেও স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিবাদের কারণে সরকার প্রকল্পটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]