এরদোয়ানের দাবার চাল
যেই এরদোয়ান পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষায় রোহিঙ্গাদের জন্য কুমিরের কান্না দেখিয়েছে, সেই এরদোয়ান চীনের ঋণের ফাঁদে পা দিয়ে তুরস্কের বারোটা বাজাতে যাচ্ছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তুরস্কের বর্তমান সরকার উগ্র জাতীয়তা আর ধর্মের জুস বানিয়ে আমজনতাকে খাওয়াচ্ছে, যা বিশ্বের অন্যান্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও দেখা যায়।
https://www.hurriyet.com.tr/ekonomi/1994-te-ecevit-ortaya-atti-mansetlere-mega-proje-diye-yansidi-17655112
বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকার কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৫৯১ সালের ৬ মার্চ সুলতান তৃতীয় মুরাত উক্ত জলপথ নির্মাণ সম্পর্কে রাজকীয় ফরমান জারি করলেও অজ্ঞাত কারণে প্রকল্পটি স্থগিত রাখা হয়। সুলতান চতুর্থ মেহমেদের শাসনামলে ১৬৫৪ সালে খালটির নির্মাণকাজ পুনরায় আরম্ভ করার জন্য চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখা হয়। সুলতান তৃতীয় মুস্তাফা শাসনামলের প্রথমদিকে দু'বার এই প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রচেষ্টা চালালেও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে প্রকল্পটি স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ 'রাজকীয় ওসমানীয় কমিটি' গঠন করেন এবং ১৮১৩ সালে উক্ত কমিটি প্রকল্পটি সম্পর্কে সুলতানের নিকট প্রতিবেদন পেশ করলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
https://emlakkulisi.com/1991-yilinda-alternatif-bogaz-kanal-istanbul/357395
তুর্কি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ইয়ুকসেল ওনেম ১৯৮৫ সালে 'তুর্ক সিতান্দার্তলারি এনস্তিতুসু'র ম্যাগাজিনে এবং ১৯৯০ সালে 'তুর্কিয়ে বিলিমসেল ভে তেকনোলোজিক আরাশতিরমা কুরুমু'র 'বিলিম ভে তেকনোলোজি দার্গিসি' জার্নালে ইস্তাম্বুল খাল সম্পর্কে দু'টি সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। ১৯৯১ সালে 'ইস্তাম্বুল মেট্রোপলিটান পৌর পরিবেশ কমিশন' এর প্রধান নুসরেত আভজি প্রস্তাব করেন কৃষ্ণসাগরকে মর্মর সাগরের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি ২৩ কি.মি. দীর্ঘ খাল খনন করা উচিত। উক্ত খাল বসফরাস প্রণালীর ওপর থেকে চাপ কমাবে এবং পরিবেশ দূষণ রোধ করবে। উক্ত খাল খননের ফলে দানিউব নদীর নৌ চলাচল তুরস্কে স্থানান্তরিত হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি পরামর্শ দেন খালটির অর্থায়ন 'বিল্ড অপারেট ট্রান্সফার' পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। সেসময় ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ ন্যাভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্সেস এর অধ্যাপক ডক্টর ইলহান আর্তুজ এবং ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ জিওলজির অধ্যাপক ডক্টর ওকায় এরোস্কায় প্রকল্পটির পরিবেশগত ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে এই ধরনের কোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। ১৯৯৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত তুর্কি স্থানীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৭ জানুয়ারি 'দেমোক্রেতিক সোল পার্তি'র তদানীন্তন সভাপতি বুলেন্ত এজেভিত কৃষ্ণসাগর ও মর্মর সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি বিকল্প জলপথ নির্মাণের প্রস্তাব করেন এবং কারণ হিসেবে বসফরাস প্রণালীতে ক্রমবর্ধমান নৌযান চলাচলকে উল্লেখ করেন। তার দলের নির্বাচনি প্রচারপত্রে এই প্রস্তাবের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। এজেভিত চারবার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেননি।
https://www.hurriyetdailynews.com/kanal-istanbul-gets-ministry-nod-on-environment-151093
২০০৯ সালের মে মাসে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তদানীন্তন তুর্কি যোগাযোগমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম কৃষ্ণসাগর ও মর্মর সাগরকে সংযুক্ত করার জন্য বসফরাস প্রণালীর বিকল্প একটি জলপথ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তুর্কি সাংবাদিক ও লেখক হিনজাল উলুচ 'সাবাহ' পত্রিকায় 'প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্ভট প্রকল্প' শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন।
https://armenianweekly.com/2021/06/16/istanbul-canal-a-megaproject-with-strategic-implications/
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত তুর্কি সাধারণ নির্বাচনের আগে ২৭ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনি র্যালিতে এরদোয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। খালটি বসফরাস প্রণালীর সমান্তরালে নির্মিত হবে এবং এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে নতুন সমুদ্রবন্দর, সেতু, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা ও কৃত্রিম হ্রদ নির্মিত হবে।
https://www.google.com/amp/s/amp.france24.com/en/middle-east/20210629-turkey-s-crazy-and-controversial-istanbul-canal-project
এরদোয়ান ঘোষণা করেন ২০২৩ সালে তুর্কি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তির সময়ে খালটি উদ্বোধন করা হবে। তিনি এই প্রকল্পকে পানামা ও সুয়েজ খাল খনন প্রকল্পের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেন। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল 'জুমহুরিয়েত হালক পার্তিসি'র প্রেসিডেন্ট কেমাল কিলিচদারোলু সেসময় মন্তব্য করেন-
"এই জাতির উদ্ভট লোকের না, চিন্তা করতে পারে এরকম লোকের প্রয়োজন।"
২০১৮ সালের তুর্কি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুসারে খালটি মর্মর সাগরের নিকটবর্তী কুচুকচেকমেজে হ্রদ অতিক্রম করবে এবং আভজিলার ও বাশাকশেহির জেলাদ্বয়ের মধ্য দিয়ে ইস্তাম্বুলের উত্তরে আর্নাভুৎকয় জেলা হয়ে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত পৌঁছাবে। খালটির ৭ কি.মি. কুচুকচেকমেজে হ্রদের মধ্য দিয়ে, ৩.১ কি.মি. আভজিলারের মধ্য দিয়ে, ৬.৫ কি.মি. বাশাকশেহিরের মধ্য দিয়ে এবং ২৮.৬ কি.মি. আর্নাভুৎকয়ের মধ্য দিয়ে যাবে। ২০২১ সালের জুনে এরদোয়ান সালিজদেরে সেতুর উদ্বোধন করেন। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হলে এই সেতুর অবস্থান হবে খালের ওপরে। আট লেনবিশিষ্ট এবং ৮৪০ মিটার দীর্ঘ সড়ক সেতুটি উত্তর মর্মর রাজপথের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এই সেতুকে তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের প্রথম অবকাঠামো হিসেবে বর্ণনা করেছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এরদোয়ান জানান, পরবর্তী ছয় বছরের মধ্যে ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হবে এবং এর নির্মাণকাজে ব্যয় হবে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উত্তর মর্মর রাজপথ ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ও তৃতীয় বসফরাস সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত। সালিজদেরে সেতু উক্ত রাজপথের সঙ্গে যুক্ত হবে বিধায় ইস্তাম্বুলের 'সিএইচপি' দলীয় মেয়র একরেম ইমামোলু ধারণা করছেন সেতুটি ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের অংশ নয়, বরং তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুলে যে যাতায়াত সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে সেটির অংশ।
https://www.mei.edu/publications/canal-istanbul-dont-believe-hype
https://www.google.com/amp/s/www.aljazeera.com/amp/news/2021/6/26/turkey-erdogan-takes-first-step-in-controversial-istanbul-canal-project
২০২১ সালের জুনে সালিজদেরে সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এরদোয়ান দাবি করেন, নতুন এই জলপথ বসফরাস প্রণালীর তুলনায় ৩০ গুণ বেশি নিরাপদ হবে এবং বিকল্প পথ সৃষ্টির ফলে বসফরাসে যানজটের পরিমাণ ৯০% হ্রাস পাবে! তার ভাষ্যমতে, খালটি তুর্কি জাতির 'গর্বের উৎস' হবে এবং অন্যান্য জাতির ঈর্ষার উদ্রেক করবে। ২০০২ সালে একেপির ক্ষমতায় আরোহণের পর ইস্তাম্বুলে তারা বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণ করে। বসফরাস প্রণালীর ওপর তারা একটি নতুন সেতু নির্মাণ করে। তারা ইস্তাম্বুলে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করে, যেটি বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর বর্তমানে। এই ধরনের মেগাপ্রকল্পগুলোকে একেপি সরকার জনসাধারণের মধ্যে নিজেদের সমর্থন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে। ইস্তাম্বুল খাল অনুরূপ একটি প্রকল্প, যেটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে তুর্কি সরকার নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে আগ্রহী। খালটি নির্মিত হবে এমন একটি জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে, যেটি সুপেয় পানির উৎস এবং সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ইস্তাম্বুলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। ইস্তাম্বুলের ৪০% পানি আসে শহরটির ইউরোপীয় অংশ থেকে, যেখানে খালটি নির্মিত হবে। ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের ফলে ইস্তাম্বুলের দু'টি জলাধার ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ইস্তাম্বুল ও পূর্ব থ্রেস অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ দূষিত হয়ে পড়বে। এজন্য ইস্তাম্বুলের মেয়র ইমামোলু ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। ইস্তাম্বুল খাল কৃষ্ণসাগর ও মর্মর সাগরের মধ্যবর্তী পানির প্রবাহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলতে পারে। উক্ত খালের মাধ্যমে কৃষ্ণসাগরের দূষিত পানি ভূমধ্যসাগরে প্রবাহিত হবে। সম্প্রতি মর্মর সাগরে সামুদ্রিক শ্লেষ্মা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাগরটি এবং সামগ্রিকভাবে তুর্কি সামুদ্রিক পরিবেশ গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের ফলে মর্মর সাগর আরো দূষিত হয়ে পড়বে। তুর্কি 'চেম্বার অফ আরবান প্ল্যানার্সে'র ভাইস প্রেসিডেন্ট পিনার গিরিৎলিওলুর ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খালের মাধ্যমে কৃষ্ণসাগর ও মর্মর সাগরের পানির সংমিশ্রণ ঘটবে এবং এর ফলে ইস্তাম্বুলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও তুর্কি সামুদ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই খাল খননের ফলে ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এরদোয়ান উক্ত প্রকল্পকে 'বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, নতুন এই সামুদ্রিক জলপথটির নির্মাণের ফলে মর্মর সাগরের বাস্তুতন্ত্র লাভবান হবে। এরদোয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী যেভাবে ওসমান গাজী সেতু নির্মাণের অর্থায়ন করা হয়েছিল, সেভাবে ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের অর্থায়ন করা হবে। ওসমান গাজী সেতু ইজমির উপসাগরের ওপর অবস্থিত। তুর্কি সরকার উক্ত সেতু নির্মাণের প্রকল্পটির দায়িত্ব 'ওতোয়োল ইয়ারিরিম এ. এস.' কোম্পানিকে প্রদান করেছিল। কোম্পানিটির আদায়কৃত শুল্কের পরিমাণ ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম এবং ২০২০ সালে তুর্কি সরকার ঐ কোম্পানিকে ৩ বিলিয়নের বেশি তুর্কি লিরা প্রদান করতে বাধ্য হয়। তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল থেকে আয় করতে পারবে কিনা, সেটি নির্ভর করবে ঐ খালে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে কিনা সেটির ওপর। যদি খালটির ক্ষেত্রে উক্ত কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হয়, সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকার খাল দিয়ে যাতায়াতকারী নৌযানগুলোর কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতে পারবে না। প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খালের ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে না। অন্যদিকে তুর্কি সরকার কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে খালটির ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। 'সিএনএন তুর্ক'কে প্রদত্ত বিবৃতিতে তুর্কি পরিবহন ও অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, অবশ্যই খালটির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নৌযান চলাচল করবে এবং তুরস্ক এই ধরনের অর্থনৈতিক মডেল প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি! তুর্কি পরিবহন ও অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৬ সাল নাগাদ ইস্তাম্বুল খাল দিয়ে বছরে ৫৪,৯০০টি নৌযান যাতায়াত করবে এবং ২০৩৯ সাল নাগাদ সংখ্যাটি বেড়ে ৬৮,০০০ এ উন্নীত হবে। কিন্তু এই অঞ্চলে পাইপলাইনের মাধ্যমে হাইড্রোকার্বন সরবরাহের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একই সঙ্গে কিছু রাষ্ট্র জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলছে। এর ফলে বসফরাস প্রণালী দিয়ে নৌযান চলাচলের হার হ্রাস পেয়েছে। এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশকে বসফরাস প্রণালী দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা ৫৩,০০০ থেকে ৩৮,০০০ এ নেমে এসেছে। বসফরাস প্রণালীতে নৌযান চলাচল যেহেতু শুল্কমুক্ত, সেহেতু বহু নৌযান বিকল্প পথে গিয়ে তাদের ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চাইবে না।
https://iari.site/2021/04/08/turkey-and-the-geopolitics-of-the-straits/
বসফরাস প্রণালী ব্যবহারকারী জাহাজ কোম্পানিগুলো এখন পর্যন্ত কৃষ্ণসাগর ও মর্মর সাগরের মধ্যে নতুন কোনো জলপথ নির্মাণের দাবিও উত্থাপন করেনি।
https://armenianweekly.com/2021/06/16/istanbul-canal-a-megaproject-with-strategic-implications/
http://www.natofoundation.org/levant/canal-istanbul-geopolitical-implications/
যেসব জাহাজের ক্যাপ্টেন 'ডয়েচ ভেলে'র টার্কিশ সার্ভিসকে সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন, তাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন ইস্তাম্বুল খালের চেয়ে বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ চালানো তাদের কাছে অধিক পছন্দনীয়। ন্যাটো ডিফেন্স কলেজ ফাউন্ডেশনের বক্তব্য অনুসারে, তুর্কিরা উক্ত খালটি নির্মাণের পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তি দেখালেও তাদের মূল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক।
https://jamestown.org/program/moscow-worried-about-ankaras-plans-for-canal-bypassing-bosporus-straits/
মনথ্রো কনভেনশনের কারণে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নৌবহরের কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ থাকায় তারা কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পূর্ণ নৌশক্তি ব্যবহার করতে পারে না। মস্কোর নৌবহরের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধিনিষেধ প্রযোজ্য। তুরস্ক ১৯৫০ এর দশক থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। কিন্তু মনথ্রো কনভেনশনের কারণে তুরস্ক চাইলেই পশ্চিমা বিশ্বকে বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে কৃষ্ণসাগরের সামরিকায়ন করার অনুমতি দিতে পারে না।
https://www.veryansintv.com/104-amiralden-montro-ve-ataturk-bildirisi
উক্ত কনভেনশন অনুযায়ী বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় দিয়ে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজগুলোর কাছ থেকে তুরস্ক কোনো শুল্ক আদায় করতে পারে না। এজন্য তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের একাংশ মনথ্রো কনভেনশন বাতিল করে দিতে আগ্রহী। তুরস্ক চাইলেই উক্ত কনভেনশন বাতিল করে দিতে পারবে না, সেক্ষেত্রে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী বাকি রাষ্ট্রগুলোর সম্মতির প্রয়োজন হবে। তুরস্ক মূলত মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইস্তাম্বুল খাল খননের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইতালি ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক 'ইনস্টিটিউট ফর দি অ্যানালাইসিস অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে'র বিশ্লেষক আলেসান্দ্রা কাসারেজ্জোর ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খাল খননের মধ্য দিয়ে তুরস্ক তুর্কি প্রণালীদ্বয়ে নৌ চলাচল বহুলাংশে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে পারবে এবং এর মধ্য দিয়ে মনথ্রো কনভেনশন কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধ বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে পারবে। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হওয়ার পর এটি যদি মনথ্রো কনভেনশনের আওতায় না পড়ে, সেক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য কৃষ্ণসাগরে নিজেদের নৌবহর প্রেরণের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধানিষেধ থাকবে না। তারা নিজেদের ইচ্ছেমাফিক সেখানে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে কৃষ্ণসাগরের সামরিক ভারসাম্যকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারবে। অন্যদিকে ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হওয়ার পর যদি এটি মনথ্রো কনভেনশনের আওতায় না পড়ে, সেক্ষেত্রে রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে তাদের বাণিজ্যিক ও সামরিক নৌযান প্রেরণের জন্য বসফরাস প্রণালীর পাশাপাশি একটি নতুন জলপথ পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের ইচ্ছেমাফিক ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে পারবে এবং ইতিপূর্বে বিশ্বের সাগরগুলোতে সামরিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তাদের জন্য যেসব আইনি ও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ছিল সেগুলো বহুলাংশে দূরীভূত হবে। 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে'র ভিজিটিং ফেলো বোরিস টুকার মতে, এতদঞ্চলে রাশিয়ার চূড়ান্ত ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামরিক উপস্থিতি স্থাপন করা এবং এর মধ্য দিয়ে ঈজিয়ান সাগর ও মধ্য ভূমধ্যসাগরে ন্যাটোর উপস্থিতিকে প্রতিহত করা। তুরস্ক কর্তৃক রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন, রাশিয়ার কাছ থেকে 'এস-৪০০ ত্রিউম্ফ' এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়, 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরির প্রকল্প থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তুরস্কের বহিষ্কার ও তুর্কি সামরিক শিল্পের ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ভূমধ্যসাগরের জ্বালানি সম্পদ নিয়ে গ্রিস ও ফ্রান্সের সঙ্গে তুরস্কের বিরোধ, নাগর্নো-কারাবাখ দ্বন্দ্ব, লিবীয় গৃহযুদ্ধে তুরস্ক ও ফ্রান্সের বিপরীতমুখী অবস্থান, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যকার প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা, তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরদোয়ানের সরকারের ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের নিন্দা জ্ঞাপন, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান ও এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী ফেতুল্লাহ গুলেনকে আশ্রয় প্রদান, কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি মার্কিন সমর্থন, কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুর্কি সামরিক অভিযান- এসব কারণে বর্তমানে তুরস্ক ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমশ নেতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে।
https://www.google.com/amp/s/tass.com/economy/1279731/amp
তুরস্ক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিস ও ফ্রান্সের সঙ্গে, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় ফ্রান্সের সঙ্গে এবং সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত। অনুরূপভাবে সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগর্নো-কারাবাখে তুরস্ক ও রাশিয়া কর্তৃক বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ, ইউক্রেন, দক্ষিণ ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় তুর্কিদের নিজস্ব প্রভাব বিস্তার ও রুশ প্রভাব খর্ব করার প্রচেষ্টা, রাশিয়ার উত্তর ককেশাস ও বৃহত্তর তুর্কি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে তুর্কিদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা, রাশিয়ায় ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তিকে স্বীকৃতি প্রদানে তুর্কিদের অনীহা, তুরস্ক কর্তৃক উত্তর ককেশাস থেকে আগত জঙ্গিদের আশ্রয় প্রদান, পূর্ব ইউরোপের রুশবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সুসম্পর্ক, তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের 'বৃহত্তর তুরান' প্রকল্প, তুরস্ক ও সিরিয়ার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগ রক্ষা, রাশিয়া কর্তৃক তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রদান, বিশ্ব অস্ত্রবাজারে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের প্রতিযোগিতা- এসব কারণে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী সম্পর্কে দ্বান্দ্বিক দিকটি ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে। তুর্কি প্রচারমাধ্যম রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের পাশাপাশি দক্ষিণ রাশিয়ার বিস্তৃত অংশ অধিকার করে নেয়ার কথা আলোচনা করছে। কিন্তু সম্প্রতি পরিচালিত একটি জরিপে অংশগ্রহণকারী তুর্কি নাগরিকদের ৭৯% যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে রাশিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছে। তুরস্কের রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান নতুন স্নায়ুযুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে উভয় পক্ষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ সুবিধা আদায় করে নেয়া এবং একইসঙ্গে তুরস্ককে একটি একচ্ছত্র আঞ্চলিক শক্তি ও বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। রুমানিয়া ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক 'গিওর্গে ব্রাতিয়ানু ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ জিওপলিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ' এর প্রধান কনস্তান্তিন কর্নেয়ানুর ভাষ্যমতে, আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক খেলাগুলোয় তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এরদোয়ান বরাবর যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন, ইস্তাম্বুল খাল সেই প্রচেষ্টার একটি নতুন হাতিয়ারে পরিণত হবে। ১৮৫৩-৫৬ সালের যুদ্ধে কৃষ্ণসাগরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ওসমানীয় রাষ্ট্র ও সার্দিনিয়ার সমন্বয়ে গঠিত জোট রাশিয়াকে পরাজিত করে। কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম মনথ্রো কনভেনশন, যার কারণে কৃষ্ণসাগরে পশ্চিমা সামরিক নৌযানের প্রবেশের ওপর নানা বিধিনিষেধ বিদ্যমান। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হলে এবং এটি উক্ত কনভেনশনের আওতায় না পড়লে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাবে। এই অঞ্চলে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পশ্চিমা সামরিক নৌযানের প্রবেশাধিকার সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে রাশিয়াকে তখন তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে এবং তুরস্ক বিনিময়ে অন্যান্য অঞ্চলে রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় চাইবে।
https://iari.site/2021/04/08/turkey-and-the-geopolitics-of-the-straits/
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সেই ইয়েরখভ জানিয়েছেন রাশিয়া মনথ্রো কনভেনশন নিয়ে নতুন করে কোনো আলোচনায় আগ্রহী নয়। তাদের এই বক্তব্যের পর তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংশোধন করে সেখানে সংযোজন করে যে, ইস্তাম্বুল খালের ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের সকল শর্ত প্রযোজ্য হবে এবং বসফরাস প্রণালী নৌ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কেবল রুশদের সন্তুষ্ট করার জন্যই তুর্কি সরকার তাদের প্রতিবেদনে এই বক্তব্য সংযোজন করেছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার ওপর সামরিক চাপ বৃদ্ধি এবং ভূমধ্যসাগরে রুশদের উপস্থিতি সীমিত রাখার জন্য তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইবে এবং সেক্ষেত্রে তুরস্ক অন্যান্য বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে ছাড় দাবি করবে। কৃষ্ণসাগরকে রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর এতদঞ্চলে রুশ প্রভাব হ্রাস পেলেও এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য রুশদের অনুকূলে রয়েছে। সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ রুশ জলসীমায় প্রবেশ করার পর রুশ কোস্টগার্ড উক্ত যুদ্ধজাহাজের গমনপথে বোমাবর্ষণ করে সেটিকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইস্তাম্বুল খালকে রুশদের বিরুদ্ধে পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে চায় তাহলে তুরস্ক যে এস-৪০০ ইস্যু, সিরীয় কুর্দিদের প্রতি মার্কিন সমর্থন ও গুলেনকে আশ্রয় প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ছাড় চাইবে। ইস্তাম্বুল খাল এতদঞ্চলে মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনুকূল হবে, এরকম প্রচারণা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মার্কিনিরা এই প্রকল্প নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের একাংশ ১৯২৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত লুজান চুক্তিকে 'দ্বিতীয় সেভ্রে চুক্তি' হিসেবে বিবেচনা করে। সেভ্রে চুক্তিকে 'সাইকস-পিকো চুক্তি'র তুর্কি সংস্করণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়; সাইকস-পিকো চুক্তির মধ্য দিয়ে যেভাবে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, তেমনিভাবে সেভ্রে চুক্তির মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তি তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিল। লুজান চুক্তি এবং পরবর্তীতে সম্পাদিত মনথ্রো কনভেনশন তুরস্কের জন্য তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক ছিল। তা সত্ত্বেও তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীরা লুজান চুক্তি ও মনথ্রো কনভেনশনকে তুরস্কের ওপর 'চাপিয়ে দেয়া চুক্তি' হিসেবে বিবেচনা করে এগুলো বাতিল করতে ইচ্ছুক। ইস্তাম্বুল খাল খননের পর এটির ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশন প্রযোজ্য হবে না, তুর্কি সরকার তুর্কি জনসাধারণকে এরকম একটি ধারণা প্রদান করেছে। এজন্য ইস্তাম্বুল খাল খননকে তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের একাংশ নিজেদের বিজয় হিসেবে বিবেচনা করছে। তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদী দল 'এমএইচপি' একেপি নিয়ন্ত্রিত তুর্কি সরকারের অংশীদার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের সমর্থন এরদোয়ানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণসাগরে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে সেই যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের একাংশ এই প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। সম্প্রতি তুর্কি নৌবাহিনীর ১০৪ জন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল একটি খোলা চিঠিতে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এই কনভেনশনের শর্তের যাতে খেলাপ না করা হয় সেটির আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, মনথ্রো কনভেনশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু তুর্কি সরকার এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে উক্ত চিঠিতে স্বাক্ষর প্রদানকারী ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তুর্কি সরকারপন্থী প্রচারমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, উক্ত নৌ কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার নির্দেশে এই খোলা চিঠি লিখেছেন। তুর্কি সরকার তুরস্কের শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলোকে এই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য রাজনৈতিকভাবে চাপ দিতে পারে, এই আশঙ্কায় তুরস্কের ৬টি শীর্ষ ব্যাঙ্ক জানায় যে তারা ইতিপূর্বে 'বৈশ্বিক স্থায়িত্ব চুক্তি'তে স্বাক্ষর করেছে এবং ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পকে যেহেতু একটি 'টেকসই প্রকল্প' হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, সেহেতু এই প্রকল্পের অর্থায়ন করতে তারা আইনত অপারগ। পশ্চিমা বিশ্ব বা রাশিয়া এই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য রাজি হবে না বিধায় তুরস্ক এই প্রকল্পের বিনিয়োগের জন্য চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়বে। এই ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পের অর্থায়নের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলা চীনা সরকারের একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউটর স্যামুয়েল রামানির ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খাল যদি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয় এবং তুর্কি অর্থনীতির বর্তমান দূরবস্থার প্রেক্ষাপটে তুরস্ক যদি চীনের কাছ থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত খালের ওপর তুরস্কের সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কা দেখা দিতে পারে। এরদোয়ানের ভাষ্যমতে, প্রকল্পটির পেছনে মোট খরচ হবে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুর্কি অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এর নির্মাণব্যয় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এই খাল নির্মাণ করতে গেলে ইস্তাম্বুলের সবগুলো রাজপথ, সড়ক, পানির পাইপ, বিদ্যুতের লাইন, গ্যাসের লাইন ও কিছু কিছু মহল্লার সম্পূর্ণ অংশ নির্মূল করে ফেলতে হবে এবং আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এসব অবকাঠামোগত সংস্কারের জন্য অন্তত ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়। ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পে সর্বপ্রথম যারা বিনিয়োগকারীদের রয়েছেন তুর্কি সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং কাতারের বর্তমান আমিরের মা মোজা বিনতে নাসের। ইতোমধ্যেই তারা ইস্তাম্বুল খালের সম্ভাব্য গতিপথ নিয়ে যে ভূমি বাণিজ্য চলছে, সেই প্রক্রিয়া থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছেন। কিছু তুর্কি বিশ্লেষকের ধারণা ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প কার্যত একটি রিয়েল এস্টেট প্রকল্প, যার মূল উদ্দেশ্য সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ ও কোম্পানিগুলোকে ব্যাপক হারে মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেয়া।

Comments