তথাকথিত চীনা সমাজতন্ত্র নাকি কনফুসিয়াসের ভূতের আছর? (পর্ব-এক)

 

কনফুসিয়াসের মতাদর্শ তার অনুগামীদের মাধ্যমে প্রথমে দাস মালিকদের এবং পরে সামন্ত প্রভুদের স্বার্থের সেবা করেছিল। চীনা পন্ডিতরা জীবনের বেশীরভাগ সময় কনফুসিয় সাহিত্য অধ্যয়ন করে কাটিয়েছে। তারা বছরের পর বছর ধরে পড়াশোনা করে কয়েক ধাপে কেন্দ্রীয় সরকারী পরীক্ষা পাশ করে রাজকর্মচারীর পদ লাভ করতো। এসব রাজকর্মচারীরা তাদের প্রশাসনিক পদাধিকার বলে বিপুল সম্পদ ক্ষমতার অধিকারী হতো। তারা সম্রাট শাসকবর্গের শাসনের ইতিহাস লিখে, শাসকদের কাছে নানা দার্শনিক বচনের ব্যাখ্যা করে হয়ে উঠতো রাজনৈতিক উপদেষ্টা। তারা জমির মালিক হয়ে আমলাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতো এবং জনসাধারণকে নিপীড়ন করতো।

https://en.wikipedia.org/wiki/Scholar-official

এরা বিভিন্ন রাজত্বে শাসকদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এভাবেই ২8টি শতাব্দী ধরে কনফুসিয় মতবাদ চীনের জোঁকেদের শোষণের ধারাবাহিকতার তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। চৌ রাজত্বে কনফুসিয়াসের জন্ম।

https://en.wikipedia.org/wiki/Zhou_dynasty

এসময়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক কাঠামো ছিল জায়গীর প্রথা।

https://en.wikipedia.org/wiki/Fief

উত্তরাধিকার সূত্রে সমস্ত সরকারী পদ দখল করতো অভিজাতরা। চৌ-দের হাতে পরাজিত হওয়ার পর শাং শাসনাধীন জনগণের বিরাট অংশ তাদের দাসরা নতুন শাসকদের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়। প্রাচীন নথিপত্র থেকে জানা যায় রাজা ৯৯টি রাজ্য আক্রমণ করে বন্দী করেছিল বহু মানুষকে।

https://en.wikipedia.org/wiki/King_You_of_Zhou

আর এসব বন্দীরা দাসে পরিণত হয়েছিল। দাসদের আরেকটি উৎস ছিল সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। যেসব সাধারণ মানুষ অভিজাতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতো তাদের পরিণত করা হতো দাসে এবং বাধ্য করা হতো সকল ধরনের পরিশ্রম করতে। হাজার হাজার দাসের মালিক রাজা ও অভিজাতদের আর্থিক অনুদানের পরিমাণ লিপিবদ্ধ করা আছে ব্রোন্জ লিপিগুলোতে। একটি ব্রোন্জ লিপির বিবরণ অনুসারে জন দাসের মূল্য একটি ঘোড়া এক বাণ্ডিল রেশমের সমান। দাসদের যে মূলত কৃষি হস্তশিল্পের শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্রোঞ্জ লিপিগুলোয়। রাজধানীর আশেপাশের সমস্ত অঞ্চলের মালিক ছিল সম্রাট, আর অন্য এলাকায় অভিজাত এবং রাজকর্মচারীদের ছিল নিজস্ব জায়গীর। দাস মালিক অভিজাতরাই জমির মালিক হতো। এই সমাজ কাঠামোর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল 'চৌ আচার বিধি'

https://en.wikipedia.org/wiki/Rites_of_Zhou

এসব নিয়মাবলী নিয়ন্ত্রণ করতো রাষ্ট্রগুলোকে, তাদের শাসকবর্গ এবং তাদের অধিকার, কর্তব্য বিশেষ সুবিধাগুলোকে। লু রাজ্যের শানটুং প্রদেশের চ্যাংপিং কাউন্টির সোউ শহরে ৫৫১ খ্রিষ্টপূ্র্বাব্দে কনফুসিয়াস জন্মগ্রহণ করেন।চিউ কুং’ নামটির লাতিন রূপ হলো কনফুসিয়াস। তিনি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। তার পূর্বপুরুষরা ছিল দাস মালিক। বাবার জীবদ্দশায় তাদের অভিজাত পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। যৌবনে কনফুসিয়াস নিম্ন স্তরের রাজকর্মচারী হিসাবে গুদামঘর দেখাশুনা করতেন; তারপর তার কাজ হলো ভেড়া ষাঁড় পালন। জীবনের বেশীর ভাগ সময় তিনি গৃহশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা তার কাছ থেকে পরামর্শ নিতো। অভিজাত পরিবারে যার জন্ম এবং প্রতিপালন, সেই কনফুসিয়াস সমাজের চরিত্রকে কখনও প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাননি, বরং সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেছেন। সেই সঙ্গে মানুষের চরিত্র এবং বহির্জগতের বিভিন্ন দিক নিয়ে নানা তত্ত্ব সূত্রায়িত করে তিনি সেই জোঁকেদের সমাজকে বিকশিত করেছেন। বসন্ত শরৎকালীন যুগের শেষের দিকে দাস মালিকশ্রেণী ক্ষয় প্রাপ্ত হলো; সমাজে অসন্তোষ বেড়ে পরবর্তীকালে পরিণত হলো দাস বিদ্রোহে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Spring_and_Autumn_period

বড় রাজ্যগুলো ছোট রাজ্যগুলোকে গ্রাস করলো। এভাবে রাজ্যের সংখ্যা ১৮০০ থেকে কমে দাঁড়ালো ০০-তে। যুদ্ধরত রাজ্যগুলোর যুগে চালু হলো সামন্ত ব্যবস্থা।

https://en.wikipedia.org/wiki/Warring_States_period

এর ফলে অর্থনতিক অগ্রগতি ঘটলো এবং সামন্ত শ্রেণীর জন্ম হলো। এরা জমি দখল করতে লাগলো এবং দাসমালিক শ্রেণীকে হারিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলো। অন্যদিকে কনফুসিয়াসের চোখে এসব কর্মকান্ড পবিত্র চৌ আচার-অনুষ্ঠানের নিয়ম লঙঘনের সামিল যা সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে! তিনি এসময় চৌ আচার বিধিতে ফিরে যাওয়ার কথা বললেন। এভাবে তিনি চেয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত দাসমালিক অভিজাতরা আবার ক্ষমতা লাভ করুক। উপরে উল্লিখিত দুটো যুগ ছিল বহু বিদ্বান ব্যক্তির যুগ।

https://en.wikipedia.org/wiki/Hundred_Schools_of_Thought

এসময় অভিজাতবর্গের শিক্ষিতরা নিজেদের তত্ত্ব প্রচারের জন্য দেশের নানা জায়গায় পরিভ্রমণ করে যাতে বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। আর এসকল কাজে সফল হলে রাজসভায় একটা ভালো চাকুরি পাওয়া যেতো। এসব ব্যক্তিদের মধ্যে কনফুসিয়াস ছিলেন অন্যতম। তার মতবাদ এবং রক্ষণশীল চিন্তা সবসময় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে ছিল।

https://drive.google.com/file/d/1OcJp0xXAxWNRaeoJOFfWq31BsB9vD1Wh/view?usp=sharing

নিজের জীবদ্দশায় কনফুসিয়াস পতনোন্মুখ দাস সমাজের শাসকদের সহায়তা করে গেছেন।

https://drive.google.com/file/d/1t8Qtf57Xiw_Er3_CMNO9UiYapFvPCtK8/view?usp=sharing

ছি-র ডিউকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এক রাজপুত্রকে পিরিয় নাচিয়েদের আক্রমণের হাত থেকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন।

https://en.wikipedia.org/wiki/Duke_Wen_of_Qi

https://en.wikipedia.org/wiki/Pyrrhichios

https://en.wikipedia.org/wiki/Sword_dance

তাছাড়া লু প্রদেশে কিছু কিছু দুর্গের প্রতিরক্ষা কাঠামো তিনি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন তিনটি অভিজাত পরিবারের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য; এই তিনটি পরিবার জাপানের মতো এক ধরনের ’শোগুনতন্ত্র' গড়ে তুলেছিল।

https://en.wikipedia.org/wiki/Shogun

এর ফলে তাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। দু’টি ক্ষেত্রেই এমন সব সেনানায়করা তাকে কর্তৃত্বের আসনে বসিয়েছিল, যারা তাদের উর্ধ্বতন সামন্ত শাসক ও সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং আমলাতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করেছিল। তার মতবাদ সম্বন্ধীয় একটি মাত্র বই বাদে আর কোন বই তিনি লিখে যাননি। বইটির নাম ’লু রাজ্যের ইতিবৃত্ত’। তার বিভিন্ন কথাবার্তা লিপিবদ্ধ করা আছে ’বচন সংগ্রহ’ বইটিতে।

https://drive.google.com/file/d/1oUR-Kkwy-11pZmVTPHSE5Vew7Edk4yhF/view?usp=sharing

বইটি তার পরবর্তী যুগের শিষ্যরাই সংকলন করেছিল, ঠিক যেমনটা ত্রিপিটকের ক্ষেত্রে হয়েছিল। অবিন্যস্ত ও অসম্পাদিত এই সংগ্রহে বিভিন্ন বিষয়ের উপর কনফুসিয়াসের বচন লিপিবদ্ধ করা আছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বচনগুলো তাদের সন্দর্ভ থেকে বিচ্ছিন্ন, যে পরিস্থিতিতে মন্তব্যগুলো করা হয়েছিল তার কোন উল্লেখ নেই। বচনগুলো তাদের ভাষ্যসহ আরও দু’টি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে ’মহান শিক্ষা’/ ’উচ্চতর শিক্ষা’।

http://classics.mit.edu/Confucius/learning.html

অন্য বইটির নাম ’মধ্যম পন্থার মতবাদ’/’সোনালী মধ্যম’।

https://en.wikipedia.org/wiki/Golden_mean_(philosophy)

https://ccnmtl.columbia.edu/services/dropoff/china_civ_temp/week03/pdfs/comple2.pdf

কনফুসিয়াসের মতে আকাশ, পৃথিবী এবং মানুষ একটি একীভূত সুসামন্জস্যপূর্ণ সামগ্রিক বস্তু যা স্বর্গের নিয়মাবলী দ্বারা পূ্র্বনির্ধারিত। মানুষের অবস্থা সহ পৃথিবীর সবকিছুই স্বর্গ কর্তৃক বিধিবদ্ধ। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জনসাধারণকে কিভাবে শাসন করা যায়- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, এ ব্যাপারে অবশ্যকরণীয় কাজ হলো প্রাচীন রাজাদের নীতিসমূহ, অভ্যাস, আইনকানুন এবং বিধি নতুন করে চালু করা। তিনি উদীয়মান ভূস্বামী শ্রেণীর বিরোধিতা করতেন এবং দাস বিদ্রোহকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। সমস্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তার চরিত্র বুঝে কনফুসিয়াস আলাদা আলাদা উত্তর দিতেন। ছাত্ররা যখন প্রশ্ন করেছিল কী করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় এবং জনসাধারণকে শাসন করতে হয়, তখন তিনি বলেছিলেন এ ব্যাপারে অবশ্যকরণীয় কাজ হলো প্রাচীন রাজত্বগুলোর রাজাদের নীতিসমূহ, অভ্যাস, আইনকানুন, সঙ্গীত এবং যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান নতুন করে চালু করা। যেমন- সিয়া যুগের ক্যালেন্ডার, ঋতু সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ, শাং যুগের বিভিন্ন ধরনের রথ (যেগুলো বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রতীক ছিল) এবং চৌ রাজত্বের পোশাক-পরিচ্ছদ।

https://en.wikipedia.org/wiki/Xia_dynasty

https://en.wikipedia.org/wiki/Shang_dynasty

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]