শ্রমিকরা এসবের কি বুঝবে!

 

পুঁজিবাদের বিলোপের পূর্বশর্ত হলো উৎপাদনের উপকরণগুলোর সামাজিকীকরণ। আরও একটা পূর্বশর্ত হলো পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী শাসনব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে বিপ্লবী শ্রমিক রাজ কায়েম করা। আজকের শ্রমিক আন্দোলনগুলো কিছু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বেশি কিছু নয়, যেগুলো হাসিল হওয়ার জন্য বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে হয় না। আবার এগুলো হাসিল হওয়াও বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কারণ মালিকপক্ষ, সরকার, প্রতিষ্ঠিত পার্টি ও সুবিধাবাদী ইউনিয়ন নেতাদের জোরালো আঁতাতকে মোকাবিলা করে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেরকম লড়াকু নেতৃত্ব ও শ্রেণী ঐক্য দরকার তার অনুপস্থিতি। বস্তুত নতুন করে বাড়তি কোনও দাবিদাওয়ার উত্থাপন নয়, বরং অতীতের লড়াই দিয়ে সেসব সুযোগ-সুবিধা আদায় হয়েছিল, সেগুলোকে রক্ষা করাটাই আজকের লড়াইয়ের মুখ্য দিক। এক কথায়, স্রেফ বেঁচে থাকার তাগিদে রক্ষণাত্মক অর্থনৈতিক আন্দোলন। শুধুই আছে অর্থনৈতিক আন্দোলন, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক লড়াই বলতে কিছুই আজ নেই তেমন। বিশ্বায়ন ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের ক্রমান্বয় হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে সরকারবিরোধী লড়াই আছে। কিন্তু এই রাজনৈতিক লড়াইগুলোর নেতৃত্ব রয়েছে এমন লোকজনের হাতে, যাদের সামনে কোনও বিপ্লবী লক্ষ্য নেই; পুঁজিবাদের ভেতরেই শ্রমিকশ্রেণীকে কিছুটা নিরাপত্তাদেয়ার এই সিস্টেমে পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবী সম্ভাবনা আদৌ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ১৮৮০ সালের মে মাসে ফ্রেঞ্চ ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মসূচির ভূমিকাটা ছিল মার্কসের বলে দেয়া

https://en.m.wikipedia.org/wiki/French_Workers'_Party

এটির ন্যূনতম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিগুলো লেখা হয়েছিল মার্কস এবং জুল গেদ এর যৌথ প্রয়াসে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jules_Guesde

সেখানে এঙ্গেলস এবং পল লাফার্গ এর সহায়তাও ছিল।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Paul_Lafargue

জুল গেদ এবং পল লাফার্গ তখন ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে মার্কসের অনুগামী নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি। ঐ বছরের নভেম্বরে কিছু সংশোধনী সহ কর্মসূচিটি পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত হয়। পরে ঐ ন্যূনতম অর্থনৈতিক দাবিসমূহ নিয়ে মার্কসের সাথে গেদ ও লাফার্গ সহ ফ্রান্সে তার অনুগামীদের একটা বিরোধ তৈরি হয়। দাবিগুলোর ভেতরে ছিল ন্যূনতম মজুরি, সপ্তাহান্তে বিশ্রামের দিন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম কাজে সম মজুরি, কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। মার্কসের মতে যে দাবিগুলো পুঁজিবাদের ভেতরে আদায় হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু জুল গেদ এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে, সংস্কারবাদী মোহ থেকে সর্বহারাকে মুক্ত করা এবং সর্বহারা বিপ্লবের অবশ্য প্রয়োজনীয়তাকে সামনে তুলে ধরার স্বার্থে পার্টির কর্মসূচিতে এই দাবিগুলো না থাকাটা বাঞ্ছনীয়। মার্কস এই ব্যাপারে বলেছিলেন -

"এদের রাজনীতিটাই যদি হয় মার্কসবাদ, তাহলে যেটা নিশ্চিত তা হলে আমি নিজে একজন মার্কসবাদী নই।"

ট্রেড ইউনিয়নবাদী রাজনীতি তথা অর্থনীতিবাদে নিমজ্জিত কমিউনিস্টরা (!) নিজেদের অবস্থানের স্বপক্ষে মার্কসের ঐ শেষোক্ত মন্তব্যকে কাজে লাগায়। কিন্তু যে মার্কসকে আমরা উপরোক্ত মন্তব্য করতে দেখি, সেই মার্কসকেই আবার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বোঝাতে এই কথা লিখতে দেখি -

“মজুরি হ্রাসের বিরুদ্ধে মজুরদের পর্যায়িক প্রতিরোধ ও মজুরি বৃদ্ধির জন্য তাদের পর্যায়িক প্রচেষ্টা মজুরি প্রথারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।” 

কথাটার সারমর্ম হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন হলো মজুরি প্রথারই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; অর্থাৎ এই আন্দোলনে মজুরি প্রথার বিনাশ ঘটার কোনও সম্ভাবনা নিহিত থাকে না। এঙ্গেলসের লিখেছেন -

“ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দ্বারা মজুরির নিয়ম বরবাদ হয়ে যায় না। উল্টো সেসবের দ্বারা তা বলবত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন মজুরি প্রথাকে আক্রমণ করে না।” 

মার্কস ও এঙ্গেলস এর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলনগুলোকে বিপ্লবী দিশায় পুষ্ট করা। মজুরি প্রথাই হলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তি। যেখানে উৎপাদকদের শ্রমক্ষমতাও বাজারের অন্যান্য পণ্যের মতই আর একটি পণ্য। মজুরি হলো যার দাম। একমাত্র এই মজুরি প্রথার দৌলতেই সৃষ্টি হয় পুঁজিপতি শ্রেণীর কাঙ্ক্ষিত মুনাফার উৎস সেই উদ্বৃত্ত মূল্য। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চলে এই মজুরি প্রথাকে ভিত্তি করেই, অর্থাৎ তাকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে নয়; বরং তাকে কাজে লাগিয়েই মজুরি বাড়ানো বা তার হ্রাস রোধের লক্ষ্যে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে মজুরির প্রশ্ন ছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য দাবিদাওয়া থাকলেও সেগুলোর প্রায় সবই মজুরির প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত। এই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনগুলো যে তাদের অন্তর্বস্তুতে মোটেই মজুরি প্রথা তথা পুঁজিবাদ বিরোধী নয়, মার্কস এবং এঙ্গেলস থেকে উদ্ধৃত শেষোক্ত কথাগুলোর সারমর্ম সেটাই। ১৮৮১ সালে ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ব্যাপারে এঙ্গেলস লিখেছিলেন -

“খাঁটি রাজনৈতিক বা চার্টিস্ট সংগঠনটি যে পরিমাণে তছনছ হোয়ে গেছে, সেই পরিমাণেই আবার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, আর বর্তমানে তা শক্তির এমনই এক স্তরে পৌঁছেছে, শ্রমিকশ্রেণীর বাইরের কোনও দেশের সংগঠন তার ধারেকাছেও নেই। দশ থেকে বিশ লক্ষ শ্রমিক সম্বলিত কয়েকটি বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন, যার পেছনে আছে ক্ষুদ্র ও স্থানীয় ইউনিয়নগুলোর সমর্থন, তারা যে ক্ষমতাকে প্রতিনিধিত্ব করছে, শাসকশ্রেণীর যে কোনও সরকারকেই তাকে ধর্তব্য গণ্য করতে হচ্ছে।” 

এঙ্গেলসের আরও লিখেছেন -

“এতদিন অবধি এই শক্তিশালী সংগঠনগুলো প্রায় কঠোরভাবেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে মজুরি ও কাজের ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণের কাজে এবং খোলাখুলিভাবে শ্রমিকবিরোধী আইনগুলোকে রদ করতে বাধ্য করার কাজে।” 

এখান এঙ্গেলসের আক্ষেপের কারণ ছিল এজন্য যে ব্রিটিশ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও ইউনিয়ন আন্দোলনের ঐ ক্ষমতাকে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতার স্তরে উত্তরণ ঘটিয়ে তার মাধ্যমে মজুরি দাসত্বের বিলোপ ঘটানোর লক্ষ্যে প্রয়াস বা প্রস্তুতি ছিল অনুপস্থিত। অর্থনৈতিক আন্দোলন হলো শ্রেণীসংগ্রামের একটা দিক মাত্র, যেখানে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শামিল হয় স্রেফ মানুষের মতো বেঁচে থাকার তাগিদে। কিন্তু শ্রেণীসংগ্রামের অন্য দিকও থাকে (রাজনৈতিক আন্দোলন ও তত্ত্বগত আন্দোলন)। এখানে চেতনার ভূমিকা অনেক বেশি। এই তিন ধরনের আন্দোলনের যথাযথ সমন্বয় থাকলে তবেই একমাত্র শ্রেণীসংগ্রামের বিপ্লবী অভিমুখ থাকতে পারে। এখানেই কমিউনিস্টদের ভূমিকা। শেষোক্ত দুই আন্দোলনকে অবহেলা করে তারা যদি কেবল প্রথম ধরনের আন্দোলনেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে স্রেফ নিজেদের গণভিত্তি প্রসারের চিন্তা থেকে আর বাস্তবতা বা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে; যেখানে গণভিত্তির গুণগত মান নয়, সংখ্যাটাই তাদের কাছে মূল বিচার্য বিষয় তাহলে বুঝে নিতে হবে তারা কমিউনিস্ট বিপ্লবীর ভূমিকায় নেই, বরং অর্থনীতিবাদ তথা সুবিধাবাদের স্তরে নিজেদের নামিয়ে আনছে।

মার্কসের বলেছিলেন -

সমালোচনার অস্ত্র নিশ্চয়ই অস্ত্রের দ্বারা সমালোচনাকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে না, বস্তুগত শক্তিকে অবশ্যই বস্তুগত শক্তির দ্বারাই উৎখাত করতে হবে; কিন্তু তত্ত্বও সঙ্গে সঙ্গেই একটা বস্তুগত শক্তি হয়ে ওঠে যখন তা জনগণকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে।”  

'কমিউনিস্ট' নামধারী নির্বাচনপন্থী বামেরা আজীবন ধরে একই ভাঙা রেডিও বাজায় এই বলে যে সাধারণ শ্রমিকরা নাকি এখনো বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করার জায়গাতে নেই; তারা যদি এই বাস্তবতাকে না বুঝে তাদের সমাজতন্ত্র বোঝাতে চেষ্টা করে, তাহলে উল্টো শ্রমিকদের সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা ঘটে যাবে! বরং যেটা করা উচিত তা হলো মালিক, সরকার এবং সুবিধাবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে তাদের নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। বস্তুত এটাই হলো অর্থনীতিবাদ। যেটা আসলে এক ধরনের সুবিধাবাদ। 'কমিউনিস্ট' নামধারী এই অর্থনীতিবাদীরা কিছুতেই চায় না শ্রমিকদের ভেতরে লাগাতার বিপ্লবী প্রচারের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে। সেই কারণেই তারা বিশ্বাসও করে না বিপ্লবী তত্ত্ব শ্রমিকশ্রেণীকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে সক্ষম, যদি লাগাতার ও নিরলস সেই প্রয়াস তাদের দিক থেকে থাকে। তারা বোঝাতে চায়, সময় এলে শ্রমিকরা নিজে থেকেই এই দিকে আকৃষ্ট হবে যদি তারা তাদের ভেতরে লেগে থেকে তাদের 'আশু সমস্যা' সমাধানের কাজে সাহায্য করে! এটাকেই বলে ট্রেড ইউনিয়নবাদী রাজনীতি। পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বিপ্লবী প্রচার এড়িয়ে চলা হলে বিপ্লবী সম্ভাবনা বিকাশের বিরুদ্ধেই আসলে কাজ করা হয়। শ্রমিক আন্দোলনের সামনে বিপ্লবী দিশা প্রতিষ্ঠার কাজ রীতিমতো এড়িয়ে চলে এসব বামেরা। 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে এই কথাটা লেখা আছে -

“বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর লড়াইকে যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে হয় তার মধ্যে তারা সর্বদা ও সর্বত্র সমগ্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং কমিউনিস্টরা হলো একদিকে কার্যক্ষেত্রে প্রতি দেশের শ্রমিকশ্রেণীর পার্টিগুলোর সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ - যে অংশ অন্যান্য সবাইকে সামনে ঠেলে নিয়ে যায়। অপরদিকে, তত্ত্বের দিক দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর অধিকাংশের তুলনায় তাদের এই সুবিধা যে শ্রমিক আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ, শর্ত এবং শেষ সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ বোধ রয়েছে।”

অর্থনীতিবাদীরা  এই “সর্বদা ও সর্বত্র সমগ্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব” করে না। তারা সমগ্র শ্রেণীর আলাদা আলাদা অংশের আশু স্বার্থটাই শুধু দেখে এবং মোটেও তারা “অন্যান্য সবাইকে সামনে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার” লক্ষ্যে সচেষ্ট থাকে না। বাস্তবতার দোহাই দিয়ে তারা স্বতঃস্ফূর্ততার লেজুড়বৃত্তি করে। একটা যুক্তিই কেবল তাদের দিতে শোনা যায় “শ্রমিকরা এখন প্রস্তুত নয় আরও সামনে এগোনোর জন্য”! দীর্ঘকাল এভাবে চলতে চলতে অভ্যাসটা তাদের এমনই দাঁড়িয়ে যায় যে, বিপ্লবী পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পেছন থেকে তার রাশ টেনে ধরতেও তাদের দ্বিধা কাজ করে না। এভাবেই বিপ্লবী পরিস্থিতির সাথে বেইমানিটা হয়। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই জিনিস বহুবার হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লবী লক্ষ্যে সামনে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার তাগিদেই প্রথমে 'কমিউনিস্ট লীগ' এবং পরবর্তীতে 'শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি' গড়ে তোলা হয়েছিল, যেগুলোতে ইউরোপের তখনকার দিনের সব থেকে অগ্রগামী শ্রমিকদের শামিল করা হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_League

https://en.m.wikipedia.org/wiki/International_Working_People%27s_Association#:~:text=The%20International%20Working%20People's%20Association,convention%20held%20in%20London%2C%20England.

সর্বহারা বিপ্লবের যুগ তখন শুরুই হয়নি, বরং পুঁজিবাদের দুর্দান্ত বিকাশের যুগ সেটা। বেলজিয়ামে বসবাসকারী জার্মান শ্রমিকদের রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভাবধারা প্রচারের জন্য ১৮৪৭­ সালে মার্কস ও এঙ্গেলসের উদ্যোগে ব্রাসেলসে 'জার্মান শ্রমিকদের সমিতি' প্রতিষ্ঠা। মার্কস, এঙ্গেলস এবং তাদের সহযোদ্ধাদের পরিচালনায় এই সমিতি হয়ে উঠেছিল বেলজিয়ামে থাকা জার্মান বিপ্লবী শ্রমিকদের বৈধ সমাবেশ কেন্দ্র। এর সবচেয়ে প্রগতিশীল সদস্যরা কমিউনিস্ট লীগের ব্রাসেলস শাখার সদস্য ছিলেন। এই সমিতি বেলজিয়ামের বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠনের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। মার্কস লিখেছিলেন -

"যেখানেই সম্ভব ছিল সেখানেই শ্রমিকদের প্রতি বুনিয়াদি উপদেশের কোর্স খোলা হয়েছিল।"

ব্রাসেলসে জার্মান শ্রমিকদের সমিতিতে মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপর একগুচ্ছ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে যেগুলো আংশিকভাবে “মজুরি শ্রম ও পুঁজি” নামে একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়।

https://www.rokomari.com/book/172473/mjuri-shrom-o-puji

ফ্রান্সে ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের অনতিকাল পরেই সমিতির সদস্যদের বেলজিয়ান পুলিশ গ্রেপ্তার ও নির্বাসিত করায় তার কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/French_Revolution_of_1848#:~:text=The%20French%20Revolution%20of%201848,of%20the%20French%20Second%20Republic.

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Friedrich_Sorge

ঐ সময়ে মার্কস যদি 'মজুরি শ্রম ও পুঁজি'র অন্তর্বস্তু নিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিতে পারেন, তাহলে এতো বছর বাদে এসব বামেরা বলে কী করে যে, “শ্রমিকরা এখন এসব বুঝবে না” বা “এসবে তাদের এখন আগ্রহ নেই”? তাদের রাজনৈতিক জীবনের গোটা পর্যায় জুড়ে মার্কস-এঙ্গেলস সুস্পষ্টভাবে সর্বহারা বিপ্লবের লক্ষ্যেই কাজ করে গেছেন। নিজেদের গণভিত্তি বাড়ানোর অন্ধ তাড়নায় বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি এই লক্ষ্য থেকে। বিপ্লবী সর্বহারার আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা গোরা থেকেই তারা উপলব্ধি করেছিলেন। কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠা ছিল সেই জায়গা থেকেই। 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-র ১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের যে ভূমিকা মার্কস এঙ্গেলস লিখেছেন, তার প্রথম বাক্যতেই লেখা আছে -

“কমিউনিস্ট লীগ ছিল শ্রমিকদের এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান”

প্রথমদিকে সেটা ছিল জার্মানিতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সেই সময়কার তুলনায় আজ যোগাযোগ ব্যবস্থার এতো উন্নতি সত্ত্বেও ঐ চরিত্রের আন্তর্জাতিক এখন কোথায়? আসলে ট্রেড ইউনিয়নবাদী রাজনীতিতে এরকম আন্তর্জাতিকের কোনও প্রয়োজন নেইবিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের লক্ষ্যে কাজ করা তো দূরের কথা, স্রেফ অভ্যাস বশত নির্বাচনপন্থী বামেরা “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগানটা দিয়ে থাকে। সেসময় বিপ্লবী সর্বহারার আন্তর্জাতিক গঠন, তার পরিচালনা ও প্রসার ঘটানো কীরকম দুরূহ কাজ ছিল আজ তা অনুমান করাই বেশ কষ্টসাধ্য। 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-র ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ফ্রান্সে ১৮৪৮ সালের জুন অভ্যুত্থানের সামান্য আগে। ম্যানিফেস্টো-র ১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস লেখেন -

“১৮৪৮ সালের জুন মাসে প্রলেতারিয়েত ও বুজোর্য়ার প্রথম মহাসংগ্রাম, প্যারিস অভ্যুত্থানের পরাজয় ইউরোপীয় শ্রমিকশ্রেণীর সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবিকে ফের কিছু দিনের মতো পিছনে হটিয়ে দিল। যেখানেই স্বাধীন প্রলেতারীয় আন্দোলনে জীবনের লক্ষণ দেখা গেলো, সেখানেই তাকে দমন করা হলো নির্মমভাবে। এইভাবেই সে সময়ে কলোন শহরে অবস্থিত কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে হানা দেয় প্রুশিয়ার পুলিশ। তার সভ্যরা গ্রেপ্তার হলো এবং ১৮ মাস কারাবাসের পর ১৮৫২ সালের অক্টোবরে তাদের বিচার হয়। বন্দীদের সাত জনকে তিন থেকে ছয় বছরের কারাদন্ড দেয়া হলো এক দুর্গের অভ্যন্তরে। দন্ড ঘোষণার অব্যবহিত পরে বাকি সভ্যরা লীগ সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়।”

ঐ ভূমিকাতেই এরপর এঙ্গেলস লেখেন -

“ইউরোপীয় শ্রমিকশ্রেণী যখন শাসকশ্রেণীর উপর আর একটা আক্রমণের মতো পর্যাপ্ত শক্তি ফিরে পায়, তখন আবির্ভূত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতি। ইউরোপ ও আমেরিকার সমগ্র জঙ্গী প্রলেতারিয়েতকে এক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংগঠিত করার বিশেষ উদ্দেশ্য থাকার দরুন এই সমিতি কিন্তু ‘ইশতেহার’-এ লিপিবদ্ধ মূল নীতিগুলো সরাসরি ঘোষণা করতে পারেনি। আন্তর্জাতিকের কর্মসূচি বাধ্য হয়েই এতটা উদার করতে হয় যাতে তা গ্রহণীয় হয় ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়ন, ফ্রান্স­, বেলজিয়াম­, ইতালি ও স্পেনের প্রুধোঁবাদী এবং জার্মান লাসালপন্থীদের কাছে। এই কর্মসূচি মার্কস রচনা করেছিলেন এই সকল দলের সন্তাষ বিধান করে; মিলিত কাজ ও পারস্পরিক আলোচনার ফলে শ্রমিকশ্রেণীর বুদ্ধিগত যে বিকাশ ছিল সুনিশ্চিত, তার উপরেই তিনি পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন।”

'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-র ১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস আবার লেখেন-

“দুনিয়ার মজুর এক হও! বেয়াল্লিশ বছর আগে [১৮৪৮ সালে] প্রথম যে প্যারিস বিপ্লবে প্রলেতারিয়েত তার নিজস্ব দাবি নিয়ে হাজির হয় ঠিক তারই পূর্বক্ষণে আমরা যখন পৃথিবীর সামনে এই ঘোষণা করেছিলাম, সেদিন অতি অল্প কন্ঠেই তার প্রতিধ্বনি উঠেছিল। ১৮৬৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের শ্রমিকেরা আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতিতে হাত মেলায়, এ সমিতির স্মৃতি অতি গৌরবজনক। সত্যকথা, আন্তর্জাতিক বেঁচে ছিল মাত্র নয় বছর।”

যে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির (যা প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক নামে পরিচিত) সাফল্য সম্পর্কে এঙ্গেলসের এই উক্তি (যার স্থায়ীত্বকাল ছিল ১৮৬৪ সাল থেকে মাত্র নয় বছর), সেই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির সাধারণ পরিষদের সাফল্য সম্পর্কে মার্কসের কথা শোনা যাক -

“সমাজ বিপ্লব সাধনের পক্ষে সকল প্রয়োজনীয় বৈষয়িক উপাদান ইংরেজ জাতির আছে। কিন্তু ইংরেজদের মধ্যে যার অভাব তা হলো, সামান্যিকরণের মানসিক প্রবণতা ও বৈপ্লবিক উদ্দীপনা। একমাত্র সাধারণ পরিষদ তাদের এটা যুগিয়ে দিতে পারে এবং এইভাবে দ্রুতগামী করে তুলতে পারে সত্যিকার বৈপ্লবিক আন্দোলনকে - এখানে এবং ফলত সর্বত্রই। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে যে বিপুল ফল পেয়েছি আমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছে শাসকশ্রেণীগুলোর সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও প্রভাবশালী সংবাদপত্রসমূহ। এরা সবাই মিলে প্রকাশ্যে আমাদের ওপর দোষারোপ করছেন এই বলে যে আমরা নাকি শ্রমিকশ্রেণীর মন বিষিয়ে দিয়েছি ও তাদের মধ্যে ইংরেজসুলভ মেজাজ দিয়েছি নষ্ট করে এবং শ্রমিকশ্রেণীকে আমরা ঠেলে নিয়ে চলেছি বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রের পথে।”

সেই বুর্জোয়া বিপ্লব তথা পুঁজিবাদের বিকাশের যুগেই শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লবী পথে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক গড়ে তোলা এবং তাতে আগুয়ান শ্রমিকদের শামিল করার কাজে মার্কস-এঙ্গেলস কতটা উদ্যমী ছিলেন। শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি প্রসঙ্গে মার্কসের আরও একটা কথা উদ্ধৃত করা যাক -

“পুলিশ প্রভাবিত বুর্জোয়া মানস স্বভাবতই মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতিকে দেখে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সংস্থারূপে, এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নাকি থেকে থেকে বিভিন্ন দেশে অভ্যুত্থান ঘটাবার আদেশ পাঠায়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমিতি সভ্য জগতের বিভিন্ন দেশের সবচেয়ে অগ্রসর শ্রমিকদের একটি আন্তর্জাতিক মৈত্রী বন্ধন ছাড়া আর কিছুই নয়। যেখানেই, যেকোনো আকারে এবং যেকোনো অবস্থায় শ্রেণীসংগ্রাম দেখা যায়; সেখানেই আমাদের সমিতির সদস্যগণ তার পুরোভাগে এসে দাঁড়াবে, এটা তো স্বাভাবিক।” 

একেবারে শুরু থেকেই বিপ্লবী দিশাকে স্পষ্টভাবে সামনে রেখে চলেছিলেন বলেই প্যারি কমিউন প্রসঙ্গে মার্কস এই দাবি করতে পেরেছিলেন -

“প্যারিসের জুন অভ্যুত্থানের পর এই অভ্যুত্থানই [১৮৭১-এর প্যারি কমিউন] আমাদের পার্টির সবচেয়ে গৌরবময় কীর্তি।”

তবে কমিউন গড়ে উঠেছিল কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনও তাত্ত্বিক উপলব্ধির জায়গা থেকে নয়। সে কারণে ১৮৮৪ সালে বার্নস্টাইনকে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস প্যারিসের শ্রমিকদের তদানীন্তন এই সৃষ্টিকে তাদের 'প্রবৃত্তিগত প্রবণতা' হিসাবে উল্লেখ করেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eduard_Bernstein

এঙ্গেলসের এই কথাটাও লক্ষণীয় -

“কমিউন সৃষ্টির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক একটিও অঙ্গুলি উত্তোলন না করলেও চিন্তাধারার দিক থেকে কমিউন যে আন্তর্জাতিকেরই সন্তান তাতে কোনও সন্দেহ নেই এবং কমিউনের জন্য যে আন্তর্জাতিককে দায়ী করা হলো তা কিছুটা পরিমাণে খুবই সঙ্গত।”

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]