মজদুরির দুষ্টচক্র

 

তাদেরই মূলত মজদুরি করতে যেতে হয়, যাদের কাছে শ্রমক্ষমতা ছাড়া বাঁচার মতো আর কিছু নেই। সমাজে বাঁচতে গেলে তাকে পুঁজিপতির কাছে কাজ করতে হবে। যার বদলে সে মজুরি পাবে। যা দিয়ে সে নিজের এবং পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারবে। এটাই হলো মজুরি প্রথা। যার একদিকে রয়েছে পুঁজিপতি আর জমিদার। অন্যদিকে রয়েছে তাদের জন্য, তাদের কাছে কাজ করা শ্রমিকরা। পুঁজিপতিদের কাছে তাদের কাজ করতেই হবে, নাহলে না খেয়ে মরতে হবে। এটাও গোলামি তথা মজুরি দাসত্ব, অর্থাৎ মজুরি প্রথার গোলামি। দাস প্রথায় যেমনটা করতে হতো সেভাবে প্রতিটি শ্রমিককে ব্যক্তিগতভাবে কোনও পুঁজিপতির কাছে গোলামি করতে হয় না ঠিকই, কিন্তু এটা তার অসহায়ত্ব যে, জীবন ধারণের তাগিদে কারও না কারও কাছে তাকে কাজ করতে হবে। এই অসহায়ত্ব গোটা শ্রমিকশ্রেণীর অসহায়ত্ব। আর এভাবে সে পুঁজিপতি শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল। একজন পুঁজিপতিকে ছেড়ে অন্য কোনও পুঁজিপতির কাছে কাজ করার স্বাধীনতাটুকু তার আছে। কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোনও না কোনও পুঁজিপতির কাছে কাজ তাকে করতেই হবে। এটাই হলো মজুরি প্রথার গোলামি। এই গোলামিকে উপলব্ধি করাটা শ্রমিকশ্রেণীর কাছে সবচেয়ে বেশি জরুরি। শ্রমিকশ্রেণীর সামনে সবসময় থাকে আগামী দিনের অনিশ্চয়তা। নিজের শ্রমক্ষমতাই হলো তার কাছে একমাত্র পণ্য। আর সেটা যদি বেচতে না পারা যায়, তাহলে কী হবে? যদি তাকে কাজ থেকে বসিয়ে দেয়া হয়, পরিবারের ভরণ-পোষণ হবে কী করে, এই চিন্তা সবসময় থাকে। এটা এমন গোলামি যা স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রতিদিনই অনুভব করা যায়। এটা সেই ধরনের গোলামি নয় যার মাধ্যমে গোলামকে মালিকের পণ্য হিসাবে কেনাবেচা করা হতো, আর সে ছিল মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আজকের গোলামি অন্য রকমের। এখানে আছে মজদুরি করে বাঁচার অসহায়ত্ব। আর নয়তো না খেয়ে মরার স্বাধীনতা। স্বাধীন শ্রমিক হওয়ার অর্থ শুধু এইটুকুই যে, মালিক বদল হতে পারে। কিন্তু অনাহার আর দুর্দশায় প্রেরিত হওয়ার অসহায়ত্ব এই স্বাধীনতাকে একটা অন্তঃসারশূন্য কথায় পরিণত করে বিশাল সংখ্যক জনতা এখানে উৎপাদনের উপকরণগুলো থেকে বঞ্চিত। যার ফলে শুধু বেঁচে থাকার জন্যই তাদের নিজেদের শ্রমক্ষমতা পুঁজিপতিদের কাছে বেচতে হয়, আর তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়তে হয়। উৎপাদন করে শ্রমিক, আর তার দ্বারা তৈরি উৎপন্নের মালিক হয় পুঁজিপতি। কারণ উৎপাদনের উপকরণগুলো রয়েছে তাদের কাছে, আর শ্রমদাতা মানুষগুলোকে ভাড়ায় লাগিয়ে তারা উৎপাদন করিয়ে নেয়। পুঁজিপতি তার শ্রমক্ষমতা কিনে নিয়ে নিজের উৎপাদনের হাতিয়ারে (মেশিন, জমি ইত্যাদি) নিযুক্ত করে কাজ করিয়ে নেয়, আর তাই দিয়ে উৎপন্ন বস্তুর মালিকানা হয়ে যায় পুঁজিপতির। শ্রমিকের জোটে কেবল তার নিজের ও পরিবারের জন্য অতি নিম্নস্তরের জীবন। বাকি সব কিছুর ওপর অধিকার পুঁজিপতির। এটাকে বলা হয় উদ্বৃত্ত মূল্য; অর্থাৎ সারা দিনের শ্রম দিয়ে শ্রমিকরা যেটা উৎপাদন করলো, সেই পণ্যের মূল্যের সেই ভাগ যা মজুরি দেয়ার পর পুঁজিপতির কাছে থেকে যায়। এই উদ্বৃত্ত মূল্যটাই তার মুনাফা। আর সে শ্রমিকদের কাজে লাগায় এই জন্যই যে, যাতে তার মুনাফা হয়। এই প্রথায় এমনটা মনে হয় যে, শ্রমিককে যদি পুরো মজুরি দেয়া হয় তাহলে তার কোনও শোষণ হবে না আর তার ওপর কোনও লুণ্ঠন হবে না, যেমনটা হতো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিছু না পেয়েও শ্রম দিতে হতো কিংবা কৃষক যা উৎপাদন করতো, তার একটা ভাগ বিনা পয়সায় জমিদারকে দিয়ে দিতে হতো। পুঁজিপতিদের দ্বারা লুণ্ঠনটা বোঝা যায় না। কিন্তু সে-ও ঐ উদ্বৃত্ত মূল্যটা নিয়ে নেয় যেটা মজুরি মিটিয়ে দেয়ার পরে বেচে যায়। আর এটাও হলো উদ্বৃত্ত শ্রম। এমনটা না হলে পুঁজিপতি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। শ্রমের এই লুণ্ঠন আবার বিধিসম্মত আর নিয়মিতই সেটা হতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মতো এখানে জমিদারের গোমস্তাদের পিটুনি, ডাণ্ডাপেটা করা ইত্যাদি জোর জবরদস্তিমুলক পদ্ধতিতে উসুল করা হয় না। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে পরিষ্কার বোঝা যেতো একেবারে বিনা পয়সায় উদ্বৃত্ত শ্রম করতে হচ্ছে কিংবা নিজের উৎপন্ন জিনিস জমিদারকে দিয়ে দিতে হচ্ছে। পুঁজিবাদে পেটের অসহায়ত্বই হল সেই কারণ, যে কারণে মানুষ মজদুরি করতে বাধ্য হয়। আর পুঁজিপতির কাছে নিজের শ্রমক্ষমতা বিক্রি করে সে কিছু পায়, যা দিয়ে বেচে থাকা যায়। অন্যদিকে পুঁজিপতি ফুলেফেঁপে ওঠে। শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের ওপর শ্রমিকের কোনও হক নেই। হক পুঁজিপতির। সে মুনাফা কামায়। বেশি বেশি করে এই উদ্বৃত্ত মূল্য আদায়ের জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করা হয়, তাতে সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থার অবনতি হতে থাকে আর পুঁজিপতি ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। মজুরির হারের ওপর সবসময় নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা থাকে। পুঁজিবাদের অন্যান্য নিয়মের স্বাভাবিক গতির ভেতর দিয়ে, অর্থাৎ মেকানাইজেশন ইত্যাদির ভেতর দিয়ে এটা হয়েই থাকে। পুঁজিবাদের ভেতর কর্মহীন মানুষের বিশাল একটা বাহিনী মজুদ থাকে, যারা নিজেদের জীবনযাপনের জন্য কঠিন শর্তে কাজ করতে বাধ্য থাকে। এর ফলে গোটা শ্রমিকশ্রেণীর মজুরির হারের ওপর প্রভাব পড়ে। পুঁজিবাদ বেকারত্ব ও অনাহারের জন্ম দেয়, আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মুনাফা তুলে নেয়। 

অন্যদিকে কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে, কাজের তীব্রতা বাড়িয়ে, কাজের শর্তের অবনতি ঘটিয়ে, মজুরির হারে ওপর আঘাত করতেই থাকে। এভাবে তা মজুরির হারের ওপর বহুমুখী প্রভাব ফেলতে থাকে। মজুরি প্রথার বন্ধনে সকল স্তরের শ্রমিকই শৃঙ্খলিত আছে। এই ব্যাপারে বোধ তৈরি হওয়াটা সচেতন শ্রমিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের গোলামিকে চিনতে পারাটাকেই বলে শ্রেণীচেতনা। এটাকে উপলব্ধি করার ভেতর দিয়ে সে অন্য শ্রমিকদের সাথে, অন্য স্তরের সমস্ত শ্রমিকের সাথে নিজের ঐক্য দেখতে পাবে এবং একই সাথে এই গোলামি থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ভাববে। আজ যখন ঠিকা শ্রমিকদের দিয়ে বেশি বেশি করে কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে, যাদের মজুরি ও কাজের অবস্থা খুবই খারাপ, তখন সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ওপরও তার প্রভাব পড়ছে। তাদের কাজের শর্তের অবনতি ঘটিয়ে ম্যানেজমেন্ট তার সুযোগ নিচ্ছে, আর সংগঠিত শ্রমিকদের লড়াইকে নিষ্প্রভ করতে সফল হচ্ছে। ক্রমাগত আউটসোর্সিং এর ভেতর দিয়ে তাদের কাজগুলোকে স্বল্প মজুরি আর কঠিন শর্তে কাজ করানো কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে শ্রমিকশ্রেণীর প্রাথমিক স্তরের লড়াই, অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন স্তরের লড়াই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এভাবে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থা আদায় করা শ্রমিকরা যদি তাদের চাইতে খারাপ অবস্থায় থাকা অসংগঠিত শ্রমিকদের কথা না ভাবে, তাহলে তো দুর্বলই হবে। মজুরি প্রথার এটাই নিয়ম। গোলামি উভয়েরই। অন্যদিকে লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থা আদায় করা সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সাথে ঐক্যই সাহায্য করবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সাফল্য পেতে। শ্রমিক আন্দোলন কোথাও দুর্বল হয়ে পড়লে পুঁজিপতির জোর বেড়ে যায় আর তার শ্রমিকবিরোধী মনোভাবে রঙ ধরে। ১৯৮৪-৮৫ সালে ব্রিটেনের কয়লা খনি শ্রমিকদের লম্বা সময় ধরে চলা ধর্মঘটকে ভাঙ্গার কাজে সরকারের সাফল্য ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং পরবর্তী দিনগুলোতে তা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের পরাজয় থেকে নিশ্চিত হয়ে গোটা দুনিয়ার পুঁজিপতিশ্রেণী ১৯৯১ সালে  'পুঁজিবাদের জয়' ঘোষণা করে। নতুনভাবে শ্রমিকশ্রেণীর ওপর হামলা শুরু হয়ে যায়। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের সম্ভাবনাকে রোধ করতে অগ্রণী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ঐখানে যে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সেগুলোও ধীরে ধীরে খতম করতে শুরু করলো। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, "শ্রমিকশ্রেণী যদি বিপ্লবী না হয়, তাহলে সে কিছুই নয়"। অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতি শ্রেণীর সাম্রাজ্যকে ধংস করে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করার কথায় উৎসাহিত হয়ে যদি না কাজ করে, তাহলে সে পুঁজিপতি শ্রেণীর সামনে কেবলই এক অসহায়ত্বেতে ভরা অংশ, যাকে সে নিজের জন্য মুনাফা সৃষ্টির কাজে নিয়োগ করে। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী সম্ভাবনাতে ভয় পেয়েই সে শ্রমিকদের নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে তুষ্ট করতে চায়। কিন্তু শ্রমিকরা তখন হাসিল হওয়া সংস্কারগুলোকে নিজেদের হক হিসাবে ধরে নেয়, আর মনোভাব পুঁজিপতিশ্রেণী বিরোধীই থেকে যায়। এই মনোভাবের ভয় না থাকলে পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিকশ্রেণীর ওপর হামলা শুরু করে দেয়। নিজেদের মজুরি বাড়ানোর জন্য, কাজের ঘণ্টা কমানোর জন্য, কাজের জায়গায় (তা সে কারখানা হোক, জমি হোক, খনি বা অন্য কোনও জায়গা হোক) তাদের ওপর চলা উৎপীড়নের প্রতিকারের জন্য, কাজের জায়গায় নিরাপত্তার প্রশ্নে, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রশ্নে কিংবা এরকম অন্য কোনও প্রশ্নে শ্রমিকদের সবসময় পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। প্রায়শই এটা করা হয় ধর্মঘটের মাধ্যমে। বিশুদ্ধ রূপে ধর্মঘট হলো শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের হাতিয়ার, যার মাধ্যমে শ্রমিকরা পুঁজিপতিকে নিজেদের দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য কাজ বন্ধ করে দেয়। পুঁজিপতির কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তার পুঁজি অচল হয়ে পড়ে, সেটা থেকে আর মুনাফা আসে না। কারণ, শ্রমিকের শ্রমই হলো মুনাফার উৎস। উৎপাদন না হলে পুঁজি বন্ধ্যা হয়ে পড়বে এবং পুঁজিপতি সেখান থেকে কিছুই পাবে না। এই পরিস্থিতি দেখে পুঁজিপতিকে মাথা নত করতে হয় এবং শ্রমিকদের দাবির ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে হয়, সেটাকে মানতে হয়। শ্রমিকদের এই সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ দেখে পুঁজিপতি ভয় পেয়ে যায় এবং সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করে। তার জন্য সে সমস্ত ধরনের চাল চালে। যেগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের ভেতরে বিভাজন তৈরি করা থেকে শুরু করে নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগও থাকে। সে পুলিশ ডাকে এবং গুলি চালনা করা অবধিও এগোয়। এতদসত্ত্বেও শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির সামনে তাকে হার মানতে হয় এবং নিজের পুঁজিকে সচল রাখার জন্য এমনটা করতে বাধ্য হতে হয়। ধর্মঘটের এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি শ্রমিকদের অনেক কিছুই শেখায় এবং তা পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটা শিক্ষালয় হিসাবে কাজ করে। পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে, পুঁজির হামলার বিরুদ্ধে এবং নিজেদের জীবনের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য নেয়া এই পদক্ষেপ শ্রমিকদের নিজেদের সংগঠিত শক্তি সম্পর্কে উপলব্ধি ঘটায়। বিশেষ কোনও উদ্যোগ, কারখানা বা খনিতে এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি তখনও শ্রেণীশক্তির রূপ নয়। মজুরি দাসত্ব শ্রমিকদের এমনই এক অসহায় অবস্থার ভেতরে রেখে দেয় যে, তাদের জোটে এক নিষ্ঠুর ও কঠিন জীবন, যেখানে সব কিছুর জন্যই লড়াই করতে হয় তা সে রুটিরুজি হোক, বস্ত্র হোক বা বাসস্থান হোক। এই ব্যবস্থা মানুষকে অজ্ঞানতার ভেতর রেখে দেয়। তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত করে। মজুরি দাস যাতে দাসই থেকে যায়, তার জন্য এটা দরকার হয়। প্রতিদিনই নিজেকে শ্রমিক রূপে পুনরুৎপাদন করতে হয়, মানে শ্রমিক হয়েই থাকতে হয় যাতে সে নিজের শ্রম করার ক্ষমতাটা বিক্রি করে পেট চালাতে পারে। এই সমগ্র অবস্থাটার বিরোধিতা যারা করেন, তারাই হলো সচেতন শ্রমিক এবং তারা অর্থনৈতিক ধর্মঘটের চাইতেও এগিয়ে ভাবে। ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘটের মাধ্যমে শ্রমিকরা পুঁজিবাদের ঘেরাটোপের ভেতরে থেকেই পুঁজিপতি শ্রেণীর মুখোমুখি হয়। মজদুরির উন্নততর শর্তের জন্য, পুঁজির নিত্যদিনের উৎপীড়ন ও হামলার বিরুদ্ধে এই ধর্মঘট সংগঠিত হয়। শ্রমিকদের জন্য এই অমানবিক ব্যবস্থাটাকে খতম করার ব্যবস্থা হলো (যেখানে না থাকবে গোলামি, না থাকবে গোলামি করার অসহায়ত্ব) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা; যেখানে থাকবে শ্রমের দুনিয়ার আধিপত্য, বহাল থাকবে তার গরিমা। মুনাফার জন্য নয়, উৎপাদন হবে সেখানে মানুষের জীবনের স্তরকে ক্রমাগত ওপরে ওঠানোর জন্য।পুঁজিবাদে বস্ত্র উৎপাদনকারী শ্রমিককে থাকতে হয় বস্ত্রহীন, বাসস্থান বানানো শ্রমিককে বাসস্থানহীন, অন্ন উৎপাদনকারীকে ভুখা! এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য লড়াই করতে হবে এবং সেটা আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক নয়, কেবল রাজনৈতিক লড়াই-ই হতে পারে।শ্রেণীর সংগ্রামের ক্ষেত্রটা তো রাজনীতির ক্ষেত্রই হয়। নিজেদের দাবি মানানোর জন্য, নিজেদের পক্ষে সংস্কার ঘটাতে বাধ্য করার জন্য, পুঁজির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রাম হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম। এর মাধ্যমে শ্রমিকরা অতীতে কিছু আইন বানাতে বাধ্য করেছে, যার সুবাদে তাদের কিছুটা সুরাহা মিলেছে। যেমন - কাজের ঘণ্টা কমিয়ে আট ঘণ্টা করা, ইউনিয়ন গঠনকে আইনী রূপ দেয়া ইত্যাদি। এসবের জন্য শ্রেণীকে ব্যাপক আকারে সংগ্রামে নামতে হয়। এতদসত্ত্বেও এই শ্রেণীসংগ্রাম পুঁজিবাদের ঘেরাটোপের ভেতরে থেকেই নিজেদের দাবিকে মানাতে বাধ্য করে। তবে এর জন্য তাদের রাষ্ট্রক্ষমতার সংগঠিত শক্তির সাথে লড়তে হয়। এই সমাজে এই রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজিপতিদের এমনই এক শক্তি যা তাদের সামগ্রিক স্বার্থের দেখভাল করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে, তার ব্যবস্থা করাই এর কাজ। এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শোষিত শ্রেণী, অর্থাৎ শ্রমিক ও মেহনতিদের দাবিয়ে রাখাটাও এর কাজ। তারা যাতে মাথা তুলে প্রতিরোধ করতে না পারে, লড়াই করে পুঁজিপতি শ্রেণীকে যাতে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে, তার জন্যই সে দমন করে। সমস্ত ধর্মঘটের ক্ষেত্রেই পুলিশ ও প্রশাসন পুঁজিপতির পক্ষ নিয়ে কাজ করে আর শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন চালায়। যখন পুঁজিবাদের ভেতরে লড়াইয়ের সাথেই এমন আচরণ করা হয়ে থাকে আর তাকে নির্মমভাবে পীড়ন করা হয়, তখন পুঁজিবাদকে উপড়ে ফেলার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রক্ষমতা, এই দমনমূলক যন্ত্র তখন পুঁজির পক্ষ নিয়ে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যই সচেষ্ট হবে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থাৎ রাষ্ট্রকে মোকাবিলা করার জন্য রাজনৈতিক রূপেই প্রস্তুত হতে হবে। শ্রমিকশ্রেণী যখন অন্য শ্রেণীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করে অথবা তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে, সে তখন আসলে রাজনৈতিক কার্যক্রমেই নামে। শ্রমিকরা যখন একটা শ্রেণী হিসাবে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে, রাষ্ট্রের সাথে তাদের টক্কর বাঁধে। শ্রমিকশ্রেণী নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামে। এটা করতে গিয়ে সে সমগ্র শ্রেণীর জন্য পুঁজিবাদী শোষণ-দমন থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কিছু সুরক্ষামূলক সংস্কারের জন্য শ্রেণীসংগ্রামে নামে। বিভিন্ন শ্রম আইন তারই দান। কিন্তু এটাই হয়ে যায় ট্রেড ইউনিয়ন লড়াইয়ের সীমা। সংস্কারের জন্য সে এই ব্যবস্থার ঘেরাটোপের ভেতরেই লড়াই করে। এতে এমনও হয় যে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে হাসিল হওয়া সংস্কারেই ব্যাপারটা খতম হয়ে যায়, যেখানে কোনও বিপ্লবী ইচ্ছা থাকে না। সংস্কারবাদে আটকে পড়া ট্রেড ইউনিয়নকে পুঁজিপতিশ্রেণী কাজে লাগায়। তারা নেতাদের কিনে নিতে থাকে আর কিছু ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা দিয়ে শ্রমিকদের তুষ্ট করে। এমতাবস্থায় শ্রমিকশ্রেণী নিজের জায়গায় থাকে না, কিছু সংস্কারের কথাই কেবল সে ভাবে। এর জন্য বেশি কিছু করার দরকার পড়ে না এবং ট্রেড ইউনিয়ন মেশিনারি নিজের রুটিনবদ্ধ ছকে কাজ করতে থাকে। শ্রম ও পুঁজির মধ্যবর্তী দুনিয়ায় সে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থেকে যায়। সেই কারণে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী লক্ষ্য বাদ দিয়ে যদি আমরা ভাবি যে, এমন ট্রেড ইউনিয়ন বানিয়ে নেবো যা চরিত্রগতভাবে একেবারে পরিচ্ছন্ন থাকবে, তাহলে এমন আশা করাটা মোটেই ঠিক হবে না। ইমানদার ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা তার নেতাকেও নিজের মেশিনারির অঙ্গ বানিয়ে সরকার, পুঁজিপতি শ্রেণী এবং তার প্রবন্ধন তাকে নখদন্তহীন করে রেখে দেয়। এমতাবস্থায় ট্রেড ইউনিয়নবাদ অন্তত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হলো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া এবং শ্রমিকশ্রেণীকে শ্রেণীচেতনায় সমৃদ্ধ হওয়া। শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণীচেতনা তাকে সেই অবধি নিয়ে যায়, যেখানে সে পুঁজির গোলামির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। পুঁজির শাসনকে বদলে দিয়ে সে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কথা বলে এবং অন্তর্বস্তুতে যা বিপ্লবী। শ্রমিকশ্রেণীকে তা রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম অবধি নিয়ে যায়, অর্থাৎ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রাম অবধি নিয়ে যায়। এমতাবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর দরকার নিজের রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা। এই সংগঠন শ্রেণীসচেতন শ্রমিকদের নিয়েই তৈরি হতে পারে, যারা এই বিপ্লবী লক্ষ্যের প্রতি সমর্পিত। এই সংগঠন আবশ্যিকভাবেই এই ধরনের শ্রমিকে সীমিত থাকতে পারে। পুঁজিবাদের ভেতরে বেশির ভাগ শ্রমিককে দারিদ্রপীড়িত অবস্থায় থাকতে হয়। কোমরভাঙ্গা মেহনত থেকে তাদের কোনও ফুরসত মেলে না। এই অবস্থায় সাধারণ শ্রমিকদের থেকে এটা আশা করা ভুল হবে যে, তারা সামনে এগিয়ে এরকম রাজনৈতিক কাজ করবে। এমনকী এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও শ্রমিকশ্রেণীর একটা বেশ বড় অংশ ট্রেড ইউনিয়নে সামিল থাকে না। এই কারণেই অগ্রণী শ্রমিকদের সংগঠন তৈরি হয়, যে সংগঠন সমগ্র শ্রেণীর স্বার্থে কাজকর্ম করে এবং তার বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। তার ওপর একটা বিরাট বড় জবাবদিহি থাকে যে, সে যেন নিজের সমগ্র শ্রেণীর কথা ভাবে। এই রাজনীতিতে দরকার শ্রমিকশ্রেণীর স্বতন্ত্র অবস্থান। নাহলে সে ট্রেড ইউনিয়নবাদ কিংবা সংস্কারবাদে আটকে থাকবে। স্বতন্ত্র অবস্থানের অর্থ হলো অন্যান্য শ্রেণীর অবস্থানের থেকে নিজেদের আলাদা অবস্থান বানানো; শ্রমিকশ্রেণীর আশু তথা দূরবর্তী স্বার্থকে বুঝতে পারা। এটা নিজেদের স্বতন্ত্র শ্রেণী বিচারধারা দিয়েই হতে পারে। পুঁজিবাদের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠিত বিচারধারা পুঁজিবাদীই হয়। এর বিরুদ্ধে সেই বিচারধারা দরকার, যা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এবং যা বিপথগামী হয়ে পুঁজিবাদী সংস্কারবাদের বদ্ধ জলাভূমিতে আটকে পড়বে না। শ্রমিকশ্রেণীর সব থেকে কাছের শ্রেণী হলো পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী। সমাজে এই পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিকশ্রেণীর চাইতে কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকে। কিন্তু সে পণ্য উৎপাদন করে এবং পুঁজিপতি হয়ে উঠতে চায়। সেজন্য তার বিচারধারা শ্রমিকদের পক্ষে বেশ বিপদজনক। শেষ বিচারে খুদে পুঁজিপতিশ্রেণীর ঐতিহাসিক গতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার দিকে। বড় পুঁজি তো ছোট পুঁজিকে গিলে খায়। কিন্তু তার বাসনা পুঁজিপতি হওয়া তথা নিজের অবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। এজন্য সে অবাস্তব সব কল্পনা করে। তার বিচারধারা এবং দাবিও সেই রকমই হয়। সেজন্য শ্রমিকশ্রেণীর নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে তোলার অর্থ হলো নিজেদের স্বার্থকে বোঝা এবং অন্য শ্রেণীর বিচারধারায় ফেঁসে না যাওয়া। এই কারণে বিচারধারার স্বতন্ত্রতা দরকার। এর মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী নিজের সমস্ত ব্যাপারে স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে পারে। শ্রমিকশ্রেণী তার বিচারধারা সমাজের সেই সমস্ত মানুষের কাছ থেকেই নেবে, যারা এই ক্ষেত্রটাতে কাজে করে। সেই সমস্ত মানুষরাই শ্রমিকশ্রেণীর বিচারধারার বাহক, যে বিচারধারার ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে তারা দেখতে পায় যে, সমাজের ভেতর ব্যাপ্ত অন্তর্বিরোধের সমাধান একমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র দিয়েই হতে পারে অর্থাৎ পুঁজিবাদকে উৎখাত করে একটা নয়া সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলেই সামনের দিকে সমাজের বিকাশ হতে পারে। এদের নিজেদের বৈচারিক প্রতিজ্ঞা এদেরকে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হতে প্রেরণা দেয়। এদের সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকদের সমাজতান্ত্রিক বিচারধারা গ্রহণ করা দরকার। এভাবেই শ্রমিকশ্রেণী নিজেদের রাজনীতির দিকে সঞ্চালিত করতে পারে। এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে স্পষ্টতই সেই শ্রেণীর বিচারধারারই আধিপত্য থাকে, সমাজ জুড়ে যার আধিপত্য থাকে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিচারধারাই রমরমা থাকে, যেটাকে আমরা সংবাদপত্র ও টিভি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও গ্রহণ করি। পুঁজিবাদী বিচারধারা সর্বত্রই ব্যাপ্ত থাকে। এই কারণে শ্রমিকও ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের ব্যাপারে ভাবতে থাকে। অথচ ব্যক্তিগত সম্পত্তির দুনিয়াকে খতম করেই এই শ্রেণীর ব্যাপক স্বার্থ রক্ষিত হতে পারে। সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির দুনিয়ার অবসান ঘটায়। শ্রমিক যদি অপমানে ভরা দুর্দশাগ্রস্ত জীবন থেকে নিস্তার পেতে চায়, তাহলে তাকে এই পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিনাশ ঘটাতে হবে, যে মজুরি দাসত্ব তাকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। নিজের গোলামির বেড়ি ভেঙ্গে ফেলার জন্য রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা দরকার, যা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। পুঁজির সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে রাষ্ট্রক্ষমতা, তার মোকাবিলা  হতে পারে কেবল রাজনৈতিক সংগঠন দিয়েই, যা বিপ্লবী বিচারধারায় পুষ্ট। কেবল তখনই সে পুঁজির এই সরকারি প্রতিনিধি, অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিটি চালকে চিনতে পারবে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবী না হলে কিছুই নয়। অতএব নিজের অস্তিত্বের এই গরিমা সৃষ্টির জন্য সে সামনে এগিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলুক, যা মজুরি দাসত্ব বিরোধী বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক বিচারধারার সাথে ওতপ্রোতহবে এবং শ্রমিক রাজ আনার লক্ষ্যে সঞ্চালিত হবে। কেবলমাত্র শ্রমিক ঐক্য দিয়েই শ্রমিকরা পুঁজিপতি শ্রেণীর মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু এই ঐক্যের অর্থ কী? সেটা হল বিচারধারার ঐক্য। বিচার আবার সাধারণ শ্রমিকদের সাথে মিলিত হয়ে বাস্তব শক্তি তৈরি করবে এবং পুঁজির বিরুদ্ধে নির্মম সংগ্রাম করবে। আর যারা পুঁজিবাদবিরোধী বিচারধারায় পুষ্ট অর্থাৎ শ্রেণীসচেতন, তারাই এই শ্রেণী ঐক্যের ভ্রূণ হিসাবে কাজ করবে। সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থের সচেতন অভিব্যাক্তি তারা দেয়। সেই কারণে অগ্রণী শ্রমিকদের রাজনৈতিক সংগঠনের ভেতরে কাজ করতে হবে। 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]