মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব

 

"নিপীড়িত জনগণ ও নিপীড়িত জাতিসমূহ নিজেদের মুক্তির জন্য কোনোমতেই সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের 'শুভবুদ্ধির' উপর ভরসা করে বসে থাকবেন না, কেবলমাত্র নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করে এবং অটলভাবে সংগ্রাম চালিয়েই তারা বিজয় অর্জন করতে পারেন।"
- মাও সে তুং, আগষ্ট ১৯৬৩

শ্রেণি শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিদ্রোহ হয়েছে। গণ বিপ্লবের সংখ্যাও কম নয়। অনেক বিপ্লব সফল হয়েছে। অনেকগুলো শাসকদের তরবারি ও গুলির আঘাতে রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এরকম বিপ্লব কখনো মানবজাতি দেখেনি। মাও সে তুং এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চীনে যেটি পরিচালিত হয়েছিল। সময়কালটি ছিল ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল। দশ বছর ধরে চলা এ বিপ্লব 'সাংস্কৃতিক বিপ্লব' নামে পরিচিত হলেও তা ছিল এক বিশাল ও মহান রাজনৈতিক বিপ্লব। এর দ্বারা নিপীড়িত শ্রেণি, যে নিজেই তখন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেই ক্ষমতার একাংশে অধিষ্ঠিত নিপীড়ক প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিকে উচ্ছেদ করে সেসব জায়গার ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। এই বিপ্লব হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক একটি দেশে ক্ষমতাসীন একটি পার্টির প্রধান নেতা মাও সে তুং এর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীনদেরই একাংশের বিরুদ্ধে। যদিও সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা একে মাও সে তুং এর কুক্ষিগত ক্ষমতা রক্ষার একটি প্রাসাদ চক্রান্ত হিসেবে এর বিরুদ্ধে হাজারো মিথ্যা প্রচার চালিয়েছে, কিন্তু এটি যে কোটি কোটি মানুষের এক বিশাল উত্থান ছিল এবং তা যে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে, বিশেষত শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপুল পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটিয়েছিল তা তারা লুকাতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক এক দেশে, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক দীর্ঘস্থায়ী ২২ বছরের গণযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এবং পরে আরো ১৭ বছর ধরে চলা সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের দ্বারা যার ভিত্তি হয়েছিল প্রতিষ্ঠিত, তেমন একটি দেশের ক্ষমতাসীন নেতাদের এক বড় অংশ গণ বিপ্লবের শত্রু হিসেবে ধুলিসাৎ হলো। কোটি কোটি ছাত্র-তরুণ স্কুল-কলেজ ছেড়ে মাও এর উদ্ধৃতি ও হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে নেমে পড়লো রাস্তায়, ছড়িয়ে পড়লো কারখানা মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে। তাদের পিছু ধরেই নামলো বিপ্লবের আসল কারিগর শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক সমাজ। স্বয়ং মাও তাদের রাজধানী বেইজিং এর তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে সাক্ষাৎ দিলেন নিজে রেড গার্ড সংগঠনগুলোর প্রতীকী ব্যান্ড নিজ বাহুতে বেঁধে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Red_Guards

প্রথমে ১০ লক্ষ, পরে ১ অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকীতে ২০ লক্ষ এবং সবমিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ তরুণ অবিশ্বাস্য শৃঙ্খলায় তাকে প্রত্যক্ষ করলো ও তার সামনে দিয়ে প্যারেড করে গেলো। তারা ঝঞ্ঝার মত সারা দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা, নগর পরিচালনা সংস্থা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে হানা দিয়ে ক্ষমতাসীন পার্টি নেতা ও আমলাদের গণআদালতের মুখোমুখি করলো। আর যাদের মনে হলো পুরনো মূল্যবোধ, ধ্যান ধারণা, রীতি ও সংস্কৃতির ধারক তাদের ক্ষমতাচ্যুত করলো। গঠন করলো নতুন ক্ষমতার সংস্থা 'বিপ্লবী কমিটি'। তাদের নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি সেক্টরে নতুন মূল্যবোধ গড়ে উঠতে লাগলো। মানুষের মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপিত হলো। ১৯৬৯ সালে মাও ও তার নেতৃত্বে পার্টি ঘোষণা করলো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সমাজতান্ত্রিক চীনেও পুঁজিবাদ পুন:প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া চলছিল তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বিপ্লব মহান বিজয় অর্জন করেছে। মাও জানালেন, এটাই শেষ নয়। যারা চীনকে পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে যেতে চায় তারা শেষ হয়নি। কে জিতবে, সমাজতন্ত্র না পুুঁজিবাদ - তার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। তাই বিপ্লব অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে। সেটা বোঝা গেল দু’বছর না যেতেই। যে নেতাদের মনে হয়েছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পক্ষে, তাদেরই একটি অংশ লিন পিয়াও এর নেতৃত্বে বিপ্লব সমাপ্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনা যখন ব্যর্থ হয় তখন তারা মাও-কে হত্যা ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা নেয়। আবার বিপ্লবের প্রথম পর্বের ধিকৃত পুঁজিবাদের পথগামীরা জায়গায় জায়গায় উঁচু পদে উঠে আসে। তাদের একাংশ ১৯৭৬ সালে দেঙ জিয়াওপিং এর নেতৃত্বে মাথা তুলে দাঁড়ায়। মাও পুনরায় এই 'ডান বিচ্যুতিপন্থী হাওয়া'র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পার্টিকে আহ্বান রাখলেন। এই লড়াই এর সমাপ্তির আগেই মাও মারা যান। পার্টির কেন্দ্রে মাওপন্থী নেতারা যখন ৬ অক্টোবর, ১৯৭৬ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সভার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখনই ঐ ডানপন্থীরা হুয়া কুয়োফেংকে সামনে রেখে একটি অভ্যুত্থান ঘটায়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hua_Guofeng

মাওপন্থী ও জিপিসিআর পন্থীদের গ্রেফতার করে তারা।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cultural_Revolution

বহু নগর ও শহরে বিদ্রোহ হয়, যাকে ক্ষমতাসীনরা রক্তাক্ত পথে দমন করে। হাজার হাজার মাওপন্থীকে গ্রেফতার ও গায়েব করে দেয়া হয়। নব্য ক্ষমতাসীনরা কিছুদিন নিজেদের মাওপন্থী হিসেবে দেখানোর ভড়ং দেখিয়ে ক্ষমতাকে সুসংহত করে। ১৯৭৮ থেকে তারা খোলস খুলতে থাকে। ১৯৮১ সালে চিয়াং চিং ও চ্যাং চুন চিয়াও-কে বিচারের প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zhang_Chunqiao

বর্তমান চীন আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান শ্রমিক শোষণের দেশ, সাম্রাজ্যবাদের পুঁজির অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ, এক নতুন সাম্রাজ্যবাদ অভিমুখী পুঁজিবাদী দেশ। এই মহান বিপ্লবের উত্তরাধিকার বিশ্বের মাওবাদীরা এবং তাদের সবচেয়ে অগ্রসর সুসংহত আন্তর্জাতিক ফোরাম 'বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন' ও অংশগ্রহণকারী পার্টিগুলো

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Revolutionary_Internationalist_Movement

তারা বিগত বহু বছর যাবৎ অসংখ্য সাহিত্য ও দলিলাদির মাধ্যমে জিপিসিআর এর তত্ত্ব ও কার্যক্রম, ইতিহাস ও অবদানকে প্রচার করেছে। বিশেষত অধুনা বিলুপ্ত 'বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন' এর আদর্শে অনুপ্রাণিত আন্তর্জাতিকতাবাদী পত্রিকা ‘এ ওয়ার্ল্ড টু উইন’ বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন নিবন্ধের মাধ্যমে সেসব প্রকাশ করেছে।

https://aworldtowinns.co.uk/

চীনের সমাজতন্ত্র ও মাও পরবর্তী চীনের পুঁজিবাদে অধ:পতনকে বুঝতে হলে জিপিসিআর-কে জানা ও বোঝার কোন বিকল্প নেই। বহু আন্তরিক বিপ্লবী সোভিয়েতের অধ:পতন থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আরেকটি বিরাট অংশ এই শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলো নিজেদের মাওপন্থী দাবি করেও জিপিসিআর ‘অনেক বাড়াবাড়ি করেছে’ যুক্তি দেখিয়ে। মাও ‘বাড়াবাড়ি’ সম্পর্কে তার 'হুনান রিপোর্ট' এ বিশ্লেষণ করেছেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Report_on_an_Investigation_of_the_Peasant_Movement_in_Hunan#:~:text=The%20Hunan%20Report's%20emphasis%20on,road%20to%20victory%20in%201949.

মাও আরো বলেছিলেন সীমা অতিক্রম না করলে কোন ভুলকে কাটানো যায় না। জিপিসিআর এই প্রথম মার্কসবাদের তত্ত্ব ভাণ্ডারে সংযোজন করে সেই তত্ত্ব যা দ্বারা সমাজতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে বিপ্লব অব্যাহত রাখা যাবে তা উল্লেখ করা হয়। কীভাবে তাকে পুঁজিবাদী পথগামীদের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে সেটাও বলা হয়। কীভাবে তাকে বিশ্ব বিপ্লবের ঘাঁটি হিসেবে রক্ষা করে বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নেয়া যাবে সেটা দেখিয়ে দেয়া হয়। এই তত্ত্ব সংযোজনের মাধ্যমেই মাও কমিউনিস্ট মতবাদকে তার তৃতীয় স্তরে উত্তরণ ঘটান। যাকে মাওবাদ বলা হয়, আর সমগ্র মতবাদটিকে আখ্যায়িত করা হয় 'মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ' হিসেবে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Marxism%E2%80%93Leninism%E2%80%93Maoism

মাও জিপিসিআর পরিচালনা করার আগে আগে পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বে জেঁকে বসা পুঁজিবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। যেমন- শিক্ষা আন্দোলন, শুদ্ধি আন্দোলন, পদচ্যুত করা ইত্যাদি। বড় পদচ্যুতির ঘটনাটি ঘটেছিল সামরিক বাহিনীর প্রধান পেং তেহুয়াই এর বিরুদ্ধে ১৯৫৯ সালে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Peng_Dehuai

পেং 'গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড' গণকমিউন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি এবং এর মাধ্যমে চীনে সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। তখনো বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন পুরোপুরিভাবে জানতো না কীভাবে সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে অধঃপতিত হয়। ১৯৫৬ সালে ক্রশ্চেভীয় সংশোধনবাদের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার পর তার কারণ নিয়ে মাও সে তুং গভীরভাবে গবেষণা করতে শুরু করেন। পার্টিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ১৯৬০ এর দশকের প্রথমার্ধে চীনা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক 'ওয়ার্ক টিম' গঠন করে শুদ্ধি ও শিক্ষা আন্দোলন চালাতে গিয়েও দেখা গেল তারও নেতৃত্বে পুঁজিবাদের পথগামীরা ঢুকে পড়েছে। যেখানে প্রয়োজন ছিল পুঁজিবাদের পথগামীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সেখানে দেখা গেলো তাদের পক্ষ হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে। যারা সেই শিক্ষা ও শুদ্ধি আন্দোলন করবেন সেই সব কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেই পুঁজিবাদী চেতনা গেড়ে বসেছিল। এরই সারসংকলন করে মাও জিপিসিআর এর ডাক দিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল নিচে থেকে লক্ষ-কোটি তরুণ ও জনগণকে জাগরিত করা, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষিত করা, এই গণ উত্থানের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পুঁজিবাদের পথগামী কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা। সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরে চিন্তার রূপান্তর ঘটানো। আর এসবের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি করা। সোভিয়েত ইউনিয়নে পুঁজিবাদ পুন:প্রতিষ্ঠার পর চীনের পুঁজিবাদের পথগামীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল যে, পিকিং এর একজন ডেপুটি মেয়র উ-হান "হাই জুই এর পদচ্যুতি" শিরোনামের এক নাটকে পেং তেহুয়াই এর সাফাই গায়। প্রয়োজন পড়লো তার কঠোর সমালোচনা করা। কিন্তু মাও কাউকে নিজ পক্ষে পেলেন না। অবশেষে চিয়াং চিং এর নির্দেশনায় ইয়াও ওয়েনইউয়ান একটি সমালোচনা পত্র লিখলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yao_Wenyuan

এটি রচনার মধ্য দিয়ে মাও তার অনুসারী এই তরুণ নেতৃবৃন্দকে বিপ্লবী রাজনীতিতে শিক্ষিত করে তুলতে চাইলেন। রচনাটি প্রায় ১১ বার সংশোধন করা হয়েছিল মাও এর পরামর্শে। কিন্তু এটি পিকিং এর কোথাও প্রকাশ করা গেলো না। পিকিং মেয়র পেন চেন তাতে বাধ সাধলো, যাকে মদদ দিচ্ছিল লিউ শাওচি ও দেঙ জিয়াওপিং এর মতো শীর্ষ নেতারা।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Peng_Zhen

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Liu_Shaoqi

অবশেষে লেখাটি নভেম্বর, ১৯৬৫ সালে সাংহাই থেকে প্রকাশিত হলো। রচনাটি প্রকাশ হতেই শীর্ষ পুঁজিবাদের পথগামীরা সতর্ক হয়ে গেলো। মাও কেন্দ্রীয় কমিটিতে যখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুললেন তখন তিনি প্রথমে সংখ্যালঘু ছিলেন। মাও এর সংগ্রামের পর তিনি সংখ্যাগুরু হলেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটি ১৬মে সার্কুলার নামের দলিলটি প্রকাশ করলো। মাও যাকে বলেছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের 'ইঙ্গিত'। কেন্দ্রীয় কমিটি এটি পাশ করলেও উচ্চ পদগুলোতে তখনো ডানপন্থীরা বহাল ছিল। মাও জুন ও জুলাই মাসের প্রায় ৫০ দিন পিকিং থেকে সরে থাকলেন। ডানপন্থীরা গুজব রটালো মাও অসুস্থ, শিগগির মারা যাবেন। সাম্রাজ্যবাদীরা তাতে মদদ দিলো। চীন সীমান্তে সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তির মহড়া চললো। ২৫ জুলাই ইয়াংসী নদীতে স্রোতের বিপরীতে মাও-কে ৭৩ বছর বয়সে কয়েক কিলোমিটার সাঁতার কাটতে দেখা গেলো এবং সেই ছবি সারা দুনিয়ায় প্রচারিত হলো।

https://thechinaproject.com/2021/07/14/power-of-symbolism-the-swim-that-changed-chinese-history/

আগস্টে মাও রাজধানীতে ফিরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডাকলেন। সেখানে তিনি ৫ আগষ্ট প্রকাশ করলেন “হেডকোয়ার্টারে তোপ দাগো” লিখিত বড় হরফের পোস্টারটি তার নিজের লেখা ছিল। ১৬ মে সার্কুলারের পর তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পিকিং এ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ শুরু হয়ে যায়। প্রথমে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও কর্মচারী সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বড় হরফের পোস্টার সাঁটায়। তাদের দমনের জন্য অপচেষ্টা হলেও দ্রুত এই বড় হরফের পোস্টার আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে সেই পোস্টার পড়েনি। “হেডকোয়ার্টারে তোপ দাগো” পোস্টারের পর লিউ শাওচি, দেঙ সহ বড় বড় নেতাদের নাম ধরে ছাত্ররা পোস্টার সাঁটাতে লাগলো। দলে দলে তরুণদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সংগঠন ‘রেড গার্ড’ গড়ে উঠলো। ৮ আগস্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ১৬ দফা সার্কলার প্রকাশ করে, যা ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ও গাইড। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিতে মাও এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু এবার ডানপন্থীরা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পক্ষের শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে তাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং সত্যিকার কমিউনিস্টদের টার্গেট করার অপচেষ্টা করলো। সাংহাই এ তারা ক্ষমতার বেশ কিছু জায়গায় শক্ত কর্তৃত্ব স্থাপন করলো। মাও চ্যাং চুন চিয়াও-কে পিকিং থেকে সাংহাই পাঠালেন পরিস্থিতি বিপ্লবীদের অনুকূলে আনার জন্য। সেখানকার শ্রমিক নেতা ওয়াং হুং ওয়েনের সহযোগিতায় শ্রমিক উত্থানের মধ্য দিয়ে সাংহাই এর ক্ষমতার সংস্থাগুলো দখলে নেয়া হলো জানুয়ারি, ১৯৬৭ সালে। যা ইতিহাসে 'জানুয়ারি ঝড়' হিসেবে পরিচিত।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Shanghai_People%27s_Commune

সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লো নগর থেকে গ্রামাঞ্চলে। সর্বত্র এক বিপুল উত্থান ও রূপান্তরের জোয়ার বইতে লাগলো। যাকে সুসংহত করা হয় ১৯৬৯ সালের ৯ম পার্টি কংগ্রেসে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/9th_National_Congress_of_the_Chinese_Communist_Party

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Four_Olds

এসময় হাজার বছরের কনফুসিয় ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালানো শুরু হয়। পুরনো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে মাও বলেছিলেন সেটার নাম দেয়া উচিত জমিদার, সম্রাট, সেনাপতি, সৌন্দর্য মন্ত্রণালয়। তাদের উচ্ছেদ করে মঞ্চ দখল করলো শ্রমিক কৃষকের বীরত্ব কাহিনী ও বীরেরা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো হয় শিক্ষাবর্ষকে সংক্ষিপ্ত করে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির নিয়ম বদলে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একাত্মতাকে প্রধান মানদন্ড করে। পুস্তকের শিক্ষাকে উৎপাদন সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের সাথে সংযুক্ত করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনায় যুক্ত হলেন বিপ্লবী শ্রমিক ও সৈনিকরা। শিল্প ও কৃষির ব্যবস্থাপনায় বুর্জোয়া ব্যক্তি পরিচালনার বদলে শ্রমিক ও কৃষকদের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা হয়। শ্রমিক-কৃষক, টেকনিশিয়ান ও অফিসার- এই তিনের সমন্বয়ে 'একের ভিতরে তিন' পদ্ধতির বিকাশ করা হয়। ক্ষমতার সংস্থা হিসেবে বিপ্লবী কমিটি'র বিকাশ ঘটানো হয় যাতে পার্টি, বাহিনী ও গণসংগঠন - এই তিনের প্রতিনিধি থাকবে এবং এখানেও 'একের ভিতর তিন' পদ্ধতির বিকাশ সাধন করা হয়। জনগণের 'চার বড় অধিকার' নিশ্চিত করা হয় - বড় হরফের পোস্টার সাঁটানো, বিরাটাকারের সমালোচনা করা, ব্যাপক বিতর্ক করা ও ব্যাপক স্বাধীনতা। এই বৃহৎ চার অধিকার এবং বিপ্লবী কমিটির ক্ষমতার সংস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ যেকোন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চেয়ে বহু গুণ উন্নত গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণকে দিয়েছিল। দেঙ চক্র ক্ষমতায় গিয়ে প্রথমেই তা হরণ করে নেয়। মার্কস বলেছিলেন, পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উত্তরণ হতে হলে পুঁজিবাদের চার ধরনের সম্পর্কের সকলগুলোর রূপান্তর প্রয়োজন। এগুলোকে 'চার সকল' বলা হয়ে থাকে। সেগুলো হলো- (১) সাধারণভাবে সকল শ্রেণি পার্থক্য বিলোপ; (২) যে উৎপাদন সম্পর্কগুলোর উপর এগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোর বিলোপ; (৩) এই উৎপাদন সম্পর্কসমূহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সকল সামাজিক সম্পর্কের বিলোপ এবং (৪) এই সামাজিক সম্পর্কসমূহ থেকে জন্ম নেয়া সকল ধারণাসমূহের বিপ্লবীকরণ। সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল এই মার্কসীয় নির্দেশ প্রয়োগের জীবন্ত উদাহরণ।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Marx%27s_theory_of_alienation#:~:text=Karl%20Marx's%20theory%20of%20alienation,society%20of%20stratified%20social%20classes.

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]