মূর্তি ভাঙার সমর্থনে - সরোজ দত্ত
তারা যে সম্মানে, মর্যাদায় ও গৌরবে ভূষিত করলো তা তার প্রাপ্য না হলেও অর্থাৎ সূর্যের আলোর মর্যাদা চাঁদের আলোর প্রাপ্য না হলেও তজ্জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তারা পরোক্ষে স্বীকার করে নিলো, ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু রুশ বিপ্লবের ও চীন বিপ্লবের নয়, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরও অংশ। অনেক সময় নিজের আরশিতে যে মুখ ঝাপসা দেখা যায় শত্রুর আরশিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংশোধনবাদীরা প্রমাণ করলো বাংলার যুবশক্তির এই মূর্তি ভাঙার ও স্কুল কলেজ ভাঙার অভিযানকে নিন্দা করতে হলে কান টানলে মাথা আসার মতো চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নিন্দা অনিবার্যভাবেই এসে যায়।
অতএব যারা বিপ্লবের স্তর ইত্যাদি নানা তর্কের অবতারণা করে একই সঙ্গে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে অভিনন্দন এবং বাংলার যুবছাত্রদের এই কার্যকলাপকে ধিক্কার জানাচ্ছেন আশা করি তারা প্রতিবিপ্লবী সিপিএম এর এই সংশোধনবাদী 'তাত্ত্বিক' কসরৎ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। এখন আসল কথায় আসা যাক। গত ১৬ আগস্টের 'যুগান্তরের' রিপোর্ট- ব্যারাকপুরে গান্ধীঘাটের প্রার্থনা সভায় রাজ্যপাল শ্রী শান্তি স্বরূপ ধাওয়ান উগ্রপন্থী যুবকদের হিংসাত্বক কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন এর মধ্যে দেশপ্রেম তো নেই-ই, বিপ্লবও বিন্দুমাত্র নেই। এখন আমার প্রশ্ন গান্ধীঘাট ব্যারাকপুরে হলো কেন? গান্ধীর চিতার ছাই এত জায়গা থাকতে ব্যারাকপুরে এই গঙ্গায় দেওয়া হলো কেন? মনে রাখতে হবে, তথাকথিত 'সিপাহি-যুদ্ধের' অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের প্রথম জাতীয় সশস্ত্র অভ্যু্থানের সূচনা হয় এই ব্যারাকপুরেই এবং অভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ প্রাত:স্মরণীয় মঙ্গল পাঁড়েকে ইংরেজরা ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে হত্যা করে এই ব্যারাকপুরে৷ এই সশস্ত্র জাতীয় অভ্যুত্থানের, কার্ল মার্কসের ভাষায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতার প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং তার প্রথম নায়ক মঙ্গল পাঁড়ের অস্বস্তিকর স্মৃতিকে চাপা দেবার জন্য লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের গোপন অনুরোধে গান্ধী স্মৃতিপূজার পীঠস্থান নির্বাচিত হয় ব্যারাকপুরে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে সিপিআই (এম-এল)-ই সর্বপ্রথম তথাকথিত 'সিপাহি যুদ্ধ'কে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব দিয়েছে এবং তাকে কৃষকযুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছে। এতদিন পরে পশ্চিম বাংলায় সিপিআই (এম-এল) এর নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করায় তারই আঘাতে ও আলোকে বিপ্লবী যুবশক্তির চোখে গান্ধী-ব্যারাকপুর রহস্য পরিষ্কার হয়ে আসছে। তাই তারা গান্ধীর মূর্তিকে ভাঙছে মঙ্গল পাঁড়ের মূর্তি গড়ার জন্য। কারণ চেয়ারম্যান মাও শিখিয়েছেন- না ভাঙলে গড়া হয়না। বিদ্যাসাগরের দেড়শো বছর পূর্ণ হওয়ার ঘটনাকে মওকা হিসেবে গ্রহণ করে আজ বিদ্যাসাগর পূজায় কেন এতো আড়ম্বর হচ্ছে? ব্যারাকপুরে যখন মঙ্গল পাঁড়ের ফাঁসি হয় এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ সারা বাংলায় জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর কি তখন তার কলেজকে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনা নিবাসে পরিণত হতে দেয়নি? ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাঁড়ে যখন ফাঁসিতে উঠেছিল বিদ্যাসাগর কি তখন সংস্কৃত কলেজে বসে ব্রিটিশের জয়গান করে বাংলার ইতিহাস রচনা করেনি? তাইতো আজ ছেলেরা ভাঙছে গান্ধী ও বিদ্যাসাগরের মূর্তি মঙ্গল পাঁড়ের মূর্তি গড়ার জন্য। কারণ মানব মুক্তির মহান শিক্ষক চেয়ারম্যান মাও শিখিয়েছেন, না ভাঙলে গড়া যায়না। ধূর্ত শাসকশ্রেণী এটা বুঝতে পেরেছে বলেই, মনীষী মূর্তি রক্ষার জন্য তাদের উচ্ছিষ্ট ভোগী দালালদের এই হিস্টিরিয়ার চিৎকার। সেইজন্যই তো যে গান্ধীঘাট তৈরী করা হয়েছে মঙ্গল পাঁড়ের পুণ্য স্মৃতি মুছে দেওয়ার জন্য সে গান্ধীঘাটে দাঁড়িয়ে নেহরুর দালাল অর্থাৎ মাউন্ট ব্যাটেনের দালালের দালাল ধাওয়ানের উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে এই গলাবাজি। ইন্দিরা-মাসানী-বাজপেয়ী থেকে প্রমোদ দাশগুপ্ত পর্যন্ত প্রসারিত মূর্তি রক্ষার 'জাতীয় মোর্চা'র নিগূঢ় রাজনীতির রহস্যের চাবিকাঠি রয়েছে এখানেই। বছর পনেরো আগে চীনবিরোধী অভিযানের সূক্ষ ও সুপরিকল্পিত পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ভারতীয় জনগণের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলার মতলবে ধূর্ত নেহরু সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উৎযাপনের ডাক দিয়েছিলো। কিন্তু অচিরেই সে বুঝতে পারলো সে চালে ভুল করেছে এবং ফল হতে চলেছে উল্টো। সিপাহী বিদ্রোহকে উপলক্ষ করে ভারতীয় জনমনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জেগে উঠেছে যা গান্ধীবাদ ও সংসদীয় রাজনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানতে পারে এবং ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলতে পারে, কারণ তখন চীন বিপ্লব ও মাও সে তুঙ এর রাজনীতির জোর প্রভাব পড়েছে ভারতীয় জনগণের উপর এবং সদ্য নেতা তেলেঙ্গানার আগুন অনুকূল বাতাসে আবার জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। আর দেরি না করে রাশ টানলো নেহরু। যদু সরকার, রমেশ মজুমদারের মতো ব্রিটিশের খয়ের খাঁ শ্রেণীর ঐতিহাসিকদের নিয়ে সে একটা কমিশন বসিয়ে দিলো, যাদের কাজ হলো এই তথাকথিত 'সিপাহি বিদ্রোহে'র চরিত্র বিশ্লেষণ। তারাও যথারীতি তাদের পান্ডিত্যের চোখ ঝলসানো তলোয়ার ঘুরিয়ে আমার আপনার মতো ইতর জনকে বুঝিয়ে দিলো যে এই বিদ্রোহ 'জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ' ছিল না, এই বিদ্রোহ ছিল প্রগতিশীল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল দেশীয় শক্তির একটা প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান। অর্থাৎ এই বিদ্রোহ দমনে যে দেশীয় 'মহাপুরুষে'রা সেদিন পরদেশগ্রাসী বিদেশি শক্তিকে সাহায্য করেছিল সমাজ, ধর্ম ও শিক্ষা সংস্কারের টোপে জনতাকে বিদ্রোহবিমুখ করার চেষ্টা করে, তারাই ছিল প্রগতির ধারক ও বাহক। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে দেখে নেহরু সেদিন তাড়াতাড়ি আধ খোঁড়া গর্তে এইভাবে মাটি চাপা দিয়েছিলো। কারণ মূর্তির প্রশ্ন তখনই এসে গিয়েছিল এবং জনতার মধ্য থেকে দাবি উঠেছিল পার্কস্ট্রিট-চৌরঙ্গীর সংযোগস্থলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দম্ভের প্রতীক আউটরামের খোলা তলোয়ার হাতে অশ্বারূঢ় মূর্তি সরিয়ে সেখানে মহাবিদ্রোহের নায়িকা শহিদ ঝাঁসীর রানি লক্ষীবাইয়ের খোলা তলোয়ার হাতে অশ্বারূঢ় মূর্তি স্থাপন করা হোক। ব্রিটিশের দালাল নেহরু সেদিন প্রমাদ গুনেছিল এবং আউটরামের মূর্তি সরিয়ে গান্ধীর মূর্তি বসানোর ব্যবস্থা করে জনতাকে ধোঁকা দিয়েছিল এবং ইংরেজকে খুশি করেছিল। এই মূর্তি পরিবর্তন যে উপনিবেশ থেকে নয়া উপনিবেশে পরিবর্তনেরই প্রতীক। এখানে একটা কথা বলা দরকার। সাম্রাজ্যবাদের খয়ের খাঁ 'স্যার' যদুনাথ-রমেশ মজুমদারের মতো ভারতীয় ঐতিহাসিকরা সেদিন সিপাহি বিদ্রোহের যে মূল্যায়ন দিয়ে মাউন্ট ব্যাটেন-নেহরু চক্রকে রক্ষা করেছিল তার বছর পনেরো আগে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং সেই সুবাদে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুরব্বি রজনী পাম দত্ত তার 'ইন্ডিয়া টুডে' গ্রন্থে সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক সেই মূল্যায়নই করেছিল, অবশ্য মার্কসবাদী বাক্যজাল বিস্তার করে। যদিও ভারতীয় মহাবিদ্রোহের সময় ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগামী বামপন্থী অংশ ব্রিটিশ শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষ থেকে এই মহাবিদ্রোহকে পরিপূর্ণ ও অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংহতি জানিয়েছিল এবং মহাবিদ্রোহের দশ বছর আগে তীক্ষ্ণ ভবিষ্যৎ দৃষ্টিতে এই মহাবিদ্রোহকে দেখতে পেয়ে ব্রিটেনে চার্টিস্ট আন্দোলনের বামপন্থী নেতা, মার্কস এঙ্গেলসের ব্যক্তিগত বন্ধু কবি আর্নেস্ট জোন্স কারাগারে বসে 'রিভোল্ট অব হিন্দুস্থান' (হিন্দুস্থানের বিদ্রোহ) নামে এক মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, যার প্রথম পংক্তি লিখেছিলেন তিনি নিজের আঙ্গুল কেটে তার রক্ত দিয়ে, কিন্তু ৭০-৮০ বছর পরে সাম্রাজ্যবাদের পতন ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে ব্রিটেনের শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী অগ্রণী অংশের প্রতিনিধি বলে আত্মপরিচয়দাতা, তথাকথিত 'লেনিনপন্থী' কমিউনিস্ট নেতা রজনী পাম দত্ত কিন্তু সে মূল্যায়নকে বর্জন করে সাম্রাজ্যবাদী মূল্যায়নই গ্রহণ করলো৷ সেসব মূর্তির গায়ে হাত পড়ায় আজ সাম্রাজ্যবাদের দালালরা আর্তনাদ করে উঠেছে৷ সেগুলোর ভিতকে সেদিন সে তার 'মার্কসবাদী' পান্ডিত্যের সিমেন্ট দিয়ে শক্ত করেছিল এবং শক্ত করেছিল ভারতীয় মহাবিদ্রোহের এই সাম্রাজ্যবাদী মূল্যায়নের ভিত্তিকেই৷ ১৯৪৬ সালে বইখানা সে নতুন করে লেখে এবং হালনাগাদ (up to date) করে৷ কিন্তু নতুন সংস্করণেও সে এ মূল্যায়ন এতটুকু পাল্টায়নি। তথাকথিত 'সিপাহি যুদ্ধ'কে স্বয়ং কার্ল মার্কস যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সে দিকে তার দৃষ্টি বারবার আকর্ষণ করা সত্ত্বেও সে নির্বিকার থাকে। 'ইন্ডিয়া টুডে' বইখানা ছিল এবং এখনো আছে, ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংশোধনবাদী মহারথীরা এই গীতাকারেরই সাক্ষাৎ শিষ্য। বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে এই সারথির কাছে রথী জ্যোতি বোস এই গীতার বাণী শ্রবণ করে (পরে তাই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়) এবং বিপ্লবী-বিশ্বরূপ দর্শনে বিপ্লবী-দিব্যদৃষ্টি লাভ করে দেশে ফিরে আসে। আজ যে সে বিড়লাদের ও ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের এত বিশ্বস্ত 'বিপ্লবী' তার রহস্য এখানেই। ১৯৬২ সালে চেয়ারম্যান মাও যখন সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্কের সূত্রপাত করেন তখন ভারতীয় সংশোধনবাদী পান্ডাদের সঙ্গে তাদের গুরুদেব স্থানীয় রজনী পাম দত্তের স্বরূপও প্রকাশ হয়ে পড়ে। আজ এই বইখানা নতুন করে পড়ে বুঝতে পারছি, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তার জন্মকাল থেকেই কী ভীষণ এক আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবী সংশোধনবাদী চক্রান্তের কব্জায় পড়েছিল। বিস্তৃত আলোচনার স্থান ও সুযোগ এখানে নেই। শুধু এইটুকু বলবো, স্বয়ং মার্কস যাকে বলেছেন ভারতের জনগণের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তাকে 'মার্কসবাদী' পণ্ডিত রজনী পাম দত্ত বলছে প্রগতিশীল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান আরও বলছে ব্রিটিশ ভারতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূচনা হচ্ছে তথাকথিত 'সিপাহি বিদ্রোহে'র আঠাশ বছর পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায়, যদিও বামপন্থী ভঙ্গি রাখার জন্য সঙ্গে সঙ্গে সে স্বীকার করেছে যে জাতীয় মহাবিদ্রোহ দমিত হওয়ার এই ২৮ বছরের মধ্যে গোটা ভারতবর্ষ আর একটা প্রচন্ড সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল যা ছিল মূলত কৃষক অভ্যুত্থান এবং যাকে রুখবার জন্য ধূর্ত ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড ডাফরিন তার ব্রিটিশ দালাল 'ভারত প্রেমিক' হিউমকে দিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তৈরী করেছিল। উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতার সশস্ত্র অভ্যুত্থান যা মূলত কৃষক অভ্যুত্থান, তা হচ্ছে প্রগতিবিরোধী প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান ও বিপদগামী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একেবারে প্রত্যক্ষ উদ্যোগে 'কিছুটা গ্যাস বেরোতে দেওয়ার জন্য' দালাল বুর্জোয়াদের উঁচু মহলের কিছু ইংরেজি শিক্ষিত প্রতিনিধি নিয়ে যে জাতীয় কংগ্রেস তৈরী হলো সেই হলো জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূচনা। এই হচ্ছে 'ইন্ডিয়া টুডে' গ্রন্থে রজনী পাম দত্তের থিসিস বা প্রতিপাদ্য এবং এই থিসিসের ভিত্তিতেই ভারতবর্ষে তার চেলারা (এখানে ডাঙ্গে বা সুন্দরাইয়ায় কোনো ভেদ নেই) এতকাল কমিউনিস্ট আন্দোলন চালিয়ে এসেছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঐ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দেশি দালাল বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি ছাড়া কিছুই হতে পারেনি। রজনী পাম দত্ত যখন এই বই লিখছে, চেয়ারম্যান মাও তখন লিখছেন-
"কৃষকদের প্রতি জমিদার শ্রেণীর নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক উৎপীড়ন জমিদার শ্রেণীর শাসনের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করতে কৃষকদের বাধ্য করেছিল। চীনের সমাজতান্ত্রিক সমাজে কেবলমাত্র এই ধরনের কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রাম, কৃষক বিদ্রোহ এবং কৃষক যুদ্ধই হলো ঐতিহাসিক বিকাশের চালিকা শক্তি।”
রজনী পাম দত্তের 'ইন্ডিয়া টুডে' বইখানা একটু তলিয়ে পড়লেই মনে হবে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর থিসিস নাটক করার উদ্দেশ্য নিয়েই সে যেন লেখনী ধারণ করেছিল। অতএব মূর্তি রক্ষার লড়াইয়ে ইন্দিরা, ধাওয়ানের সঙ্গে ডাঙ্গে, সুন্দরাইয়া যে এক 'জাতীয় মোর্চা'য় সামিল হবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এ মূর্তি রক্ষার 'জাতীয় মোর্চা' আসলে কৃষিবিপ্লবের বিরুদ্ধে 'জাতীয় মোর্চা'; যার সংশোধনবাদী তাত্ত্বিক ভিত্তি রজনী পাম দত্তের 'ইন্ডিয়া টুডে'। ১৯৪৯ সালে চীন বিপ্লবের বিজয়ী পরিসমাপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি ডিন এচেসনের 'চীনা ইতিহাসের বিশ্লেষণ' এর জবাবে 'ইতিহাসের ভাববাদী ধারণার দেউলিয়ারূপ' নামে যে প্রবন্ধ লেখেন, আজ বোঝা যাচ্ছে তা শুধু ডিন এচেসনেরই জবাব ছিল না, জবাব ছিল তার নিজের দেশের লিউ শাওচি গোষ্ঠীর এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের রজনী পাম দত্ত কোম্পানিরও৷ লক্ষণীয় ১৯৪৯ সালে রজনী পাম দত্ত যখন 'ইন্ডিয়া টুডে'র নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে, প্রায় ঠিক তখনই চেয়ারম্যান এই প্রবন্ধটি লেখেন। (মাও সে তুং নির্বাচিত রচনাবলি, পিকিং, ৪র্থ ভল্যুম)৷ পনেরো বছর পর আজ যখন নকশালবাড়ি হয়েছে, মাও সে তুং চিন্তাধারা ভারতের কৃষক জনতার গভীরে প্রবেশ করেছে, সিপিআই (এম-এল) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সারা ভারতে বিশেষ করে সারা পশ্চিম বাংলায় লক্ষ লক্ষ কৃষক ক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র গেরিলাযুদ্ধে সামিল হয়েছেন এবং তারই অনিবার্য প্রভাবে জেগে উঠেছে যুবশক্তি, শ্রমিক ও ব্যাপক জনতা, তখন তাদের চোখে এই ধোঁকাবাজি ধরা পড়ে যাচ্ছে, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। তাই আজ তারা মূর্তি ভাঙছে পাল্টা মূর্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদে। গান্ধীর মূর্তি ভাঙছে, ঝাঁসির রানির মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য৷ গান্ধীঘাট ভাঙছে তারা মঙ্গলঘাট তৈরির জন্য। প্রশ্ন উঠবে, তরুণরা কি এতো সব বুঝে এইসব কাজ করছেন? বিপ্লবী জনতা সবকিছু বুঝে বিপ্লবী কাজ করে না। যার মূর্তি তারা ভাঙছেন তার কার্যকলাপকে কি তারা বিচার করে দেখেছেন? না, করেননি। তবু তারা সঠিক কাজ করছেন। তারা বিপ্লবের বিজয়ের যুগে জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন। প্রবীণদের মতো সংশোধনবাদী পূর্ব সংস্কারে তারা ভারাক্রান্ত নন। যে মূর্তি চিনতে প্রবীণদের পুরাতন বন্ধন ছিন্ন করার তীব্র বেদনাময় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সে মূর্তিকে আজকে তরুণরা অনেকটা সহজাতভাবেই চিনে ফেলবেন। প্রবীণদের মতো তাদের দৃষ্টি পূর্ব সংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল না। তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের তীব্র আলো চোখে লাগতেই তারা চোখ মেলে অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, যা হয়তো প্রবীণদের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রশ্ন উঠবে ওসব মূর্তি না ভেঙে কি নিজেদের মন মতো মূর্তি গড়া যায় না?নিজেদের মন মতো ঘাট বানানো যায় না? না, তা যায় না। চেয়ারম্যান মাও আমাদের শিখিয়েছেন, না ভাঙলে গড়া যায় না। যা গড়তে হবে তার বিপরীতকে ভাঙতে হবে এবং এই বিপরীতকে ভাঙার মধ্য দিয়েই গড়া হয়। সাম্রাজ্যবাদের দালাল শাসকশ্রেণী ও তাদের দালাল সংশোধনবাদীরাও তাদের দিক থেকে অর্থাৎ তাদের মন মতো মূর্তি গড়ার ও রক্ষার কাজ করছে এবং এই কাজে সংশোধনবাদীদের তাত্ত্বিক রসদ জোগাচ্ছে রজনী পাম দত্তের 'ইন্ডিয়া টুডে'। তাই ১৮৫৭-৫৮ সালের জাতীয় মহাবিদ্রোহের এবং তার পূর্ববর্তীকালের জনতার, বিশেষত কৃষক জনতার বারংবার সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থানের যারা বিরোধিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তথাকথিত সমাজ, ধর্ম ও শিক্ষার সংস্কারবাদী আন্দোলন চালিয়ে তাদেরই আদর্শ পুরুষ রূপে খাড়া করা হয়েছে। তাদেরই মূর্তি গড়া হয়েছে। মূর্তি গড়া হয়নি ঐ সংগ্রাম যারা করেছেন এবং ঐ সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের। মূর্তি গড়া হয়েছে বিদ্যাসাগরের, মূর্তি গড়া হয়নি মঙ্গল পাঁড়ের। মূর্তি গড়া হয়েছে আশু মুখুজ্যের, মূর্তি গড়া হয়নি কানাইলাল-ক্ষুদিরামের। মূর্তি গড়া হয়েছে সুরেন বাঁড়ুজ্যে-বিপিন পালের, মূর্তি গড়া হয়নি সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক শহিদ কানু-সিধুর। মূর্তি গড়া হয়েছে বিবেকানন্দের, আর মূর্তি গড়া দূরে থাকুক পাঠ্য ইতিহাসের পাতা থেকে সযত্নে ও সুকৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে নীল বিদ্রোহের কৃষক নেতাদের নাম। অতএব নিছক মূর্তি স্থাপন নয়, এ যে এক মূর্তিকে সরিয়ে আর এক মূর্তিকে বসানো; বিপ্লবের মূর্তিকে সরিয়ে বিপ্লবের বিরোধিতার মূর্তিকে বসানো। তাই এরা যে প্রাণপনে পুরনো মূর্তিগুলো রক্ষা করতে চাইছে, তার কারণ এরা জানে এগুলো রক্ষা করতে না পারলে এগুলোর জায়গায় নতুন মূর্তি এসে যাবে এবং তাহলেই সর্বনাশ। কারণ নতুন মূর্তি মানেই নতুন রাজনীতি, সশস্ত্র সংগ্রামের বিপ্লবী রাজনীতি, নকশালবাড়ির রাজনীতি, সিপিআই (এম-এল) এর রাজনীতি, চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর রাজনীতি। তাই মূর্তি ভাঙার লড়াই আসলে দুই মূর্তির লড়াই এবং দুই মূর্তির লড়াই আসলে দুই রাজনীতির লড়াই; দুই লাইনের লড়াই, দুই শ্রেণীর লড়াই। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্থান এখানে নেই। একে অন্যকে উচ্ছেদ না করে এ লড়াইয়ের ফয়সালা হবে না। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন-
"শ্রেণীতে শ্রেণীতে লড়াই চলে। কোনো কোনো শ্রেণী জয়লাভ করে, অন্যরা উচ্ছেদ হয়ে যায়। এই হচ্ছে ইতিহাস, এই হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার ইতিহাস। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করা ঐতিহাসিক ভাববাদ।”
আজকের দিনের এই মূর্তির লড়াইকে বিচার করুন চেয়ারম্যান মাও সে তুঙের এই অমূল্য শিক্ষার আলোকে। যারা মূর্তি ভাঙছেন তারা সিপিআই (এম-এল) এর নন। তারা সবাই যে সিপিআই (এম-এল) এর নির্দেশ মেনে চলেন এমন কথা নেই। সিপিআই (এম-এল) পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলে যে বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের সূচনা করেছে এবং বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে তারই আঘাতে নাড়া খাওয়া এবং তারই আলোকে জেগে ওঠা যুব ছাত্রদের এ এক অভিনব গণ আন্দোলন। আমাদের পার্টিই এই আন্দোলন শুরু করেছে, তবে সংশোধনবাদী কায়দায় নয়। কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায় বসে না থেকে পাটির যুব ছাত্ররা কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও জনতার মেজাজ অনুযায়ী এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন যা দেখতে দেখতে বিপুল ও ব্যাপক এক যুব গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনই আজ স্বাধীনতার পলেস্তারা ঢাকা ও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ভূমিকম্পের মতো নাড়া দিচ্ছে। যার ফলে আড়াইশো বছর ধরে লালিত ও পূজিত মূর্তিগুলো ভেঙে পড়েছে। শহরে ঝড় উঠেছে, কিন্ত শহরের এ ঝড়ের উৎপত্তি শহরে নয়; এর ঝটিকাকেন্দ্র গ্রামের কৃষক সমুদ্রে, সেখানে সিপিআই (এম-এল) এর নেতৃত্বে কৃষকের গেরিলাযুদ্ধ যে ভীষণ নিম্নচাপ সৃষ্টি করেছে এ ঝড় উঠে আসছে সেখান থেকেই; একে সেইভাবেই বিচার করতে হবে। এ পার্টির মুষ্টিমেয় যুব ছাত্রদের কাজ নয়; এ হাজারে-হাজারে যুব ছাত্রদের গণআন্দোলন। প্রতিদিন এ আন্দোলনে নতুন নতুন যুব-ছাত্র দলে দলে এসে যোগ দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে 'গণ-প্রতিরোধ' জেগে উঠেছে বলে বুর্জোয়া পত্র-পত্রিকায় যে প্রচার করা হচ্ছে তা যে ঘটনা নয়, ঘটনা ঘটাবার জন্য নিছক রটনা অর্থাৎ উসকানি দেওয়ার ওজর মাত্র তা বুঝতে কারো কষ্ট হচ্ছে না। বরং উল্টোটাই যে সত্য তা মাঝে মাঝে ঐ বুর্জোয়া কাগজপত্রেই প্রকাশ হয়ে পড়ছে। বিপ্লবী পার্টি কর্তৃক সূচিত ও পরিচালিত বিপ্লবী কৃষকদের সংগ্রাম এই যুব গণ আন্দোলনের জন্মদাতা, অতএব এই গণ আন্দোলন স্বয়ম্ভূ ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়, ঠিক তেমনি আবার পার্টির ছককাটা পথে, পার্টি কর্তৃক পদে পদে নিষেধের নিগড়ে নিয়ন্ত্রিত হয়ে এ আন্দোলন অগ্রসর হচ্ছে না এবং হতে পারে না। সচেতন নেতৃত্বের ও স্বাধীন বিকাশের এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। তাছাড়া আজকের এ বিপ্লবের বিজয়ের যুগে গণসংগঠন ছাড়াই যে বিরাট ও ব্যাপক গণ আন্দোলন হতে পারে এ আন্দোলন তার একটি জ্বলন্ত সাক্ষ্য। চোখের উপর দেখছি, ক্রমে শ্রমিকদেরও এক বিরাট গণ আন্দোলন শুরু হচ্ছে এইভাবে গণসংগঠন ছাড়াই, গণ-সংগঠনের বেড়ি ভেঙে। তাই এই যুব গণ আন্দোলন পার্টিরই; পার্টি এ আন্দোলনকে সমর্থন জানায়, সংহতি জানায়, এ আন্দোলনকে পার্টি তার আত্মজ বলে মনে করে। এ আন্দোলনের প্রতি পার্টির দায়িত্ব হবে শুধু সর্বক্ষণ তাকে তার উৎসের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। যে সময় পশ্চিম বাংলায় শ্রেণীশত্রু খতমের হার প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক সেই সময় তারা রটাচ্ছে পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলে কৃষক সংগ্রাম একেবারে থেমে গেছে এবং নকশালপন্থীদের কাজ এখন সম্পূর্ণভাবে শহরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। গূঢ় মতলব নিয়েই তারা এ রটনা করছে। কারণ তারা জানে এই শহরাঞ্চলে তাদের সংগ্রামের উৎসের কথা যদি যুব ছাত্রদের ভুলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাদের এই আন্দোলন অহমিকায় অন্ধ হয়ে ভেঙে যাবে। ফলে বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই পার্টি তাদের আন্দোলনের উৎসের কথা সর্বক্ষণ যুব ছাত্রদের স্মরণ করিয়ে দেবে। উৎস শুকিয়ে গেলে যে তারাও শুকিয়ে যাবে সর্বক্ষণ এই হুঁশিয়ারি দেবে৷ উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় সর্বক্ষণ তাদের উৎসাহিত করবে। পার্টির কাজ এর বেশি নয়। পার্টি গুহামুখ থেকে ঠেলে পাথর সরিয়ে দিয়েছে। উন্মুক্ত জলস্রোত যত নিচে নামছে তত প্রবল ও ব্যাপক হচ্ছে। তার সামনে বেত হাতে দাঁড়িয়ে "ওদিকে যেয়ো না", “ও ক্ষেত ভাসিয়ো না", "ও গ্রাম ডুবিয়ো না" বলে মাস্টারি করার মতো মূঢ় আমাদের পার্টি নয়। বিপ্লবী যুব ছাত্রদের কোন কাজটা বেঠিক হচ্ছে, কোথায় কোন কাজে তাদের কতটুকু বিচ্যুতি হচ্ছে, কোথায় তারা মাত্রা ছাপিয়ে যাচ্ছে তা নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে বুড়ো মুদির মতো সর্বক্ষণ নীতির নিক্তিতে ওজন করে দেখা আমাদের পার্টির কাজ নয়। এই আন্দোলনে বাড়াবাড়ি হবেই, না হলে বুঝবো কিছুই হচ্ছে না। চেয়ারম্যান আমাদের শিখিয়েছেন বাড়াবাড়ি না করলে অন্যায়ের প্রতিকার করা যায় না। চেয়ারম্যান আমাদের শিখিয়েছেন "বিপ্লব মানেই বাড়াবাড়ি"।আমরা সংশোধনবাদীদের মতো বিপ্লবের প্রস্তুতি করছি না, আমরা বিপ্লব করছি; তাই বাড়াবাড়ির ভয় করলে আমরা আর বিপ্লবী থাকবো না। যুব ছাত্রদের যদি অভিনন্দিত করতে হয় তবে এই বাড়াবাড়ির জন্যই করবো। পশ্চিম বাংলার যুব ছাত্রদের এই বিপ্লবী গণ আন্দোলন প্রধানত পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আসা যুবকদেরই গণ আন্দোলন। কারণ আমাদের স্কুল-কলেজে এখনো শ্রমিক ও গরিব কৃষক ঘরের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য। নেই বললেই চলে। কৃষকের বিপ্লবী সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ পেটিবুর্জোয়া ঘরের এই যুবকরা প্রতিক্রিয়াশীল ঔপনিবেশিক শিক্ষা-সংস্কৃতি ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ শিকার এবং তারা বয়সে কাঁচা। তাই এর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহ আসছে প্রথমত তাদের কাছ থেকেই। পঞ্চাশ বছর আগে চীনেও তাই এসেছিলো, তাদের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম সর্বহারা মতাদর্শ ও সংস্কৃতি চীনে প্রবেশ করেছিল। এখানে আজ এরা এদের নিজেদের শ্রেণী ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন এবং এই ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে সর্বহারা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেছেন। একটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো৷ এই সংগ্রামে যুব ছাত্ররা অসামান্য বীরত্ব দেখাচ্ছেন। বীরত্ব ব্যক্তিগত নয়, বীরত্ব শ্রেণীগত। যে শ্রেণী থেকে তারা আসছেন সাধারণভাবে তার সমর্থন না থাকলে এ বীরত্ব তারা দেখাতে পারতেন না। এদের নিন্দা করে সিপিএম এর রাজ্য কমিটি যে বিবৃতি দিয়েছে তাতেও এই সমর্থনকে তারা স্বীকার করেছে। যুবশক্তির এই বিপ্লবী গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাই শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে পেটিবুর্জোয়ার যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠেছে বলা চলে। লিন পিয়াও বলেছেন গণতান্ত্রিক বিপ্লবে অ-মেহনতি জনতাকে নিয়ে শ্রমিক-কৃষকের যে যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠে তা সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না একান্তভাবে এই শ্রমিক-কৃষকের যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এবং শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব বলতে স্পষ্টভাবেই তিনি বলে দিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পূর্বশর্ত প্রথম যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা এবং এই প্রথম যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলতে হলে কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর নেতৃত্বে সশস্ত্র কৃষকদের সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে সর্বহারা সংস্কৃতির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে এই নেতৃত্বেই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও শ্রমিক,কৃষক ও অ-মেহনতি জনতার যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠবে। সর্বহারা শ্রেণীর এই সাংস্কৃতিক লড়াই, তার শ্রেণী সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক কারণে শুরু করেছেন পেটিবুর্জোয়া ঘরের যুব ছাত্ররা এবং লক্ষ্য করার বিষয় নিজেদের অ-মেহনতি শ্রেণীর বিরোধিতা তারা পাচ্ছে না, সম্ভবত এটাও বিপ্লবের বিজয়ের যুগের লক্ষণ। পেলে এ সাহস ও উদ্যোগ তাদের আসতো না, বরং তারা মুষ্টিমেয় হয়ে থাকতেন; গণ আন্দোলনের উৎস ও প্রেরণা ছিল চীন জাতির প্রতি জাপানি সাম্রাজ্যবাদের নিদারুণ অপমান; আর আজকের পশ্চিম বাংলার এই যুব আন্দোলনের উৎস ও প্রেরণা হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম। চীনের ৪ঠা মে'র আন্দোলন থেকে জন্মলাভ করেছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। আর পশ্চিম বাংলায় আজকের এ যুব আন্দোলন জন্ম নিলো সদ্যগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নেতৃত্বে পরিচালিত সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের মধ্য থেকে। চীনের ৪ মে'র আন্দোলন অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাবে হলেও চেয়ারম্যানের যুগে হয়নি। আর পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের এ যুব আন্দোলন চেয়ারম্যানের যুগে হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদের দ্রুত ও সম্পূর্ণ ধ্বংসের ও সমাজতন্ত্রের বিস্তৃতির যুগে হচ্ছে, চীনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের
বিজয়োৎসবের মধ্যে হচ্ছে। এই জন্যই একে অভিনব মনে হচ্ছে এবং সত্যই এ অভিনব। এর তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া যে কি সুদূরপ্রসারী হবে তা সম্ভবত আমরা এখন বুঝতে পারবো না। এ যুগ চেয়ারম্যানের যুগ, বিপ্লবের বিজয়ের যুগ এবং ৫০ কোটির দেশ ভারতবর্ষে যে বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে, ততএব বহু অভাবনীয় ঘটনা ঘটবে যা পুরনো মাপকাঠিতে মাপা যাবে না, যা পুরনো ধারণা দিয়ে ধরা যাবে না। এইসব ঘটনার জন্য আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ হুশিয়ার থাকতে হবে, প্রজাপতি ধরার জাল দিয়ে সিংহ ধরতে যাওয়ার মূঢ়তা যেন আমাদের পেয়ে না বসে।
[দেশব্রতী, ২০ আগস্ট, ১৯৭০]
[দেশব্রতী, ২০ আগস্ট, ১৯৭০]
Comments