নেপালের অগ্নিকন্যারা
নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)’র নেতৃত্বে নেপালের গণযুদ্ধ ১৯৯৬-২০০৬ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল। সেই গণযুদ্ধে নারীদের বিশাল ভূমিকা ছিল। মাওবাদী পার্টির নেতৃত্বাধীন গণমুক্তি বাহিনীতে (PLA) প্রায় ৪০% নারী গেরিলা ছিল। উচ্চতর রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন নারীরা।
“ইতিহাস সম্পর্কে যার সামান্য ধারণা আছে তিনি অবশ্যই জানেন যে বিশাল আকারের সামাজিক পরিবর্তনকারী জাগরণ ব্যতিরেকে নারী জাগরণ অসম্ভব।”
- কার্ল মার্কস
সিপিএন (মাওবাদী) কর্তৃক ১৯৯৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গণযুদ্ধের সূচনা হওয়ার পর থেকে বহু নারী শহীদ হয়েছেন, বহু নারী সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করছেন, নিখোঁজের সংখ্যা অসংখ্য। ধর্ষিত, নির্যাতিত, অত্যাচারিতাদের সংখ্যা অগণিত। নেপালের পশ্চিমের জেলাগুলো (রোলপা, রুকুম) থেকে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল তা গোটা নেপালে দাউ দাউ করে জ্বলেছে। এ ঘটনাকে সরকারি বা বিদেশি প্রচার মাধ্যমগুলো হাজারো প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চেপে রাখতে পারেনি। নেপাল হচ্ছে আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যার মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে সামন্ততন্ত্রের ওপর। নেপালের জনসংখ্যার প্রায় ৮৮% গ্রামে বাস করে এবং প্রায় ৮১% জনগণ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। সমগ্র জাতীয় উৎপাদনের (জি.এন.পি.) ৪২% আসে কৃষিক্ষেত্র থেকে। সামন্ততান্ত্রিক ভূমি সম্পর্কের প্রকৃষ্ট উদাহরণ নেপালে শতকরা ১০ ভাগ জমির মালিক হলো শতকরা ৬৫ ভাগ গরীব চাষী আর শতকরা ১০ জন ধনী চাষীরা হলো শতকরা ৬৫ ভাগ জমির মালিক। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য, পৈত্রিক সম্পত্তিতে নেপালের নারী সমাজের কোনও উত্তরাধিকার জন্মায় না। নারীদের উপর অর্থনৈতিক শোষণের শিকড় নিহিত রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক তথা আধা-সামন্ততান্ত্রিক ক্ষুদ্র কৃষি উৎপাদন সম্পর্কের গভীরে। পুরুষতান্ত্রিক নেপালী সমাজে নারীদের সম্পত্তির ওপর সরাসরি কোনও অধিকার নেই, গৃহস্থালির কাজ ও ক্ষেতের কাজের দ্বিগুণ বোঝা বহন করেও আইনত মহিলারা পুরুষদের সাথে সমানাধিকারের ভিত্তিতে সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত। অনুরূপভাবে জমির ওপর প্রজাসত্ত্বজনিত অধিকার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বঞ্চিত তারা। ফলস্বরূপ তারা কোনো বাণিজ্যিক লেনদেন ও ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে না এবং নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে অক্ষম, ফলত পুরুষদের থেকে মেয়েরা পিছিয়ে পড়া অবস্থানে থাকতে বাধ্য হয়। এর ওপর মধ্যযুগীয় সামন্ত অবস্থিতির দরুন যেমন তরাই অঞ্চলে দাসপ্রথা, ঋণের দায়ে তরাই ও পার্বত্য অঞ্চলে বেগার প্রথা ইত্যাদি কারণে নেপালি নারীরা নিরন্তর শোষণের যাঁতাকলে আটকে পড়ে। সামন্ত প্রভুর ঘরের কাজ ও ক্ষেতের কাজ করার পরও প্রভুদের দেহদান ও পদসেবা করতে বাধ্য হয়। নারীদের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ তীব্র হওয়ার অন্যতম কারণ হলো নেপালে উৎপাদনের উপকরণের অপরিসীম পশ্চাৎপদতা। কৃষিকাজে শ্রমের মূল উপাদান হলো কায়িক শ্রম ও পশুশ্রম আর যন্ত্রপাতি হলো মান্ধাতার আমলের কাস্তে, খন্তা, শাবল ইত্যাদি। গৃহস্থালির কাজে জ্বালানি, পানির অভাব তথা খামারের কাজে যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার কারণে কায়িক শ্রম ও বহু সময় ব্যয় মেয়েদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। অসম বিকাশজনিত সমাজে যত শ্রমনির্ভর কাজ হয় তার বেশিরভাগ বোঝার ভার বহন করতে হয় মেয়েদের। যেহেতু কৃষিকাজ মূলত বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, তাই বৃষ্টি না হলে কাজের অভাবে প্রচ্ছন্ন বেকারের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। তখন পাইকারি হারে কাজের আশায় গ্রামীণ জনতা শহরের দিকে অথবা ভারতে ছোটে। এভাবে তারা মহিলা ও শিশুদের উপর জমি ও গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ চাপিয়ে দিয়ে যায়। বিদ্যমান গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির মেরুদন্ড হলো নারী সমাজ। যেহেতু মেয়েদের গৃহস্থালির কাজে আটকে রাখা হয়, সেজন্য তাদের মজুরি কম দেয়া হয়। সম পরিমাণ গার্হস্থ্য বা জমির কাজের জন্য নারীরা পুরুষদের অর্ধেক মজুরি পায়। গ্রামের নারীরা যদি পশ্চাৎপদ মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার হয় তাহলে শহরের কর্মরত মেয়েরাও শোষিত হচ্ছে। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ফলস্বরূপ তারা অল্প বেতন পায় ও প্রায়ই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। পোষাক, নির্মাণ ও কার্পেট শিল্পের নারীরা আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতিদের মোক্ষম শিকার যাদের মদতদাতা সাম্রাজ্যবাদীরা ও সম্প্রসারণবাদী ভারত। নারীদের উপর শোষণের কাঠামোর শিকড় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত রয়েছে। নারীদের উপর সামাজিক শোষণের মূল ভিত্তি হলো ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের জাতপাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থা যা পুরুষতন্ত্র কায়েম করে, বিপরীতে মেয়েদের অবজ্ঞা ও অসম্মান করে। শৈশবে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন - এটাই মেয়েদের বিধিলিপি। পৈত্রিক উত্তরাধিকার আইনের সুবাদে নেপালের সমাজে পুত্রের চাহিদা পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে প্রবল।নেপালে পুরুষের গড় আয়ু ৫৫ বছর আর নারীদের গড় আয়ু ৫২ বছর। প্রসূতি মৃত্যুর হারে নেপাল পৃথিবীর অন্যতম অগ্রণী দেশ, প্রতি লক্ষে ৮৭৫ জন। প্রতি দশটি শিশুর মধ্যে একটি মারা যায় বছর না ঘুরতে। এর সাথে আছে বাল্যবিবাহ, অকাল মাতৃত্ব, ঘন ঘন সন্তান ধারণ যা মেয়েদের শরীর ভেঙে দেয়। সম্পত্তি সম্পর্কের জন্য মেয়েদের দেখা হয় ছেলে জন্মানোর মেশিন হিসেবে। মেয়েরা বারংবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভধারণ করে যতক্ষণ না ছেলের জন্ম হচ্ছে, নাহলে তার ভূ-সম্পত্তিতে অধিকার বর্তাবে না অথবা সতীনের সাথে ঘর করতে হবে। পুত্রবিহীন স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করে, পুত্রবিহীন নারী সমাজে অপাংক্তেয় ও অবজ্ঞার বস্তু। জাতপাতভিত্তিক সমাজে হিন্দু সংস্কৃতির মাত্রা এতটাই তীব্র যে, যেসব নারীরা হিন্দু না এবং সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির বেড়াজালে ততটা আবদ্ধ না, তারাও মূল প্রবাহের চাপে পিষ্ট হতে বাধ্য হয়। পিতৃতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নেপালের নারী সামজের উপর রাজতন্ত্রী-সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত রাজনৈতিক শোষণের চিত্র ভয়াবহ। একমাত্র পুরুষরা বংশানুক্রমে মসনদে আসীন হতে পারে, কেননা তারাই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি! নারীরা কোনও অবস্থাতেই মসনদের দাবিদার হতে পারবে না। পৃথিবীর অন্যান্য বুর্জোয়া প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে নিদেনপক্ষে নারীদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে আইনী অধিকার আছে সেখানে নেপালি নারী সমাজের সেই আইনি সুযোগটুকু বিন্দুমাত্র নেই। এর ফলে নারীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নীতিগত দিক থেকে বিরাট বাধার সৃষ্টি করে। সংসদীয় ব্যবস্থায় নারীরা হলো ভোট ব্যাংক তথা ভোট জোগাড়ের হাতিয়ার। তাদের সাথে পুরুষদের সম্পর্কের ভিত্তিতে সংসদীয় ব্যবস্থায় যার মূলধন আছে তারই জয়লাভের সম্ভাবনা। নেপালে কিছু সংখ্যক নারী যারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে, তারা মূলত পরিচিত রাজনীতিবিদদের বিধবা স্ত্রী অথবা কন্যা।
নেপালের নারীদের নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবে অংশগ্রহণের মূল কারণ হলো এই সংগ্রাম তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পথপ্রদর্শক। নেপালে মেয়েদের আর্থিক শোষণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সমাজে পুরুষদের সাথে সমানভাবে জমির ভোগদখল বা মালিকানা লাভ মেয়েরা করতে পারে না। আর নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো কৃষি বিপ্লব। এই ব্যবস্থায় এর সফল রূপ প্রদানের শ্লোগান হলো ‘কৃষকের হাতে জমি’। এর সাথে সাথে পুরুষ ও নারীদের অধিকার কায়েম হলে গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। এই সম্পত্তি-সম্পর্কের ভিত্তিতে শহুরে নারীরা সমভাবে উপকৃত হবে। মেয়েরা শহরেও জমির মালিকানা পাবে, অন্যান্য উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা তাদের করায়ত্ত হবে (শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারখানা)। ফলে শহরের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার তারা পাবে। এটাই হবে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রথম ধাপ, যার দ্বারা অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য লড়াই করতে তারা সক্ষম হবে। নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলো সামন্ততন্ত্র বিরোধী। প্রথমে এটা রাষ্ট্রের দ্বারা আরোপিত বাধ্যতামূলক ধর্মীয় বিধিনিষেধগুলো হটিয়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বাতাবরণ তৈরি করবে। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সংস্কৃতির অবসানের ফলে নারীরা সংস্কৃতিগতভাবে পুরুষ প্রাধান্যের হাত থেকে অব্যাহতি পাবে। এর ফলে কন্যা সন্তানদের আর অবজ্ঞার পাত্রী হতে হবে না, বরং পরিবারেও তারা পুত্র সন্তানদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। নয়া-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কোনো স্থানই থাকতে পারে না। রাজতন্ত্র হলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীদের শাসন করার প্রতীক। রাজনৈতিকভাবে নয়া-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন একটি সমাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে যেখানে পুরুষতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত অংশগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নারীরা সামন্ততন্ত্র-উপনিবেশবাদ বিরোধী যুক্তমোর্চা পরিচালিত সরকারে অংশগ্রহণ করবে। এজন্যই নেপালে নয়া-গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য নারীরা জীবন-মরণ লড়াই করেছে। নয়া-গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে সমস্ত অসম সম্পর্কগুলোর মূলোৎপাটন হবে, সাম্রাজ্যবাদী তথা সম্প্রসারণবাদী দেশসমূহের স্বার্থবাহী পতিতালয়গুলোর উচ্ছেদ সাধন করবে, বিশাল সংখ্যক নারী মুক্তি পাবে অর্থনৈতিক ও যৌন নিপীড়নের হাত থেকে। এর ফলে এমন এক পটভূমি তৈরি হবে যেখানে নারীদের পতিতাবৃত্তি করতে বা ভোগ্যপণ্য হতে হবে না। নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মর্মবস্তুকে আত্মস্থ করার ফলে বিভিন্ন নারী সংগঠন বিশেষত ‘অল নেপালিজ উইমেন্স এসোসিয়েশন (বিপ্লবী)’ বিশেষ ধারা সৃষ্টি করেছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/All_Nepal_Women%27s_Association_(Revolutionary)
নেপালের নারী আন্দোলন মূলত তিনটি ধারায় বিভক্ত। দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারা খোলাখুলি সামন্ততান্ত্রিক ও আমলা পুঁজির স্বার্থের ধারক ও বাহক। তারা নারী মুক্তির কথা মুখে বলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে। রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট হিন্দুধর্মের তারা একনিষ্ঠ পূজারী; সাম্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট এনজিও - আইএনজিও এর দ্বারা পরিচালিত কর্মকান্ডে তারা সরাসরি যুক্ত। এরা নারীদের পণ্য হিসেবে গণ্য করার বিরোধিতা করে, কিন্তু সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। তারা গণযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিন্দা করতে এক পায়ে খাড়া, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচ্চারণ করে না। এরা শাসক শ্রেণির দলগুলোর যেমন- নেপালি কংগ্রেস, ‘সংযুক্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী’ এবং ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি’র অতীব ঘনিষ্ঠ।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nepali_Congress
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_Party_of_Nepal_(Unified_Marxist%E2%80%93Leninist)
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_Party_of_Nepal_(Marxist%E2%80%93Leninist)_(2002)#:~:text=The%20Communist%20Party%20of%20Nepal,(Unified%20Marxist%E2%80%93Leninist).
দ্বিতীয় সংশোধনবাদী ধারার প্রবক্তারা বুলিতে বিপ্লবী, কিন্তু অনুশীলন করে সংস্কারবাদ। তারা নিজেদের প্রজাতন্ত্রী বলে জাহির করে, কিন্তু রাজতন্ত্রী সংসদীয় ব্যবস্থার একান্ত অনুগামী। এরা তত্ত্বগতভাবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর কাজকর্মের বিরোধিতা করে, কিন্তু এদের অনেকে এনজিও - আইএনজিও এর সাথে সরাসরি যুক্ত। এরা ‘মার্শাল’, ‘ইউনিটি সেন্টার’ ইত্যাদি দলের কাছাকাছি।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_Party_of_Nepal_(Mashal)
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_Party_of_Nepal_(Unity_Centre)
তৃতীয় ধারাটি বিপ্লবী ধারা। এদের প্রতিনিধিত্ব করে 'অল নেপালিজ উইমেন্স এসোসিয়েশন (বিপ্লবী)'। এরা সি.পি.এন. (মাওবাদী)-র ঘনিষ্ঠ।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_Party_of_Nepal_(Maoist_Centre)
ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার দৌলতে যে পুরুষ প্রাধান্য বিরাজমান এ ব্যাপারে তারা পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কে তাদের ধারণা স্বচ্ছ। শ্রেণি শোষণ ও লিঙ্গ শোষণে রাষ্ট্রের যে একাধিপত্য জারি আছে সে ব্যাপারে তারা অত্যন্ত সচেতন। তারা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর (এনজিও-আইএনজিও) বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এই সংগঠনগুলো সাম্রাজ্যবাদী তথা সম্প্রসারণবাদীদের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে জমি তৈরি করে যার আসল উদ্দেশ্য একাধারে প্রভুদের বাজারের বিস্তারসাধন, অপরদিকে জনগণের প্রকৃত বিপ্লবী আন্দোলনের গতিরোধ করা। ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি অনুসরণ করে এরা অপরাপর শক্তিগুলোর সাথে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলছে, বিশেষত সামন্তবাদ বিরোধী ও উপনিবেশবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করে, যেমন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিরোধিতা এবং অশ্লীল পত্রপত্রিকা ও মদ বিক্রির বিরুদ্ধে সংগ্রাম মারফৎ। গণযুদ্ধের সমর্থক-দরদীদের উপর অনুষ্ঠিত নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন, বিশেষত মহিলাদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে তার বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। যখন অন্যরা গণযুদ্ধের নিন্দায় মুখর তখন সংগঠনটি সশস্ত্র শক্তির বলে গণযুদ্ধের দ্বারাই যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় অবলম্বন করতে হবে সে ব্যাপারে সোচ্চার।
“নারীরা আকাশের অর্ধেক ধরে রেখেছে”
- মাও সে তুং
অতীতে কেন্দ্রীভূত সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধীনে যখন রাষ্ট্রের সামন্ততান্ত্রিক কার্যক্রম ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, বিশেষ করে ১৮১৫ সালে দেরাদুনের নালাপানির যুদ্ধে নেপালি নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের নজির বিদ্যমান।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Nalapani
এই যুদ্ধে নেপালি নারী, শিশুরা পুরুষদের পাশাপাশি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। শুধু সংখ্যাতে নয়, উন্নততর অস্ত্রের দিক থেকেও ব্রিটিশ বাহিনী নেপালি বাহিনীকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনবারের চেষ্টায় তারা সফল হয়েছিল কলঙ্গা দুর্গ দখল করতে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রচুর। ১৯৪৭-৫০ পর্বে নেপালি রাণাশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে রাণাশাহী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রভূত পরিমাণে নারীদের সামিল করেছিল। ১৯৫০ সালে রাণাশাহীর পতন হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rana_dynasty
https://en.m.wikipedia.org/wiki/1951_Nepalese_revolution
১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে নারীরা ব্যাপকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ফলস্বরূপ ৩০ বছরব্যাপী স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ‘পঞ্চায়েত’ এর পতন ঘটে এবং রাজতন্ত্রী সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন হয়। এই সমস্ত সংগ্রামে পরিচিত রাজনৈতিক পরিবারের মেয়েরা অথবা শহুরে শিক্ষিত মহিলারা শহরভিত্তিক সংগ্রামের ভাগীদার ছিল।শুধুমাত্র সিপিএন (মাওবাদী) সূচিত গণযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তৃণমূল স্তরের নারীরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। মূলত গ্রামীণ নারীরা সমাবেশিত হতে থাকে। আদিম অস্ত্র যেমন- পাথর, কাস্তে, লাঠি যা আগের সংগ্রামগুলোতে নারীরা শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করতো তার থেকে অনেক এগিয়ে আজ তারা বন্দুক, রাইফেল, গানপাউডার ব্যবহার করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হচ্ছে। আগে তাদের গণ্য করা হতো সহায়ক শক্তি হিসেবে অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনের মজুত বাহিনী হিসেবে। আজ তারা নেতা, গেরিলা স্কোয়াডের কমান্ডার হিসেবে সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই বিকাশকে অনুধাবন করতে গেলে আমাদের নেপাল সরকারের ১৯৬০ সালের সেনা আইনের ১০নং ধারা মোতাবেক রাজকীয় সৈন্যবাহিনীতে নারীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটা। নারীদের উপর দ্বৈত জানতে হবে। শোষণের অবস্থা নিরূপণের পর সিপিএন (মাওবাদী) সিদ্ধান্ত নেয় নারীদের বর্তমান করুণ অবস্থার জন্য দায়ী যে ব্যবস্থার দ্বারা তারা নির্যাতিত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে সংগঠিত করে আঘাত হানতে হবে। প্রতিটি গেরিলা স্কোয়াডে অন্তত দু’জন করে নারীকে নিয়োগ করতে হবে (একটি গেরিলা স্কোয়াডের সদস্য সংখ্যা ৯-১১ জন)। নারী গেরিলারা রাতের বেলায় গেরিলা যোদ্ধা, দিনের বেলায় উৎপাদন ও প্রচার কার্যে নিয়োজিত। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ নারী গেরিলা বাহিনী নির্মাণ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে রোলপা’র একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। একটি সম্পূর্ণ নারী গেরিলা বাহিনীর উদ্যোগে একজন স্বৈরাচারী নারী মাংসলোভী সামন্ত প্রভুর মৃত্যুদন্ড নারী গেরিলারা কার্যকর করে। প্রতিটি গ্রাম ও জেলা স্তরে নারীদের সংগঠিত করা হয় তাদের নিজস্ব গণসংগঠনে। যেখানে বিপ্লবীদের শক্ত ঘাঁটি সেখানে গণআদালত স্থাপন করা হয়। অন্যান্য বিষয় ছাড়াও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আদালত পরিচালিত হয় এবং দোষীদের শাস্তি বিধান করে গ্রামরক্ষী বাহিনী, নারী গণসংগঠন এবং জনগণের যৌথ উদ্যোগে গণআদালতগুলো পরিচালিত হয়। বিধবাদের জমি তথা একক নারীদের জমি যারা হরণ করে নিয়েছে তাদের জমি এই আদালতের মাধ্যমে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। অত্যাচারী, মদ্যপ তথা স্ত্রী নির্যাতনকারী স্বামীদের তথা বহু নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তিদের গণআদালতগুলোর দৌলতে স্বাভাবিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। পার্বতী জেলার একটি ঘটনা উল্লেখ করার মতো। একজন স্কুল শিক্ষক মেয়েদের উপযুক্ত বরের সন্ধান দেয়ার অজুহাতে যৌন নিপীড়ন করতো। তাকে গণআদালতে হাজির করে কয়েক মিনিট যাবত কান ধরে ওঠ-বস করানো হয় এবং সর্বসমক্ষে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। ভবিষ্যতে আবার এই ধরনের ঘটনা ঘটলে আরও কঠোর সাজা দেয়া হবে- এই লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে রেহাই পায়। যেখানে নারীরা সরাসরি গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেখানে তারা গেরিলা যুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তারা সংগঠক, প্রচারক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সৈন্য সংগ্রাহক, আহত যোদ্ধাদের পরিচর্যাকারী, গোপন সংবাদ সংগ্রহ, পার্টি কর্মী ও যোদ্ধাদের আড়াল করা, জেলে অবস্থিত কমরেডদের সাথে সংযোগ রাখা ও তাদের উদ্দীপ্ত রাখা, শহীদদের পরিবারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি সমস্ত ভূমিকা পালন করে এবং স্থানীয়ভাবে গানপাউডার তৈরি করার প্রশিক্ষণ তাদের দেয়া হয়। নারী কর্মীরা নতুন এলাকায় দ্রুত গৃহকর্মের মাধ্যমে সকলের মন জয় করে নিতে পারে এবং এভাবে দ্রুত গণসংযোগ গড়ে তুলতে পারে। এর ফলে পুরুষ কর্মীদের গৃহস্থের ঘরে দ্রুত আশ্রয় নিতে সুবিধা হয়। এটাও দেখা গেছে যেসব অঞ্চলে স্থানীয় নারীদের সন্নিবেশিত করা গেছে সেসমস্ত অঞ্চলের লড়াইগুলো দীর্ঘদিনব্যাপী টিকিয়ে রাখা তথা শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। ঘরে-বাইরে নারীদের বহুমুখী ভূমিকার জন্য তারা বহুবিধ সমস্যার সমাধান করতে পারে, গোপন সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে গেরিলা যোদ্ধা ও পার্টি ক্যাডারদের আড়াল করা সবই এই কাজের মধ্যে পড়ে। গণযুদ্ধের প্রতি নারীদের অবিচল আস্থা নজর কাড়ার মতো ব্যাপার। যদিও তারা গণযুদ্ধে অংশ নিতে তড়িঘড়ি করে না বরং একটু বেশি সময় নেয়, কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নিলে তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। আত্মসমর্পণ বা রণক্ষেত্র থেকে পলায়নের ঘটনা নারীদের ক্ষেত্রে বিরল। পার্টির গোপন তথ্য ফাঁস করার ঘটনাও নারীদের ক্ষেত্রে বিরল। পার্টির গোপন তথ্য ফাঁস করার ঘটনাও নারীদের ক্ষেত্রে বিরল। পুরুষদের তুলনায় তাদের অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা অনেক বেশি। বস্তুত এই সংগ্রাম থেকে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের পাওয়ার জগতটা অনেক বেশি, তাই তারা এতো একনিষ্ঠ। নারীরা জনগণতান্ত্রিক সমাজে শুধু শ্রেণি শোষণের হাত থেকে রেহাই পাবে তা নয়, বরং লিঙ্গ বৈষম্যের হাত থেকেও নিষ্কৃতি পাবে।
দিলমায়া ইয়োনজান হলেন প্রথম নারীযোদ্ধা যিনি বেথান অস্ত্র দখল অভিযানে অংশগ্রহণ করে শহীদ হন। একটি বোমায় যখন তিনি অগ্নিসংযোগ করছিলেন তখন তার মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন নেপালের নির্যাতিত ও পিছিয়ে থাকা তামাং জনজাতির সদস্য।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tamang_people
লালি রোক্কা রোলপা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমাজ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত অবস্থায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারে। ‘অপরাধ’ হচ্ছে তার অঞ্চলে একটি এনজিও সংস্থার মুখোশ তিনি জনসমক্ষে উদঘাটন করেন।
বিন্দি চৌলগাইকে জঙ্গলে অবস্থিত গেরিলাদের খাদ্য-সরবরাহের জন্য থানায় নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করা হয়, আর তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। অত্যাচারের ফলে পেটের বাচ্চা আগেই মৃত অবস্থায় মাতৃজঠর থেকে নির্গত হয়, এর কয়েকদিন পর নির্যাতনের ফলস্বরূপ মা-ও মৃত্যুমুখে পতিত হন।
সুনসারা বুধা ছিলেন পার্টি কর্মীর স্ত্রী। স্বামীর গোপন খবর জানার জন্য ২ বছরের শিশুর সামনে মায়ের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। যখন কোনো খবরই বের করা যাচ্ছে না তখন মায়ের সামনে চলে ২ বছরের শিশুর ওপর নির্যাতন। এতো নির্যাতনেও যখন কোনো ফল পাওয়া গেলো না তখন আহত শিশু সন্তানটির সামনে নিষ্ঠুরভাবে মাকে হত্যা করলো পুলিশ।
কমলা ভট্ট শিক্ষিকা এবং গোরখা জেলার এএনডব্লিউএ (আর) এর সভাপতি ছিলেন যিনি গ্রামে নারীদের মধ্যে গণসাংগঠনিক কাজকর্ম সেরে ঘরে ফিরছিলেন। পথের মধ্যে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বিশেষ কমান্ডো ফোর্স গ্রেপ্তার করে ধর্ষণ করে এবং পরে হত্যা করে।
দেবী খাদকা বর্বর ও নিষ্ঠুর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জাজ্বল্যমান নিদর্শন। পুলিশ হেফাজতে ধরে নিয়ে গিয়ে একের পর এক পুলিশ তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করে, তাঁর যোনিদ্বার বেরিয়ে আসে। তাকে বারংবার ধর্ষণের পরও জেলে বন্দী ভাইয়ের ডেথ-সার্টিফিকেট কিছুতেই তাকে দিয়ে সই করানো যায়নি। চিনিয়া, লামা, নির্মলা দেবকোটা, মঞ্জু কুঁয়ার, সভদ্রা সাপকোটা এবং এদের সঙ্গী আরও তিনজন পুরুষ সাংস্কৃতিক কর্মীকে প্রতিক্রিয়াশীল, সংশোধনবাদী ইউএমএল এর স্থানীয় নেতাদের প্ররোচনায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে হত্যা করে। তাদের ‘অপরাধ’ প্রগতিশীল সংস্কৃতি প্রচারের মাধ্যমে তারা গ্রামবাসীদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন এবং সংগঠিত করছিলেন।
এগুলো অজস্র ঘটনার কয়েকটি মাত্র। নারীদের গণধর্ষণ, হেলিকপ্টারে টহল দিতে দিতে বিপ্লবীদের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে হঠাৎ নেমে এসে নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে অন্যত্র ছুঁড়ে দেয়ার খবর প্রায়ই আসে। প্রাথমিক স্তরে গ্রেপ্তারের পর অত্যাচার ও ধর্ষণ করে মেয়েদের ছেড়ে দিতো বর্বররা। কিন্তু পরে তাদের হত্যা করা শুরু হয়। প্রতিক্রিয়াশীল সশস্ত্র বাহিনীও আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মেয়েদের অপরাজেয় বিপ্লবী মানসিকতার। নারীরা ব্যাপকভাবে গণযুদ্ধে অশগ্রহণ করছে বিভিন্ন রূপে ও মাত্রায়।
“গণযুদ্ধ হচ্ছে একটি সর্বাঙ্গীন যুদ্ধ”
- মাও সে তুঙ
নেপালে গণযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার অপরিসীম প্রভাব নারী সমাজের উপর বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথমত, গণযুদ্ধ পার্টি কর্মীদের পারিবারিক জীবনে কতকগুলো মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পার্টি কর্তৃক গণযুদ্ধ সূচিত হওয়ার আগে তত্ত্ব ও প্রয়োগে লিঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়ে পরিবার তথা পরিবার বহির্ভূত সামাজিক জীবনে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ পুত্র সন্তানের প্রতি অগ্রাধিকার, মেয়েদের বাল্যবিবাহ, পুরুষদের বহুবিবাহ এবং নারীদের জন্য এক বিবাহের পরামর্শ ও বাধ্যবাধকতা, সামন্ততান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আচার যথা শুভলগ্নে ও শুভদিনে মেয়েদের উপবাস পালন, ঋতুমতী ও নিম্নবর্ণের মানুষকে অচ্ছুৎ হিসেবে গণ্য করা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি প্রবল আকাঙ্খাজনিত কারণে নারীদের গৃহস্থালি কাজের মধ্যে আটকে রাখা প্রভৃতি এবং অন্যদিকে পুরুষদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিধি চলে আসছিল। কিন্তু গণযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বহু গৃহবধু স্বামীদের হাত ধরে ঘর ছেড়ে সন্তানদের প্রতিপালনের বিকল্প ব্যবস্থা করে গণযুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়েছে। আবার যে সমস্ত গৃহবধুরা ঘরেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি স্বয়ম্ভর এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার জন্য বহুল পরিমাণে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছে। পার্টির তরফে নারীদের রাজনীতি সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা, গণযুদ্ধের ফলে রাজনৈতিক বাতাবরণের যে পরিবর্তন ঘটেছে যেমন ঘন ঘন তল্লাশি, ওয়ারেন্ট, হুমকি, অত্যাচার, এমনকি কখনও কখনও বলাৎকার তাদের আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিরোধী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছে। শিশুদেরও এই আক্রমণের হাত থেকে রেহাই নেই। অত্যাচারের ফলে তারা অল্প বয়সে রাজনৈতিকভাবে পক্ক হয়ে উঠেছে। দেখা গেছে গ্রাম প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে শিশুরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে, প্রচারকার্যে সাহায্য করেছে এবং গোপন সংবাদ আদান-প্রদান ইত্যাদি বহুবিধ কাজ তারা করেছে। যে সমস্ত এলাকায় বিপ্লবী কর্মকান্ড যথেষ্ট শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে পরিচালিত হয়েছে সেখানকার প্রায় সকল পুরুষ আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। নারী ও শিশুদের রেখে গেছে সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও পুলিশী তান্ডবের মোকাবেলা করার জন্য। পুরুষদের অনুপস্থিতি পরিবারের আগের লিঙ্গ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। দেখা গেছে মেয়েরা কৃষি জমিতে লাঙ্গল দিচ্ছে যেটা ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত নয়। মেয়েরা ঘরের চাল ছাইছে বা ছাদ পেটাচ্ছে, যেটা সাংস্কৃতিকভাবে অননুমোদিত। বিপ্লবী অঞ্চলের নারীরা স্বামী পুলিশের গুলিতে নিহত হলে শাস্ত্রানুযায়ী বৈধব্য অনুষ্ঠান পালন করে না, বিপরীতে পার্টি সচেতনভাবে প্রচেষ্টা চালায় শোককে ঘৃণায় পরিণত করে স্বামী হত্যার বদলা নিতে।
রোলপা’র অধিবাসী সঙ্গীতা বুধা’র ঘটনাটিকে বলা যাক। ১৯৯৭ সালে পুলিশী তান্ডবে তার স্বামী শহীদ হন। সঙ্গীতা বুধা বলেছেন-
"বাবাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন আমার বাপের বাড়ি সামলাতে সেখানেই কাজ করতে হয়েছিল আর আজ আমার স্বামী শহীদ হওয়ার পর আমাকে জঙ্গলে যেতে হচ্ছে স্বামীর আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করতে, সাথে সাথে তার হত্যাকারীদের নির্মূল করতে।"
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীরা বিপুল রূপান্তর সাধন করেছে। প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু উৎসব তীজ-কে (স্বামীর মঙ্গল কামনায় আর কুমারীদের ভালো বর পাওয়ার জন্য ব্রত। এই ব্রত পালনের জন্য কনের পোষাক পরে সারাদিন উপোস করে প্রকাশ্য স্থানে নৃত্যগীত পরিবেশন করতে হয়) বিপ্লবী রাজনীতি প্রচারে তথা গণযুদ্ধের সপক্ষে প্রচার চালানোর কাজে এবং নেপালে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করা গেছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Teej
পরিবারে পুরুষদের অনুপস্থিতি, সঙ্গে নিরন্তর পুলিশী হানা ও নির্যাতন নারীদের পারস্পরিক সহযোগিতার মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেছে। পার্টি গুরুত্ব সহকারে প্রচারাভিযানে নামে গণসমাজভিত্তিক বাজার ব্যবস্থার প্রবর্তন, সমষ্টিগত শ্রম যেমন ‘পরমার’ (কয়েকটি ক্ষেতে কৃষি শ্রমিকদের অদলবদল করে শ্রমদান) বৃহৎ আকারে প্রচলন, নতুন রাস্তা নির্মাণ তথা পুরাতন রাস্তার সংস্কার, সমবেতভাবে নতুন জলাধার নির্মাণ, সমষ্টিগতভাবে পশুখাদ্য ও জ্বালানি আহরণ, নতুন নতুন চৌতারা (গণ-বিশ্রামের স্থান) নির্মাণ ইত্যাদি। রোলপা ও সালিয়ান জেলার সীমান্তে স্থানীয় গ্রামবাসীরা এই রকম একটি চৌতারা নির্মাণ করেছে তিন শহীদ কুমারী বুধা, সুনসারা বুধা ও সালি রোক্কার অমর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে। সমবায় প্রথায় চাষের ফলে যে সমস্ত পুরুষ গণযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, এমনকি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দূরবর্তী স্থানে বা শহরে চলে গেছে কাজ করতে, সেই সমস্ত পরিবারের অশেষ উপকার হয়েছে। কোথাও কোথাও এই প্রথা প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক বাহিনীতে কর্মরত পরিবারের লোকজনের মন জয় করেছে। গণবিচারের কার্যক্রম চালু হওয়ার পর নারীরা ঘরে বাইরে আরো বেশি নিরাপত্তা বোধ করেছে, স্বামীরা কোথাও কুকর্ম করলে অথবা লম্পটেরা কোথাও উৎপাত করলে গণআদালত যথাযথ শাস্তি দিয়েছে। নারীরা আগের থেকে অনেক বেশি তাদের আইনী অধিকার ও নিজেদের দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন। বিপরীতে পুলিশের ক্রমাগত ধর্ষণ ও রাষ্ট্র কিভাবে এই ধর্ষণকারী ও গুন্ডাদের আড়াল করছে তা জনগণের কাছে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র ও লিঙ্গ আধিপত্যের চরিত্র বুঝতে আরো সাহায্য করেছে, জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বেড়েছে। ধর্ষিতারা কলঙ্কিনী হিসেবে গণ্য হতো, কিন্তু রাষ্ট্র ধর্ষণ ও খুনকে প্রায় বিধিসম্মত ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছে, ফলে লজ্জা ও কলঙ্কের ভাব দূর হয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন শ্রেণি ঘৃণা ও বিদ্রোহের মনোভাব তৈরি হয়েছে। পুলিশের যথেচ্ছ হয়রানি ও বলাৎকারের দরুন শাসক শ্রেণির ঘরের মহিলারাও রাষ্ট্রের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়েছে, নিপীড়িত ও নির্যাতিতরা ক্রমশ সহমর্মিতা অনুভব করছে ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এককাট্টা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের জীবনে গণযুদ্ধ বিকল্প বিপ্লবী জীবনের ইশারা জাগিয়ে তুলেছে। গ্রামীণ নারীদের জীবনে প্রতিদিন একই কাজের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি। যেহেতু খুবই অল্প বয়সে তাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় তাই গতানুগতিক বিধিলিপিকে তারা অতিক্রম করতে পারে না। যে সমস্ত নারী গ্রামীণ জীবনের এই শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় তাদের অবস্থা ভয়াবহ, অজ্ঞতাজনিত কারণে অধিকাংশ মেয়েরাই কোনও না কোনওভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে বাধ্য হয় পতিতালয়ে আশ্রয় নিতে, বেশিরভাগ চালান হয়ে যায় ভারতের শহরগুলোর বিভিন্ন পতিতালয়ে। আনুমানিক দেড় লক্ষ নেপালি নারী ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে হীন জীবন যাপন করছে। বিভিন্ন স্থানে নেপালি নারীরা খুব অল্প বেতনে কাজ করতে বাধ্য হয়, সেখানেও তারা বিভিন্নভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার। নেপালি মেয়েদের এভাবে চালান হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বহু মেয়েকে গণযুদ্ধ ছুঁড়ে দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ, পুরুষদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে তারাও যে সক্ষম সেটা প্রমাণ করার। সমাজ পরিত্যক্ত বহু নারী গণযুদ্ধের দৌলতে পেয়েছে সম্মানজনক জীবন। স্বামী-পরিত্যক্ত, প্রতারকের পাল্লায় পড়ে কৌমার্য হারানো যেসব নারী নির্জন কোণে কালাতিপাত করছিল অথবা বিবাহযোগ্য অথচ বিবাহ হচ্ছে না এমন মেয়েরাবিভিন্নভাবে গণযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সমাজে তিলে তিলে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করার চাইতে তাদের কাছে গণযুদ্ধে জীবনদান অনেক বেশি আকর্ষণীয়। গণযুদ্ধ জনজীবনে প্রগতিশীল ভাবধারার বীজ রোপণে সফল হয়েছে। নয়া জমানার মেয়েরা চিরাচরিত প্রথায় সম্বন্ধ করে বিবাহ করতে অস্বীকার করছে। মতাদর্শগত মিল আছে এমন পুরুষের সাথে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা বিয়ে করতে উৎসুক হচ্ছে। তারা পুত্র সন্তানের জন্য মাথা খুঁড়তে রাজি নয়। বস্তুত বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যাতে কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা না আসে তাই তারা সীমিত সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। পুরুষেরা অনেক বেশি দরদ দিয়ে সহযোগিতা করছে সাংসারিক কর্মকাণ্ডে। পার্টি পুরুষদের জন্য এক বিবাহের কঠোর নির্দেশ জারি করেছে, তাই বিবাহিত পুরুষ কোনও গুপ্ত প্রণয়ে লিপ্ত একথা ফাঁস হলে কঠিন সাজা পাচ্ছে। অনুরূপভাবে বিবাহিত নারীরা সমদোষে দুষ্ট হলে রেহাই পাচ্ছে না। বিবাহ বিচ্ছেদের উপযুক্ত কারণ থাকলে বিবাহ বিচ্ছেদে উৎসাহিত করা হয় এবং পুনরায় বিবাহের ক্ষেত্রেও কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়না। এরূপ বহু পুনর্বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধে যাদের পতি বা পত্নী বিয়োগ হয়েছে তারা অনেকে পুনর্বিবাহ করছে। পার্টি এক্ষেত্রে বিধিনিষেধের বদলে উৎসাহ দান করেছে। গণযুদ্ধ নারীদের মধ্যে সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্যের বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে বহু নারী এগিয়ে আসছে তাদের গণযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, পুলিশী নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে স্মৃতিকথা, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ তথা তাত্ত্বিক নিবন্ধ রচনা করতে এবং সংবাদপত্র ও জার্নালে এগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। এনজিও, আইএনজিও ইত্যাদি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো, যেমন আমা মিলন কেন্দ্র (মায়েদের মিলন কেন্দ্র); এদের কাজ হলো মন্দির নির্মাণ করা এবং মহিলাদের সংগঠিত করার নামে ধর্মপ্রচার করা। গণযুদ্ধ সাহসভরে এদের ভণ্ডামী ও ভুয়া কার্যকলাপের মুখোশ উন্মোচন করতে পেরেছে। নেপালে বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে গণযুদ্ধের প্রভাব পড়েছে অপরিসীম। যেমন ইন্দো-আরিয়ান গোষ্ঠীর উপর আরোপিত ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হিন্দু মৌলবাদী ধর্মীয় বিধিনিষেধের ফলে নারীরা ছিল অবদমিত। গণযুদ্ধ এই নারীদের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে তথা এদের মধ্যে সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছে। তিব্বতী-বামিজ গোষ্ঠীর মেয়েরা যদিও আপেক্ষিকভাবে অনেক স্বাধীন এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বাধীনতা প্রচুর, তাই গণযুদ্ধ তাদের সামনে তুলে ধরেছে বৈচিত্র্যময় নতুন জীবনের স্বাদ যা তারা আগে কখনও পায়নি। গণযুদ্ধ যে তাদের কেবল শ্রেণিশোষণ ও লিঙ্গবৈষম্যের যাতনা থেকে মুক্ত করেছে তা নয়, তাদের জাতিগত নিপীড়ন থেকেও মুক্ত করেছে। তপশিলী জাতির মেয়েরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক তথা যৌন জীবনে যেভাবে শোষিত-নিপীড়িত হচ্ছিলো গণযুদ্ধ সেক্ষেত্রে তাদের সামনে মুক্তিদূত হিসেবে হাজির হয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘৃণায় এসব মহিলারা আজ সোচ্চার। নেপালের নারী আন্দোলনে পরিমাণগত তথা গুণগতভাবে অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে গণযুদ্ধ। এতদিন নেপালের নারী আন্দোলনের ভারকেন্দ্র ছিল শহর, আজ নারী আন্দোলনের ভারকেন্দ্র হলো গ্রামাঞ্চল। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গীর মূল কথা হলো “ব্যাপকতম নারীদের আজ জড়ো করতে হবে”- এই দৃষ্টিভঙ্গীকে বাস্তবে রূপদান করে অতীতের নারী আন্দোলন পরিবর্তিত হয়েছে বৈপ্লবিক গণআন্দোলনে। গণযুদ্ধের দৌলতে সর্বত্র নারী জাগরণের প্রভাব অপরিসীম। নারী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা অতুলনীয়। রোলপা, রুকুম ও অন্যান্য জেলায় শুধু ছয়জনের সাংবাদিক দল সরকারি নির্যাতনের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি দেশি ও বিদেশি সংবাদপত্রে তুলে ধরেছে তাতে গোটা বিশ্ব সচকিত। গণযুদ্ধ বিভিন্ন নারী সংগঠনকে একই মঞ্চে সমবেত হতে বাধ্য করেছে। তারা সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করেছে। একযোগে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট নারী সংগঠন একত্র হয়ে দেবী খাদকার ওপর ধর্ষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ সংগঠিত করে তা অবশ্যই একটি নজির। সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে নেপালে নারী সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হলো সামন্ততন্ত্র। কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরেও সামন্ততন্ত্রের অবশেষগুলো চোরাগোপ্তাভাবে পার্টি কাঠামোতে ঢুকে পড়তে পারে। নারীদের দুইটি ফ্রন্টে লড়াই করতে হয়। একদিকে শ্রেণিবৈষম্য, অন্যদিকে লিঙ্গবৈষম্য। অনেক সময় সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে যখন বিভিন্ন কমিটি ও গেরিলা ইউনিটে নারী নেতৃত্বকে অবজ্ঞা করা হয়, তখন তা পার্টির মধ্যে সমস্যার উদ্রেক করে। এক্ষেত্রে সিপিএন (মাওবাদী)’র নীতি হলো, গণযুদ্ধে নারীদের আরও বেশি মাত্রায় সর্বস্তরে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দান করা। পাশাপাশি শহরে সাম্রাজ্যবাদীদের ব্যাপক প্রভাবজনিত কারণে নারীদের সংকীর্ণ নারীবাদী স্রোতে ভেসে যাওয়ার বিপদ আছে। এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে, যে সমস্ত শিক্ষিত নারীরা পরিবারের অভ্যন্তরে সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সংগ্রামে সামিল হয়েছে। তাদের শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী তারা শ্রেণিগত বিষয়ের চেয়ে লিঙ্গগত বিষয়ে জোর দিতে ইচ্ছুক। এই বিষয়ে যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন না করলে সংস্কারবাদী অথবা দক্ষিণপন্থী ঝোঁক পার্টির মধ্যে মাথা চাঁড়া দিতে পারে। এই বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার ক্ষেত্রে পার্টির রক্ষাকবজ হলো নারী আন্দোলনের নেতৃত্বে আরও বেশি মাত্রায় শ্রেণি নেতৃত্ব টেনে আনা। পার্টির পক্ষে এটা সম্ভব কেবল মাও এর নির্ধারিত গণলাইনকে যথার্থভাবে অনুশীলন করে। পার্টি যদিও নিচুতলার মানুষের গভীরে শিকড় গেড়েছে তথাপি সমস্ত রকমের সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলা চলবে না। শ্রেণি সচেতনতা প্রয়োগের মাত্রাতিরিক্ত দোহাই দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই স্থগিত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে পার্টিতে বাম সংকীর্ণতাবাদী ঝোঁক প্রভাব বিস্তার করবে। পরস্পরবিরোধী এই দুই ঝোঁকের রাশ টেনে ধরতে হলে সম্পন্ন শিক্ষিত নারীদের আরও বেশি শ্রেণি সচেতন করে তোলা এবং গরীব নারীদের (সেই সাথে পুরুষদেরও) লিঙ্গগত বৈষম্যের ব্যাপারে আরও বেশি অনুভূতিপ্রবণ হওয়া দরকার। একটি এম.এল.এম. (মালেমা) সংগঠনের মধ্যে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে একটি নারী সংগঠনের অস্তিত্ব রাখার কারণ হলো সক্রিয় শ্রেণি-সচেতন, লিঙ্গ-বৈষম্যের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা রেখে নারীরা যাতে সংগঠক হিসেবে অন্যান্য গণসংগঠন বা স্থানীয় যুক্তফ্রন্টে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। বস্তুগতভাবে নারীদের গণযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনেক কারণ আছে। কিন্তু আত্মগত কারণে মেয়েরা এখনও পুরুষদের থেকে পিছিয়ে আছে। দীর্ঘদিনের অধীনতা, স্বল্প শিক্ষা, বহির্জগতের ব্যাপারে অজ্ঞতা ইত্যাদি নারীদের পশ্চাৎপদতার কারণ। শ্রেণিযুদ্ধ হচ্ছে নিজেই এক মহান শিক্ষক। এটা রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। বিশেষভাবে নারীদের কাছে সামন্ততান্ত্রিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের গোষ্ঠীপতি পিতৃতান্ত্রিক স্বরূপটা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। নেপালের নারীরা রাষ্ট্রের শ্রেণিকাঠামো তথা গোষ্ঠীতান্ত্রিক/পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ত্রিবিধ উপায়ে শান্তি পাচ্ছে। তাদের নির্যাতন, ধর্ষণ ও হননের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীরা সবচেয়ে ভুক্তভোগী। পিছিয়ে পড়া দমনমূলক সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং শহুরে বিকৃত সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি তথা গোষ্ঠীতান্ত্রিক/পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামজনিত কারণে নারীরা সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নির্ভরযোগ্য শক্তি। নারীরা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ পর্যন্ত সময়ব্যাপী বিপ্লবের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি। নারীদের সমাজের সম্পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান না ঘটা পর্যন্ত। আর সাম্যবাদ ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ সাধন অসম্ভব। শ্রেণিসংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য নারীদের শান্তিরক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে চায়। অপরদিকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী শক্তিগুলো নারীদের ইস্পাতদৃঢ় করে গড়ে তুলে স্থাপন করতে চায় বিপ্লবের প্রথম সারিতে এবং তা সেই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যে সমাজব্যবস্থা তাদের বিবিধভাবে শোষণ করেছে।
Comments