গান্ধী প্রসঙ্গে - সরোজ দত্ত

 


বিপ্লবী যুব-ছাত্রদের হাত থেকে গান্ধীকে রক্ষা করার জন্য প্রফুল্ল সেন থেকে অসিত সেন পর্যন্ত জোট বেঁধে দাঁড়িয়েছে পেছনে অবশ্য সিআরপি রয়েছে, নইলে গান্ধী রক্ষার অভিযানে এতখানি তড়পানি তারা দেখাতে পারতো কিনা সন্দেহ। দেশগাঁয়ে একটা কথা আছে, "মেড়া কোঁদে খুটোর জোরে"। এই সেন বংশীয় মেড়ারা যে সিআরপি'র খুটোর জোরেই কুঁদছে তা আজ বুঝতে কারো বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছে না। আর একদল গান্ধীরক্ষক আছে, যারা আরও বজ্জাত। 'ফ্রন্টিয়ার' কাগজের অশোক রুদ্র এদের একজনবিপ্লবী যুব-ছাত্রদের রুদ্রমূর্তি দেখে এরা সম্মুখ সমর এড়িয়ে 'গেরিলা কৌশল' অবলম্বন করেছেএরা বিপ্লবী যুব-ছাত্রদের গালাগাল দিচ্ছে না, খোলাখুলি পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার কথাও বলছে লা, বরঞ্চ সহানুভূতিই দেখাচ্ছে। কিন্তু সরাসরি স্থল আক্রমণ থেকে এই সহানুভূতিই আরও বেশি বিপজ্জনক, এই বন্ধুদের থেকে শক্ররা অনেক ভালোএরা যা বলছে তার অর্থ গান্ধী ছিল মহান বিপ্লবী ও মহান ব্যক্তি, কিন্তু তার ভক্তরা তার মহান শিক্ষাকে বিকৃত করে এবং তার মহান নামকে ভাঙিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে এবং দেশ ও দেশবাসীর দুর্গতির সৃষ্টি করছে। তারা বলতে চাইছে, ঘৃণা করো গান্ধীবাদী ইন্দিরা-চাবন-প্রফুল্ল সেনকে, পূজো করো গান্ধীকেইন্দিরা-চাবন-প্রফুল্ল সেনদের দেখে গান্ধীকে বিচার করো না। বরঞ্চ মহান গান্ধীকে বাঁচাও এদের হাত থেকে। ভাবখানা এই, সাচ্চা বিপ্লবীরা যেমন ক্রুশ্চেভপন্থী সংশোধনবাদীদের হাত থেকে মহান লেনিন ও তার শিক্ষাকে বাঁচানোর কথা বলছে, তেমনই এদের হাত থেকেও গান্ধী ও তার শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে। তাই এরা বিপ্লবী যুব-ছাত্রদের 'বিপথগামী' বললেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে গান্ধী পুজোয় প্রবৃত্ত করাতে চাইছে। এই হাড় বজ্জাতদেরই একজন হচ্ছে অশোক রুদ্র, যার স্তবকেরা তাকে ভীষণ এক আগুনখোর বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ও মার্কসবাদী মহাপন্ডিত বলে বাজারে চালু করে রেখেছে। ফ্রন্টিয়ারে অশোক রুদ্র লিখছে, "আমাদের সমাজের খারাপ সমস্ত কিছুর জন্য গান্ধী দায়ী না হতে পারেন এবং তাঁর মতাদর্শ যে দায়ী নয় তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কারণেই হোক মানবতা ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সমস্ত পাপ করা হয়েছে তার নামেই। অতএব যারা বর্তমান সমাজকে পুরোপুরি বর্জন করে তারা যে তাকেই প্রতীক শত্রু রূপে বেছে নেবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।" লক্ষ্য করুন, ভালো করে তলিয়ে দেখুন এই ধড়িবাজ বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর বক্তব্যটিকেগান্ধী ভালো, গান্ধীবাদীরা খারাপ। অতএব গান্ধীবাদীদের উপর রাগ করে গান্ধীকে মেরো না, বরং এই গান্ধীবাদীদের হাত থেকে গান্ধীকে বাঁচিয়ে তাকে পুজোর আসনে বসাও ও নিজেরা নয়াযুগের নয়া গান্ধীবাদী বনে যাও এবং এইভাবে গান্ধীবাদকে দিয়ে মাওবাদ ঠেকিয়ে ধ্বস নামা সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার দিনকে যতটা পারো প্রলম্বিত করো। আর এ কাজ যদি মার্কসবাদের নামে করতে পারো তাহলে তো কথাই নেইসাম্রাজ্যবাদ অকৃতজ্ঞ নয়, তারা তোমাদের পুরস্কৃত করবে, যেমন করছে অশোক রুদ্রদের। 'মার্কসবাদী' অশোক রুদ্ররা কি জানে না কে এই গান্ধী এবং কী বস্তু এই গান্ধীবাদ এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাসে কী ভূমিকা গ্রহণ করেছে এই গান্ধী ও তার গান্ধীবাদ? ভালোভাবেই জানে এবং জেনেশুনেও চেপে যাচ্ছে তারাগান্ধী এদেশের লোক হলেও এদেশের ছিল না। বাপ ছিল নেটিভ স্টেটের দেওয়ানগান্ধী বিলেত থেকে ব্যরিস্টারি পাস করে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল প্রাকটিস করতে। ভণ্ডামি ও বজ্জাতিতে সে গোড়া থেকেই পাকাদক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জুলু উপজাতীয় কৃষকদের যে ব্যাপক বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা নির্মমভাবে দমন করেছিল সেই দমন কার্যে ইংরেজ প্রভুদের দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে সাহায্য করে দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয়। তখন থেকে সেখানে সে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের, অর্থাৎ মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হয়ে 'অহিংস' আন্দোলনের প্রবর্তন করে। তখন থেকেই সে ইংরেজের চিহ্নিত ব্যক্তি। ১৯১৪ সালে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আড়কাঠিরূপে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে গান্ধীর প্রথম আবির্ভাব ঘটেযুদ্ধ চালাবার জন্য ভারতবর্ষ থেকে লোক অর্থাৎ কামানের খোরাক এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য এসেছিলো এই গান্ধীপ্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধে লেনিন যখন ঐ যুদ্ধের বিরোধিতা করে বিপ্লব করার জন্য ইয়োরোপ ও রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত করছিলেন, ভারতবর্ষে গান্ধী তখন সাম্রাজ্যবাদের আড়কাঠিরূপে যুদ্ধের লোক ও টাকা জোগাড় করছিলো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতার সুবাদে এখানকার ক্লীব ও কাপুরুষ মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের আস্থাভাজন প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ও অক্টোবর বিপ্লবের আঘাতে ও প্রভাবে সারা ভারত জুড়ে শ্রমিক কৃষকের যে বিপ্লবী অভ্যুত্থান শুরু হয় তাকে ঠেকানোর জন্য গান্ধীকেই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচিত করে সাম্রাজ্যবাদ ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা। ইতোপূর্বে বিহারের চম্পারণের কৃষক বিদ্রোহের প্রতি সুকৌশলে বিশ্বাসঘাতকতা করে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সে কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিল। ভাষায়, ভাবে, ভঙ্গিতে এবং ভন্ড তপস্বীর সুকৌশলী জীবনযাত্রার দ্বারা অনগ্রসর জনতার মনে মোহ সৃষ্টি করার যে শয়তানি ক্ষমতা ছিল তার; তারই পূর্ণ প্রয়োগের দ্বারা জাগ্রত জনতার রাশ টেনে রেখে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদের স্বার্থরক্ষা করার ক্ষমতা ছিল তার অবিসম্বাদী। তাই ধূর্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদও বুঝেছিলো অক্টোবর বিপ্লবের পর সারা দুনিয়ার সাথে তাদের সাম্রাজ্যের মধ্যমণি ভারতবর্ষও যখন বিশ্ব সমাজতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করলো, তখন লেনিনের ভাবধারাকে এবং ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধকে রোধ করতে হলে গান্ধী ও গান্ধীবাদের চেয়ে বড় সহায় তাদের আর নেই। কারণ ততক্ষণে গান্ধী সহিংস সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে তার অহিংস নিরস্ত্র সংগ্রামের তত্ত্ব প্রচার ও প্রয়োগ করতে শুরু করেছে; সশস্ত্র আক্রমণ মারফত সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিবর্তে চরকা, সত্যাগ্রহ, অনশন, কারাবরণ, শান্তিপূর্ণ মিছিল, হরতাল মারফত চাপ সৃষ্টি করে কিছু 'কনসেশন' আদায়ের নীতি ও কৌশল সে প্রচার ও প্রয়োগ করতে শুরু করেছে এবং শুরু করেছে বিপ্লবী জনগণকে পেছন থেকে ছুরি মেরে শেষ করে ফেলার শয়তানি খেলাজালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড, চৌরিচৌরার ঘটনা, পেশোয়ারের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সেনা বিদ্রোহ, দক্ষিণ ভারতের মোপালা কৃষক বিদ্রোহের মতো অসংখ্য ঘটনার মধ্যে যা প্রকট হয়ে ওঠে। অক্টোবর বিপ্লবের পর আতঙ্কে দিশেহারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গান্ধীগান্ধীবাদের মধ্যে তার রক্ষাকর্তা ও রক্ষাকবচ খুঁজে পায়। তারা বুঝতে পারে সেদিনের বিপ্লবী আবহাওয়ায় মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পুরাতন ধাঁচের লিবারাল রাজনীতি অচল হয়ে গেছে, তাদের নতুন ধাঁচের যে রাজনীতির এখন প্রয়োজন তা হচ্ছে গান্ধীবাদ এবং যে নতুন ধাঁচের নেতার এখন প্রয়োজন, সে হচ্ছে নেংটি পরা গান্ধী। তারা বুঝলো যে গান্ধীবাদই পারে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের বিরোধী ও বিকল্প হিসেবে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার নেতৃত্বে একটা ঝুটা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সৃষ্টি করতে যা আখেরে সাম্রাজ্যবাদকে বাঁচাবে। নতুবা ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের পর যখন সমগ্র দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলো এবং তার সাথে যুক্ত হবার উপক্রম হলো সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শীর্ষে দণ্ডায়মান মহান লেনিনের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বিপ্লবীরা, উপনিবেশিক মুক্তি বিপ্লবের নতুন ধারা; তখন মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পুরনো ধাঁচের সাহেবি পোশাক পরা লিবারাল নেতাদের সাধ্য ছিল না তাকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার। সে যোগ্যতা ছিল ষোলো আনার উপর আঠারো আনা নেংটি পরা গান্ধীর। গান্ধী ছাড়া সেদিন কারো সাধ্য ছিল না সেই আবহাওয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণিত 'চেমসফোর্ড রিফর্ম' মেনে নেওয়ার জন্য দেশবাসীর কাছে সুপারিশ করার৷ দেশ যখন শ্রমিক ধর্মঘটের ঢেউ-এ ঢেউ-এ উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং মোপালা কৃষক বিদ্রোহের মতো সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থান এখানে ওখানে ফেটে পড়ছে এবং পেরিয়ে ভেসে আসছে বলশেভিক বিপ্লব ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে তৈরী হচ্ছে চীন ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে কমিউনিস্ট পার্টি, তখন তথাকথিত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নামে খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে আঁতাত করে অসহযোগ আন্দোলনের অবতারণা করে যে বিরাট সম্ভাবনাকে ধ্বংস করা হলো এবং শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সাচ্চা মুক্তি আন্দোলনের স্থানে যে ঝুটা দালাল বুর্জোয়ার নেতৃত্বে মুক্তি আন্দোলনের প্রবর্তন করা হলো গান্ধী ছাড়া আর কারো পক্ষে তা সম্ভব ছিল না৷ আর এই ঝুটা মুক্তি আন্দোলনের মধ্যেও যখন চৌরিচৌরা ঘটে গেলো এবং হিংসার গন্ধ পেয়ে সুযোগ-সন্ধানী গান্ধী তৎক্ষণাৎ তার আন্দোলন তুলে নিয়ে দেশকে হতাশা সাম্রাজ্যবাদী পীড়নের মুখে ছেড়ে দিয়ে সরে এলো তখন সাম্রাজ্যবাদ বুঝলো গান্ধীর কদরবুঝলো ভারতীয় বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতকতার এত বড় নিপুণ ওস্তাদ শুধু ভারতবর্ষে কেন, সারা ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় আর নাই৷ ১৯৩০ সালে বিশ্ব বাণিজ্যিক মন্দার আঘাতে আবার দেশ যখন বিপ্লবী আলোড়নে উত্তাল হয়ে উঠলো; অমৃতসরে, পেশোয়ারে, শোলাপুরে সৈনিকরা এবং শ্রমিকরা ইতিহাস রচনা করতে শুরু করলো এবং আবার যখন বিভিন্ন প্রদেশে কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হলো তখন শুরু হলো গান্ধীর নতুন খেল- আইন অমান্য আন্দোলন এবং তারপরে হঠাৎ সে 'আন্দোলন' তুলে নিয়ে বিলেতে গোলটেবিল বৈঠকে যাত্রা এবং সেখান থেকে ফিরে এসে হরিজনদের মন্দির-প্রবেশ আন্দোলন। আবার অভয় পেলো সাম্রাজ্যবাদ, আবার বুঝলো তাদের এত বড় দক্ষ দালাল ভূ-ভারতে নেই। এই ত্রিশ দশকের একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব নিয়ে বোম্বাইয়ের শ্রমিক মিছিলে গুলি চালায় এবং অহিংসার প্রতীক গান্ধী তাতে সমর্থন জানালোগান্ধীর অহিংসা কাদের জন্য তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেলো। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইংরেজ আবার বিচলিত হয়ে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো বশংবদ গান্ধী সে বললো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এই বিপদে সে বিব্রত করবে না, সাহায্য করবে। নির্লজ্জের মতো বললো লন্ডনের রাজপ্রাসাদের উপর বোমা পড়বে একথা ভাবতেও তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্ত স্তালিনের রাশিয়া আক্রান্ত হলে যুদ্ধের যখন রপাস্তর ঘটলো এবং ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তিত্রয়ের (জার্মানি, জাপান ও ইতালি) কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় সুনিশ্চিত বলে ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের দৃঢ় ধারণা হলো তখন গান্ধী হঠাৎ 'বিজয়ী' সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করে রাতারাতি ভীষণ ব্রিটিশবিরোধী বনে গেলো এবং হিটলার-মুসোলিনি-তোজার সোৎসাহ সমর্থনে ৪২-এর আন্দোলন শুরু করে দিয়ে এইভাবে স্তালিনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী যে ফ্যাসিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল তাকে মারাত্মক রকমের আঘাত হেনে নিজেরা জেলে চলে গেলো। তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। যুদ্ধের ফলাফলে তার হিসাব যখন গোলমাল হয়ে গেলো, তখন বিজয়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আবার সে বশংবদ গোলামে পরিণত হলো এবং যুদ্ধের মধ্যে ও পরে সারা দেশ জুড়ে যে গণ-অভ্যুত্থানের আগুন জ্বলে উঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পুড়িয়ে মারার উপক্রম করলো, গান্ধী তখন প্রাণপণ শক্তিতে তার রাস টেনে ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে দেশ দুভাগ সুযোগ করে দিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের, সুযোগ করে দিলো নতুন কায়দায়, নতুন কৌশলে ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার। কিন্তু ইতিহাসের এমনই পরিহাস হিন্দু-মুসলমান মেহনতি জনতার ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামকে বারবার বানচাল করে দিয়ে এবং শ্রেণিভিত্তিক গণ-বিপ্লবকে বারবার ব্যর্থ করে দিয়ে যে ব্যক্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার আগুন জ্বালাবার সুযোগ ও ক্ষমতা তৈরী করে দিচ্ছিলো, সেই দাঙ্গার আগুনে সে-ই পুড়ে মরলো। এ হলো সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষায় সাম্রাজ্যবাদের এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু সবচেয়ে মজা হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট নেতারা গান্ধীর এই খেল বুঝলো না, ইচ্ছে করেই বুঝলো না। কারণ তারা যে নিজেরাই গোড়া থেকেই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তারা যদি সর্বহারা পার্টির দায়িত্ব পালন করতো তা হলে দেশে গান্ধী ও গান্ধীবাদ নোঙর গাড়তে পারতো না। তাই তো দেশের সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের ও সামন্তশ্রেণির প্রতিনিধি 'গান্ধী'র আন্দোলনকে তারাও সাচ্চা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বলে ধরে নিয়ে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনকে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার লেজুড়ে পরিণত করলো, এমনকি গান্ধীকে 'জাতির পিতা' আখ্যা দিতেও ইতস্তত করলো না। আজও ডাঙ্গের দল ও সুন্দরাইয়ার দল গদি নিয়ে নিজেদের মধ্যে যতই কামড়াকামড়ি করুক না কেন, গান্ধীকে দুজনেই বাবা বলে ডাকছে। এরা দুজনেই নাকি কংগ্রেসকে উচ্ছেদ করতে চায়, অথচ কংগ্রেসের নেতা গান্ধী এদের দুজনেরই বাবাএ এক বিচিত্র হেঁয়ালি, যার উত্তর দিচ্ছে আজ দেশের বিপ্লবী যুবশক্তি গান্ধীর মূর্তি ভেঙে ও বই পুড়িয়ে। তাই আর্তনাদ উঠেছে ডাঙ্গে ও সুন্দরাইয়ার শিবিরে। এখন প্রায় শোনা যাচ্ছে লেনিন নাকি গান্ধীর প্রশংসা করেছিলেন। যারা একথা বলছে তারা লেনিনের কোনো রচনার উল্লেখ করছে না; উল্লেখ করছে দলত্যাগী এম.এন. রায়ের, যে ব্যক্তি চীন বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য স্তালিন পরিচালিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকে বিতাড়িত হয়ে খোলাখুলি সাম্রাজ্যবাদের দালালে পরিণত হয়েছিলদলত্যাগী এম.এন. রায়ের মুখে যারা মহান লেনিনের ঝাল খেতে চাইছে, সেই 'মার্কসবাদী'দের জিজ্ঞাসা করি গান্ধী সম্পর্কে স্তালিনের বিখ্যাত উক্তিটিকে তারা বেমালুম চেপে যাচ্ছে কেন। 'মার্কসবাদী' মহাপন্ডিত অশোক রুদ্ররা তো মার্কস, এঙ্গলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সে তুঙ এর লেখা বেটে খেয়েছেন; তাদের কী চোখে পড়েনি গান্ধী সম্পর্কে স্তালিনের ১৯৩০ সালের এই উক্তিটি:

"ভারতবর্ষ, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি সম্পর্কে বলা যায় এইসব দেশে বিপ্লবী আন্দোলনের সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নাই। এই আন্দোলন সময় সময় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের রূপ গ্রহণ করছেএইসব দেশকে বুর্জোয়া কসাইরা রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে চাইছে। পুলিশি সঙ্গিনের উপর নির্ভর করে এবং গান্ধীর মতো লোকের সাহায্য নিয়ে একাজ তারা করছেসঙ্গিন যে নড়বড়ে খুঁটি তাতে সন্দেহ নাই। জারতন্ত্র তার কালে পুলিশি সঙ্গিনের উপর নির্ভর করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সকলেই জানেন সে খুঁটি কী নড়বড়ে খুঁটিই না হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর গান্ধীর মতো লোকেদের সাহায্য সম্পর্কে বলা যায়, জারতন্ত্রের ছিল ঐ ধরনের এক পাল লোক যারা ছিল নানা ধরনের উদারনীতিবাদী আপসপন্থী; কিন্তু এ থেকে মুস্কিল ছাড়া কিছুই লাভ হয়নি জারতন্ত্রের।"

[সিপিএসইউ(বি)-র ষোড়শ কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক রিপোর্ট (১৯৩০), স্তালিন রচনাবলী, ভল্যুম ১২, পৃ: ২৫৯]

এম۔ এন۔ রায়ের কানে কানে লেনিন বলেছিলেন গান্ধী বিপ্লবী, আর লেনিনের মৃত্যুর ছয় বছর পরেই স্তালিন গান্ধীকে বলেছেন সাম্রাজ্যবাদের দালাললেনিন থেকে স্তালিনের বিচ্যুতি প্রমাণের জন্য যারা দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করছে তারা এত বড় 'বিচ্যুতি' সম্পর্কে এখনও চুপ করে আছে দেখে কৌতুকবোধ করছিমধ্যযুগীয় ধর্মীয় কুসংস্কারের যে অপসংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সবচেয়ে বড় সহায় কীভাবে কৌশলে তা জিইয়ে রেখেছিল গান্ধী এবং কীভাবেই বা ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের নামে বিপ্লবী গণ-অভ্যুত্থানকে বারবার সে পথভ্রান্ত করেছে তার বিস্তৃত বিবরণের মধ্যে যাচ্ছি না, এই ভণ্ড তপস্বীর নৈতিক চরিত্রের বিশ্লেষণেও আজ যাচ্ছি না, গান্ধীবাদী অধ্যাপক নির্মল বোস তার স্মৃতিকথায় গান্ধীর ব্রক্ষচর্যের নামে লাম্পট্যের যে রোমহর্ষক বিবরণ লিখেছে ও ভক্তি গদ গদ হয়ে তার ফ্রয়েডীয় ব্যখ্যা করেছে সে প্রসঙ্গও আপাতত তুলছি না। কিন্ত আমি না তুললেও উঠবে, কারণ বিপ্লবী যুবছাত্ররা আজ গুহামুখ থেকে পাথর সরিয়ে দেওয়ায় এমন অনেক জিনিস বেরিয়ে আসবে যাতে জনসাধারণের অনেক দিনের অনেক মোহজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে এবং জাতির জনকের ভয়ে চমকে চমকে উঠবে। এই গবেষণার ভার নিতে হবে আজ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের, বিপ্লবী যুবশক্তি ঐতিহাসিক উদ্যোগ নিয়ে যে সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করেছেন তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সি.পি.আই (এম.এল) ও কমরেড চারু মজুমদারের আহ্বানে বাংলার যে বিপ্লবী যুবশক্তি এই নতুন মোহমুদগর রচনা করেছেন, তাদের লাল সেলাম জানিয়ে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি



Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]