বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে - সরোজ দত্ত

 


ওরা বন্যা দিয়ে বিপ্লব ঠেকাতে চেয়েছিলো। বন্যার মওকা পেয়ে রাতারাতি ওরা সিআরপি'কে বন্যার্ত জনতার ত্রাণকর্তারূপে খাড়া করেছিল। বুর্জোয়া কাগজে রংবেরঙের ছবি ও কাহিনী ছেপে ওরা লালবাজারকে করে তুলেছিল বন্যা ত্রাণের সদর দপ্তর। আর এই কাজে ওদের সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিল সংশোধনবাদী দলগুলো, বিশেষ করে সিপিএম। তাদের "সিআরপি তুলে নাও" স্লোগান রাতারাতি 'হে সিআরপি তুমি আমায় কোলে তুলে নাও" স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। সিআরপি ট্রাকে উঠে সিপিএম এর কমীদের বন্যা ত্রাণের ট্যুর দেখে অনেকের তাক লেগে গিয়েছিলো। তারপর যথারীতি শুরু হয়, যা ছিল ভোটের রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি, শুরু হয় বন্যার্তদের মধ্যে ডোল-কম্বল বিলি করার পবিত্র অধিকার নিয়ে আঠারোটি কুকুরের রক্তারক্তি কামড়াকামড়ি, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বাঘা কুকুর হচ্ছে সিপিএম। বিপ্লব ঠেকাতে গিয়েছিলো ওদের দালাল সংশোধনবাদীরা, বিশেষ করে প্রমোদ-জ্যোতি চক্র, বুর্জোয়া মানবপ্রেম দিয়ে শ্রেণীসংগ্রামের চাকা আটকে দিতে চেয়েছিল ওরা। 'নকশালদের' হাতে পুলিশ, সিআরপি গোয়েন্দা খতম অভিযান যখন ব্যাপক জনতার মধ্যে একটা উৎসাহ ও উল্লাসের জোয়ার এনেছে তখন বন্যার মওকা নিয়ে ওই শুয়ার কা বাচ্চারা এই অভিযান বানচাল করার স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু হায়রে, স্বপ্ন জমে উঠতে না উঠতেই সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। যারা স্বপ্ন দেখছিলো রাজপ্রাসাদের পালংকে রাজকন্যার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে তারা দেখলো তারা রাস্তার ধারে গাছতলায় শুয়ে আছে থান ইট মাথায় দিয়ে, আতঙ্কে তারা চিৎকার করে উঠলো, দুর্গত মানবতার সেবামূর্তি যে পুলিশ, সিআরপি নকশালরা তাদেরও খতম করা বন্ধ করলো না বরং বাড়িয়ে দিলো সে খতমের তীব্রতা, সিআরপি পুলিশের সহযোগিতা করে বন্যার্ত উদ্ধারের পবিত্র মানবসেবার সঙ্গেও তারা এগিয়ে গেলো না। তারা শ্রেণী তিক্ততা, শ্রেণী বিদ্বেষ, শ্রেণী ঘৃণা, শ্রেণী সংগ্রামকেই বিশেষ করে রাঙিয়ে তুললো। তারা করুণায় বিগলিত হওয়ার পরিবর্তে যেন আরও নিষ্করুণ নিদারুণ হয়ে উঠলো। দরিদ্র নারায়ণের সেবা না করে দরিদ্র জনতাকে শ্রেণীশত্রু খতমের পথে নিয়ে গেলো। বিবেকানন্দের মূর্তির গলায় মালা না দিয়ে সে মূর্তির মুখে তারা কালি মাখিয়ে দিলো। পুলিশের বড়কর্তা রঞ্জিত গুপ্ত সাংবাদিক সম্মেলনে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো হায়রে, নিষ্ঠুর নকশালদের মধ্যে এতটুকু মানবতাবোধও নেই। কারণ দেখতে দেখতে তখন বন্যার জলের উপরই শ্রেণীশত্রু খতমের, পুলিশ খতমের আগুন আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। শুধু শহরে নয়, শুধু কলকাতায়, কৃষ্ণনগরে, বহরমপুরে নয়, গ্রামাঞ্চলে বন্যার মধ্যেই শ্রেণীশত্রু খতমের সংখ্যা না কমে বরং ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ওরা বুঝলো, বড় দাগা পেয়ে বড় ঘা পেয়ে ওরা বুঝলো বন্যা দিয়ে বিপ্লব ঠেকানো যায় না। আজকের যুগে, বিপ্লবের বিজয়ের যুগে, সিপিংআই (এম এল) ও নকশালবাড়ি, শ্রীাকুলামের যুগে আর বুর্জোয়া মানবতা দিয়ে শ্রেণী সংগ্রাম রোখা যায় না। যেমন বন্যা দিয়ে ওরা বিপ্লব ঠেকাতে চেয়েছিল তেমনই বিদ্যাসাগর দিয়েও ওরা বিপ্লব ঠেকাতে চাইছে। মনে পড়ছে আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগেকার কথা৷ মনে পড়ছে বাংলাদেশের ইংরেজ আমলের কথা। মনে পড়ছে, আর আজকের দিনের সঙ্গে সেদিনের একটা অদ্ভুত মিল দেখে কৌতুক অনুভব করছি। সেদিনও বাংলাদেশে বিপ্লবী যুবশক্তির ইংরেজ খতম অভিযান রুখবার জন্য দুটি হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল ইংরেজ শাসকেরা, এন্ডারসনি আইন ও বিদ্যাসাগর। আইরিশ বিদ্রোহ রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে উপনিবেশের বিদ্রোহ দমনের বিশেষজ্ঞরূপে স্যার জন এন্ডারসনের সাম্রাজ্যবাদী মহলে তখন খুব নামডাক, তাকেই ওরা এনেছিল বাংলার গভর্নর করে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন দমনের জন্য। তখন বাংলাদেশে বিপ্লবী যুবশক্তির হাতে একের পর এক বাঘা বাঘা সাহেব খতম হওয়ায় আতঙ্কের আর্তনাদ উঠেছিল ইংরেজ শাসকমহলে ও তাদের দালাল কংগ্রেসি শিবিরে। এন্ডারসন চালু করলো সেই কুখ্যাত ঘৃণিত কালাকানুন, 'সন্ত্রাসবাদ দমন আইন'। লক্ষ্য করুন আজ ঠিক সেই আইনটিই আবার ওরা চালু করলো বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন দমনের জন্য। কিন্তু বিপ্লব দমনে শুধু পুলিশ পন্থা গ্রহণ করেই সেদিন ধূর্ত এন্ডারসন ক্ষান্ত থাকলো না। একহাতে ধরলো সে ঐ আইন, অন্য হাতে ধরলো সে বিদ্যাসাগর। মেদিনীপুর বিপ্লবী যুবশক্তির হাতে একের পর এক তিনটি সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট খতম হলো; পেডি, বার্জ, ডগলাস। এন্ডারসনি আইনে সন্ত্রাসের বন্যা বয়ে গেলো মেদিনীপুরে তথা সারা বাংলায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে ধূর্ত এন্ডারসন একজন ঝানু বদমাইস বাঙালি আইসিএস-কে পাঠালো মেদিনীপুরে ম্যাজিস্ট্রেট করে। সে লোকটার নাম বি.আর۔ সেন। সেন মশাই মেদিনীপুরে গিয়ে একদিকে চালালেন পূর্ণমাত্রায় ঐ এন্ডারসনি আইনের সন্ত্রাস, অন্যদিকে মেতে উঠলেন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। ছি ছি ছি, একি লজ্জার কথা। বিদ্যাসাগর মেদিনীপুরের লোক, অথচ মেদিনীপুর তাকে ভুলে যাচ্ছে! বিদ্যাসাগর প্রেমে ও মেদিনীপুর প্রেমে বিগলিত হয়ে উঠলেন সেন মশাই। হৈ হৈ করে শুরু করলেন তিনি বিদ্যাসাগর জন্মোৎসব পালন। শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত পেটি বুর্জোয়া সমাজকে তিনি জমায়েত করার চেষ্টা করলেন বিদ্যাসাগর স্মৃতি উৎসবের আয়োজনে। এন্ডারসন দরাজ হাতে টাকা ঢাললো সে আয়োজনে। আর তার দালাল বি۔আর. সেন উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, মাস্টার, ছাত্র, ক্লাব, লাইব্রেরি সব জমায়েত করতে লাগলো এই বিদ্যাসাগর স্মৃতি উৎসবের আয়োজনে আর রিপোর্ট পাঠাতে লাগলো রাইটার্স বিল্ডিংস এ এবং শক্তিগতভাবে গভর্নরের কাছে, বিদ্যাসাগর মারফত বিপ্লব দমনের কাজ বেশ ভালোভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। কাগজগুলো মারফত বিদ্যাসাগর বার্ষিকী আয়োজনের প্রচার চলতে লাগলো পূর্ণমাত্রায়। বি۔আর. সেন ও রাইটার্স বিল্ডিংস এর ফরমাইশ মাফিক বিদ্যাসাগরের জীবনী বেরুতে লাগলো কাগজে কাগজে। তারপর কান ফাটানো ঢাকঢোল পিটিয়ে রবি ঠাকুরকে নিয়ে যাওয়া হলো বীরসিংহ গ্রামে ঐ উৎসবের উদ্বোধন করানোর জন্য। সজনী দাসের শনিবারের চিঠি তখন উঠে পড়ে লেগে গেছে বিদ্যাসাগরকে বিপ্লবী বাংলার পূর্বপুরুষরূপে দাঁড় করানোর জন্য। এইভাবে সেদিন অন্তরালবর্তী এন্ডারসনের নেতৃত্বে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন এবং বাংলার বিপ্লবী যুবশক্তি দমনের এক গভীর ষড়যন্ত্র অগ্রসর হতে লাগলো। যে বিদ্যাসাগর এতদিন ছিল একজন নিরামিষ সমাজ সংস্কারক তাকে খাড়া করা হলো একজন সমাজ বিপ্লবের নায়ক রূপে। মেদিনীপুরের গৌরবরূপে এন্ডারসনের দালাল বি.আর. সেন বিদ্যাসাগরকে বেছে নিলো কেন? ক্ষুদিরামও তো মেদিনীপুরের লোক ছিলেন। ক্ষুদিরামকে বাদ দিয়ে সে বিদ্যাসাগরকে বেছে নিলো কেন? এ কেনর জবাব খুব সোজা। ক্ষুদিরামকে চাপা দেবার জন্যই সে বিদ্যাসাগরকে বেছে নিয়েছিলো। ১৮৫৭-৫৮ সালের ভারতীয় জাতীয় মহাবিদ্রোহের সময় বাংলাদেশে যখন ঐ আগুন জ্বলে ওঠার উপক্রম হয়েছিল তখন বিদ্যাসাগর ঐ বিদ্রোহ দমনে ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতা, বিশেষ করে কৃষক জনতা ক্রোধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল এবং বারংবার নানাভাবে বিস্ফোরণ হচ্ছিলো তখন বিদ্যাসাগর ঐ শাসনকেই কায়েম করতে চাইছিলো এবং সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় সংস্কার আন্দোলন চালু করে বিপ্লবী আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করতে চাইছিলো। তাই এন্ডারসন ও তার দালাল উপদেষ্টা বি.আর. সেন বুঝেছিলো বিপ্লবী যুবশক্তিকে বিভ্রান্ত করতে হলে, বিপ্লবী জনতার বিপ্লবী মেজাজকে ভোঁতা করতে হলে বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তির পূজার প্রচলন করা বিশেষ প্রয়োজন। এই পূজা মারফতই বিপ্লববিরোধী সংস্কারবাদী আন্দোলনে বিপ্লবী জনতাকে তাকে টেনে আনা যায়। সাম্রাজ্যবাদের গণ বিপ্লবী অভ্যুত্থানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যেমন হিংস্র দমননীতি একটা পথ, এও তেমনি একটা পথ এবং দুটো পথ পাশাপাশি চলা উচিত, কোনোটিকে বাদ দিয়ে দিলে চলবে না। প্রায় ৪০ বছর পরে আজ আবার তারা সেই দুটি অস্ত্র বের করেছে, এন্ডারসনি কালাকানুন ও বিদ্যাসাগর। কিন্তু নির্বোধরা বুঝছে না যে জমানা পাল্টে গেছে, সেদিনের বিপ্লবী যুবশক্তি শ্রমিক-কৃষক জনতার প্রতিনিধি ও একাত্ম অংশ ছিল না, তখনও আমাদের দেশে মার্কসবাদ লেনিনবাদের তত্ত্ব তেমন প্রবেশ করেনি, বিশ্ব পরিস্থিতিতে সে যুগ ছিল বিপ্লবের ভাটার যুগ, সাম্রাজ্যবাদ ছিল আজকের তুলনায় আপেক্ষিকরূপে প্রবল। তাই এন্ডারসনি কালাকানুন ও বিদ্যাসাগর দিয়ে সেদিন ঠেকা দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আজ চীন বিপ্লবের পর এখন চেয়ারম্যানের যুগ, এখন হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সম্পূর্ণ ও দ্রুত ধ্বংসের ও সমাজতন্ত্রের দ্রুত বিজয়ের যুগ। এখন এখন তৈরি হয়েছে নকশালবাড়ি, তৈরি হয়েছে সিপিআই (এম-এল), দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে কৃষকযুদ্ধ এবং তারই পরিপূরক হিসেবে জেগে উঠেছে বিপ্লবী যুবশক্তি ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের অংশীদার হিসেবে। অতএব আজ এন্ডারসনি আইন দিয়েও যেমন এ শ্রেণিযুদ্ধ রোধ করা যাবে না তেমনি বিদ্যাসাগর দিয়েও তাকে ঠেকা দেওয়া যাবে না। বিপ্লবের বিজয়ের যুগে বাংলার যুবশক্তির আঘাতে পড়বে ও পড়ছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি এবং সে মূর্তি পুড়ছে চেয়ারম্যানের চিন্তাধারায় সিপিআই (এম-এল) এর মশালের আগুনে জলে ওঠা কৃষক যুদ্ধের আগুনে। প্রায় ৪০ বছর পরে আবার যারা এন্ডারসনি আইনের আড়ালে বসে বিদ্যাসাগরের মূর্তি পূজায় মেতেছে তারা ভুলে যাচ্ছে যুগ পাল্টাচ্ছে, জমানা পাল্টে গেছে।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]