বই পোড়ানো প্রসঙ্গে - সরোজ দত্ত

 


বিপ্লবী যুব ছাত্ররা গান্ধীর বই পোড়াচ্ছে দেখে একদল বুদ্ধিজীবী ভীষণ বিচলিত হয়ে এক দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছে। গান্ধীর বইতো বটেই, বই পোড়ানোতেই নাকি এদের আপত্তি ও উদ্বেগ। এই প্রসঙ্গে হিটলারে নাম করেছে। লক্ষ্য করার বিষয় সিপিএম এর পলিটব্যুরোও তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে, এমনকি হিটলারের নাম পর্যন্ত তাদের প্রস্তাবে উল্লেখ করেছে। শুধু গান্ধীর বই নয়, বই পোড়ানোতেই এদের আপত্তি। তাই যদি হয়, তবে ১৯৬২ সালে যখন শুধু মাও সে তুং এর বই-ই নয়, শুধু চীন বিপ্লব সংক্রান্ত বই-ই নয়, সর্বপ্রকারের মার্কসবাদের বই পোড়ানো হয়েছিল তখন তারা চুপ করে ছিল কেন? আর শুধু কি চুপ করেছিল, তারা কি চীন ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে গরম গরম বিবৃতি দিয়ে প্রতিদিন সেই বই পোড়ানোর আগুনে ঘি ঢালেনি? বিবৃতি দাতাদের মধ্যে মনোজ বোসকে দেখে কৌতুক অনুভব করছি। এই মনোজ বোস যখন নিজের হাতে লেখা বই 'চীন দেখে এলাম' গাদা গাদা নিজের হাতে পুড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছিল তখন তো তার বিরুদ্ধে আজকের এই বই দরদিদের কেউ একটা টুঁ শব্দ করেনি, বরং তখন যে গগন-বিদারী বাহবা ধ্বনি উঠেছিল তাতে এরাও সোৎসাহে সুর মিলিয়েছিল। মনে আছে নিশ্চয়ই তখন ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও অন্যান্য লাইব্রেরি থেকে যত চীন-ভারত সীমান্ত আর ম্যাপওয়ালা বই পাওয়া গিয়েছিল সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। কই তখন তো এদের কেউ বই পোড়ানোর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি? যে বার্ট্রান্ড রাসেল মরে গেলে এরা কেঁদে বুকে ভাসিয়েছে সেদিন তার 'আনআর্মড ভিকট্রি' বইখানাকে পুড়িয়ে দেবার দাবি উঠেছিল তখন তো এদের কেউ বিরোধিতা করেনি? সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের মতো ভারত সরকার চালাচ্ছে বিপ্লবী বইয়ের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট অভিযান। তারা যে শুধু মাও সে তুংয়ের বই এবং বিপ্লবী চীনের বই-ই এদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না তা নয়, সেগুলো গাদা গাদা বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে বা অন্য উপায়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই তো সেদিন দেশব্রতী ও লিবারেশনের অফিস থেকে পুলিশ গাদা গাদা বই নিয়ে গিয়ে সেগুলো ধ্বংস করেছে। কই, কেউ তো কোনো কথা বলছে না? বিবৃতি দাতাদের মধ্যে দেখছি সন্তোষ ঘোষ, সুবোধ ঘোষ, প্রমথ বিশীদের মতো বুর্জোয়া সাংবাদিকদের নাম রয়েছে। কই তারা তো তাদের কাগজে এই বই ধ্বংসের সংবাদটুকু পর্যন্ত ছাপলো না। এমনকি নকশাল দরদি বরুণ সেনগুপ্ত পর্যন্ত এই ব্যাপারে চুপ। এদের কাছে কি তবে আঁতুর ঘরে ঢুকে শিশুহত্যা নরহত্যা নয়? তাহলে দেখা যাচ্ছে, এরা ভান করছে যে এরা বই পোড়ানোর বিরুদ্ধে। সাধারণভাবে, বই পোড়ানোর বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক ন্যাকা ঢং দেখিয়ে এই সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা আসলে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী বইগুলোকেই বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করতে চায় এবং প্রগতিশীল ও বিপ্লবী বইগুলো ধ্বংস করতে চাইছে। বিপ্লবী যুব ছাত্রেরা শুধু গান্ধীর বই-ই পোড়াচ্ছে না, ঐ সঙ্গে পোড়াচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদেরও, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারিত পুঁথিপত্র। কিন্তু লক্ষ্য করুন, বিবৃতি দাতারা বিপ্লবী যুব ছাত্রদের শুধু গান্ধীরই বই পোড়ানোর অভিযোগ করছে, সাম্রাজ্যবাদীদের বইপত্র পোড়ানোর কথা বেমালুম চেপে যাচ্ছে। আসলে কিন্তু লাগছে তাদের ওখানেই, অথচ সে কথা বলার সাহস তাদের নেই! তাই গান্ধী সাহিত্যকে ওরা শিখন্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে আসলে সাম্রাজ্যবাদকেই বাঁচাতে চাইছে। কিন্ত বিপ্লবীরা পিতামহ ভীষ্ম নন, সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্যকে ধ্বংস করতে গিয়ে তার শিখন্ডী সাহিত্যকে ধ্বংস করার প্রয়োজন হলে তারা তা বিনা দ্বিধায় করবেন এবং করছেনও বটে। এখান থেকে আরেকবার প্রমাণ হচ্ছে যে গান্ধী সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে মোক্ষম শিখন্ডী। ওরা হিটলারের নাম করছে, কিন্তু মুসোলিনির নাম করছে না। সিপিএম এর বিবৃতি শুধু হিটলারের নাম করা হয়েছে, মুসোলিনির নাম করা হয়নি। এর একটা গূঢ় কারণ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে সর্বপ্রথম ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয় হয়। মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের রূপকার, নামটাও তারই দেয়া। হিটলার তো মুসোলিনির শিষ্য, মুসোলিনির পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেক পরে জার্মানিতে তার আবির্ভাব।আধুনিককালে মুসোলিনি সর্বপ্রথম জমকালোভাবে বই পোড়ানো শুরু করে। শুধু মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিনের বই নয়; সমাজতন্ত্রের গন্ধযুক্ত সব বই-ই রাস্তায়, পার্কে পুড়িয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলে সে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে। দেশে দেশে তখন সে দালাল দিয়ে গুপ্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল, বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে এই দালাল সংগ্রহ করা হতো, ভারতবর্ষে এমনি তার একটি ঘাঁটি তৈরি হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। সেখানে তুর্চি নামে তার এক গুপ্তচরকে সে ইতালীয় ভাষার অধ্যাপক করে পাঠায়। তুর্চি সেখানে বসে সুনীতি চাটুজ্যে, বিনয় সরকার, কালিদাস নাগ প্রমুখ জনকয়েক বাঘা রবীন্দ্রভক্তকে মুসোলিনির টাকা খাইয়ে একটা চক্র গড়ে তোলে এবং এই চক্র এক গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হয়। কালিদাস নাগ, বিনয় সরকার আজ মরে গেছে; তাই আজ তাদের কীর্তির কথা আপাতত থাক। সুনীতি চাটুজ্যে তখন রামানন্দ চাটুজ্যের মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় মুসোলিনি ও তার ফ্যাসিজমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখতে শুরু করে। তখন স্তালিনের আমল, সোভিয়েত সরকার সব খবর রাখতেন। মুসোলিনির টাকা খাওয়া ভারতীয় বুদ্ধিজীবী দালাল সুনীতি চাটুজ্যে তখন নিরীহ ভাষা বিজ্ঞানী সেজে রাশিয়ায় ঢুকতে চাইলে রুশ সরকার ভিসা দিতে অস্বীকার করেন; এইজন্য তখন মডার্ন রিভিউতে স্তালিন ও রুশ সরকারকে তীব্র আক্রমণ করা হয়। এই শয়তানদের মারফত মুসোলিনি রবি ঠাকুরকে ইতালি ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায় ও শান্তিনিকেতনে বিরাট এক সেট তার স্বনিবাচিত বই উপহার দেয়। ইতালিতে যখন মুসোলিনি পুরোদমে সমাজতন্ত্রের বই পুড়িয়ে চলেছে; ঠিক সেই সময়ে রবি ঠাকুর মুসোলিনির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দলবল নিয়ে ইতালিতে যায় এবং মুসোলিনির আপ্যায়নে বিগলিত হয়ে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বিবৃতি দেয়। পরে অবশ্য সে বলে অতসব কথা সে বলেনি। এইসব কেলেঙ্কারির কাহিনির কিছু কিছু রমা রল্যার ডায়েরিতে আছে। রবি ঠাকুরের প্রামাণ্য জীবনীকার প্রভাত মুখুজ্যে এ ঘটনার উল্লেখ না করে পারেনি। তখন রমা রল্যা রবি ঠাকুরকে এই ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন ও তার খোয়ানো সুনাম পুনরুদ্ধারের জন্য রাশিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। এ তার নিজের ভাষায় লেখায় তো আছেই, প্রভাত মুখুজ্যেও উল্লেখ করেছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার কথা, ঠিক এই সময়ে গান্ধী হঠাৎ এই বই পোড়ানো মুসোলিনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে এক বিবৃতি প্রচার করে। আজ বই পোড়ানো দেখে যাদের ব্যথায় বুক ফেটে যাচ্ছে তাদের তালিকায় দেখছি সেই সুনীতি চাটুজ্যের নাম। আর দেখছি মৈত্রেয়ী দেবীর নাম, যে ছিল তখনকার ইয়োরোপ ভ্রমণে রবি ঠাকুরের যাত্রাসহচরী এবং বই পোড়ানো মুসোলিনির প্রতি যার গদ গদ প্রেম দেখে রমা রল্যা সেদিন চমকে উঠেছিলেন। ওরা যে শুধু শিষ্য হিটলারের কথা বলছে গুরু মুসোলিনির কথা বলছে না, তার কারণ এইখানেই। ওরা জানে মুসোলিনির কথা বললে অনেক অস্বস্তিকর কথা উঠতে পারে, তাই ও নামটা চেপে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি, জার্মানি ও জাপানি ফ্যাসিজমের পতনের পরে এরা সবাই দল বেঁধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালের দলে ভর্তি হয়। সুযোগ পেলে পরে এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। বিবৃতি দাতাদের মধ্যে দেখছি অম্লান দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুর নাম। আবু সৈয়দ আয়ুবের নাম দেখছি না; প্রমুখ এর মধ্যে আছে কিনা জানি না, তবে তার সুযোগ্য সহধর্মিণী গৌরী আযুবের নাম দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের মনে থাকতে পারে ১৯৬৭ সালে সিআইএ কম্বোডিয়ায় ক্যু করেছে। কয়েকদিনের মধ্যে হাজার হাজার নরনারী, শিশু, বৃদ্ধ হত্যা করেছে; নাপাম বোমা ফেলে শত শত নগর-গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং নিশ্চয়ই ঐসব নগর-গ্রামে শুধু মানুষই পুড়ছে না, লাখো লাখো বইও পুড়ছে। আর এখানে সিআইএ এর হাতে নাতে ধরা পড়া দালালরা বিপ্লবী ছাত্রদের হাতে ইয়াঙ্কি ও গান্ধীর কিছু বই পোড়ানো দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে, আবার বলছে আজ যারা বই পোড়াচ্ছে কাল তারা মানুষ পোড়াবে।" আমি যতদূর জানি এই সিআই.এ'র দালালরা এবং ডাংগে চক্রের বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছে এই বিবৃতি প্রচারের মূল উদ্যোক্তা। এদেরই যুক্ত উদ্যোগে এই তথাকথিত বই বাঁচানো আন্দোলন হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেছে শুধু পুলিশ মিলিটারি দিয়ে বিপ্লবীদের দমন করা যাবে না, ঐ সাথে জনমতও তৈরি করতে হবে। পুলিশ মিলিটারির পরিপূরক হিসেবে এরা তাই এই ভাবে জনমত তৈরি করছে। এখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা জোট বেঁধেছে ভারতীয় বিপ্লবের বিরুদ্ধে। লক্ষ্য করার বিষয় সিপিএম এর পলিটব্যুরো যে বিবৃতি দিয়েছে তার সাথে এদের বিবৃতির প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মিল। তারাও হিটলারের কথা বলছে, মুসোলিনির কথা চেপে গেছে। এটা নিছক বাদ পড়ে যাওয়া নয়। আর বসুমতীর বিবেকানন্দ মুখুজ্যে যে সোৎসাহে এই বিবৃতি প্রদান করে এক লম্বা সম্পাদকীয় লিখে ফেলেছে তাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করি, কম্বোডিয়ায় সিআইএ'র ক্যু ও সরাসরি মার্কিন আক্রমণের মুখে সে ম্যানিলায় গিয়েছিলো যে সম্মেলনে সে সম্মেলন আসলে কিসের সম্মেলন এবং সম্মেলনের নেপথ্যে উদ্যোক্তা ছিলেন কারা? হঠাৎ ঠিক এই সময়ে এই সম্মেলন ডাকা হলো কেন? এই ভ্রমণে তার নেতা ও গুরু হিসেবে যে তার সঙ্গে গিয়েছিল সেই স্বনামধন্য কুখ্যাত অমিতাভ চৌধুরীকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা খাস মার্কিন মুলুকে নিয়ে গিয়ে শুধু তালিমই দেয়নি, ইনামও দিয়েছে। তলে তলে অনেক দূর গড়াচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। এই বই পোড়ানো বিরোধী অভিযান যে সিআইএ সংগঠিত এবং স্থানীয় দপ্তর যে লালবাজারে তাতে আর সন্দেহের অবকাশ থাকছে না। আবহমানকাল ধরে শোষণকারী শাসকশ্রেণী পুঁথি ও বই পুড়িয়ে আসছে। যে পুঁথি ও বইকে সে তার শোষণের পরিপন্থী মনে করেছে তাকে সে পুড়িয়েছে বা অন্যভাবে ধ্বংস করেছে। শুনেছি, প্রাচীন ভারতের একজন বস্তবাদী দার্শনিকের সমস্ত বই বেদ ও ব্রাহ্মণ বিরোধী বলে শাসকেরা পুড়িয়ে দেয়। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে মানুষের ইতিহাসে। শ্রেণীর এই একটি বিশেষত্ব, শ্রেণী একনায়কত্বের এ একটি বিশেষ প্রয়োগ। কিন্তু এতকাল বই পোড়ানো, বই ধ্বংস একতরফা হয়ে আসছিল। এতে শাসক শ্রেণীর দালাল বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ কোনো প্রতিবাদ করেনি, করলেও এমনভাবে করেছে যাতে কাজের বাধা না হয়। কিন্তু যখন বিপ্লবী পরিস্থিতিতে শোষিতশ্রেণীও তার স্বার্থের পরিপন্থী পুঁথিপত্র পোড়াতে বা ধ্বংস করতে শুরু করে অর্থাৎ যখনই শাসকশ্রেণীর হাত থেকে শাসিতরা বই পোড়ানোর একচেটিয়া অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে থাকে তখনই রব ওঠে, গেলো গেলো সব গেলো। শোষকের শ্রেণী রাষ্ট্রের ও শ্রেণী একনায়কত্বের পাল্টা হিসেবে যখনই শোষিতের ও সর্বহারার একনায়কত্বের প্রক্রিয়া শুরু হয় তখনই বুর্জোয়া পুলিশ মিলিটারির সহযোগী হিসেবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া মানবিকতাকে দিয়ে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। সেইজন্য মাও সে তুঙের বই পোড়ালে যারা প্রতিবাদ না করে মদত দেয়, অবস্থা পাল্টে গিয়ে যখন গান্ধীর বই পোড়ানো শুরু হয় তখন তারাই দেখি বই পোড়ানোর বিরুদ্ধে সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র রক্ষার অভিযান শুরু করে। যেমন আবহমানকাল ধরে শাসকশ্রেণি শোষিতশ্রেণীকে খুন করে আসছে অথচ যেই শোষিতশ্রেণী শাসকশ্রেণীকে পাল্টা খুন করতে শুরু করে, তখনই শুধু আইন শৃঙ্খলা নয় তার চেয়েও বড় অহিংসা ও মানবতার প্রশ্ন তুলে অর্থাৎ গান্ধীবাদ দিয়ে তা ঠেকানোর চেষ্টা হয়। প্রতিবিপ্লবীরা বুঝেছে মাও সে তুং এর চিন্তাধারা আজ ভারতীয় প্রতিবিপ্লবের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই তারা তার বই পোড়াচ্ছে বা পোড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। '৬২ সালে যার প্রকট প্রকাশ আমরা চোখের উপর দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে তারা এও বুঝেছে মাও সে তুং এর চিন্তাধারার মোকাবিলা করার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে গান্ধীর চিন্তাধারা। তাই তারা প্রাণপণে জনতার মধ্যে গান্ধীর মূর্তি ও বই বানিয়েছে ও ছড়িয়েছে। অনেক ঠেকে ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা আজ একথা বুঝেছেন, তাই বিপ্লবী যুব ছাত্রেরা ঐতিহাসিক উদ্যোগ নিয়ে সেই '৬২ সালে প্রতিবিপ্লবীরা যা করেছিল এই '৭০ সালে ঠিক তার পাল্টাটি করা শুরু করেছেন। অর্থাৎ মাও সে তুং এর বই বাড়াতে ও ছড়াতে চাইছেন এবং গান্ধীর মূর্তি ও বই ভাঙতে ও পোড়াতে চাইছেন। অর্থাৎ বুর্জোয়া একনায়কত্বকে চূর্ণ করে সর্বহারার একনায়কত্বকে প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছেন! সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুদ্ধিজীবীরা গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি রক্ষার নামে বই পোড়ানো বন্ধ করার আওয়াজ তুলে এই ঐতিহাসিক সত্যটাকে চাপা দিতে চাইছে। তারা দেওয়ালের লিখন দেখছে না, তারা ইতিহাসের বিরুদ্ধাচরণ করছে। আজ তাদের যত বলশালী মনে হোক, কাল তারা অবলুপ্ত হয়ে যাবে।

দেশব্রতী, ২৯ মে ১৯৭০।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]