শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ
ক্রুশ্চেভ প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুন রাষ্ট্র কাঠামো দ্বারা 'রিপ্লেস' করার (পাল্টানোর) যে প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন সে সম্পর্কে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু কী উপায়ে তা করা সম্ভব - শান্তিপূর্ণ উপায়ে, নাকি সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মারফৎ - এটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনও কোনও দেশে সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব - এই অভিমত এক সময়ে কার্ল মার্কস ব্যক্ত করেন। কিন্তু সেদিন বাস্তব অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। সেদিন পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উদীয়মান গণতান্ত্রিক আবহাওয়া দেখে তিনি অনেক আশা করেছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে যায়। তাই কমরেড লেনিন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে সশস্ত্র গণঅভ্যুথান ছাড়া, বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধুলিসাৎ করা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটতে পারে না। একথা আজও প্রযোজ্য। বাস্তব পরিস্থিতিকে সামনে না রেখে কোনও বিষয়ে আলোচনা করা মার্কসীয় নীতি বিরোধী। লেনিনের সময়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের অবশ্য প্রয়োজনীয়তাকে জনসাধারণের মনে দানা বাঁধাতে পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বিরাটভাবে কাজ করেছে। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আশপাশের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা লেনিন বলেছিলেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্রুশ্চেভ বলেছেন যে, “যদি পুঁজিবাদীরা রাস্তা ছেড়ে দেয় কোন প্রকার বলপ্রয়োগ না করে, তাহলে কমিউনিস্টরাও বলপ্রয়োগ করবে না। কিন্তু যেহেতু একথা নিশ্চিত যে, তারা বলপ্রয়োগ করবেই তাই আমাদেরও তৈরি থাকা দরকার।” 'কমিউনিস্টরা রক্তচোষা' (blood thirsty) এই মিথ্যা প্রচারের জবাবে তার এই যুক্তি খুবই উপযুক্ত সন্দেহ নেই। তিনি যদি একথা বলেই থামতেন তাহলে ভাল হ'ত। কিন্তু তিনি আরো বলেছেন যে, বর্তমান পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক অবস্থায় অনেকগুলি পুঁজিবাদী এবং পূর্বেকার ঔপনিবেশিক দেশে নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে! আমরা এই চিন্তার সাথে একমত হতে পারিনি। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে একথা আদপেই গ্রহণ করা যায় না। কোন সন্দেহ নেই যে, ক্রুশ্চেভের এই চিন্তা বিভিন্ন দেশের সাম্যবাদী আন্দোলনে শোধনবাদী-সংস্কারবাদী প্রবণতার জন্ম দিতে সাহায্য করবে। প্রত্যেক দেশের কমিউনিস্টরাই এর দ্বারা ভাবতে শুরু করতে পারেন যে, তাদের দেশেই শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সংগঠিত হবে। ফলে বিপ্লবী প্রস্তুতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ হ'ল একটি দিক। অপর আর একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। এ ব্যাপারে ত্রুশ্চেভের নিজের বক্তব্য স্ব-বিরোধিতার দোষে দুষ্ট। একবার তিনি বলেছেন, যেসমস্ত পুঁজিবাদী দেশে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য আছে একমাত্র সেই সমস্ত অত্যন্ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতেই (the highly developed capitalist countries where democracy is traditional) শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র আসবে। পরক্ষণেই আবার বলেছেন, একমাত্র 'দুর্বল পুঁজিবাদী দেশগুলোর' ক্ষেত্রেই এই পন্থা প্রযোজ্য। আবার আর এক জায়গায় তিনি বলছেন - উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিপ্লব অপরিহার্য। এই সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে স্ব-বিরোধিতা অত্যন্ত প্রকট। আমরা এই বিষয়ে স্ট্যালিনের বক্তব্যকেই আজও সঠিক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। স্ট্যালিনের বক্তব্য হচ্ছে, “আজ সমাজতান্ত্রিক দেশকে যেভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলো ঘিরে আছে, সেই অবস্থার বদলে যখন গুটিকয়েক পুঁজিবাদী দেশকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ঘিরে ফেলবে সেই সুদূর ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন আসতে পারে।” ("The question of establishment of socialism in a peaceful way can arise in that remote future when the present capitalist encirclement will be replaced by a socialist one.")
-শিবদাস ঘোষ

Comments