অনুরাধা গান্ধী - কমিউনিস্টদের আলোকবর্তিকা
[অনুরাধা গান্ধী ভারতীয় বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ও চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন মুম্বাই ও নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং এই দুই শহরে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তীতে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় বনাঞ্চলে জনগণের উপর অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত হন এবং সিপিআই(মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় সদস্য ও কেন্দ্রীয় মহিলা উপ কমিটির প্রধান হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি কেন্দ্রীয় সদস্য কোবাদ গান্ধীকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালের এপ্রিলে দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলের গেরিলা জোনে সেরেব্রাল ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুর দিনটিতেও তিনি নারী ক্যাডারদের নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়নের উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।]
https://terabox.com/s/1w92k9Z8RN4H5oUXOwoMxqw
'আন্তর্জাতিক নারী দিবস - অতীত ও বর্তমান'
- অনুরাধা গান্ধী
"২০০১ এর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ৯১তম বার্ষিকী যা ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম ঘোষিত হয়। সে বছর সমাজতান্ত্রিক শ্রমজীবী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমেরিকার শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ক্লারা জেটকিন বাৎসরিকভাবে নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব পেশ করেন। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সভায় নারী অধিকারের আন্দোলনকে মর্যাদা প্রদান করতে ও সারা বিশ্বে নারীদের ভোটাধিকার অর্জনে সহায়তার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত একটি নারী দিবস চালু করা হয়। ১৭টি দেশের ১০০ জনেরও বেশী নারীদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। দিবসটি পালনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নির্বাচন করা হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালের ১৯শে মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে দশ লাখেরও বেশী নারী ও পুরুষ এক র্যালিতে অংশগ্রহণ করে। ভোটের অধিকার ছাড়াও তারা কাজ ও কারিগরী প্রশিক্ষণের অধিকার ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বন্ধের দাবী জানায়। জার্মানীতে নারীরা ১৯শে মার্চ দিনটি বেছে নেয়, কারণ ১৮৪৮ সালের এই দিনে এক সশস্ত্র বিদ্রোহের সময় প্রুশিয়ার রাজা নারীদের ভোটাধিকার সহ অনেক রকম সংস্কার সাধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনটি বদলে করা হয় ৮ই মার্চ। ঐ দিনে ঘটে যাওয়া দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মরণে এটি করা হয়। ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ নিউইয়র্ক শহরে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলের নারী শ্রমিকরা দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজ ও নিম্ন মজুরী প্রদান ইত্যাদি অমানবিক অবস্থার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এতে পুলিশ হামলা চালায় ও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। দুই বছর পর আবারো মার্চ মাসে এই নারীরা প্রথমবারের মতো একটি ইউনিয়ন গঠন করে। ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ পুনরায় সীমিত কর্মঘন্টা, উন্নত মজুরী, ভোটাধিকার ও শিশু শ্রম বন্ধের দাবীতে ১৫,০০০ নারী নিউইয়র্ক শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। তাদের শ্লোগান ছিল ‘রুটি ও গোলাপ’; অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতীক হলো রুটি এবং জীবনযাত্রার উন্নত মান বোঝাতে গোলাপ। সে বছরের মে মাসে আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক পার্টি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার দিনটিকে জাতীয় নারী দিবস হিসেবে পালনের জন্য মনোনীত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম জাতীয় নারী দিবস পালিত হয় ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি। শীঘ্রই ইউরোপের নারীরা ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার দিনটিতে নারী দিবস উদযাপন করতে আরম্ভ করে। এই পটভূমিতে ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯১১ সালে প্রথমবারের মতো এ দিবস উদযাপনের এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ট্র্যাজিক ট্রায়াঙ্গেল ফায়ারে’ (‘Triangle Shirtwaist Factory’তে সঙ্ঘটিত অগ্নিকাণ্ডে) ১৪০ জন শ্রমজীবী নারী নিহত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম আইনে এই ঘটনা সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে আরো বেগবান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯১৩ সালে রুশ নারীরা প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। পরের বছর ৮ই মার্চ কিংবা তার কাছাকাছি সময়ে ইউরোপে নিপীড়িত নারীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে নারীরা র্যালির আয়োজন করে। সবথেকে বিখ্যাত শ্রমজীবী নারী দিবস ছিল ১৯১৭ সালের ৮ই মার্চ (রুশ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৪শে ফেব্রুয়ারি)। এদিন সেন্ট পিটার্সবুর্গের রুশ নারীদের নেতৃত্বে ‘রুটি ও শান্তি’র দাবীতে হরতাল পালিত হয়। ক্লারা জেটকিন এবং আলেকজান্দ্রা কোল্লনতাই উভয়েই এতে অংশগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের হরতালে দাঙ্গা তৈরি হয় যা ৮ থেকে ১২ই মার্চের মধ্যে গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের (এটি এ নামেই পরিচিত) ফলে জারের পতন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ৮ই মার্চকে বীর নারী শ্রমিকদের বীরত্ব উদযাপনের পাশাপাশি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। তখন থেকে ৮ই মার্চ এর তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সারা পৃথিবী জুড়ে দিনটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার প্রসঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে নারী অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয় যা সারা বিশ্বের নারীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা ছিল। ১৯৪৯ সালের চীন বিপ্লব দেখিয়ে দিল সামন্তীয় মূল্যবোধ ও পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটিতে নারীরা পরিবর্তনের জন্য কী করে জেগে উঠতে পারে। সমাজতান্ত্রিক চীনে নারীরা যে বিরাট পদক্ষেপটি নিয়েছিল তা ছিল গোটা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের জন্য একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত। চীনে নারীদের ক্ষমতায়নের একটি বড় উৎস হিসেবে বিশেষভাবে কাজ করেছে মহান প্রলেতারিয়েত সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও সামন্তীয় কনফুসিয় ধ্যান ধারণার উপর এর নিরন্তর আক্রমণ। কমরেড চিয়াং চিয়াং ছিলেন এর জীবন্ত প্রতীক। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক উত্থান ঘটে এবং তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতাশালী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠে এবং এসময় নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনেও পুনর্জাগরণ ঘটে। গোটা বিশ্বে এই আন্দোলন এতো বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল যে সাম্রাজ্যবাদীরা আত্তীকরণের মাধ্যমে একে স্বপক্ষে এনে ও নিজেদের গ্রহণযোগ্য পথে এর গতি পরিবর্তন করে একে ধ্বংস করতে চাইলো। আত্তীকরণের মাধ্যমে স্বপক্ষে টানার এই প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ রূপ হলো ১৯৭৭ সালে ৮ই মার্চকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রদান। সেই থেকে চরম বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোও ৮ই মার্চ ‘উদযাপন’ করে আসছে। অবশ্য যে বিপ্লবী উপাদান ও সংগ্রামের ইতিহাস থেকে এর উদ্ভব সেটুকু তারা বর্জন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে চীনে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটে যা এই অবস্থার পিছনে অনুঘটকের কাজ করে। এই সব পরিবর্তনের ফলে প্রথম যে ক্ষতিটা হয় তা হলো সমাজতন্ত্রের অধীনে নারীদের অর্জিত কিছু অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানানো। তারপরও বিশ্বের নিপীড়িত নারীদের মাঝে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বেঁচে আছে। কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সমাজতন্ত্রের সাময়িক অবনতি এবং পুঁজিবাদের/সাম্রাজ্যবাদের পুনর্বহাল নারীদের কঠিন আঘাত করেছিল। বিশ্বায়ন ও এর সাথে চূড়ান্ত ভোগবাদের ফলে নারীদের যে মাত্রায় পণ্যায়ন ঘটেছে তা আগে শোনা যায়নি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতি কোনো ধরনের সম্মান না দেখিয়ে প্রসাধনী শিল্প, পর্যটন ও বুর্জোয়া গণমাধ্যম এমনভাবে নারীদের মর্যাদার হানি করেছে যা পূর্বে কখনো ঘটেনি। এর সাথে গণ দারিদ্র্য যোগ হয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে দেহব্যবসার দিকে ঠেলে দিয়েছে যেমনটা ঘটেছে পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, নেপাল ইত্যাদি স্থানে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং বিভিন্ন উপদলের উত্থান যা নারীদের আরেকটি অংশকে প্রাচীন অন্ধকার যুগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই দুই চরমপন্থীর মাঝখানে চাপা পড়ে নারীরা আজ তাদের পুরুষ প্রতিমূর্তির সাথে স্বাধিকারের, আত্মমর্যাদার ও সমতার প্রয়োজনীয়তা আগের থেকে অনেক বেশী করে অনুভব করছে। সুতরাং, আজ ৮ই মার্চের তাৎপর্য্য আরো বেশী। সংশোধনবাদী ও বুর্জোয়া উদারবাদীরা সহানুভূতিশীল ত্রাতার ভূমিকায় অভিনয় করে ও ছদ্ম ‘উদ্বিগ্নতা’ দেখিয়ে নারীদের গৃহবন্দী করে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে স্তিমিত করার পায়তারা খোঁজে। তারা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামন্তীয় ধ্যানধারণার সাথে আপোষ করে আর নারীদের ক্ষমতায়ন ও স্বাধিকারকে ভয় পায়। অবশ্য এরাও রুটিনমাফিক নারী দিবস ‘উদযাপন’ করে এবং নিয়মিত ভণ্ডামিপূর্ণ বিবৃতি দেয়। সারা পৃথিবী জুড়ে বিপ্লবী শক্তি বিশেষ করে মাওবাদীরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মাঝে জীবনীশক্তি ফিরিয়ে এনেছে; দিনটিকে তারা আরো একবার সকল পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শোষণমূলক রীতি থেকে মুক্তির জন্য, আত্মমর্যাদার জন্য, সমতা ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভারত সহ সারা পৃথিবীর নিপীড়িত নারীদের মাঝে ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে এই বিপ্লবী চেতনা।"
২০০৮ সালের ১২ এপ্রিল কমরেড অনুরাধা ফেলসিফেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বিহার ঝাড়খন্ডের গেরিলা অঞ্চলের কিছু পার্টি কাজ সেরে ফিরে আসার পর জ্বরে আক্রান্ত হন। ৬ এপ্রিল তার উচ্চমাত্রার জ্বর থাকার পরও গোপন জীবনের জটিলতার কারণে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পারেননি। স্থানীয় প্যাথলজিস্টের ভুল রক্ত পরীক্ষার ফলাফলের কারণে ভুল চিকিৎসা হয়। অন্য একটি রক্ত পরীক্ষায় ১১ এপ্রিল যখন জানা যায় তিনি ফেলসিফেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত, তখন তাকে দ্রুত মুস্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হলেও সেটা ছিল তার শেষ মুহূর্ত। কষ্ট সহিষ্ণু বৈশিষ্ট্যের কারণে বাইরে থেকে তখনো তাকে ভালো দেখা গেলেও ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া ইতিমধ্যেই তার হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও কিডনী আক্রমণ করে ফেলে এবং এক ঘন্টার মধ্যে তার সকল অঙ্গের কার্যক্রম বিকল হওয়া শুরু হয়। প্রথমে অক্সিজেন এবং পরে লাইফ সাপোর্ট ব্যবস্থা দেয়া হলেও পরের দিন সকালে তার জীবনাবসান ঘটে। ১৯৫৪ সালে অনুরাধা মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সিপিআই মুম্বাই অফিসে তার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল। ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা পার্টিতে সক্রিয় ছিলেন। তার বাবা গণেশ শনবাগ একজন উকিল ছিলেন। তিনি পার্টির নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্য ছিলেন এবং তেলেঙ্গানার সংগ্রামে গ্রেফতারকৃত কমিউনিস্টদের মামলার স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন। মা কুমুদ শনবাগ সমাজকর্মী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন। শেষ বয়সে তিনি একটি নারী দলের সাথে জড়িত ছিলেন। অনুরাধার ভাই ছিলেন মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট নাট্যকার। অনুরাধা সান্তাক্রুজে জেবি ক্ষুদে স্কুলের মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ক্লাসে তিনি সর্বদা শীর্ষ অবস্থানে থাকতেন। সেখানে তিনি ধ্রুপদী নাচ শিখেছিলেন। স্কুলটিতে শিশুদের জ্ঞান বিকাশের জন্য নানাবিধ বিষয়ে অধ্যয়নকে উৎসাহিত করা হতো। এ ধরনের পরিবেশের কারণে তিনি রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পান এবং সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ও বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সেসময় চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিরাট প্রভাব, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের গণযুদ্ধের ঐতিহাসিক অগ্রগতির সংবাদ বিশ্বব্যাপী যুব সমাজকে আন্দোলিত করেছিল এবং সেই আন্তর্জাতিক বিদ্রোহ, বিপ্লবের মধ্যে নকশালবাড়ীর সশস্ত্র গণ উত্থানের বিস্ফোরণ সমগ্র ভারতব্যাপী এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল। কমরেড অনুর ওপর এসকল দেশীয়-আন্তর্জাতিক আন্দোলনের প্রভাব পড়ে।মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৭২ সালে অনুরাধা বিপ্লবী জীবন শুরু করেন। সেসময় কলেজটি বামপন্থী বিপ্লবী কর্মীদের প্রাণকেন্দ্র ছিল। তখন একদল ছাত্রছাত্রীর সাথে যুদ্ধ আক্রান্ত বাংলাদেশীদের শরণার্থী শিবির এবং মহারাষ্ট্রের দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকাগুলো দেখে তিনি স্পর্শকাতর হয়ে পড়েন এবং তখন থেকে কলেজের ও সমাজের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে তিনি গরীবদের সাথে অংশ নিতেন। এ প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের মধ্যে যখন তিনি সক্রিয় তখন নকশাল আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত ছাত্র সংগঠন ‘প্রগতিশীল যুব আন্দোলন’ এর সংস্পর্শে আসেন। শীঘ্রই এর সক্রিয় সদস্য এবং পরে এর নেতৃত্ব দেন। তিনি বস্তিতে কাজ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথমে দলিত আন্দোলন ও অস্পৃশ্যতার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি দলিত প্যান্থার আন্দোলনে যোগ দেন এবং মহারাষ্ট্রের ওররলিতে তিন মাস স্থায়ী দাঙ্গায় শিবসেনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Dalit_Panthers
তিনি দলিত নিপীড়নের মর্মবেদনায় উদ্বেলিত হন এবং তার প্রতিকারের প্রচেষ্টায় ব্রতী হন। ১৯৭০ এর দশকে যুদ্ধ, দাঙ্গায় আক্রান্ত দরিদ্র, নিপীড়িত দলিত জনগণের অধিকার রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় অনুরাধা প্রথমে মাওবাদী ছাত্র রাজনীতি, সিভিল লিবার্টিজ মুভমেন্ট ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির সামনের সারিতে চলে আসেন এবং ব্যাপকভাবে মার্কসবাদ অধ্যয়ন করেন। মহারাষ্ট্রে সিপিআই (এমএল) পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসেবে ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৮০ এর দশকে সিপিআই (এম-এল)(পি.ডব্লিউ) সর্বপ্রথম গডচিরোলী থেকে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। মুম্বাই থেকে বিদর্ভ অঞ্চলে বিপ্লবী তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পার্টির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তিনি উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তি জীবন ও মুম্বাই কলেজের চাকরি ত্যাগ করে সম্পূর্ণ অচেনা নাগপুরে স্থানান্তরিত হন। বিদর্ভ অঞ্চলে তার কাজের প্রকাশ্য দিক ছিল প্রাথমিকভাবে ট্রেড ইউনিয়ন ও দলিতদের মধ্যে সংগঠন ও আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা। ট্রেড ইউনিয়নে তিনি প্রথমে নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে সেখানে বহু জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট করেছিলেন। খাপার খোলার থর্মোল পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের সময় সেখানে প্রায় ৫,০০০ শ্রমিক কাজ করতেন। পুলিশের গুলি এবং অঞ্চল জুড়ে কারফিউ জারি করে রাষ্ট্র আন্দোলনকে দমন করে। তিনি নাগপুরের গৃহপরিচারক, হিংনার এসআইডিসি কোম্পানির শ্রমিক, রেলওয়ে শ্রমিক, ভান্দারার বিড়ি শ্রমিক, কাম্পতির পাওয়ার লুম শ্রমিক এবং অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করার সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরে কয়লাখনি শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিকদের সাহায্য করার জন্য তিনি চন্দপুরে স্থানান্তর হন। এসকল অসংগঠিত শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত ট্রেড ইউনিয়ন করার কোনো অধিকার ছিল না এবং প্রচলিত ইউনিয়নগুলো এসকল শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে যেতো। তিনি চন্দপুর, অমরাবতী, জবলপুর, ইরাটমাল প্রভৃতি এলাকায় অন্যান্য প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সাথে যৌথ তৎপরতা বিকশিত করেন। এই সংগ্রামে তিনি কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং কিছুদিন নাগপুর জেলে কাটিয়েছেন। চাকরি থাকার পরও তিনি এ অঞ্চলের একজন বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আরো বেশী সক্রিয় ছিলেন দলিত সম্প্রদায়কে প্রচলিত শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে তাদের স্বাধীনতা ও জাত-পাতের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও জাগরিত করার জন্য। তিনি বিপ্লবী মার্কসবাদীদের একজন যিনি সর্বপ্রথম দলিত ও জাত-পাত ইস্যুর বিশেষত্বকে চিহ্নিত করেন। জাত-পাত প্রশ্নে তিনি আম্বেদকর এবং অন্যান্য সমাজ বিজ্ঞানীদের লেখা ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেন। তথাকথিত মার্কসবাদীদের মতো গতানুগতিক না থেকে দলিত ইস্যুর বিশেষত্ব উপলব্ধি করার পর তিনি বসবাসের জন্য মহারাষ্ট্রের দলিতদের বৃহৎ অঞ্চল নাগপুরে চলে যান। যদিও এখানে দলিত রাজনীতি এবং অধিকাংশ দলিত নেতাদের শক্তি ও তাদের বিকাশের উপযুক্তু ভিত্তি ছিল, তারপরও অনুরাধার তৎপরতায় যুবকদের একটি বড় অংশ মাওবাদীদের প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হতে থাকে। বিশেষত সাংস্কৃতিক দল সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। দলিত আন্দোলনে তিনি মাওবাদীদের প্রকাশ্যমুখ এবং বিদর্ভ অঞ্চলের অধিকাংশ দলিত জনসভার বক্তা হয়ে উঠেছিলেন। যদিও দলিত নেতাদের দ্বারা প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু আম্বেদকর, দলিত ইস্যু ও জাত-পাতের নিপীড়নের প্রশ্নে তার গভীর অধ্যয়ন থাকায় তিনি টিকে থাকতে পেরেছিলেন এবং যুবকদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। তিনি নাগপুরে বিপ্লবী নারী আন্দোলন গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখেন। সমাজের পিতৃতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের জন্য যেসকল নারী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের কাছে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি নারীদের বড় একটি অংশকে শুধু নারী সংগঠনে নয়, পার্টিতেও যোগদানের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তিনি অসংখ্য উত্তরাধুনিকতাবাদী প্রবণতা এবং দলিত ও জাত-পাত প্রশ্নে মার্কসবাদীদের ভুল ব্যাখ্যার পাল্টা শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিগত বিষয় তুলে ধরে ইংরেজী ও মারাঠী উভয় ভাষায় প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। দলিত প্রশ্নে ২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধে মার্কসবাদী অবস্থান তুলে ধরে দলিতদের স্বাধীনতাকে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাথে যুক্ত করে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি হচ্ছেন সেই কমরেড যিনি বহুবছর আগে ভারতের মার্কসবাদী আন্দোলনে পূর্বতন সিপিআই (এম-এল)(পি.ডব্লিউ)-র জাত-পাত প্রশ্নে প্রথম নীতিগত খসড়া দলিল উপস্থিত করেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন আভিজাত্যবাদী জাত-পাতের প্রথাকে চূর্ণ না করে এবং এর নগ্নরূপ অস্পৃশ্যতার আকারে দলিতদের ওপর নানাবিধ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে ভারতে গণতন্ত্রায়ন অসম্ভব। এ প্রশ্নে ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি প্রচুর ব্যাখ্যা করেন। যেগুলো পরে সিপিআই (মাওবাদী)’র কংগ্রেসে গ্রহণ করা হয়। দু'টো ক্ষেত্রের এসকল কাজ ছাড়াও নাগপুরে এমন অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে যেগুলোর প্রবর্তক ছিলেন কমরেড অনুরাধা। নির্দিষ্টভাবে এ জাতীয় দু'টো ঘটনার উদাহরণ উল্লেখ করা যায় যেখানে বিদর্ভের জনগণের সচেতনতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিলো। প্রথমটি ছিল ১৯৮৪ সালে কমলাপুর সম্মেলন এবং দ্বিতীয়টি ১৯৯২ সালে গদ্দরের নেতৃত্বে জননাট্যমন্ডলী(জ ন ম) এর অনুষ্ঠান। কমলাপুর সম্মেলনটি এ অঞ্চলে মাওবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় গডচিরোলীর গভীর জঙ্গলে সংগঠিত করা হয়েছিল। সম্মেলনে উপস্থিতির জন্য অনুরাধার নেতৃত্বে বিদর্ভের সর্বত্র ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হয়েছিল। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে ব্যাপক সশস্ত্র স্কোয়াডের সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল। পুলিশ নির্মমভাবে দমন করে সম্মেলন ভেঙ্গে দিয়েছিল। তারপরও হাজার হাজার জনগণ গভীর জঙ্গলের গ্রাম কমলাপুরে যাওয়া শুরু করেছিল এবং মাসব্যাপী এ অঞ্চলের বিপ্লবী সংবাদ মিডিয়ার শিরোনাম আকারে প্রচারিত হয়েছিল। নাগপুরে গদ্দরের অনুষ্ঠানটি পুলিশের নির্মম দমনে ধ্বংস হয়ে যায়। তবুও ব্যাপক জনগণ ও প্রগতিশীলদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানের বিরাট প্রভাব পড়েছিল। এখানে বিরাট সংখ্যক সাংবাদিক, প্রভাষক, লেখক, আইনজীবী এবং সিনিয়র ফ্যাকাল্টি সদস্যদের সমাবেশ ঘটেছিল। তারা গদ্দরকে শীঘ্রই দেখার জন্য লাঠিতে আগুন জ্বেলেছিল। অনুষ্ঠানটি হতে না পারলেও প্রায় দু’মাস এ নিয়ে পত্রিকায় শিরোনাম করে সংবাদ এসেছে। সমগ্র বিদর্ভ অঞ্চলে বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়ানোর ক্ষেত্রে এ সকল ঘটনাবলী বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল এবং কমরেড অনুরাধা ছিলেন উভয় অনুষ্ঠানের স্থপতি। তিনি তার ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। যিনি একটি লেকচারও মিস না করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। অধ্যাপনাকেও কাজ হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। তিনি এখানে ধারাবাহিকভাবে থাকতেন। ছাত্ররা তাকে খুব ভালবাসতো এবং সহকর্মী অধ্যাপকগণ তাকে সম্মান করতেন। পরবর্তীতে পুলিশের চাপের বিবেচনায় পার্টি তাকে গোপন জীবনে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেয়। ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি গোপন জীবনের সকল জটিলতাকে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিন বছর দন্ডকারণ্যের জঙ্গলে সশস্ত্র স্কোয়াড সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। সিপিআই (এম-এল)(পি.ডব্লিউ)’র মহারাষ্ট্র রাজ্য শাখার সম্পাদক এবং এর ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে সিপিআই (মাওবাদী) নবম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। বিদর্ভ অঞ্চলে দেড় দশক বিপ্লবী রাজনীতির অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তিনি প্রচুর প্রভাব সৃষ্টি করেন। অন্যদের সাথে একত্রে শ্রমিক শ্রেণি ও দলিতদের মধ্যে শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন; ছাত্রদের বিপ্লবী আন্দোলন, সিনিয়র অধ্যাপক, সাংবাদিক, উল্লেখযোগ্য নাটক লেখক, এ অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী সহ বুদ্ধিজীবীদের বিশাল অংশকে আকৃষ্ট করেছিলেন। নাগপুরে আসার পর অন্ধ্র প্রদেশের বিপ্লবী কবি চেরাবান্ডা রাজুর মৃত্যুর পর তার কবিতা মারাঠী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং এ অঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত মারাঠী কবির মাধ্যমে একটি অনুষ্ঠানে সংকলন আকারে প্রকাশ করেন। তার মারাঠী অনুবাদ সমগ্র মহারাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে বিক্রি হয় এবং বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে। গোপন পার্টি সংগঠকের কর্মপদ্ধতি বজায় রেখে গণনেতৃত্ব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ বিপ্লবী জীবনে অনুরাধাকে বিভিন্ন ভূমিকা নিতে হয়েছে। তিনি প্রথমদিকে বিদ্যার্থী প্রগতি সংগঠন, সিপিডিসার, এআইএলআরসি, এনবিএস, স্ত্রী চেতনা, অখিল মহারাষ্ট্র কমাগড় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য অসংখ্য গণসংগঠনের সহযোগী ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল ছাত্রদের ম্যাগাজিন 'কলম' এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, যে সংগঠনটির দেশব্যাপী প্রভাব ছিল। এই ম্যাগাজিনটি ইংরেজি এবং মারাঠী উভয় ভাষায় প্রকাশিত হতো। তিনি নাগপুর থেকে হিন্দিতে প্রকাশিত বিপ্লবী ম্যাগাজিন 'জনসংগ্রাম' এর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ভ্যানগার্ড, পিপলস মার্চের মতো ম্যাগাজিনে বিভিন্ন ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতেন। স্থানীয় মারাঠী পার্টি ম্যাগাজিন 'ঝিরানামা'র প্রকাশনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মূলত তাত্ত্বিক ও মতাদর্শগত রচনা লিখেছেন। তাছাড়া দলিত প্রশ্নে যেসকল মার্কসবাদী শত্রুভাবাপন্ন ও উত্তরাধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন তাদের খন্ডন করে অনেক লেখা লিখেছেন। তিনি সিপিআই (এম-এল)(পি.ডব্লিউ)’র জাত-পাত প্রশ্নে মূল খসড়া নীতিগত দলিল লিখেছেন। তিনি সিপিআই (মাওবাদী)’র নারী বিষয়ক নীতি প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন এবং পার্টির ৮ মার্চের বিবৃতির বহু খসড়া লিখেছেন। তার বেশীরভাগ মতাদর্শগত অবদান জাত-পাত ও দলিত নিপীড়ন এবং নারী আন্দোলনের বিভিন্ন প্রশ্নে, বিশেষত বুর্জোয়া নারীবাদের ওপর বিশদ বিশ্লেষণ মার্কসবাদী উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি মাওবাদী পার্টিতে নারী বিষয়কে কাঠামোগত রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত ছিল না এমন কোনো লেখা তিনি লিখেননি। ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি ভাষার তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। তার বহু প্রবন্ধ ও লেখা অন্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তিনি ইংরেজি, হিন্দি ও মারাঠিসহ অসংখ্য ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন; গুজরাটিতে ভালো ধারণা ছিল; তেলুগু, কন্নড় ও গোন্ডী ভাষা বুঝতেন। প্রখ্যাত লেখক অরুন্ধতি রায় বলেছেন-
"কমরেড অনুরাধার বর্ণনা একজন পাঠককে হ্যান্ড গ্রেনেডের মতো বিস্ফোরিত করতে পারে।"
তিনি অন্যত্র বলেছেন অনুরাধার লেখা পড়ে নারী প্রশ্নে মাওবাদীদের সম্পর্কে তার ভুল ধারণাকে সংশোধন করেছেন তিনি। কমরেড অনুরাধা পার্টির নীতিমালা ও অনুশীলনের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ভুলকে সমালোচনার ক্ষেত্রে খোলামেলা ছিলেন। পার্টি ফোরামে তিনি কোনো ইতস্তত না করে দৃঢ়ভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতেন। তিনি নারী প্রশ্নে পার্টির ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলদ্ধিতে ব্যাখ্যা করে নারী ফ্রন্টে পার্টির উপলব্ধি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রচুর অবদান রেখেছেন। তিনি পার্টির মধ্যে যদি কারো ভুল দেখতেন তবে যে কাউকে পার্টিতে তার পদ, স্তর ইত্যাদি গ্রাহ্য না করে সরাসরি সমালোচনা করতেন।
Comments