.....গান্ধী অনেক ভ্রমন করা একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। বিশ্বের অন্যপ্রান্তে বয়ে চলা বাতাস সম্পর্কে তাকে সজাগ থাকতে হতো। তিনি আফ্রিকানদের সম্পর্কে যখন এই মর্যাদাহানিকর শব্দগুলো লিখছিলেন, প্রায় সেই সময় ডব্লিউ.ই.বি. দু বইস 'দ্য সোল অফ দ্য ব্ল্যাক ফোক'-এ লিখেছিলেন:
"One ever feels this twoness - An American, a Negro; tow souls, two thoughts, two unreconciled strivings, two warring ideals in one dark body, whose dogged strength alone keeps it from being torn asunder."
গান্ধী যখন একটি ঔপনিবেশিক শাসকের সাথে একসঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় নৈরাজ্যবাদী এমা গোল্ডম্যান বলেছিলেন:
“শক্তির কেন্দ্রীভবনের ফলে দুনিয়ার সমস্ত নিপীড়িত জাতির মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক সংহতির অনুভূতি তৈরি হচ্ছে; একটা সংহতি, যা একজন আমেরিকান খনি শ্রমিকের সাথে তার স্বদেশবাসী শোষকের সাদৃশ্যের তুলনায়, কোনো আমেরিকান শ্রমজীবীর সাথে বিদেশে একই পেশায় নিযুক্ত তার ভাইয়ের সাথে সাদৃশ্যের বেশি করে প্রতিনিধিত্ব করে; একটা সংহতি, যা বিদেশী আক্রমণকে ভয় করে না, কারণ সেটা সমস্ত শ্রমিককে কাছাকাছি এনে দেবে, তখন তারা একসাথে তাদের মালিককে বলবে "যাও আর নিজেদেরকে হত্যা করো। আমরা তোমাদের জন্য এটা যথেষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে করেছি।”
পণ্ডিতা রমাবাঈ (১৮৫৮-১৯২২) গান্ধীর সমসাময়িক ছিলেন। তবে গান্ধীর মতো সহজাত সংস্কার তার ছিল না। যদিও তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছেন, পুরুষতন্ত্র ও বর্ণভেদের জন্য তিনি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি আ্যাঙ্গলিকান চার্চের সাথেও ঝগড়া বাঁধান। তিনি ভারতের বর্ণ বিরোধী ধারায় এক উল্লেখযোগ্য নাম হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকা ভ্রমণ করার সময় তার সাথে হ্যারিয়েট টুবম্যানের দেখা হয়, যিনি একসময় ক্রীতদাস ছিলেন। অন্য আর যাদের সাথে তার পরিচয় হয়েছে, তাদের সবার তুলনায় হ্যারিয়েটকে তিনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। আফ্রিকান লোকেদের প্রতি গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে দাঁড়িয়ে পণ্ডিতা রমাবাঈ হ্যারিয়েট টুবম্যান এর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছিলেন:
“হ্যারিয়েট এখনও কাজ করছেন। তার নিজের একটা ছোট্ট বাড়ি আছে, সেখানে তিনি আর তার স্বামী একসাথে থাকেন এবং তাদের নিজেদের লোকেদের জন্য একসাথে কাজ করেন। হ্যারিয়েট দীর্ঘদেহী এবং শক্তিশালী। তিনি আমাকে ভাল্লুকের মতো জড়িয়ে ধরেছিলেন আর এতো জোরে করমর্দন করেছিলেন যে, আমার দুর্বল ছোট্ট হাতে এখনও ব্যথা রয়ে গেছে!”
১৮৭৩ সালে জ্যোতিরাও ফুলে তার গোলামগিরি (Slaver) উৎসর্গ করেন:
“নিগ্রো দাসত্বের প্রতি মহত্তম অনিচ্ছা এবং আত্মত্যাগের নিষ্ঠাযুক্ত আমেরিকার সেই ভালো মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত বন্ধুত্বের স্মারক; আর ব্রাহ্মণদের কৃতদাসত্বের বাঁধন থেকে শুদ্র ভাইদের বন্ধনমুক্তি ঘটাতে আমার দেশবাসীরা তাদের মহান দৃষ্টান্তকে পাথেয় করুন, এ আমার আন্তরিক বাসনা।”
অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে ফুলে বিধবাদের পুনর্বিবাহের ও নারী শিক্ষার স্বপক্ষে প্রচারণা চালান, তিনি অচ্ছুতদের জন্য একটা স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসবের পাশাপাশি তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন “দাসদের মালিকরা তাদের সাথে ভারবাহী জন্তুর মতো আচরণ করতেন, প্রবল মারধর এবং ক্ষুধার মধ্যে রাখতেন” আর কিভাবে তারা “বলদের জায়গায় দাসদের জুতে, গনগনে রোদের মধ্যে মাঠে লাঙল টানতে বাধ্য করতেন।” ফুলে বিশ্বাস করতেন শূদ্র এবং অতিশূদ্ররা দাসত্ব বিষয়টা অন্য সকলের চেয়ে ভালো বোঝেন, কারণ “তাদের দাসত্বের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, অন্য কারো সেটা নেই; শূদ্ররা ব্রাহ্মণদের দ্বারা অধিকৃত এবং তাদের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।”
...............................................................................
গান্ধী যিনি অচ্ছুতদের মধ্যে ধর্মপ্রচারক সুলভ প্রোৎসাহ নিয়ে কাজ করেছেন, তারা নিজেরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করবে, এর জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে সেই সম্ভাবনার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তার হরিজন সেবক সংঘ জিডি বিড়লার অর্থ সাহায্যে চলতো - যেটা মন্দির প্রবেশাধিকার আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল, সেই সংঘে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের সদস্যরাই ছিলেন। মহাজন মজদুর সংঘ নামে মিল শ্রমিকদের যে ইউনিয়ন গান্ধী আহমেদাবাদে শুরু করেছিলেন সেখানে শ্রমিকরা, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন অচ্ছুত, তাদের কোনো পদাধিকার দেওয়া হতো না, তাদের নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার দেওয়া হতো না। ১৯৩১ সালে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধী বলেন:
"আমার অন্তরের বার্তায় আমি নিজেকে অচ্ছুতদের প্রতিনিধি বলে দাবী করছি।"
বইয়ের পিছনে 'পুনা প্যাক্ট' নিয়ে এস۔ আনন্দ নোটে উল্লেখ করেন, গান্ধী কংগ্রেসের এক অচ্ছুত প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে বলেন, যদি তাকে বলা হয় হরিজনরা স্টেট কাউন্সিল এবং পঞ্চায়েত বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব করবে, তিনি বলবেন সেই নীতি 'বিপদজনক'।
..........................................................................
অন্যদিকে তিনি তার 'Doctrine of Trusteeship' - এ বলেছেন, ধনীদের তাদের সম্পদ দখল করে রাখতে দেওয়া উচিত এবং বিশ্বাস রাখা উচিত যে সেটা তারা গরীব লোকের উপকারে ব্যবহার করবে - যাকে আমরা আজকের দিনে Corporate Social Responsibility (পুঁজিপতিদের সামাজিক কর্তব্য) বলি - এটাকে সম্ভবত গভীরভাবে মেনে নেওয়া যায় না।
..........................................................................
১৯১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মিলিটারি নেতা জন স্মার্টস এর সঙ্গে একটা মীমাংসা চুক্তি সই করার পর গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়েন। ভারতে ফেরার আগে তিনি লন্ডনে যান, সেখানে তাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জনসেবা (public service) করার জন্য 'কাইজার-ই-হিন্দ' অভিধায় পুরস্কৃত করা হয়। সাম্রাজ্যবাদ এবং বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম করলে কিভাবে তিনি এগুলো পেতে পারতেন?
........................................................................
৮ জানুয়ারি, ১৯২৫, ভাবনগরে, কাথিয়াওয়ার রাজনৈতিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে গান্ধী বলেন:
"যদি আমি কখনও কোনো পদ চাই, তাহলে আমি একজন ভাঙ্গির পদ চাইবো। ময়লা সাফ করা অত্যন্ত পবিত্র কাজ, একজন ব্রাহ্মণের জন্য, ভাঙ্গির জন্যও; প্রথমজন এই কাজের পবিত্রতা জেনে করে, দ্বিতীয়জন না জেনে। আমি উভয়কেই শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। এই দুইয়ের যে কারোর অনুপস্থিতিতে হিন্দু ধর্ম বিলোপ পেতে বাধ্য হবে। আমি এই কর্মপদ্ধতি পছন্দ করি; তাই আমি ভাঙ্গিদের পছন্দ করি। তাদের সাথে খাবার ভাগ করে খেতে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আমি আপনাদের তাদের সাথে আন্তঃভোজন বা আন্তঃবিবাহ করতে বলবো না। কিভাবে আমি আপনাদের সেই পরামর্শ দিতে পারি?"
..........................................................................
বাল্মীকিদের প্রতি গান্ধীর বিশেষ মনোযোগ, ভাঙ্গিদের কলোনিতে তার বহুল প্রচারিত যাতায়াত তাকে সুফল দিয়েছিল, তাদের প্রতি তিনি অনুকম্পা ও তাচ্ছিল্যের আচরণ করা সত্ত্বেও। ১৯৪৬ সালে যখন তিনি এমন এক কলোনিতে থাকছিলেন:
“তিনি সেখানে পরিদর্শনে যাওয়ার আগে অর্ধেকের বেশি আবাসিককে সরিয়ে ফেলা হয় এবং আবাসিকদের খুপরিগুলো ভেঙ্গে সেখানে পরিচ্ছন্ন নতুন কুটির বসানো হয়। কুটিরের দরজা এবং জানলাগুলো মাদুর দিয়ে ঢাকা দেওয়া হয়েছিল এবং গান্ধী যতক্ষণ সেখানে ছিলেন, মাদুরগুলিতে জল ছিটিয়ে রাখা হয়েছিল যাতে ঘর শীতল থাকে৷ স্থানীয় মন্দিরটা সাদা রং করে দেওয়া হয় আর ইট দিয়ে নতুন করে রাস্তা বানানো হয়।”
লাইফ ম্যাগাজিনের চিত্র সাংবাদিক মার্গারেট বার্ক হোয়াইটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গান্ধীর এই সফরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন বিড়লা কোম্পানির দীননাথ তিয়াং অচ্ছুৎ কলোনির এই উন্নতিকে ব্যাখ্যা করেন-
“গত কুড়ি বছর ধরে আমরা গান্ধীজীর স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খেয়াল রেখে চলেছি।”
স্কলার বিজয় প্রসাদ তার দিল্লীর বাল্মীকি কলোনির ইতিহাসে বলেছেন, ১৯৪৬ সালে মন্দির মার্গের বালীকি কলোনিতে গান্ধী যখন পরিদর্শনে এসেছিলেন, তখন তিনি সেই গোষ্ঠীর সাথে একসাথে খেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেছিলেন-
"তোমরা আমাকে ছাগলের দুধ পান করতে দিতে পারো, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি দাম দিয়ে কিনবো। তোমরা যদি ব্যগ্রভাবে চাও যে আমি তোমাদের তৈরী খাবার গ্রহণ করি, তাহলে এখানে এসো আর আমার জন্য খাবার রান্না করো।"
গান্ধীর দ্বিচারিতার কথা প্রবীণ বাল্মীকিরা এখনও স্মরণ করেন, কিন্তু সেটা একটা অস্বস্তির অনুভূতি থেকে। একজন দলিত গান্ধীজীকে কিছু বাদাম দিলে তিনি সেগুলো তার ছাগলকে খাইয়ে দেন এবং বলেন যে, ছাগলের দুধের মধ্যে ওগুলো পরে খেয়ে নেবেন। গান্ধীর বেশিরভাগ খাদ্য, বাদাম এবং দানা শস্য বিড়লা হাউজ থেকে আসতো; তিনি এগুলো দলিতদের থেকে নিতেন না।
............................................................................
১৯ শতকের শেষ এবং ২০ শতক শুরুর সময় যখন বিভিন্ন সংস্কারবাদী সংগঠনগুলি অচ্ছুৎ অধিবাসীদের ধর্মান্তর করছিল, তখন দক্ষিণপন্থা ছিল অন্য সবার চেয়ে বেশি ব্যগ্র। উদাহরণস্বরূপ, তিলকের শিষ্য এবং হিন্দু অধিকারের নায়ক ভি. ডি. সাভারকর ১৯২৭ সালে আম্বেদকার এর নেতৃত্বে হওয়া মাহার সত্যাগ্রহকে সমর্থন করেন। সেখানে আন্দোলনকারীদের দাবী ছিল, অচ্ছুৎদের সাধারণের ব্যবহার্য পানি ব্যবহারের অধিকার দিতে হবে। তাতে গান্ধীর সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল না। পুনা প্যাক্ট এর সইদাতা কারা ছিলেন? অনেকেই ছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে জি۔ ডি۔ বিড়লা গান্ধীর শিল্পপতি রক্ষাকর্তা ছিলেন, যিনি জীবনের বেশিভাগ সময়ে তাকে অর্থের জোগান দিতেন; পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য, একজন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ এবং হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা এবং সাভারকর, যিনি গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে অভিযুক্ত ছিলেন। তারা সকলেই জটিল পদ্ধতিতে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। বিড়লারা গান্ধীর পাশাপাশি আর্য সমাজের শুদ্ধি আন্দোলনেও অর্থের যোগান দিতেন। গান্ধী হত্যার পর আরএসএস যখন নিষিদ্ধ হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য বিড়লা আহ্বান জানান। ক্যারাভান পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ আরএসএস নেতা এবং ধর্মপ্রাণ গান্ধীবাদীর পুত্র স্বামী অসীমানন্দ, যিনি জেলে রয়েছেন সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ - যেখানে ৮০ জনের মতো মানুষ মারা যান - এছাড়াও একাধিক বিস্ফোরণের চেষ্টার দায়ে, বলেছেন গুজরাটে তার আশ্রমে কিভাবে প্রত্যেকদিন সকালে একতা মন্ত্র ভজন করার মধ্য দিয়ে ভক্তদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ তৈরি হতো, যেটা আহ্বান করেছেন আরএসএস এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবাদর্শীরা; গান্ধী, এম. এস. গোলওয়ালকর প্রমুখ। নরেন্দ্র মোদী তার হিংস্র বক্তব্যগুলির মধ্যে অনেকগুলি রেখেছেন গুজরাটের চমৎকার ও নতুন কনভেনশন হলে, যার নাম মহাত্মা মন্দির। ১৯৩৬ সালে গান্ধী The Ideal Bhangi নামে একটি অসামান্য প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি এটা বলে শেষ করেছেন যে - “একজন আদর্শ ভাঙ্গি যখন কাজ থেকে তার জীবিকা আহরণ করে, সেটা সংগ্রহ করাকেই একমাত্র পবিত্র কাজ মনে করে। সে সম্পদ জমানোর স্বপ্ন দেখতে পারে না।” সত্তর বছর পর তার কর্মযোগী বইয়ে (পরবর্তীতে বাল্মীকি সম্প্রদায় প্রতিবাদ করলে তিনি তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন) নরেন্দ্র মোদী বলেছেন-
“আমি বিশ্বাস করি না যে তারা শুধু জীবিকা আহরণ ধরে রাখার জন্য কাজ করেন। যদি তাই হতো তাহলে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই ধরনের কাজ চালু রাখতো না। কোনো না কোনো সময়, কেউ না কেউ আলোকপ্রাপ্ত হবে, তাদের (বাল্মীকিদের) কর্তব্য হলো ঈশ্বর ও সমস্ত সমাজের জন্য সুখ নিয়ে আসা; তাদের এই কাজটা করতে হবে যেটা ঈশ্বর তাদের অর্পণ করেছেন; আর এই কাজগুলোকে এগিয়ে চলতে হবে শতকের পর শতক জুড়ে অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপকে জারি রাখার জন্য।”
......................................................................
১৯০১ সালে বুয়র যুদ্ধের অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গান্ধী বলেন ইংরেজ এবং ভারতীয়দের মধ্যে আরও ভালো বোঝাপড়া তৈরির উদ্দেশ্যে নাতাল কংগ্রেস কিভাবে কাজ করতে পারে সে কথা। তিনি বলেন, তিনি একটা 'সাম্রাজ্যিক ভ্রাতৃত্বের' সন্ধানে আছেন, যেটা 'সাম্রাজ্যের সমস্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ'। সেটা হওয়ার ছিল না। বুয়ররা গান্ধীর রণকৌশল ও ভ্রাতৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ১৯০২ সালে তারা ব্রিটিশদের সাথে ভেরীনিগিং (Vereeniging) সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। সন্ধিপত্র অনুসারে ট্রান্সভালের বুয়র প্রজাতন্ত্র এবং স্বাধীন রাষ্ট্র অরেঞ্জ, ব্রিটিশ রাজমুকুটের সার্বভৌমত্বের অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশে পরিণত হয়। এর পরিবর্তে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশগুলিকে স্বশাসন দিতে রাজি হয়। বুয়ররা ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর প্রতিনিধিতে পরিণত হন। একসময়ের ভয়ঙ্কর বুয়র 'সন্ত্রাসবাদী' ইয়ান স্মাটস শিবির বদল করেন এবং অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। শ্বেতাঙ্গ লোকেরা নিজেদের মধ্যে শান্তি এনেছিল। তারা নিজেদের মধ্যে হীরা, সোনা এবং জমি ভাগ করে নেয়। কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয় এবং 'কালারড'রা তালিকার বাইরেই রয়ে যায়। গান্ধী নিরস্ত হননি। দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই তাকে আবার সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখা যায়। ১৯০৬ সালে জুলু নেতা বাম্বাথা কামাসিন্জার নেতৃত্বে নতুন করে ব্রিটিশদের ১ পাউন্ড পোল ট্যাক্স চাপানোর বিরুদ্ধে জুলুরা একটা অভ্যুত্থান ঘটান। জুলু এবং ব্রিটিশরা পুরনো শত্রু, এরা আগেও নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশরা জুলু রাজ্যে আক্রমণ করলে জুলুরা ব্রিটিশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেয়, আর এই বিজয় জুলুদের বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দেয়। আগ্নেয়াস্ত্রধারী ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা না করতে পারার ফলে পরের বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে জুলুরা জমি হারাতে এবং পরাস্ত হতে থাকে। তবুও তারা শ্বেতাঙ্গদের খামারে কাজ করতে অস্বীকার করে; সেই কারণেই ভারত থেকে জাহাজে করে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে আসতে হতো। সময়ে সময়ে বারবার জুলুরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বাম্বাথা বিদ্রোহের সময় জুলুরা বর্শা এবং গরুর চামড়ায় তৈরি ঢাল দিয়ে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা করেছিল। ১৯০৩ সাল থেকে গান্ধী ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন নামে চারটি ভাষায় একটা দৈনিক সংবাদপত্র চালু করেন; বিদ্রোহের খবর এসে পৌঁছানো মাত্র সেখানে তিনি ধারাবাহিকভাবে চিঠি প্রকাশ করতে থাকেন। (টাটা শিল্প সাম্রাজ্যের রতনজি জামসেদজি টাটা পত্রিকার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন) ১৯০৫-এর ১৮ নভেম্বরের চিঠিতে গান্ধী বলেন-
“মনে থাকা উচিৎ, বুয়র যুদ্ধের সময় ভারতীয়দের ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তা তারা যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় পালন করেছেন, এমনকি খুব কঠিন হওয়া সত্ত্বেও এম্বুলেন্সের কাজেও তারা অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। খোদ জেনারেল বাটলার প্রত্যয়িতভাবে জানিয়েছেন, নাতাল ইন্ডিয়ান স্বেচ্ছাসেবক এম্বুলেন্স বাহিনী কিভাবে তাদের কাজ করেছিল। একমাত্র যদি সরকার বুঝতে পারতেন কিভাবে একটা মজুদ বাহিনীর অপচয় হচ্ছে, তাহলে তারা সেটার সদ্ব্যবহার করতেন এবং ভারতীয়দের আসল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতেন।”
১৯০৬ সালের ১৪ এপ্রিল গান্ধী আবার ইন্ডিয়ান অপিনিয়নে লিখলেন (গুজরাটি থেকে অনুবাদ করা)-
“উপনিবেশের এই চরম দুর্দিনে আমাদের কর্তব্য কি? কাফিরদের (জুলুদের) এই বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত না অন্যায়, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। ব্রিটিশ শক্তির সৌজন্যে আমরা এই নাতালে আছি। আমাদের অস্তিত্ব এর ওপরেই নির্ভর করছে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো, প্রতিদানে যথাসাধ্য সাহায্য করা।পত্রপত্রিকাগুলিতে আলোচনা হচ্ছে, আসল যুদ্ধের সময় ভারতীয়রা কি ভূমিকা নেবে। এই পত্রিকার ইংরেজি কলামে আমরা ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছি যে, ভারতীয় সম্প্রদায় তাদের ভূমিকা নিতে প্রস্তুত; আর আমরা বিশ্বাস করি, বুয়র যুদ্ধের সময় আমরা যে ভূমিকা নিয়েছিলাম, আবার এখন আমরা সেই ভূমিকা নিতে পারবো।”
অবশেষে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়। বিদ্রোহের নেতা বাম্বাথা ধরা পড়েন এবং তার মাথা কেটে ফেলা হয়। চার হাজার জুলুকে হত্যা করা হয়, আরও কয়েক হাজার আহত এবং বন্দী হন। এমনকি এই সহিংসতা দেখে যুদ্ধবাজ উইনস্টন চার্চিলের (তখন তিনি সেক্রেটারি অফ স্টেট এর অধীনে ছিলেন) পর্যন্ত মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন-
“সেক্রেটারি অফ স্টেটকে এই বলে সতর্ক করা আমার কর্তব্য যে, এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চলতে থাকলে হাউস অফ কমন্সে সমর্থন হারানোর সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ বনাম শ্বেতাঙ্গদের এই লড়াইয়ের স্কোর বর্তমানে ৩৫০০ আর ৮।"
গান্ধী শ্বেতাঙ্গদের যুদ্ধ আর বাম্বাথা অভ্যুত্থানে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার জন্য কখনও দুঃখ প্রকাশ করেননি। তিনি এই বিষয়টি উপেক্ষা করেছিলেন। কয়েক বছর বাদে ইয়ারাওয়াদা সেন্ট্রাল জেলে বসে তার স্মৃতিকথা, সত্যাগ্রহ ইন সাউথ আফ্রিকা লিখেছিলেন; দু'টো গল্পই সেখানে নতুন করে উদ্ভূত ছিল। তখন থেকেই চারিদিকে দাবার ঘুঁটিগুলো বোর্ডে চলতে শুরু করেছিল। গান্ধী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তার নতুন বিচারে, বাম্বাথা বিদ্রোহে স্ট্রেচার বাহক বাহিনীর সত্য, অন্য 'সত্যে' বিবর্ধিত হয়েছিল-
"জুলু 'বিদ্রোহ' শুরু হওয়ার সাথে সাথে ট্রান্সভালের ভারতীয়দের উপর আরও বেশি অক্ষমতা চাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো। তাই আমি সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলাম স্ট্রেচার বাহকদের একটা বাহিনী গড়ে তোলার, যারা যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীকে সহযোগিতা করবে। বাহিনী মাসখানেক সক্রিয় পরিষেবা দিয়েছিল। সেখানে আমাদের অনেক জুলুর ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে হতো, এই কাজ পাঁচ দিন ছ'দিনের বেশি করা করা যেতো না এবং এর ফলে ভয়ংকর দুর্গন্ধ সহ্য করতে হতো। আমাদের এই কাজ ভালো লাগতো। জুলুরা আমাদের সাথে কথা বলতে পারতো না, কিন্তু তাদের আকার ইঙ্গিত এবং চোখের অভিব্যক্তি দেখলে মনে হতো তারা আমাদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং তাদের ত্রাতা রূপে দেখছে।”
মার খাওয়া, হেরে যাওয়া জুলুদের অতীত সম্বন্ধীয় ছবি বানাতে গিয়ে - একটা বোবা পশু, ঈশ্বরের শান্তির বার্তা বাহকদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে - সম্পূর্ণ মিথ্যে বলা হচ্ছে। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই বছরগুলোতে তার নিজের খবরের কাগজে জুলুদের সম্বন্ধে তার কি দৃষ্টিভঙ্গি বেড়িয়ে এসেছিল। গান্ধীর বাম্বাথা বিদ্রোহের পুনঃউদ্ভাবিত গল্পে পরাজিত জুলুরা তার আর একটি লক্ষ্যের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ালেন - সেটা হলো কৌমার্য:
“যখন আমি বাহিনীর সাথে কাজ করছিলাম, আমার মাথায় ভেসে বেড়ানো দু'টো ভাবনা এই সময় দৃঢ়ভাবে স্থিত হয়। প্রথমত, জীবনকে সেবায় সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার পিছনে যে উচ্চাকাঙ্খা কাজ করে, সেটা অবশ্যই কৌমার্যের আয়ুষ্কাল। দ্বিতীয়ত, তাকে দারিদ্রকে গ্রহণ করতে হবে সারা জীবনের ধ্রুব সাথী হিসাবে। সারাজীবন কোনো জীবিকার সাথে যুক্ত থাকা যাবে না, কারণ সেটা ব্যক্তিকে আটকাবে অথবা ছোট ছোট দায়িত্ব কিংবা বড় ঝুঁকি নেওয়ার প্রশ্নে তার মধ্যে দোদুল্যমানতা দেখা দেবে!”
দারিদ্র এবং কৌমার্য নিয়ে গান্ধীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় Phoenix Settlement (ফিনিক্স স্যাটেলমেন্ট)-এ; এই কমিউনিটি তিনি তৈরি করেন ১৯০৪ সালে। নাতালের কেন্দ্রভাগে যেখানে আখের খেত ছিল, ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা যেখানে কাজ করতো, সেখানে ১০০ একর জমির ওপর এটি তৈরি হয়৷ কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে কিছু ইউরোপিয়ান ছিলেন এবং বাকিরা ভারতীয় (চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বাদে), কিন্তু কোনও কালো আফ্রিকান ছিলেন না। সেপ্টেম্বর ১৯০৬, বাম্বাথা বিদ্রোহের মাত্র এক মাস পর বন্ধুত্ব এবং আনুগত্য স্বীকারের প্রস্তাব সত্ত্বেও গান্ধী আবার পথে বসলেন। ব্রিটিশ সরকার ট্রান্সভাল এশিয়াটিক ল' আ্যামেন্ডমেন্ট আইন পাস করলো। এটার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ব্যবসায়ীদের (যাদেরকে সাদা চামড়ার ব্যবসায়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো) ট্রান্সভালে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। প্রত্যেক এশীয়কে পরিচয়ের জন্য নাম নথীকরণ/রেজিস্টার করাতে হতো এবং আদেশানুসারে একটা আঙুলের ছাপ সম্বলিত সার্টিফিকেট পূর্ণ করে জমা দিতে হতো। অনথীভুক্ত লোকেরা বিতাড়িত হতে বাধ্য থাকতেন। সেখানে এর বিপরীতে আবেদন করার কোনো অধিকার ছিল না। এক সম্প্রদায় যার নেতা স্বপ্ন দেখছিলেন 'সাম্রাজ্যিক ভ্রাতৃত্বের', হঠাৎই তাদের মর্যাদা আবারও অধঃপতিত হলো - “দক্ষিণ আফ্রিকার আদিবাসী আর কালো চামড়ার লোকেদের থেকেও মর্যাদা নিচে নেমে গেলো।” গান্ধী সামনে দাঁড়িয়ে, সাহসিকতার সাথে প্রবাসী ভারতীয়দের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণঅগ্নিকুণ্ডে দু'হাজার মানুষ নিজেদের পাসগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন; গান্ধী নির্মমভাবে প্রহৃত হলেন এবং তাকে বন্দী করা হলো। আর তারপর তার দুঃস্বপ্নগুলো বাস্তব পরিণতি পেলো। যে ব্যক্তি কাফিরদের সাথে একই পথ দিয়ে ডাকঘরে প্রবেশ করাকে পর্যন্ত স্বীকার করতে পারতেন না, এখন তাকে বন্দী কুঠুরিতে তাদের সঙ্গেই কাটাতে হচ্ছিলো:
“আমরা সমস্ত কষ্ট স্বীকার করতে তৈরি ছিলাম, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। শ্বেতাঙ্গদের সাথে আমাদের এক শ্রেণীতে কেন রাখা হয়নি সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম, কিন্তু তাই বলে নেটিভদের স্তরে নামিয়ে তাদের সাথে আমাদের রাখাটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিলো আমাদের জন্য। তারপর আমি উপলব্ধি করলাম, ভারতীয়রা আমাদের পরোক্ষ প্রতিরোধটুকুও দ্রুত শুরু করতে পারেনি। এটা আরও একটা প্রমাণ সেই আপত্তিকর আইনের, যা ভারতীয়দের পুরুষত্বহীন করে দিতে চায়। এতে আমাদের অধঃপতন ঘটেছে কি ঘটেনি, সে প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও আমি অবশ্যই বলবো, এটা আরও ভয়ংকর। সমাজ ব্যবস্থার দিক দিয়ে দেখলে কাফিররা অসভ্য - যারা বন্দী তারা আরও বেশি অসভ্য। তারা বিরক্তিকর, ভীষণ নোংরা, অনেকটা পশুর মতো।”
এর এক বছর বাদে, দক্ষিণ আফ্রিকায় তার কাটানো কুড়ি বছরের মধ্যে ষোল বছর পার করার পর তিনি ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন-এ লিখেছিলেন, 'মাই সেকেন্ড এক্সপেরিয়েন্স ইন গাওল' (১৬ জানুরারী, ১৯০৯):
“আমাকে একটা সেলে একটা বিছানা দেওয়া হয়েছিল। সেই সেলে বেশিরভাগ বন্দীরাই কাফির এবং সেখানে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি ভয়ানক দুর্দশা ও ভয়ের সাথে সেই সেলে রাতটা কাটিয়েছিলাম। আমি ভগবৎ গীতা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটাই পড়ছিলাম। আমার সেই পরিস্থিতির সাথে তাৎপর্যপূর্ণ পদগুলি আমি পড়ছিলাম এবং সেগুলির মধ্যে ধ্যানস্থ হয়ে আমি নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। আমি এতোটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম কারণ, কাফির এবং চীনা বন্দীদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা বুনো, খুনে এবং ব্যভিচারী হয়ে ওঠতে পারে। তার (চৈনিক বন্দী) উপস্থিতি এদের মধ্যে জঘন্যতম ছিল। সে আমার বিছানার কাছে এসে আমায় খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলো। আমি স্থির হয়ে ছিলাম। তারপর সে বিছানায় শুয়ে থাকা এক কাফির এর দিকে গেল। তারা নিজেদের মধ্যে অশ্লীল রসিকতা বিনিময় করলো এবং তারপর একে অন্যের জননেন্দ্রিয় উন্মোচন করলো। আমি মানসিকভাবে স্থির প্রতিজ্ঞ হলাম, একটা বড় আন্দোলন করতে হবে যাতে ভারতীয় বন্দীদের কাফির বা অন্য কারো সাথে না থাকতে হয়। আমরা এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারি না যে, তাদের এবং আমাদের মধ্যে কোনও মিলের ক্ষেত্র নেই। তবুও তাদের সাথে যদি কেউ এক ঘরে শুতে চায়, তাহলে তার তাদের মতোই কাজ করবার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।”
জেলের ভিতর থেকে গান্ধী শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষের কাছে জেলের ভিতরে আলাদা ওয়ার্ডের জন্য আবেদন জানাতে শুরু করেন। তিনি পৃথকীকরণ করার যুদ্ধ শুরু করেছিলেন অনেকগুলি কারণে - তিনি আলাদা কম্বল চেয়েছিলেন, কারণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, “কাফিরদের মধ্যে নোংরাতম ব্যক্তির ব্যবহার করা কম্বল, কোনো ভারতীয়কে ব্যবহার করতে হতে পারে।" তিনি জেলে বিশেষভাবে ভারতীয় রুচির সাথে মানানসই খাবার চেয়েছিলেন - ভাতের সাথে ঘি এবং তিনি 'কাফির'দের পছন্দের খাবার, 'অন্ন পাপ' বলে খেতে অস্বীকার করেন। ভারতীয় বন্দীদের জন্য পৃথক শৌচাগারের দাবীতেও তিনি আন্দোলন করেন। কুড়ি বছর পর ১৯২৮ সালে এই সমস্ত সত্যগুলো সম্পূর্ণ অন্য গল্পে পরিবর্তিত হয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় এবং আফ্রিকানদের শিক্ষার পৃথকীকরণ নিয়ে এক প্রস্তাবের জবাবে গান্ধী লিখেছিলেন:
“এদেরকে ওদের থেকে আলাদা করার ভাবনার ক্ষেত্রে বলতে হয়, ভারতীয়দের সাথে আফ্রিকানদের খুব বেশি মিল রয়েছে। তারা আফ্রিকানদের সক্রিয় সহানুভূতি এবং বন্ধুত্ব ছাড়া কখনোই দক্ষিণ আফ্রিকায় টিকে থাকতে পারতো না। সাধারণ ভারতীয়রা কখনও নিজেদের আফ্রিকান ভাইদের প্রতি শ্রেষ্ঠত্বের ভাব পোষণ করেছেন, এমনটা আমি জানি না আর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে এমন কোনও আন্দোলন যদি ভিত্তি পেয়ে থাকে, তবে সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হবে।”
জওহরলাল নেহেরু বিশ্বাস করতেন দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণবর্ণ আফ্রিকানদের এবং ভারতীয়দের একসাথে শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিৎ। ১৯৩৯ সালে নেহেরুর সাথে দ্বিমত পোষণ করে গান্ধী আবারও নিজের স্ববিরোধীতা বজায় রেখে বলেন-
“কেউ যদি বান্টুদের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেন, তাতে বেশি কিছু যায় আসে না; ভারতীয়রা তাদের সাথে নিজেদের সাধারণ স্বার্থ মেলাতে পারে না।”
........................................................................
১৮৯৯ সালে রামকৃষ্ণ মঠের বিবেকানন্দ - ১৮৯৩ সালে শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যিনি সাধুর পোশাকে বক্তব্য রেখে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন-"হিন্দু ধর্ম ছেড়ে অনেকে চলে যাওয়ার ফলে একজন একজন করে শুধু মানুষ কমছে না, বরং শত্রুও বেড়ে যাচ্ছে।"
.....................................................................
হিসাবের খাতায় অচ্ছুৎ বর্ণকে 'হিন্দু' হিসাবে দেখানো হতো। আম্বেদকার এর মতে, ১৯৩০ সালে অচ্ছুৎদের সংখ্যা ছিল ৪৪۔৫ মিলিয়ন। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের সংখ্যা ছিল ৮۔৮ মিলিয়ন। বড় মাত্রায় অচ্ছুৎরা হিন্দু সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে গেলে, সংখ্যাগুরু 'হিন্দুদের' সর্বনাশ হতে পারতো। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দেশভাগের আগে অবিভক্ত পাঞ্জাবে, ১৮৮১ থেকে ১৯৪১-এর মধ্যে, বড় সংখ্যার নিপীড়িত বর্ণের মানুষ ইসলাম, শিখ ও খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করায়, হিন্দু জনসংখ্যা ৪৩۔৮ শতাংশ থেকে ২৯۔১ শতাংশে নেমে এসেছিল।
.................................................................
...গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে টাকার যোগান দিতো বিড়লা, টাটা এবং বাজাজের মত বড় বড় শিল্পপতিরা আর তিনি কখনও তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সচেষ্ট হননি। তাদের অনেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক টাকা কামিয়েছিল, আর এরপর তারা সকলে কাচের সিলিং ভাঙতে এগিয়ে এলেন। তারা ব্রিটিশ শাসন এবং নিজেদের বর্ণ ব্যবস্থার ঝাড়ুদারীতে বিরক্ত এবং আবদ্ধ ছিলেন। তাই তারা জাতীয় আন্দোলনের পিছনে নিজেদের বোঝা ছুঁড়ে ফেললেন। গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে আসেন, সেইসময় কর্তৃপক্ষের অভাবনীয় লাভ হলেও মিল শ্রমিকরা এর ফলে এতোটুকুও লাভবান হচ্ছিলেন না, ফলে তারা অশান্ত হয়ে ওঠেন এবং আহমেদাবাদের মিলগুলোয় বিদ্যুৎ গতিতে ধারাবাহিক ধর্মঘট চলতে থাকে। মিল মালিকেরা গান্ধীকে মধ্যস্থতা করতে বললেন। সেই সময়কালে শ্রমিক বিদ্রোহে গান্ধীর হস্তক্ষেপ করা নিয়ে আমি লিখেছি। তার শ্রমিক ইউনিয়নগুলো পরিচালনা এবং ধর্মঘট সম্পর্কে শ্রমিকদের প্রতি তার উপদেশ - এর বেশিরভাগই ভীষণ হতবুদ্ধিকর। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও বিখ্যাত গান্ধীবাদী 'বাস্তবধর্মীতা' খুবই অদ্ভুত কিছু বাঁক নিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৪ সালে পুনের কিছু দূরে টাটাদের বোম্বে মিলগুলির বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মুলসি ড্যাম বানানোর বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা যখন আন্দোলন করছিলেন, গান্ধী তাদের চিঠি লেখেন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেবার উপদেশ দিয়ে।
.................................................................
১৯২১ সালে গান্ধী 'নবজীবন' পত্রিকায় নিচের কথাগুলো লিখেন, যেগুলো গুজরাটি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন আম্বেদকার-
"জাতিবর্ণের আর এক নাম হলো নিয়ন্ত্রণ। বর্ণ আনন্দের সীমারেখা টেনে দেয়। বর্ণ একজন ব্যক্তির আনন্দের পশ্চাদ্গমন করে এবং সীমানা পেরোতে দেয় না। এর অর্থ - এক বর্ণ পৃথক বর্ণের খাদ্যগ্রহণ, বিবাহ ইত্যাদির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়۔۔۔۔এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, যারা বর্ণব্যবস্থা ধ্বংস করতে চায়, আমি তাদের বিরোধী।"
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Navjivan_(newspaper)
Comments