’দ্য ডক্টর এন্ড দ্য সেইন্ট’ বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি : (পর্ব-২)
....১৯০১ সালে বুয়র যুদ্ধের অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গান্ধী বলেন ইংরেজ এবং ভারতীয়দের মধ্যে আরও ভালো বোঝাপড়া তৈরির উদ্দেশ্যে নাতাল কংগ্রেস কিভাবে কাজ করতে পারে সে কথা। তিনি বলেন, তিনি একটা 'সাম্রাজ্যিক ভ্রাতৃত্বের' সন্ধানে আছেন, যেটা 'সাম্রাজ্যের সমস্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ'। সেটা হওয়ার ছিল না। বুয়ররা গান্ধীর রণকৌশল ও ভ্রাতৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ১৯০২ সালে তারা ব্রিটিশদের সাথে ভেরীনিগিং (Vereeniging) সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। সন্ধিপত্র অনুসারে ট্রান্সভালের বুয়র প্রজাতন্ত্র এবং স্বাধীন রাষ্ট্র অরেঞ্জ, ব্রিটিশ রাজমুকুটের সার্বভৌমত্বের অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশে পরিণত হয়। এর পরিবর্তে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশগুলিকে স্বশাসন দিতে রাজি হয়। বুয়ররা ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর প্রতিনিধিতে পরিণত হন। একসময়ের ভয়ঙ্কর বুয়র 'সন্ত্রাসবাদী' ইয়ান স্মাটস শিবির বদল করেন এবং অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। শ্বেতাঙ্গ লোকেরা নিজেদের মধ্যে শান্তি এনেছিল। তারা নিজেদের মধ্যে হীরা, সোনা এবং জমি ভাগ করে নেয়। কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয় এবং 'কালারড'রা তালিকার বাইরেই রয়ে যায়। গান্ধী নিরস্ত হননি। দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই তাকে আবার সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখা যায়। ১৯০৬ সালে জুলু নেতা বাম্বাথা কামাসিন্জার নেতৃত্বে নতুন করে ব্রিটিশদের ১ পাউন্ড পোল ট্যাক্স চাপানোর বিরুদ্ধে জুলুরা একটা অভ্যুত্থান ঘটান। জুলু এবং ব্রিটিশরা পুরনো শত্রু, এরা আগেও নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশরা জুলু রাজ্যে আক্রমণ করলে জুলুরা ব্রিটিশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেয়, আর এই বিজয় জুলুদের বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দেয়। আগ্নেয়াস্ত্রধারী ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা না করতে পারার ফলে পরের বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে জুলুরা জমি হারাতে এবং পরাস্ত হতে থাকে। তবুও তারা শ্বেতাঙ্গদের খামারে কাজ করতে অস্বীকার করে; সেই কারণেই ভারত থেকে জাহাজে করে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে আসতে হতো। সময়ে সময়ে বারবার জুলুরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বাম্বাথা বিদ্রোহের সময় জুলুরা বর্শা এবং গরুর চামড়ায় তৈরি ঢাল দিয়ে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা করেছিল। ১৯০৩ সাল থেকে গান্ধী ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন নামে চারটি ভাষায় একটা দৈনিক সংবাদপত্র চালু করেন; বিদ্রোহের খবর এসে পৌঁছানো মাত্র সেখানে তিনি ধারাবাহিকভাবে চিঠি প্রকাশ করতে থাকেন। (টাটা শিল্প সাম্রাজ্যের রতনজি জামসেদজি টাটা পত্রিকার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন) ১৯০৫-এর ১৮ নভেম্বরের চিঠিতে গান্ধী বলেন-
“মনে থাকা উচিৎ, বুয়র যুদ্ধের সময় ভারতীয়দের ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তা তারা যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় পালন করেছেন, এমনকি খুব কঠিন হওয়া সত্ত্বেও এম্বুলেন্সের কাজেও তারা অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। খোদ জেনারেল বাটলার প্রত্যয়িতভাবে জানিয়েছেন, নাতাল ইন্ডিয়ান স্বেচ্ছাসেবক এম্বুলেন্স বাহিনী কিভাবে তাদের কাজ করেছিল। একমাত্র যদি সরকার বুঝতে পারতেন কিভাবে একটা মজুদ বাহিনীর অপচয় হচ্ছে, তাহলে তারা সেটার সদ্ব্যবহার করতেন এবং ভারতীয়দের আসল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতেন।”
১৯০৬ সালের ১৪ এপ্রিল গান্ধী আবার ইন্ডিয়ান অপিনিয়নে লিখলেন (গুজরাটি থেকে অনুবাদ করা)-
“উপনিবেশের এই চরম দুর্দিনে আমাদের কর্তব্য কি? কাফিরদের (জুলুদের) এই বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত না অন্যায়, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। ব্রিটিশ শক্তির সৌজন্যে আমরা এই নাতালে আছি। আমাদের অস্তিত্ব এর ওপরেই নির্ভর করছে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো, প্রতিদানে যথাসাধ্য সাহায্য করা।পত্রপত্রিকাগুলিতে আলোচনা হচ্ছে, আসল যুদ্ধের সময় ভারতীয়রা কি ভূমিকা নেবে। এই পত্রিকার ইংরেজি কলামে আমরা ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছি যে, ভারতীয় সম্প্রদায় তাদের ভূমিকা নিতে প্রস্তুত; আর আমরা বিশ্বাস করি, বুয়র যুদ্ধের সময় আমরা যে ভূমিকা নিয়েছিলাম, আবার এখন আমরা সেই ভূমিকা নিতে পারবো।”
অবশেষে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়। বিদ্রোহের নেতা বাম্বাথা ধরা পড়েন এবং তার মাথা কেটে ফেলা হয়। চার হাজার জুলুকে হত্যা করা হয়, আরও কয়েক হাজার আহত এবং বন্দী হন। এমনকি এই সহিংসতা দেখে যুদ্ধবাজ উইনস্টন চার্চিলের (তখন তিনি সেক্রেটারি অফ স্টেট এর অধীনে ছিলেন) পর্যন্ত মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন-
“সেক্রেটারি অফ স্টেটকে এই বলে সতর্ক করা আমার কর্তব্য যে, এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চলতে থাকলে হাউস অফ কমন্সে সমর্থন হারানোর সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ বনাম শ্বেতাঙ্গদের এই লড়াইয়ের স্কোর বর্তমানে ৩৫০০ আর ৮।"
গান্ধী শ্বেতাঙ্গদের যুদ্ধ আর বাম্বাথা অভ্যুত্থানে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার জন্য কখনও দুঃখ প্রকাশ করেননি। তিনি এই বিষয়টি উপেক্ষা করেছিলেন। কয়েক বছর বাদে ইয়ারাওয়াদা সেন্ট্রাল জেলে বসে তার স্মৃতিকথা, সত্যাগ্রহ ইন সাউথ আফ্রিকা লিখেছিলেন; দু'টো গল্পই সেখানে নতুন করে উদ্ভূত ছিল। তখন থেকেই চারিদিকে দাবার ঘুঁটিগুলো বোর্ডে চলতে শুরু করেছিল। গান্ধী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তার নতুন বিচারে, বাম্বাথা বিদ্রোহে স্ট্রেচার বাহক বাহিনীর সত্য, অন্য 'সত্যে' বিবর্ধিত হয়েছিল-
"জুলু 'বিদ্রোহ' শুরু হওয়ার সাথে সাথে ট্রান্সভালের ভারতীয়দের উপর আরও বেশি অক্ষমতা চাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো। তাই আমি সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলাম স্ট্রেচার বাহকদের একটা বাহিনী গড়ে তোলার, যারা যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীকে সহযোগিতা করবে। বাহিনী মাসখানেক সক্রিয় পরিষেবা দিয়েছিল। সেখানে আমাদের অনেক জুলুর ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে হতো, এই কাজ পাঁচ দিন ছ'দিনের বেশি করা করা যেতো না এবং এর ফলে ভয়ংকর দুর্গন্ধ সহ্য করতে হতো। আমাদের এই কাজ ভালো লাগতো। জুলুরা আমাদের সাথে কথা বলতে পারতো না, কিন্তু তাদের আকার ইঙ্গিত এবং চোখের অভিব্যক্তি দেখলে মনে হতো তারা আমাদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং তাদের ত্রাতা রূপে দেখছে।”
মার খাওয়া, হেরে যাওয়া জুলুদের অতীত সম্বন্ধীয় ছবি বানাতে গিয়ে - একটা বোবা পশু, ঈশ্বরের শান্তির বার্তা বাহকদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে - সম্পূর্ণ মিথ্যে বলা হচ্ছে। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই বছরগুলোতে তার নিজের খবরের কাগজে জুলুদের সম্বন্ধে তার কি দৃষ্টিভঙ্গি বেড়িয়ে এসেছিল। গান্ধীর বাম্বাথা বিদ্রোহের পুনঃউদ্ভাবিত গল্পে পরাজিত জুলুরা তার আর একটি লক্ষ্যের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ালেন - সেটা হলো কৌমার্য:
“যখন আমি বাহিনীর সাথে কাজ করছিলাম, আমার মাথায় ভেসে বেড়ানো দু'টো ভাবনা এই সময় দৃঢ়ভাবে স্থিত হয়। প্রথমত, জীবনকে সেবায় সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার পিছনে যে উচ্চাকাঙ্খা কাজ করে, সেটা অবশ্যই কৌমার্যের আয়ুষ্কাল। দ্বিতীয়ত, তাকে দারিদ্রকে গ্রহণ করতে হবে সারা জীবনের ধ্রুব সাথী হিসাবে। সারাজীবন কোনো জীবিকার সাথে যুক্ত থাকা যাবে না, কারণ সেটা ব্যক্তিকে আটকাবে অথবা ছোট ছোট দায়িত্ব কিংবা বড় ঝুঁকি নেওয়ার প্রশ্নে তার মধ্যে দোদুল্যমানতা দেখা দেবে!”
দারিদ্র এবং কৌমার্য নিয়ে গান্ধীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় Phoenix Settlement (ফিনিক্স স্যাটেলমেন্ট)-এ; এই কমিউনিটি তিনি তৈরি করেন ১৯০৪ সালে। নাতালের কেন্দ্রভাগে যেখানে আখের খেত ছিল, ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা যেখানে কাজ করতো, সেখানে ১০০ একর জমির ওপর এটি তৈরি হয়৷ কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে কিছু ইউরোপিয়ান ছিলেন এবং বাকিরা ভারতীয় (চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বাদে), কিন্তু কোনও কালো আফ্রিকান ছিলেন না। সেপ্টেম্বর ১৯০৬, বাম্বাথা বিদ্রোহের মাত্র এক মাস পর বন্ধুত্ব এবং আনুগত্য স্বীকারের প্রস্তাব সত্ত্বেও গান্ধী আবার পথে বসলেন। ব্রিটিশ সরকার ট্রান্সভাল এশিয়াটিক ল' আ্যামেন্ডমেন্ট আইন পাস করলো। এটার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ব্যবসায়ীদের (যাদেরকে সাদা চামড়ার ব্যবসায়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো) ট্রান্সভালে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। প্রত্যেক এশীয়কে পরিচয়ের জন্য নাম নথীকরণ/রেজিস্টার করাতে হতো এবং আদেশানুসারে একটা আঙুলের ছাপ সম্বলিত সার্টিফিকেট পূর্ণ করে জমা দিতে হতো। অনথীভুক্ত লোকেরা বিতাড়িত হতে বাধ্য থাকতেন। সেখানে এর বিপরীতে আবেদন করার কোনো অধিকার ছিল না। এক সম্প্রদায় যার নেতা স্বপ্ন দেখছিলেন 'সাম্রাজ্যিক ভ্রাতৃত্বের', হঠাৎই তাদের মর্যাদা আবারও অধঃপতিত হলো - “দক্ষিণ আফ্রিকার আদিবাসী আর কালো চামড়ার লোকেদের থেকেও মর্যাদা নিচে নেমে গেলো।” গান্ধী সামনে দাঁড়িয়ে, সাহসিকতার সাথে প্রবাসী ভারতীয়দের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণঅগ্নিকুণ্ডে দু'হাজার মানুষ নিজেদের পাসগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন; গান্ধী নির্মমভাবে প্রহৃত হলেন এবং তাকে বন্দী করা হলো। আর তারপর তার দুঃস্বপ্নগুলো বাস্তব পরিণতি পেলো। যে ব্যক্তি কাফিরদের সাথে একই পথ দিয়ে ডাকঘরে প্রবেশ করাকে পর্যন্ত স্বীকার করতে পারতেন না, এখন তাকে বন্দী কুঠুরিতে তাদের সঙ্গেই কাটাতে হচ্ছিলো:
“আমরা সমস্ত কষ্ট স্বীকার করতে তৈরি ছিলাম, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। শ্বেতাঙ্গদের সাথে আমাদের এক শ্রেণীতে কেন রাখা হয়নি সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম, কিন্তু তাই বলে নেটিভদের স্তরে নামিয়ে তাদের সাথে আমাদের রাখাটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিলো আমাদের জন্য। তারপর আমি উপলব্ধি করলাম, ভারতীয়রা আমাদের পরোক্ষ প্রতিরোধটুকুও দ্রুত শুরু করতে পারেনি। এটা আরও একটা প্রমাণ সেই আপত্তিকর আইনের, যা ভারতীয়দের পুরুষত্বহীন করে দিতে চায়। এতে আমাদের অধঃপতন ঘটেছে কি ঘটেনি, সে প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও আমি অবশ্যই বলবো, এটা আরও ভয়ংকর। সমাজ ব্যবস্থার দিক দিয়ে দেখলে কাফিররা অসভ্য - যারা বন্দী তারা আরও বেশি অসভ্য। তারা বিরক্তিকর, ভীষণ নোংরা, অনেকটা পশুর মতো।”
এর এক বছর বাদে, দক্ষিণ আফ্রিকায় তার কাটানো কুড়ি বছরের মধ্যে ষোল বছর পার করার পর তিনি ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন-এ লিখেছিলেন, 'মাই সেকেন্ড এক্সপেরিয়েন্স ইন গাওল' (১৬ জানুরারী, ১৯০৯):
“আমাকে একটা সেলে একটা বিছানা দেওয়া হয়েছিল। সেই সেলে বেশিরভাগ বন্দীরাই কাফির এবং সেখানে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি ভয়ানক দুর্দশা ও ভয়ের সাথে সেই সেলে রাতটা কাটিয়েছিলাম। আমি ভগবৎ গীতা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটাই পড়ছিলাম। আমার সেই পরিস্থিতির সাথে তাৎপর্যপূর্ণ পদগুলি আমি পড়ছিলাম এবং সেগুলির মধ্যে ধ্যানস্থ হয়ে আমি নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। আমি এতোটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম কারণ, কাফির এবং চীনা বন্দীদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা বুনো, খুনে এবং ব্যভিচারী হয়ে ওঠতে পারে। তার (চৈনিক বন্দী) উপস্থিতি এদের মধ্যে জঘন্যতম ছিল। সে আমার বিছানার কাছে এসে আমায় খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলো। আমি স্থির হয়ে ছিলাম। তারপর সে বিছানায় শুয়ে থাকা এক কাফির এর দিকে গেল। তারা নিজেদের মধ্যে অশ্লীল রসিকতা বিনিময় করলো এবং তারপর একে অন্যের জননেন্দ্রিয় উন্মোচন করলো। আমি মানসিকভাবে স্থির প্রতিজ্ঞ হলাম, একটা বড় আন্দোলন করতে হবে যাতে ভারতীয় বন্দীদের কাফির বা অন্য কারো সাথে না থাকতে হয়। আমরা এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারি না যে, তাদের এবং আমাদের মধ্যে কোনও মিলের ক্ষেত্র নেই। তবুও তাদের সাথে যদি কেউ এক ঘরে শুতে চায়, তাহলে তার তাদের মতোই কাজ করবার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।”
জেলের ভিতর থেকে গান্ধী শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষের কাছে জেলের ভিতরে আলাদা ওয়ার্ডের জন্য আবেদন জানাতে শুরু করেন। তিনি পৃথকীকরণ করার যুদ্ধ শুরু করেছিলেন অনেকগুলি কারণে - তিনি আলাদা কম্বল চেয়েছিলেন, কারণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, “কাফিরদের মধ্যে নোংরাতম ব্যক্তির ব্যবহার করা কম্বল, কোনো ভারতীয়কে ব্যবহার করতে হতে পারে।" তিনি জেলে বিশেষভাবে ভারতীয় রুচির সাথে মানানসই খাবার চেয়েছিলেন - ভাতের সাথে ঘি এবং তিনি 'কাফির'দের পছন্দের খাবার, 'অন্ন পাপ' বলে খেতে অস্বীকার করেন। ভারতীয় বন্দীদের জন্য পৃথক শৌচাগারের দাবীতেও তিনি আন্দোলন করেন। কুড়ি বছর পর ১৯২৮ সালে এই সমস্ত সত্যগুলো সম্পূর্ণ অন্য গল্পে পরিবর্তিত হয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় এবং আফ্রিকানদের শিক্ষার পৃথকীকরণ নিয়ে এক প্রস্তাবের জবাবে গান্ধী লিখেছিলেন:
“এদেরকে ওদের থেকে আলাদা করার ভাবনার ক্ষেত্রে বলতে হয়, ভারতীয়দের সাথে আফ্রিকানদের খুব বেশি মিল রয়েছে। তারা আফ্রিকানদের সক্রিয় সহানুভূতি এবং বন্ধুত্ব ছাড়া কখনোই দক্ষিণ আফ্রিকায় টিকে থাকতে পারতো না। সাধারণ ভারতীয়রা কখনও নিজেদের আফ্রিকান ভাইদের প্রতি শ্রেষ্ঠত্বের ভাব পোষণ করেছেন, এমনটা আমি জানি না আর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে এমন কোনও আন্দোলন যদি ভিত্তি পেয়ে থাকে, তবে সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হবে।”
জওহরলাল নেহেরু বিশ্বাস করতেন দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণবর্ণ আফ্রিকানদের এবং ভারতীয়দের একসাথে শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিৎ। ১৯৩৯ সালে নেহেরুর সাথে দ্বিমত পোষণ করে গান্ধী আবারও নিজের স্ববিরোধীতা বজায় রেখে বলেন-
“কেউ যদি বান্টুদের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেন, তাতে বেশি কিছু যায় আসে না; ভারতীয়রা তাদের সাথে নিজেদের সাধারণ স্বার্থ মেলাতে পারে না।”
.............................................................................
গান্ধী ২৪ বছর বয়সে লন্ডনের ইনার টেম্পল থেকে ওকালতির প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে ১৮৯৩ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান। তার পেশা ছিল এক ধনী গুজরাটি মুসলিম ব্যবসায়ীর আইনী উপদেষ্টার কাজ। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন তখন আফ্রিকা মহাদেশে নিজের ভিত শক্ত করছিল। সেখানে পৌঁছানোর কয়েক মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক জাগরণ গান্ধীকে ভীষণরকম নাড়া দেয়। গল্পের অর্ধেকটা মহাকাব্যিক - পিটারমারিৎজবার্গে ট্রেনের 'শুধু সাদাদের জন্য সংরক্ষিত' প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে গান্ধীকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। গল্পের অন্যভাগটা কম জানা - বর্ণভিত্তিক পৃথকীকরণের জন্য গান্ধী ক্ষুব্ধ হননি। তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ 'ভারতীয় যাত্রীদের' - ভারতীয় ব্যবসায়ীরা, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম, কেউ কেউ বর্ণ হিন্দু - যারা আফ্রিকায় ব্যবসা করতে এসেছেন, তাদের সাথে নেটিভ কালো আফ্রিকানদের মতো আচরণ করা হতো। গান্ধীর অভিযোগ ছিল, যে ভারতীয় যাত্রীরা নাতালে এসেছেন তারা ব্রিটিশ প্রজা এবং রানী ভিক্টোরিয়ার ১৮৫৮ সালের ঘোষণা বলছে সাম্রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের সমানাধিকারের কথা, সেই অনুযায়ী ভারতীয় যাত্রীদেরও সুব্যবহার পাওয়া উচিৎ। নাতাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের (এন.আই.সি.) প্রতিষ্ঠাতা এবং তহবিলের যোগানদার ছিলেন ভারতীয় ধনী ব্যবসায়ী এবং বেনিয়ারা। গান্ধী ১৮৯৪ সালে এর সম্পাদক হন। সদস্যপদের জন্যও তিন পাউন্ড দিতে হতো, অর্থাৎ এটা একটা উচ্চবিত্তের ক্লাব হয়েই রয়ে যায়। (তুলনা করে দেখুন - এর ১২ বছর পর জুলুরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ করেছিলেন, কারণ তাদের বিরুদ্ধে এক পাউন্ডের পোল ট্যাক্স বসানো হয়েছিল, যেটা দেওয়ার সামর্থ তাদের ছিল না।) এন.আই.সি. এর প্রথমদিককার রাজনৈতিক বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ডারবান ডাকঘর সমস্যার 'সমাধান'। ডাকঘরে ঢোকার মাত্র দু'টো রাস্তা ছিল - একটা কালোদের জন্য, অন্যটা সাদাদের জন্য। গান্ধী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রার্থনা করেন ডাকঘরে তৃতীয় একটা দরজা রাখার জন্য, যাতে ভারতীয়দের 'কাফির'দের সাথে একই পথ দিয়ে প্রবেশ করতে না হয়। ১৮৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর নাতাল আইনসভার কাছে একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে তিনি বলেন, ইংরেজ এবং ভারতীয় দু'জনেরই 'উদ্ভব ইন্দো-আর্যদের থেকে' এবং নিজের আবেদনকে শক্তিশালী করতে ম্যাক্স মুলার, আর্থার স্কোপেনহাওয়ার ও উইলিয়াম জোন্সকেও তিনি উদ্ধৃত করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, "ভারতীয়দের ঘৃণ্য কাফেরদের পর্যায়ে টেনে নামানো হচ্ছে”। ভারতীয় জনজাতির মুখপাত্র হিসাবে গান্ধী সর্বদা সতর্কভাবে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের সাথে ভারতীয় যাত্রীদের দূরত্ব ও পার্থক্য বজায় রাখতেন-
“তারা হিন্দু বা মুসলমান যা-ই হন না কেন, নামের সাথে যোগ্য কোনো ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। বাইরের সাহায্য ছাড়া নিজেদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য তারা যথেষ্ট পড়াশোনা করেননি। এইভাবে তারা অল্প লোভের জন্য মিথ্যা কথা বলতে পটু। কিছু সময়ের পর মিথ্যে কথা বলাটা তাদের স্বভাবে এবং রোগে পরিণত হয়। তারা কোনো কারণ ছাড়াই, নিজেদের বস্তুগত কোনো উন্নতির প্রত্যাশা ছাড়াই মিথ্যে বলেন, বাস্তবিকভাবে তারা কি করছেন এটাই জানেন না। তারা জীবনের এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছেছেন, যেখানে তাদের নৈতিক কর্মশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে তারা অবহেলার পাত্র হয়ে রয়েছেন।”
ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক, যাদের 'নৈতিক কর্মশক্তি' তলানিতে এসে ঠেকেছিল, তাদের বেশিরভাগই নিপীড়িত বর্ণের এবং বলতে গেলে তারা থাকতেন এবং কাজ করতেন প্রায় দাসেদের মতো, আখের ক্ষেতে অবরুদ্ধ থেকে। তারা মার খেতেন, অনাহারে কাটাতেন, কারারুদ্ধ হতেন, কখনও বা যৌন নিগ্রহের শিকার হতেন আর তাদের একটা বড় অংশ এ নির্যাতনে মারা যেতেন। গান্ধী দ্রুত ভারতীয় যাত্রীদের জন্য সবথেকে বিশিষ্ট মুখপাত্রে পরিণত হলেন। ১৮৯৬ সালে গান্ধী ভারতে বেড়াতে এসে জনপূর্ণ সভাস্থলে ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই সময় শ্বেতাঙ্গ শাসনব্যবস্থা ভারতীয় জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তাদের কাছে গান্ধী ছিলেন 'কুলিদের' নেতা; সমস্ত ভারতীয়দের এই নামেই ডাকা হতো। স্বেচ্ছাচারী অনুভূতিতে তাদের বর্ণবিদ্বেষ ব্যাপক আকার নিচ্ছিল; গান্ধী যে মহান উচ্চতা প্রাপ্ত হচ্ছেন এটা তারা খেয়াল করলেন না। গান্ধী ডারবানে পৌঁছনোর আগেই তার প্রচারের খবর চলে এসেছিল। গান্ধীর জাহাজ শক্রপক্ষীয় শ্বেতাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের সম্মুখীন হয়, যারা জাহাজটিকে ডকে প্রবেশের অনুমতি দিতে রাজি ছিল না। বেশ কিছুদিন আলাপ আলোচনা চালানোর পর গান্ধীর জাহাজ থেকে নামার অনুমতি মেলে। ১৮৯৭-এর ১২ জানুয়ারী বাড়ির পথে তিনি আক্রান্ত ও প্রহৃত হন। তিনি সাহসিকতা ও সম্ভ্রমের সাথে আক্রমণ সহ্য করে নেন। এর দু'দিন বাদে দ্য নাতাল এডভার্টাইজার এর সাথে সাক্ষাৎকারে পুনরায় গান্ধী 'কুলিদের' সাথে তার দূরত্বের কথা জানান-
“আমি জোরের সাথে প্যামফ্লেট এবং অন্যত্র বলেছি যে, নাতালে ভারতীয় চুক্তিবদ্ধদের সাথে যে ব্যবহার করা হয়, তা দুনিয়ার অন্য অংশের চেয়ে ভালো বা খারাপ কোনটাই নয়। আমি এটা কখনও দেখাতে উদ্যোগী হইনি যে, ভারতীয় চুক্তিবদ্ধরা এখানে কতটা বিদ্বেষমূলক ব্যবহার পাচ্ছে।”
১৮৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় লুণ্ঠনের দখলদারী নিয়ে ইংরেজরা ডাচ ঔপনিবেশিকদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৮৭০ সালে কিস্বারলিতে হীরা এবং ১৮৮৬-তে উইটওয়াটারস্র্যান্ডে সোনার সন্ধান পাওয়া যায়। তখন এই যুদ্ধকে বলা হতো এংলো-বুয়র যুদ্ধ, বর্তমানে এটা দক্ষিণ আফ্রিকান যুদ্ধ বা শ্বেতাঙ্গ মানুষের যুদ্ধ বলে পরিচিত। হাজার হাজার কালো আফ্রিকান এবং চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিককে বাধ্য করা হয়েছিল দু'পক্ষের বাহিনীতে যোগ দিতে। ভারতীয়দের হাতে অস্ত্র দেওয়া হতো না। তাদের কাজ করতে হতো পরিচারক বা স্ট্রেচার বাহক হিসেবে। গান্ধী এবং একদল প্রবাসী ভারতীয় অনুভব করেন, সাম্রাজ্যের প্রজা হিসাবে ব্রিটিশদের স্বেচ্ছায় সেবা করা তাদের কর্তব্য। গান্ধী এম্বুলেন্স বিভাগে নাম লেখান। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে বুয়র গেরিলাদের এই যুদ্ধ অত্যন্ত নৃশংস ছিল। এলাকা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য ব্রিটিশরা বুয়রদের হাজার হাজার ক্ষেত খামার জ্বালিয়ে দিতে থাকে, একই সাথে সাধারণ মানুষ ও গবাদি পশুদের উপর চলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। লক্ষাধিক বুয়র সম্প্রদায়ের মানুষকে, বিশেষত মহিলা ও শিশুদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অন্তত ৩০,০০০ মানুষ মারা যান। অনেকেই শুধুমাত্র না খেতে পেয়ে মারা যান। এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোই পরবর্তীকালে হিটলারের ইহুদী বিনাশ ক্যাম্পের পথ দেখিয়েছিল। বহু বছর বাদে ভারতে ফিরে আসার পর গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধ নিয়ে তার স্মৃতিকথায় লেখেন, তিনি বন্দীদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ক্যাম্পের মধ্যে খোশমেজাজে সত্যাগ্রহ অনুশীলন করতে (একই ধরনের উপদেশ তিনি জার্মানির ইহুদীদেরও দিয়েছিলেন)-
“বুয়র মহিলারা বুঝেছিলেন তাদের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের ধর্ম নির্যাতন স্বীকার করার দাবী করছে। আর তাই খোশমেজাজে, ধৈর্যের সাথে সমস্ত কষ্ট তারা সহ্য করেছিলেন। দগ্ধানো তাপ, ভয়ানক ঠাণ্ডা, ক্ষুধার যন্ত্রণা তারা সহ্য করেছেন। কখনও কখনও কোনও সৈন্য মাতাল অবস্থায় অথবা কামতাড়িত হয়ে অরক্ষিত মহিলাদের উপর শারীরিক নির্যাতনও করেছে। তবুও সেই সাহসী মহিলারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি।”
যুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশরা ঘোষণা করলো, সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেককে তাদের সাহসিকতার জন্য 'কুইনস চকলেট' ফলক দেওয়া হবে। গান্ধী ঔপনিবেশিক সম্পাদককে চিঠি লেখেন, যে সমস্ত এম্বুলেন্স কর্মীরা বেতন ছাড়া স্বেচ্ছা সেবার কাজ করেছেন, তাদেরকেও পুরস্কার দেওয়ার জন্য-
“এটা তাদের কাছে উচ্চ প্রশংসিত হবে এবং পুরস্কারটা বহুমূল্য হয়ে উঠবে যদি মহারাণীর অনুগ্রহে তৈরি হওয়া এই উপহার ভারতীয় নেতাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।”
ঔপনিবেশিক সম্পাদক চাঁছাছোলা ভাষায় জবাব দেন, চকলেট শুধুমাত্র নন-কমিশনড অফিসারদের দেওয়ার জন্য।
Comments