পশ্চিমারা কি আসলেই শ্রেষ্ঠ? (পর্ব-এক)
নোয়াম চমস্কির মতে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র নয়, রয়েছে পলিয়ার্কি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় জনসমষ্টির একটি ক্ষুদ্র অংশ রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মতো বিষয়ে মৌলিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আর বাদবাকি মানুষদের ধরে নেয়া হয় তারা থাকবে নীরব, হবে সাক্ষীগোপাল, তারা গণতন্ত্র ছেড়ে দেবে অভিজাতদের হাতে। 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' এর মতো আন্দোলনগুলো তার বক্তব্যের সত্যতাই প্রমাণ করে দেয়। তার মতে, পৃথিবীতে তিনটি পাওয়ার সেন্টার রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক, জার্মানিভিত্তিক পশ্চিমা বিশ্ব, জাপান ও চীনভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।
অন্যদিকে স্যামুয়েল হান্টিংটন এর মতো উগ্র ডানপন্থী বলেছেন সভ্যতার দ্বন্দ্বের কথা। হান্টিংটন মোট ৮টি সভ্যতার কথা বলেছেন যাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই নাকি নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার দিক নির্দেশনা দেবে! এগুলো হচ্ছে- পশ্চিমা সভ্যতা, কনফুসিয়াস, জাপানিজ, ইসলাম, হিন্দু, স্লাভিক-অর্থোডক্স, ল্যাটিন আমেরিকান এবং আফ্রিকান সভ্যতা।
তার মতে, আমেরিকা ও পশ্চিমের অন্যান্য দেশের বহু সংস্কৃতিবাদ তাদের জন্য বিপদ সংকেত নিয়ে আসে! এই লোকের মতে, "সভ্যতা হচ্ছে সংস্কৃতির সম্মেলন"। অঞ্চল, ধর্ম, জাতীয়তা, এথনোসিটি প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার সাথে আরব সভ্যতার পার্থক্য কোন যুক্তিতে করলেন? কিংবা জাপানি সভ্যতার সাথে কনফুসীয় সভ্যতার? কিংবা হিন্দুদের (বহু মনীষীর পরস্পর সাংঘর্ষিক চিন্তা ও ঐক্যমতের সমন্বয়ে গঠিত) সাথে প্রাচীন আর্যদের দেশগুলোর? কিংবা ল্যাটিন আমেরিকানদের (প্রায় সবগুলোই স্পেনের উপনিবেশ হওয়ায় খ্রিষ্ট ধর্ম থেকে শুরু করে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনেক উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেখানে) সাথে অন্যদের? আফ্রিকায় আরব সংস্কৃতি ও আফ্রিকান সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাঙালি মুসলমানরা আর্যদের ও আরবদের সংস্কৃতি যৌথভাবে পালন করে। সংস্কৃতির পারস্পরিক বিনিময় এর ঐতিহ্য জানতে ইয়স্তেন গার্ডারের 'সোফির জগৎ' বইটা চমৎকার রেফারেন্স। আরবদের নানা লেখা ইউরোপে অনুবাদিত হয়ে আলোকায়নের যুগের সূচনা করেছিল, আরবরা প্রাচীন ভারত থেকে অনেক কিছুই অনুবাদ করে উপকৃত হয়েছিল, ভারতীয়রা গ্রিক ও ব্যাবিলনীয়দের অনেক অনুবাদ কাজে লাগায়, প্রাচীন সিল্ক রোড কিংবা কটন রোড অসংখ্য জাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটিয়েছিল, গ্রিকরা আফ্রিকায় আলেকজান্ড্রিয়া লাইব্রেরি তৈরী করেছিল, রোমানরা এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল।
'মান্দারিন' শব্দটি সংস্কৃত 'মন্ত্রী' শব্দটি থেকে এসেছে যা প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মালয় হয়ে চীনে পৌঁছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mandarin_(bureaucrat)
...আর্যভট্ট তাকে বলতেন 'অর্ধ জ্যা (অর্ধেক রেখা)' ও 'জ্যা অর্ধ (রেখা অর্ধেক)' এবং তারপর সংক্ষেপে শুধুই 'জ্যা (রেখা)' ব্যবহার করতেন। জ্যা থেকে আরবরা ধ্বনি অনুসারে বার করলো জিবা, যেটা স্বর বাদ দিয়ে লেখার আরবি রীতি অনুযায়ী লেখা হলো জ্ব্। এখন প্রায়োগিক তাৎপর্যের বাইরে জিবা আরবিতে অর্থহীন শব্দ। পরবর্তী লেখকরা যখন অর্থহীন জিবা শব্দের সংক্ষিপ্ত চিহ্নরূপে জ্ব্ শব্দটি পেলেন, তারা তার বদলে সৃষ্টি করলেন জাইব, যাতে একই অক্ষর আছে অথচ যেটা 'খাড়ি' বা 'উপসাগর' অর্থের প্রচলিত আরবি শব্দ। আরও পরে জেরার্ড অব ক্রেমোনা (আনুমানিক ১১৫০) যখন আরবি থেকে তার তর্জমাগুলি করলেন, তিনি আরবি জাইব এর জায়গায় বসালেন সমার্থক লাতিন শব্দ, সাইনাস [অর্থ: খাড়ি বা উপসাগর], যার থেকে এলো আমাদের এখনকার শব্দ 'সাইন'।...
- এন ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য হিস্ট্রি অব ম্যাথমেটিক্স, হাওয়ার্ড ইভ্স
ইরান কিভাবে আরব সভ্যতার অংশ হয়? ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীদের যেই ধর্ম ইসলাম, তা অনেকগুলো নিয়ম এডপ্ট করেছে বাকি দুই আব্রাহামিক ধর্ম এবং প্যাগানদের কাছ থেকে এবং এই তিন আব্রাহামিক ধর্ম অনেক নিয়ম এডপ্ট করেছে জরাথ্রুস্ট ছাড়াও এই অঞ্চলের নানা প্রাচীন সভ্যতা থেকে। এজন্যই নূহ এর মিথ পাওয়া যায় গিলগামেশের মহাকাব্য থেকে শুরু করে সুদূর ল্যাটিন আমেরিকার আদিবাসীদের মাঝেও। একই কথা বলা যায় দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও। সেখানে কনফুসিয়াসের দর্শনের সাথে বিভিন্ন প্রাচীন মনীষীর দর্শন, বৌদ্ধ ধর্ম, এমনকি মার্ক্সবাদের সমন্বয় পর্যন্ত ঘটেছে।
হান্টিংটন বলেছেন সভ্যতাগুলো নাকি ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্ম দ্বারা পৃথক! অথচ বিবর্তনবাদ সংক্রান্ত গবেষণা থেকে প্রমাণিত আমাদের সকলের পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে আগত। এই উগ্র পুঁজিবাদের সমর্থকের কি আন্দাজে কথা বলার আগে ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাস কিংবা পশ্চিমা ও আরব ঔপনিবেশিকদের দ্বারা পরিচালিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিহাস মনে পড়েছিল? তিনি নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে পর্যাপ্ত পড়াশোনা যদি আদৌ করতেন তাহলে বলতেন না সভ্যতায় মানুষ, ঈশ্বর-মানুষ, ব্যক্তি-গোষ্ঠী, রাষ্ট্র-নাগরিক, সন্তান-মা বাবা, স্বামী-স্ত্রী প্রভৃতি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ ধারণ করে। তার বর্ণিত তথাকথিত প্রতিটি আলাদা সভ্যতার সাধারণ মানুষকে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে, নারীদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করতে হয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রাণ দিতে হয়েছে, ধর্মের পান্ডাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে।
হান্টিংটনের মতে এসব সভ্যতা নাকি স্বাধীনতা, সাম্য, কর্তৃত্ব, জবাবদিহিতা সম্পর্কেও ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ ধারণ করে! এই তথাকথিত 'ভিন্নতা' তাদের রক্ষণশীল দার্শনিক, ধর্মীয় গুরুদের দ্বারা তৈরী হয়েছে নাকি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট? তাহলে কনফুসীয় দর্শনকে পরাস্ত করে চীনের জনগণ কিভাবে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিল? স্লাভরা কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করতে পারলো অন্যদের সাথে মিলে? তথাকথিত একই সভ্যতার অংশ ইউরোপীয়রা দুই বিশ্বযুদ্ধে নিজেরা নিজেদের খুন করলো কেন? আরবরা কেন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নিয়োজিত? তিনি বলেছিলেন জাতীয় রাষ্ট্রভিত্তিক পরিচয়ে মানুষ দুর্বলতা অনুভব করে আর এই দুর্বলতাকে লোপ করে ধর্ম! তার দাবী সঠিক হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট যে কৃত্রিমভাবে পশ্চিমা ও মিত্র দেশগুলোর দ্বারা সৃষ্ট তা সর্বজনবিদিত। তাদের পা চাটা দালাল শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিও অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ সৃষ্টির প্রধানতম কারণ যা আরব বসন্ত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এর ফলশ্রুতিতেই ইউরোপে অভিবাসী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করতে পেরেছে 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা', 'ব্যক্তি স্বাধীনতা', 'ধর্মীয় স্বাধীনতা' ইত্যাদি গালভরা শব্দের আড়ালে। আর অন্যায় যুদ্ধগুলোর স্বপক্ষে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে।
মুসলিম প্রধান দেশগুলোর পারস্পরিক যুদ্ধকে তিনি হাস্যকরভাবে নাম দিয়েছেন 'মুসলিম যুদ্ধ' যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পশ্চিমাদের 'প্রক্সি ওয়ার' হিসেবে খ্যাত। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তালেবানদের মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সমর্থনের ব্যাপারটাও তার এই কথিত তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হলেও তালেবানদের যারা সৃষ্টি করেছে ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে তাদের অনেকেই ছিল পশ্চিমা ও অমুসলিম প্রধান দেশ। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম প্রধান প্রজাতন্ত্রগুলোর গন্ডগোলকেও একই সূত্রে ফেলার চেষ্টা করেছেন (আসল কারণ মাও আর স্তালিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ অনুসরণ না করা)! তার কি জানা আছে মধ্যপ্রাচ্যে কারা আইসিস এর অর্থায়নকারী এবং রুশ বম্বিং এর পর কারা তাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে? তার অতি বিখ্যাত (!) বইটিতে নানা গোঁজামিল দিয়ে এটাই বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পশ্চিমারা সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ। এই উগ্র তাত্ত্বিক আরও বলেছেন-
"যুক্তরাষ্ট্রকে এবং পাশ্চাত্যকে বাঁচাবার জন্য প্রয়োজন পাশ্চাত্য আত্মপরিচয়ের পুনরুজ্জীবন।"
তিনি তার বইটিতে দম্ভ সহকারে দাবী করে বলেছেন "আধুনিক হওয়ার অনেক আগে থেকেই পশ্চিম ছিল পশ্চিমই।" 'সামাজিক বহুত্ব', 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ' ছাড়াও তথাকথিত আরো নানা বৈশিষ্ট্য উঠে আসে হান্টিংটন কর্তৃক বর্ণিত পশ্চিমা দুনিয়ার ব্যাপারে। অথচ বিখ্যাত পশ্চিমা পন্ডিত অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলার তার 'দ্য ডিক্লাইন্ড অব দ্য ওয়েস্ট' গ্রন্থে প্রমাণ করে দিয়েছেন মানুষের তৈরী সভ্যতাগুলো একে অন্যের কাছে ঋণী।
হান্টিংটন পশ্চিমাদের সহিষ্ণুতা ও স্বাধীনতা প্রীতির উল্লেখ করলেও তিনি নাৎসিদের বর্বরতা কিংবা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর ঔপনিবেশিক আমলের কুকর্মের কথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই উল্লেখ করেননি। পাশের দেশ ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাছেও এই লোক অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এরা তার তত্ত্ব অনুযায়ীই ভারতকে 'হিন্দু সভ্যতা' হিসেবে প্রচার করে বেড়ায়। এই বিষয়ে কয়েকটা মিথ্যা প্রচারণা খণ্ডন করা যাক। এরা প্রচার করে যে ভারত থেকেই নাকি বিভিন্ন আর্য ভাষার উৎপত্তি হয়েছে এবং তারাই নাকি শূন্যের আবিষ্কারক!
শূন্য সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা আছে অভিজিৎ রায়ের 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব' বইটাতে।
হান্টিংটন পশ্চিমাদের কথিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার চিন্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথিত একচেটিয়া প্রাচীন ঐতিহ্যের দাবী করতে গিয়ে সম্রাট অশোক, সম্রাট আকবর কিংবা মধ্যযুগের বাংলার সুলতানি আমলের শাসকদের কথা লুকিয়েছেন। একই কাজ বর্তমানে করে যাচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা, যারা কিনা ভুলে যায় উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের অতীত অভিন্ন। আকবরের শাসনামলে ইউরোপে ইনকুইজিশনের বর্বরতা চলছিল। আকবর আবুল ফজলকে বলেছিলেন-
"যুক্তি অনুসরণ করা ও ঐতিহ্যবাদ প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজনটা এতো উজ্জ্বলভাবে প্রকট যে তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। যদি ঐতিহ্যবাদই সমীচীন হতো, ধর্মগুরুরা তো স্ব স্ব পূর্বগামীদেরই অনুসরণ করতেন এবং নতুন বার্তা নিয়ে আসতেন না।"
আকবর অমুসলিমদের উপর ধার্যকৃত 'জিজিয়া কর' ব্যবস্থা তুলে দিয়েছিলেন। তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিলেন। তার যুক্তি ছিল-
"বিয়ের যেটা উদ্দেশ্য সেটা তখনও অনেক দূরবর্তী এবং এর আশু সম্ভাবনাটি হচ্ছে ক্ষতিকর।"
আকবর আরও বলেছিলেন-
"যে ধর্মে বিধবা বিবাহ [হিন্দু ধর্ম] নিষিদ্ধ, সেখানে কষ্ট আরও বেশি।"
সম্পত্তির ভাগ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন-
"মুসলিম ধর্মে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কন্যার অংশ কম, যদিও তার দুর্বলতার কারণে তার অংশ বেশিই হওয়া উচিত ছিল।"
আকবরের দ্বিতীয় পুত্র মুরাদ যখন পিতার কাছে জানতে চান সব আচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে দেয়া উচিত কিনা, তখন আকবর বলেছিলেন-
"যে নির্বোধ মনে করে শারীরিক কসরৎ করলেই ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়, সে পথ বন্ধ করে দিলে তার ঈশ্বরকে স্মরণ করাই সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।"
আকবর আরও বলেছিলেন-
"আমার মতে, পুণ্যকর্মের সাধনের সময়ে মৃত্যুর কথা মনে আসাই উচিত নয়। এতে কোনও আশা ও আশঙ্কার কথা না ভেবেই কেবল ভালো বলেই শুভ কাজ করা যায়।"
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাম্রাজ্যের অধীন সব ক্রীতদাসদের মুক্তি দেয়ার সংকল্প করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন-
"শক্তি প্রয়োগের দ্বারা লাভবান হওয়া ন্যায়বিচার ও সদাচারের পরিপন্থী।"
শিরিন মুসভির 'Episodes in the life of Akbar' বইটিতে আকবরের যুক্তিবাদী মানসিকতার চমৎকার বিবরণ আছে।
আকবরের চিকিৎসক হাকিম আলী ধূমপানের বিরোধিতা করে বলেছিলেন-
"আমাদের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে প্রথা অনুমোদন করেননি, ইউরোপীয়দের অনুসরণ করে বিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তা গ্রহণ করতে হবে এমন কোনও কথা নেই।"
আকবর তখন পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন-
"পৃথিবীর মানুষ যা গ্রহণ করেছে, তেমন জিনিস আমাদের শাস্ত্রে লেখা নেই বলে আমরা কখনোই খারিজ করে দিতে পারি না। তাহলে আমাদের অগ্রগতি কি করে হবে?"
এরপর আকবর ধূমপান করে দেখলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই অপছন্দ করলেন। তিনি আর কখনও ধূমপান করেননি এরপর থেকে।
"বিয়ের যেটা উদ্দেশ্য সেটা তখনও অনেক দূরবর্তী এবং এর আশু সম্ভাবনাটি হচ্ছে ক্ষতিকর।"
আকবর আরও বলেছিলেন-
"যে ধর্মে বিধবা বিবাহ [হিন্দু ধর্ম] নিষিদ্ধ, সেখানে কষ্ট আরও বেশি।"
সম্পত্তির ভাগ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন-
"মুসলিম ধর্মে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কন্যার অংশ কম, যদিও তার দুর্বলতার কারণে তার অংশ বেশিই হওয়া উচিত ছিল।"
আকবরের দ্বিতীয় পুত্র মুরাদ যখন পিতার কাছে জানতে চান সব আচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে দেয়া উচিত কিনা, তখন আকবর বলেছিলেন-
"যে নির্বোধ মনে করে শারীরিক কসরৎ করলেই ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়, সে পথ বন্ধ করে দিলে তার ঈশ্বরকে স্মরণ করাই সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।"
আকবর আরও বলেছিলেন-
"আমার মতে, পুণ্যকর্মের সাধনের সময়ে মৃত্যুর কথা মনে আসাই উচিত নয়। এতে কোনও আশা ও আশঙ্কার কথা না ভেবেই কেবল ভালো বলেই শুভ কাজ করা যায়।"
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাম্রাজ্যের অধীন সব ক্রীতদাসদের মুক্তি দেয়ার সংকল্প করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন-
"শক্তি প্রয়োগের দ্বারা লাভবান হওয়া ন্যায়বিচার ও সদাচারের পরিপন্থী।"
শিরিন মুসভির 'Episodes in the life of Akbar' বইটিতে আকবরের যুক্তিবাদী মানসিকতার চমৎকার বিবরণ আছে।
আকবরের চিকিৎসক হাকিম আলী ধূমপানের বিরোধিতা করে বলেছিলেন-
"আমাদের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে প্রথা অনুমোদন করেননি, ইউরোপীয়দের অনুসরণ করে বিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তা গ্রহণ করতে হবে এমন কোনও কথা নেই।"
আকবর তখন পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন-
"পৃথিবীর মানুষ যা গ্রহণ করেছে, তেমন জিনিস আমাদের শাস্ত্রে লেখা নেই বলে আমরা কখনোই খারিজ করে দিতে পারি না। তাহলে আমাদের অগ্রগতি কি করে হবে?"
এরপর আকবর ধূমপান করে দেখলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই অপছন্দ করলেন। তিনি আর কখনও ধূমপান করেননি এরপর থেকে।
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ চৈতন্যদেবকে নিরুপদ্রবে ধর্ম প্রচারে সহযোগিতার জন্য কোতোয়ালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বৈদিক হিন্দু সাহিত্যের সবচেয়ে দার্শনিক অংশ উপনিষদের যে ফার্সি অনুবাদটি ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেটি ছিল মুঘল রাজপুত্র দারাশিকোর করা।
ক্রুসেডের বিখ্যাত মুসলিম বীর সালাউদ্দিন আইয়ুবি মিশরের সভায় অসহিষ্ণু ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া ইহুদি দার্শনিক মায়মোনায়ডিসকে সম্মানীয় স্থান দিয়েছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Maimonides
'দি অর্নামেন্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটিতে মারিয়া রোসা মেনোক্যাল দেখিয়েছেন দশম শতাব্দীর সময় মুসলমান শাসিত স্পেনে কর্ডোভার সুনাম জায়গাটিকে 'পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য স্থান' এর দাবিদার করে তুলেছিল। তার পিছনে ছিল তৃতীয় খলিফা আব্দ আল রহমান এবং তার ইহুদি উজির হাজদাই ইবনে শাপরুত এর যৌথ প্রচেষ্টার গঠনমূলক প্রভাব।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Abd_al-Rahman_III
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hasdai_ibn_Shaprut
https://drive.google.com/file/d/1Ywc-s3Yv-0Tji2H3sFtTVeYuHtKzGASP/view
লেখিকা আরও লেখেন-
"মুসলমানদের বিজয়ের পর ইহুদিদের অবস্থার সবদিক দিয়ে উন্নতি হলো, তারা অত্যাচারিত সংখ্যালঘু থেকে সুরক্ষিত সংখ্যালঘুতে পরিণত হলো।"
সম্রাট অশোক এরিস্টটলের মতো নারী ও ক্রীতদাসদের মৌলিক স্বাধীনতার দাবীর বাইরে রাখেননি। এমনকি তিনি এটাও বলেছিলেন-
"শহর থেকে দূরে যেসব প্রাক কৃষি সংস্কৃতির বনবাসীরা থাকে তাদেরও এইসব অধিকার দিতে হবে।"
বৈদিক হিন্দু সাহিত্যের সবচেয়ে দার্শনিক অংশ উপনিষদের যে ফার্সি অনুবাদটি ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেটি ছিল মুঘল রাজপুত্র দারাশিকোর করা।
ক্রুসেডের বিখ্যাত মুসলিম বীর সালাউদ্দিন আইয়ুবি মিশরের সভায় অসহিষ্ণু ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া ইহুদি দার্শনিক মায়মোনায়ডিসকে সম্মানীয় স্থান দিয়েছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Maimonides
'দি অর্নামেন্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটিতে মারিয়া রোসা মেনোক্যাল দেখিয়েছেন দশম শতাব্দীর সময় মুসলমান শাসিত স্পেনে কর্ডোভার সুনাম জায়গাটিকে 'পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য স্থান' এর দাবিদার করে তুলেছিল। তার পিছনে ছিল তৃতীয় খলিফা আব্দ আল রহমান এবং তার ইহুদি উজির হাজদাই ইবনে শাপরুত এর যৌথ প্রচেষ্টার গঠনমূলক প্রভাব।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Abd_al-Rahman_III
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hasdai_ibn_Shaprut
https://drive.google.com/file/d/1Ywc-s3Yv-0Tji2H3sFtTVeYuHtKzGASP/view
লেখিকা আরও লেখেন-
"মুসলমানদের বিজয়ের পর ইহুদিদের অবস্থার সবদিক দিয়ে উন্নতি হলো, তারা অত্যাচারিত সংখ্যালঘু থেকে সুরক্ষিত সংখ্যালঘুতে পরিণত হলো।"
সম্রাট অশোক এরিস্টটলের মতো নারী ও ক্রীতদাসদের মৌলিক স্বাধীনতার দাবীর বাইরে রাখেননি। এমনকি তিনি এটাও বলেছিলেন-
"শহর থেকে দূরে যেসব প্রাক কৃষি সংস্কৃতির বনবাসীরা থাকে তাদেরও এইসব অধিকার দিতে হবে।"
ভারতে অমুসলিমদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী আকবর বিশাল আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। মূল ধারার হিন্দু ও মুসলমান দার্শনিকরা (শিয়া, সুন্নি,সুফি) ছাড়াও খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, জৈন চার্বাকপন্থীদেরও তিনি এসব সভায় ডাকতেন।
প্রাচীন গ্রিসের পূর্ব ও দক্ষিণে যে সভ্যতাগুলো ছিল তারা পশ্চিমাদের বহু আগে গ্রিকদের গণতান্ত্রিক ধারণাকে গ্রহণ করে। তৎকালীন ইরান, ব্যাকট্রিয়া ও ভারতের কিছু নগর পৌর প্রশাসনে আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণার অনেকগুলো উপাদান ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের শুসান শহরে বহু শতক ধরে নির্বাচিত উপদেষ্টা পরিষদ, বিধায়কদের গণপরিষদ, উপদেষ্টাদের দ্বারা প্রস্তাবিত ও বিধায়কদের দ্বারা মনোনীত হাকিম নিয়ে প্রশাসন চালানো হতো।
আফ্রিকা মহাদেশের বিখ্যাত দুইজন নৃতত্ত্ববিদ মেয়ার ফর্বস এবং এডওয়ার্ড এভান্স প্রিচার্ড যৌথভাবে লেখা 'আফ্রিকান পলিটিক্যাল সিস্টেমস' এ লিখেছেন-
"আফ্রিকান রাষ্ট্রের অঙ্গবিন্যাস থেকে বোঝা যায় যে রাজা ও দলপতিরা জনতার সম্মতিতে রাজত্ব করেন।"
১৫২৬ সালে কঙ্গো এবং পর্তুগালের রাজাদের মধ্যে যখন পারস্পরিক সৌজন্যের বিনিময় চলছিল, তখন ক্রীতদাস প্রথা যে অসহনীয় সেই মত ব্যক্ত করেছিলেন কঙ্গোর রাজা, পর্তুগালের রাজা নয়। রাজা নজিংগা মবেমবা পর্তুগালের রাজাকে লিখেছিলেন-
"ক্রীতদাস প্রথা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কেননা আমরা চাই কঙ্গোর এইসব রাজ্যে ক্রীতদাস নিয়ে কোনও ব্যবসা যেন না চলে, ক্রীতদাসের কোনও বাজার যেন না থাকে।"
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Afonso_I_of_Kongo
"ক্রীতদাস প্রথা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কেননা আমরা চাই কঙ্গোর এইসব রাজ্যে ক্রীতদাস নিয়ে কোনও ব্যবসা যেন না চলে, ক্রীতদাসের কোনও বাজার যেন না থাকে।"
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Afonso_I_of_Kongo
অলডাস হাক্সলি'র 'পয়েন্ট কাউন্টার পয়েন্ট' উপন্যাসটিতে মৌর্য যুগের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উল্লেখ আছে।
রাধাকুমুদ মুখার্জির 'লোকাল গভর্নমেন্ট ইন এনশ্যেন্ট ইন্ডিয়া' বইটিতে প্রাচীন ভারতের স্থানীয় গণতান্ত্রিক শাসনের বিভিন্ন উদাহরণ আছে।
ইউরোপীয় সভ্যতার অগ্রগতিতে মুসলিমদের অবদানের বিস্তারিত বর্ণনা আছে ডেভিড লেভারিং লিউইস এর 'গড'স ক্রুসিবল: ইসলাম এন্ড দ্য মেকিং অফ ইউরোপ' বইটিতে।
ইংরেজ নাট্যকার থমাস কিড'কে ধর্ম অবমাননার দায়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছিল।
ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো'কে নাস্তিকতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং এর ১২ দিন পর মাত্র ২৯ বছর বয়সে ছুরি দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয় তাকে।
ইংরেজ নাট্যকার থমাস ন্যাশ'কে তার রচিত 'The Isle of Dogs' এর মাধ্যমে ব্রিটিশ রানী ও তার কর্মচারীদের ব্যঙ্গ করার কারণে কারাবরণ করতে হয়েছিল। তার নাটকটি প্রকাশের পরপরই গায়েব করে দেয়া হয়েছিল।
হেনরি ফিল্ডিং (Henry Fielding) এর রাজনৈতিক লেখনীর কারণে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র Theatrical Licensing Act চালু করেছিল। এই আইন অনুসারে যেকোনো সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করার পূর্বে তা সরকারিভাবে পরীক্ষা করা হতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Licensing_Act_1737
এডমান্ড স্পেনসার তার 'A View of the Present State of Ireland' এ বলেছিলেন আয়ারল্যান্ডকে ইংরেজরা কখনোই দমাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের স্বদেশী ভাষা ও আচার-প্রথাকে সহিংসভাবে ধ্বংস করা হবে। তিনি সেসময় রাজার প্রতিনিধির সচিব হিসেবে আয়ারল্যান্ডে নিযুক্ত ছিলেন।
Comments