পশ্চিমারা কি আসলেই শ্রেষ্ঠ? (পর্ব-তিন)

 

দশ বছর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন ই জিং।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yijing_(monk)

বৌদ্ধদর্শন অধ্যয়ন ছাড়াও তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের অধ্যয়ন করেন (আয়ুর্বেদ)। তিনি ছিলেন প্রথম শতাব্দির বহু চীনা জ্ঞানান্বেষীদের মধ্যে একজন, যারা বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য বিষয়ে চর্চার জন্য এবং সংস্কৃত দস্তাবেজগুলো সংগ্রহ করার জন্য প্রাচীন ভারতে আসেন

চীন থেকে বিখ্যাত পরিব্রাজক জুয়ান ঝাং প্রাচীন ভারতে এসেছিলেন সপ্তম শতাব্দীতে

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Xuanzang

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, তর্কশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন

অন্যদিকে প্রথম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে শত শত ভারতীয় পন্ডিত চীনে গেছেনঅনেক ভারতীয় গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী চীনের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চপদে অভিষিক্ত ছিলেন। গৌতম সিদ্ধ নামে এক ভারতীয় বিজ্ঞানী অষ্টম শতাব্দীতে চীনের সরকারি জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্ষদের সভাপতি হয়েছিলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gautama_Siddha

পঞ্চম শতকে ফা হিয়েন এবং সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং এর বর্ণনা থেকেও জানা যায় তাদের উৎসাহ শুধুমাত্র ধর্মীয় তত্ত্বে সীমাবদ্ধ ছিল নাদু'হাজার বছরেরও আগে থেকে প্রাচীন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মধ্য এশিয়ায় পুনঃরপ্তানির জন্য চীন থেকে পণ্য আমদানির ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন। হান রাজবংশের দূত ঝাং কিয়ান খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ব্যাকট্রিয়ার স্থানীয় বাজারে চীনের ইউনানে উৎপন্ন সুতিবস্ত্র ও বাঁশের তৈরি পণ্যদ্রব্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zhang_Qian

তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সেসব দ্রব্য ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে প্রাচীন ভারত ও আফগানিস্তান হয়ে ঐ বাজারে পৌঁছেছিল। প্রথমদিকে রেশম ছিল গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, কিন্তু একাদশ শতাব্দীর মধ্যে রপ্তানিকৃত চীনা পণ্যগুলোর মধ্যে চীনামাটির বাসনপত্র রেশমকে অপসৃত করে দেয় ও ভারত হয়ে রপ্তানিকৃত চীনা পণ্যগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত কৌটিল্য'র অর্থশাস্ত্রে প্রাচীন চীনের রেশম ও রেশম বস্ত্র মূল্যবান দ্রব্য হিসেবে স্থান পেয়েছেমহাভারতে চীনা তন্তু (চীনাংশুক) অর্থাৎ রেশমের উল্লেখ আছে। প্রাচীন 'মনুস্মৃতি'তে এটির উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকে কালিদাসের শকুন্তলা নাটকে মৃগয়ারত রাজা দুষ্মন্ত দেখতে পান ঋষিকন্যা শকুন্তলাকে। তার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে রাজা বলেন-

"অঙ্গ আমার এগিয়ে যায়
পিছিয়ে আসে অনিচ্ছুক মন
হাওয়ার তোড়ে যেমন ওড়ে চীনাংশুক"

সপ্তম শতাব্দীতে বাণভট্ট রচিত 'হর্ষচরিত' এ দেখা যায় রাজ্যশ্রীর আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানটি বিশেষভাবে জমকালো হয়ে তার নিজেকে চীনা রেশম বস্ত্রে সাজিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে। ঐ সময়ের সংস্কৃত সাহিত্যে রেশম ছাড়াও অন্যান্য চীনা পণ্যসামগ্রীর প্রাচীন ভারতে আমদানি হওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে ছিল কর্পূর, মৌরি জাতীয় হলুদ রঙের সুগন্ধি শাক, সিঁদুর, উৎকৃষ্ট মানের চামড়া, নাসপাতি, পিচ ইত্যাদি।

প্রাচীন ভারতীয় সন্ন্যাসীদের চীন যাওয়ার প্রথম নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম শতকে, যখন হান সম্রাট মিংদি-র আমন্ত্রণে ধর্মরত্ন ও কাশ্যপমাতঙ্গ চীনে যান

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Emperor_Ming_of_Han

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kasyapa_Matanga

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Dharmaratna

তারা প্রচুর পুঁথি ও স্মারক নিয়ে একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে চীনদেশে পৌঁছান। চীনারা তাদের জন্য একটি মঠ নির্মাণ করে দেয়, যেখানে তারা জীবনের বাকি সময় অতিবাহিত করেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/White_Horse_Temple

এই একুশ শতকের মতোই প্রাচীন যুগেও বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়যেমন- হান ইউ ৮১৯ খ্রিস্টাব্দে তার 'বৌদ্ধ ধর্মের স্মরণে' গ্রন্থে লিখেন:

"বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল বর্বরদের মধ্যে। তার ভাষা চীনাদের ভাষা থেকে পৃথক, তার পোশাকও আলাদা, তার মুখ থেকে উদ্গত কথাগুলো পূর্বতন রাজাদের বাণী থেকে আলাদা; রাজাদের দ্বারা নির্দিষ্ট পোশাক তার গাত্রদেহ আবৃত করে না। তিনি রাজা ও প্রজার মধ্যকার সম্পর্ককে স্বীকার করতেন না; এমনকী পিতা ও পুত্রের মধ্যকার ভাবানুভূতিকেও না।"

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Han_Yu#:~:text=Han%20Yu%20(Chinese%3A%20%E9%9F%93%E6%84%88%3B,the%20development%20of%20Neo%2DConfucianism.

তিনি আরও বলেন:

"লিয়াং এর সম্রাট ইউ নিজেকে বুদ্ধের সেবায় উৎসর্গ করেন। তাদের বংশের মন্দিরে বলি হিসেবে পশুর ব্যবহারকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি দিনে মাত্র একবার আহার করতেন এবং তার খাদ্য তালিকায় থাকতো শুধু ফলমূল ও শাকসবজি। শেষে তাকে বিতাড়িত করা হয় এবং ক্ষুধার জ্বালায় তার মৃত্যু ঘটে। তার রাজবংশ এইভাবে অকালে অবলুপ্ত হয়ে গেলো।
তিনি বুদ্ধের সেবা করছিলেন সৌভাগ্য লাভের আশায়, কিন্তু তার জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসে তা ছিল অনেক বেশি ঘোরতর। এই ঘটনার আলোকে দেখলে এটা নিশ্চিত বোঝা যায় যে, বুদ্ধের মধ্যে তেমন কিছুই নেই যার জন্য তার সেবা করা যায়।"

কনফুসিয়াস এর অনুসারীদের অনুরূপ তাওপন্থীদের মধ্যেও উগ্র জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধিতা দেখা যেতো

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Taoism

চতুর্থ শতকের প্রথমদিকে ওয়াং ফু নামে এক তাওপন্থী 'তাইশাঙ লিংবাও লাওজি হুয়াহু মিয়াওজিং (লাও জু প্রণীত অসভ্যদের সভ্য করার চিরায়ত গ্রন্থ)' লেখেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Huahujing

এই গ্রন্থে লাও জু-কে একটি কাল্পনিক সভ্যকরণ অভিযানে প্রাচীন ভারতে পাঠানো হয়, বিশেষত গৌতম বুদ্ধকে প্রভাবিত করার জন্য (বুদ্ধ লাও জি'র কথিত আগমনের কয়েক শতক আগেই মারা গেছেন)।

চার্লস হাকার এই বিষয়ে লিখেছেন:

"ওয়াং ফু'র মূল প্রতিপাদ্য হলো লাও জু চীন থেকে বেরিয়ে মধ্য এশিয়া হয়ে ভারতে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে হয় (১) জাদু বলে তার সঙ্গী কোনও শিষ্যকে ঐতিহাসিক বুদ্ধে রূপান্তরিত করলেন অথবা (২) বুদ্ধকে তাওবাদে দীক্ষিত করলেন কিংবা (৩) নিজেই বুদ্ধে পরিণত হলেন - ভাষ্যগুলো গ্রন্থটির বিভিন্ন পাঠের উপর নির্ভরশীল। তাওবাদী এই আক্রমণ প্রতিহত করতে বৌদ্ধরা বুদ্ধের জীবনকালকে আরও পিছিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন এবং সেইভাবে তাওবাদীরাও লাও জু-র আগমনের তারিখটিকে পিছিয়ে নিতে লাগলেন।"


https://en.m.wikipedia.org/wiki/Charles_Hucker

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Wang_Fu_(Han_dynasty)

লিওঁ হারভিৎজ (Leon Hurwitz) ও ৎসাই হেংতিং বলেন:

“যখন বৌদ্ধধর্ম চীনের মাটিতে শক্তভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুললো তখন কনফুসিয় ও তাওবাদীদের দ্বারা এই বিরোধিতাটি বারংবার উঠে আসতে লাগলো।”

কনফুসিয়পন্থী নেতা ফু-ই সপ্তম শতাব্দীতে তাং সম্রাটের কাছে লিখেছিলেন-

"মধ্য এশিয়া থেকে অদ্ভুত ও বর্বর রূপে বৌদ্ধ ধর্ম চীনে প্রবেশ করে। আপাতদৃষ্টিতে তখনকার অবস্থায় এটি ছিল কম বিপজ্জনক। কিন্তু হান যুগ থেকে ভারতীয় গ্রন্থগুলো চীনা ভাষায় অনূদিত হওয়া শুরু হয়। এদের সম্প্রচার রাজন্যবর্গের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে এবং সন্তানোচিত ভক্তিভাব অবক্ষয় পেতে থাকে। লোকেরা মস্তক মুন্ডন করতে আরম্ভ করে এবং রাজন্যবর্গ ও তাদের নিজেদের পূর্বপুরুষদের সামনে মাথা নত করে সম্মান জানাতে অস্বীকার করে।"

তিনি আরও লিখেন:

"আমার অনুরোধ, এদের বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক এবং তারপর তাদের সন্তানদের আপনার সৈন্যদলে ভর্তি করার জন্য লালনপালন করা হোক।"

মৌ জি তার 'লিহাও লুন' (ভ্রান্তি দূর করা) নামক
বইটিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বলেন:

"বিবরণীতে আছে ধ্রুবতারা স্বর্গের কেন্দ্রে এবং মানুষের উত্তরে অবস্থিত। এ থেকে যে কেউই দেখতে পারেন যে চীনাভূমি আবশ্যিকভাবে স্বর্গকেন্দ্রের নীচে অবস্থিত নয়। বৌদ্ধ লেখাগুলো অনুসারে ঊর্ধ্ব, অধ: ও সমগ্র পারিপার্শ্ব, রক্তবাহী সমস্ত সত্তাই বৌদ্ধকুলের অন্তর্ভুক্ত।"

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mozi

কিছু চীনা ভাষ্যকারের সন্ত্রস্ত হওয়ার পিছনে চীনের কেন্দ্রীয় ভূমিকাটি হারিয়ে যাওয়ার চেয়েও যে ভয়টি প্রধান ছিল তা হলো কিছু বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের ভারতকে কেন্দ্রীয় ভূমিকাটিতে বসানোর প্রবণতা। বৌদ্ধদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতকে বৈশ্বিক কার্যক্রমের কেন্দ্রে উপস্থাপিত করার প্রবণতাটি ছিল বেশ জোরালো। যেমন- পঞ্চম শতাব্দীতে ফা হিয়েনের ভারত ভ্রমণ সংক্রান্ত গ্রন্থে ভারতকে 'মধ্যবর্তী রাজ্য' হিসাবে বর্ণনা করে চীনকে একটি সীমান্তবর্তী দেশ হিসাবে দেখা হয়।

অন্যদিকে ভারতীয় চিন্তার অংশবিশেষে ভিনদেশিদের প্রতি সন্দেহপ্রবণতা ছিল প্রবহমান ব্যাপার। আলবেরুণী তার 'তারিখ আল হিন্দ (ভারতের ইতিহাস)' বইটিতে বিদেশিদের সম্পর্কে ভারতীয়দের মনোভাব নিয়ে লিখেছেন:

"সামগ্রিকভাবে ঈশ্বরতত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনায় তাদের নিজেদের মধ্যে খুব কমই বিরোধ আছে বিপরীতে তাদের সমস্ত ধর্মান্ধতা বর্ষিত হয় যারা তাদের মধ্যে পড়ে না তাদের উপর - সমস্ত বিদেশিদের উপর। তারা অন্যদের বলে ম্লেচ্ছ, অর্থাৎ অশুচি এবং তাদের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সম্পর্কই - তা সে বিবাহ বা অন্য কোনও ধরনের সম্বন্ধ কিংবা একত্রে বসে পান-ভোজন যাই হোক না কেন, সবকিছুই নিষিদ্ধ করে রাখে।"

https://xeroxtree.com/pdf/varotthoto.pdf

ভারতীয়দের উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জুয়ান ঝাং এর শিষ্য হুই লি-র বিবরণীতে লিপিবদ্ধ আছে:

"সন্ন্যাসীরা যখন জুয়ান ঝাং এর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কথা শুনলেন তখন তারা এখানেই থেকে যাওয়ার জন্য তার কাছে এই বলে প্রার্থনা করলেন, ভারত হচ্ছে বুদ্ধের জন্মভূমি এবং যদিও তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন, তার অনেক চিহ্ন এখানে আছে তাহলে এতদূর এসেও আপনি সেসব ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন কেন? তদুপরি, চীন হলো গুরুত্ব পাওয়ার অযোগ্য ম্লেচ্ছদের দেশ যারা ধর্মীয় ভাবাপন্নদের [বৌদ্ধ] বিশ্বাসকে ঘৃণা করে। সেই কারণেই বুদ্ধ সেখানে জন্মগ্রহণ করেননি। সেখানকার লোকেদের মন সংকীর্ণ এবং তাদের পরিশীলনের অভাব সীমাহীন; সে কারণে সাধু বা মুনিঋষিদের কেউই সেখানে যান না। সেখানকার আবহাওয়া শীতল ও দেশটি রুক্ষ - আপনার আরও একবার ভেবে দেখা উচিত।"

জবাবে তিনি বলেছিলেন:

"বুদ্ধ তার মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যাতে তা সব দেশেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। কে তাকে একাই উপভোগ করতে চাইবে এবং ভুলে যেতে চাইবে তাদের যারা এখনও জ্ঞানের দ্বারা আলোকিত হয়ে ওঠেনি?"

তিনি আরও বললেন:

"তাছাড়া আমাদের দেশে বিচারকরা মর্যাদাপূর্ণভাবে অধিষ্ঠিত এবং সর্বত্র আইন মেনে চলা হয়। সম্রাট পুণ্যবান ও প্রজারা বিশ্বাসপরায়ণ, পিতামাতারা স্নেহময় ও পুত্ররা অনুগত, মানবতা ও ন্যায়বিচার সর্বোচ্চ মর্যাদা পায় এবং বয়োবৃদ্ধ ও ঋষিদের সম্মানের আসনে বসানো হয় তাহলে কীভাবে আপনারা বলতে পারেন যে আমার দেশটি তাৎপর্যহীন বলে বুদ্ধ সেখানে যাননি?"

জ্য ক্লদ মার্জলফ (Jean-Claude Martzloff)
লিখেছেন-

"ভাবধারার সম্প্রচারের মতো অন্য কোনও বিষয় এত বারবার আলোচনায় আসেনি, তবুও এখনও পর্যন্ত আমরা এই বিষয়ে খুব সামান্যই জানি।"

জোসেফ নিডহাম চীন থেকে ভারতে ছড়িয়ে পড়া গাণিতিক ধারণাগুলোর তালিকা দেওয়ার তৈরী করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন বিভিন্ন ভাবধারাগুলোর চীন থেকে ভারতে যাওয়ার মাত্রাটি ভারত থেকে চীনে আসার চেয়ে অনেক বেশি থেকেছে

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Joseph_Needham

চীনাদের সংরক্ষিত নথিপত্রগুলো ভারতীয়দের তুলনায় অনেক ব্যাপক এবং ভালভাবে সংরক্ষিত থাকলেও বর্তমানে বিজেপি সমর্থকদের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে একপেশেভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদীদের দায়ী করাঅথচ প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলিকে কালানুক্রমিকভাবে সাজানোর কাজে উৎসাহের অভাব ছিল। বিপরীতে, বিশদ নথিপত্র তৈরি ও সেগুলো সংরক্ষণের ব্যাপারে চীনারা অনেক বেশি নিখুঁত থাকার চেষ্টা করেছে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন দলিল-পত্রাদির অভাবের অন্য একটি কারণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে জন কিয়েশ্চনিক (John Kieschnick) বলেছেন:

"ধাতু, মাটি ও পাথরের খোদাইগুলো বাদ দিলে প্রাচীন ভারতের বেশিরভাগ নথিপত্রই গাছের ছাল বা তালপাতার উপর লেখা হতো ও সেগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে রাখা হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগের এরকম পান্ডুলিপির খুব কমই টিকে আছে; এটির জন্য মাধ্যমটিতে অনাগ্রহের চেয়ে গাছের ছাল ও তালপাতার ক্ষণস্থায়িত্বই অধিকতর দায়ী।"

উল্লেখ্য, সংস্কৃত 'ধ্যান' শব্দটি চীনে পৌঁছে হয়ে যায় 'চান' এবং পরবর্তীতে 'জেন'

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zen

থিওডর ডি বেরি বলেছেন:

"সং রাজবংশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এবং এর নব্য কনফুসিয় ধারণাগুলো মিং রাজত্ব পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে যাওয়ার ফল হিসেবে গুরুত্বের দিক দিয়ে নারী শিক্ষা একটি নতুন মাত্রা অর্জন করে। মিং রাজত্বকাল মুদ্রণ, সাক্ষরতা ও বিদ্যালয় শিক্ষার বিপুল প্রসারের সঙ্গে সংযুক্ত।"

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Wm._Theodore_de_Bary

৪০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসে ফা হিয়েন তৎকালীন ভারতের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর পাটলিপুত্রে চিকিৎসা পরিষেবার সরকারি সুযোগসুবিধাগুলো দেখে:

"দেশের সকল দরিদ্র ও নিঃসহায় এবং সমস্ত রোগপীড়িত লোক এইসব ভবনগুলোতে যায়, সেখানে তাদের সব ধরনের সাহায্য দেয়া হয় এবং চিকিৎসকরা তাদের রোগ-অসুখ পরীক্ষা করে দেখেন। তারা যথা প্রয়োজন পথ্য ও ওষুধপত্র পায় এবং তারা যাতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়; তাদের অবস্থার উন্নতি হলে তারা নিজেরাই সেখান থেকে চলে যায়।"

এর ২৫০ বছর পর ই জিং প্রাচীন ভারতের স্বাস্থ্য
পরিষেবাকে খুঁটিয়ে দেখার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং ভারতের উপর লেখা তার গ্রন্থের তিনটি পরিচ্ছেদ ব্যয় করেছিলেন এই বিষয়েভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার চেয়ে এখানকার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অভ্যাসগুলো তার মনে বেশি দাগ কেটেছিল। তিনি প্রধানত উপশমমূলক কিছু ভারতীয় চিকিৎসা বিধির প্রশংসা করেছেন। যেমন- ঘি, তেল, মধু বা ক্বাথ সর্দি থেকে আরাম দিতে পারে। কিন্তু তিনি পরে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, আকুপাংচার ও দাহক (ছ্যাকা দেয়া)-র মতো আরোগ্য কলা বা নাড়ি পরীক্ষণের দক্ষতা ইত্যাদিতে ভারত কখনওই চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তার মতে দীর্ঘায়ু হওয়ার ঔষধও একমাত্র চিন দেশেই পাওয়া যায়।” তার বর্ণনা থেকে জানা যায় জল ছাঁকার জন্য প্রাচীন ভারতীয়রা সূক্ষ্ম শ্বেতবস্ত্র ব্যবহার করতো এবং তিনি বলেছেন চীনে সূক্ষ্ম রেশম ব্যবহার করা উচিততিনি আরও বলেছেন-

“চীনে এখনকার লোকেরা প্রধানত না রাঁধা কাঁচা
মাছ ও শাকসবজি খেয়ে থাকে, কিন্তু কোনও ভারতীয়ই এরকমটা করে না।”

উপমহাদেশের উগ্র দেশপ্রেমিকরা (বিশেষ করে 'ইন্দোম্যানিয়া' বা 'ইন্দোফিলিয়া' নামক রোগে আক্রান্ত কথিত মুক্তমনারা) সচরাচর দাবি করে থাকেন যে আর্যদের চার্বাক দর্শন কিংবা গৌতম বুদ্ধের দর্শনেই কেবল নাস্তিক্যবাদী উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সংশয়বাদী ধারণার অস্তিত্ব পৃথিবীর নানা প্রান্তের সভ্যতার অধিবাসীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, এমনকি গহীন জঙ্গলের অনেক আদিবাসীদের মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায় তা। এই পোস্টে প্রাচীন চীনের উদাহরণ দেয়া হলো। দার্শনিক কনফুসিয়াস 'সু কিং' নামক একটি গ্রন্থের সংকলন করেছিলেন, যাতে স্বর্গ ও নরকের ব্যাপারে উল্লেখ ছিল না। কনফুসিয়াস বলেছিলেন- 

"যেখানে বর্তমান জীবনের বিষয়েই আমরা অবগত নই, তাই মৃত্যুর পরে কি হবে তা কে বলতে পারবে?"

.....................................................................

মাদার তেরেসা বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে করতেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি প্রার্থনা ও আশীর্বাদের মাধ্যমে অলৌকিক উপায়ে রোগ নিরাময়ের প্রথায় বিশ্বাস করতেন। যীশু যেরকম ক্রুশ বিদ্ধ হয়েও বেদনায় মুক্তি খুঁজেছিলেন, বেদনাকে ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার রাস্তা হিসাবে দেখেছিলেন; ঠিক তেমনি ক্যাথলিক বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের কাছে যন্ত্রণাকে মুক্তি হিসেবে দেখাবার ধারা বহুকাল ধরে বিদ্যমান, তেরেসার বিশ্বাসও ছিল এমনটা। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি বাদ দিয়ে মুমূর্ষু রোগীদের তেরেসা ঈশ্বরের বাণী শোনাতেন, যীশুকে স্মরণ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে বলতেন। কারো সঠিক চিকিৎসা তেরেসা করেননি ডাক্তার দিয়ে, কারণ তাতে তিনি ঈশ্বর বিরোধিতা দেখতেন। তেরেসা গর্ভপাত বিরোধী ছিলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকার বাহিনীর হাতে ধর্ষিত বাংলাদেশী নারীদের তিনি গর্ভপাতের বিরুদ্ধে গিয়ে সন্তান জন্ম দিতে বলেছিলেন। তিনি চিরকাল নারীমুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতা করতেন এবং নিজের শরীরের ওপর নারীর অধিকার মানতে অস্বীকার করতেন ক্যাথলিক শাস্ত্র অনুসারে। তেরেসা ছিলেন পোপ জন পলের মতোই তীব্র কমিউনিজম বিরোধী। তিনি শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের কট্টর বিরোধী ছিলেন, ভ্যাটিকানের হুকুমে নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন সহ যেকোনো কৃষক বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছেন। তিনি নাস্তিকদের নরকবাসী ভাবতেন এবং নিজের পেশা অনুসারে গরিব মানুষের মুক্তির পথ হিসেবে খ্রিষ্টধর্মকে তুলে ধরতেন; অভাব, শোষণ আর অনাহারক্লিষ্ট জনতাকে তেরেসা প্রার্থনায় ডুবে থাকতে বলতেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর তার দালালদের এই প্রিয় পাত্রী এসব কারণেই ২৯,০০০ মানুষকে যন্ত্রণাময় মৃত্যু দেয়ার জন্য নোবেল পুরস্কার পান! ম্যাকনামারার মতো ক্রিমিনাল তার নাম নোবেলের জন্যে সুপারিশ করেছিল। উল্লেখ্য, ১৯৪৫ সালে টোকিওতে বোমাবাজির মাধ্যমে এক রাতের মধ্যে লাখ খানেক মানুষ মারার পর এই রবার্ট ম্যাকনামারা হয়ে যায় ভিয়েতনামের উপর বর্বরতার প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং শেষে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট!

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bombing_of_Tokyo?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR2-ZzoK7abS7LlqvmJaPohHnF09C_fViEmd56_aS4CS9WcR_vFni8fh8Ow_aem_q6GF8ZQWSBurdxo2VutmTw#:~:text=On%20the%20night%20of%209%E2%80%9310%20March%201945%2C%20334%20B,(610%E2%80%93760%20m)

আর্থিক অনুদান নেয়ার ক্ষেত্রে তেরেসা ও আসারাম কিংবা সত্য সাই বাবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। চোর, ডাকাত, খুনি, স্মাগলার - সবার থেকে তেরেসা কোটি কোটি টাকা নিয়ে দান করেছেন ভ্যাটিকানে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Asaram

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sathya_Sai_Baba

রোমান ক্যাথলিক গির্জা ২০০ বছর ধরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের পরিবর্তন করেছে, আর বিশ্ব পুঁজিবাদের বৃহৎ সমর্থনকারী শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের পর থেকে, বিশেষ করে বলশেভিক বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে সারা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের আধ্যাত্মিক রক্ষাকর্তা হিসেবে ক্যাথলিক চার্চ এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার পথে নামে। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের পর থেকে ধর্মে বিশ্বাস মানুষের কমতে থাকে আর প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধারার উৎপত্তি ও শক্তিবৃদ্ধির কারণে ক্যাথলিক চার্চ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়লে জনগণের জীবনের উপর ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে শুরু হয়। দেশে দেশে গরিব মানুষের মধ্যে দান খয়রাত ও সেবা দ্বারা সরকার বা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণাকে বিলীন করে শোষিত মানুষদের বিপ্লব-বিদ্রোহ বিমুখ করার কাজ শুরু করে ভ্যাটিকান। এজন্যই 'কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার' লেখার শুরুতে মার্কস আর এঙ্গেলস পোপকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন।

গরিবের প্রতি প্রেম বা দরদ থেকে নয়, তেরেসা এনজিওগিরি করতেন স্বর্গে নিজের স্থান পাকা করার জন্য। তেরেসা নিচু জাতের অসংখ্য হিন্দু ও দলিতদের খ্রিষ্টধর্মে ব্যাপটাইজ করেন। অন্যদিকে তেরেসার গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত মৌলবাদী আরএসএস পরিচালিত 'বনবাসী কল্যাণ' সংস্থাটি প্রতিনিয়ত দেশটির আদিবাসী জনগণকে হিন্দু বানায়, আবার অর্থের ভিত্তিতে দ্বিজ বা ব্রাক্ষণ হয় কেউ কেউ। অথচ তেরেসা বেঁচে থাকার সময় উগ্র হিন্দুরা কোনোদিন কুষ্ঠ রোগীদের ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি, যাদের কাছে কুষ্ঠ রোগ পূর্ব জন্মের পাপ, যারা কুষ্ঠ রোগীদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতো। উঁচু জাতের বাঙালিদের কাছে কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা ভিখারি আর অনাহারে মরা মানুষগুলো কীটপতঙ্গের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। বজরং দলের লোকেরা যখন উড়িষ্যার কন্ধমলে খ্রিষ্টান নানদের ধর্ষণ করেছিল তখন তারা 'ভারত মাতার জয়' বলে স্লোগান দিয়েছিল! দেশটিতে একের পর এক গির্জায় আক্রমণ করা হয়েছে, গির্জার পাদ্রীদের মারা হয়েছে, অল্টার এ হনুমান বসানো হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]