তথাকথিত সমাজতন্ত্রী মুজিব ও তার কন্যা

 


"শেখ মুজিব বলেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি রোজ কেয়ামত পর্যন্ত ভূমি রাজস্ব আদায় স্থগিত রাখবেন।" 

(দৈনিক পাকিস্তান, ১-৯-১৯৭০) 

জনতা ও বামপন্থীদের পরিষদের প্রবল চাপ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে ছিটেফোঁটা সংস্কার করানো সম্ভব হয়নি পাকিস্তান আমলে। খাসমহাল কর্মচারীরা ঘুষ খেয়ে ভূমিহীনদের বঞ্চিত করে খাস জমিগুলো জোতদার ও মহাজনদের বন্দোবস্তি দিতো তারা ক্ষমতায় থাকার সময়েই। যেই ৬৯' এর বিপ্লবী জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিব আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পায়, সেই মুজিব জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সাঙ্গপাঙ্গসহ শাসকগোষ্ঠীর সাথে গোলটেবিল বৈঠকে আপোষ করলেন নির্দ্বিধায়। তখন ভাসানী ও অন্যান্য সংগ্রামী নেতারা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন "গোলটেবিল না রাজপথ?" জনতা তখন উত্তর দিয়েছিলো "রাজপথ, রাজপথ"। এই কাজের জন্য শেখ মুজিবকে আদমজী নগরে সোনার মেডেল পরিয়ে সংবর্ধনা দেয় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী। অপরদিকে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মামলা প্রত্যাহারের জন্য কোনো চেষ্টা পর্যন্ত করেননি শেখ মুজিব সেসময়। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনে গিয়ে সেখানে মিয়া মমতাজ দৌলতানার সাথে বৈঠক করেন। এই বৈঠকের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের আকাশবাণী হতে বলা হয় 'শেখ মুজিব মিয়া মমতাজ দৌলতানার সাথে সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন।' লন্ডন হতে করাচী পৌঁছে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন "৬-দফা কোরান বা বাইবেল নয়। প্রয়োজন হলে এর রদবদল করা যাবে।" তাছাড়া আওয়ামী লীগ ৬-দফাকে 'জাতির মুক্তির সনদ' হিসেবে দাবী করলেও জোতদার-মহাজনদের উচ্ছেদ করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বিতরণের কথা লেখা ছিল না সেখানে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বাজেয়াপ্ত করে দেশের কোটি কোটি টাকার মুনাফা পাচার রোধের কথা নেই সেখানে। এমনকি যেই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, তাদের দেশীয় চামচা জোতদার-মহাজন ও ধনী জোঁকেরা পূর্ব বাংলার নিরান্নব্বই ভাগ আমজনতার রক্ত চুষে গেছে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তাদের কথাও লেখা ছিল না এতে। ঐ কথিত মুক্তির সনদে 'কৃষক', 'মজুর' ও 'নিম্নবিত্ত' শব্দ তিনটা পর্যন্ত ছিল না! প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আইনগত কাঠামোর ২০, ২৫ ও ২৭ ধারার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বায়ত্তশাসনের পথে বাধা সৃষ্টি করা। ব্যাপারটা জানার পরও গদির লোভ ছাড়তে পারেনি আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরাই সিলেটে কৃষকদের উপর এবং খুলনায় ও চট্টগ্রামে কালুরঘাট ইস্পাহানী জুটমিলে শ্রমিকদের উপর গুলির নির্দেশ দিয়েছিল। জুটমিলের মালিক ছিল ইস্কান্দার মির্জার আত্মীয়। তৎকালীন দুর্নীতি দমন মন্ত্রী শেখ মুজিব ১১ শ্রমিককে গুলি করে মারার পর চট্টগ্রাম আসলে আমজনতা ও স্থানীয় দলীয় নেতারা তাকে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি দিয়ে ঘটনা তদন্ত করানোর কথা বললেও সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্ব পাওয়ার পথে সমস্যা সৃষ্টি হবে বিবেচনায় তাদের অনুরোধ না রেখেই চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনারের সাথে মিটমাট করে ঢাকা চলে যান।

................................................................................. 

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন জমির সিলিং (পরিবার পিছু জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ) একশ বিঘা নির্ধারণ করেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির ২৪ বছর পর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও শেখ মুজিব জমির সিলিং ঐ একশ বিঘাই রেখে দেন। এই হচ্ছে জোতদারি ও মহাজনী প্রথা অক্ষুণ্ন রেখে সমাজতন্ত্রের নামে বাটপারি! আয়ুব খানের শাসনামলে সিলিং ছিল ৩৭৫ বিঘা। মণি সিং, মোজাফফরদের দল 'লাঙ্গল যার জমি তার' নীতির উল্টোপথে হেঁটে জমির সিলিং ৫০ বিঘা করার সংস্কারবাদী দাবী তুলেছিল। অপরদিকে প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা হয়ে গেলো 'অতি বিপ্লবী'। এদের উত্তরসূরি বিভিন্ন দলের বাংলাদেশের নির্বাচনপন্থী বামেদের আচরণেও বিভিন্ন ইস্যুতে এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো দেখা যায়। চার খলিফা (শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আসম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী) সেসময় ২৫ বিঘা সিলিং এর দাবী তুলেছিলেন। এই তথাকথিত সমাজতন্ত্রী জাতির পিতা দেখা মাত্র নক্সালপন্থীদের গুলি করে মারতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ তার সময়ে ভারতের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা দেশটাকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলার পরও তিনি এদের বিরুদ্ধে পাখি মারার বন্দুকও ব্যবহার করতে বলেননি। ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়ে ৫০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ঐসময় অতি মুনাফার লোভে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা কাপড়ের গোপন মজুত গড়ে তুলেছিল। মৃতের কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছি না। খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকার তিন হাজারের বেশি কাপড়ের গুদাম সিল করেছিল। এরপর ঘুষের বিনিময়ে এই জোঁকেরা নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার পতন ঘটায়। সংবিধানের ৯৩ ধারা অনুসারে পরে গভর্নর কেসী শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয়। (সূত্র: বাংলাদেশের ইতিহাস- রমেশচন্দ্র মজুমদার) শেখ মুজিবের সময়ে ভারত এদেশ থেকে ৫০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য, ৩০ লক্ষ বেল (পরিমাপের একক) পাট, দেড় লক্ষ বেল সূতা, ১২০০০ টন ইলিশ মাছ, ২৩০০ কোটি টাকার অস্ত্র, ৮৫০০ যানবাহন ও অন্যান্য জিনিস নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। চট্টগ্রামের এক জনসভায় জাতির পিতা বলেছিলেন যদি প্রয়োজন হয় আরো এক কোটি লোকের জীবনের বিনিময়ে হলেও অতিবিপ্লবীদের দমন করার জন্য তিনি সবার হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন এবং নিজে পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। (দৈনিক স্বাধীনতা, ৩০-৩-১৯৭২) খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী আবুল ফজল এই জনসভায় সভাপতিত্ব করলেও চামচাগিরির জন্য তিনি মুখ দিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ একটা শব্দও বের করেননি। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে, এখানে যা-ই ঢালা হবে তা-ই হারিয়ে যাবে। জাতির পিতা প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন- 

"এতদিন অন্যরা খাইসে, এবার আমার লোকেরা খাইবো।"

..............................................................................

পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার কংগ্রেস রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন অবিভক্ত ভারতে। এজন্য পাকিস্তান হওয়ার পর তাকে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তিনি শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ছিলেন। দল ভারী করার জন্য বা দল ছেড়ে যেন চলে না যায় সেজন্য তিনি ৪০ জন এমপিএ-কে মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন এবং উচ্চপদস্থ আমলাদের প্রশ্রয় দেন। মেজরিটি থাকা সত্ত্বেও আইন সভার বৈঠক ডাকলে কোনো কোনো সদস্য দলত্যাগ (Floor Crossing) করতে পারে এই ভয়ে তিনি পরিষদের বৈঠক ডাকা দীর্ঘকাল স্থগিত রাখেন। এতে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার আমলে পুলিশ ধর্মঘট হয়। পুলিশের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্তা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগ্রহভাজন হয়ে ভবিষ্যতে মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রদূত হওয়ার উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে কেন্দ্রের সাথে যোগসাজশে এই ধর্মঘট ঘটায়। কেন্দ্রীয় সরকার আবু হোসেনকে নির্দেশ দেয় ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের গ্রেফতার করতে। বামপন্থীরা ধর্মঘটের সাথে জড়িত না জানার পরও আবু হোসেন সরকার এলোপাতাড়ি বামপন্থী ধরা শুরু করেন। শেখ মুজিব পল্টনের এক জনসভায় বলেছিলেন "আমি আবু হোসেন সরকারকে পুঁটি মাছের মতো ভেজে খেয়ে ফেলবো।" আবু হোসেন সরকার ক্ষমতায় এসে দশ টাকা মণ দরে গরিবদের মধ্যে চাল বিলির ব্যবস্থা করেন। নিয়ম অনুযায়ী তার দলের এমপিএদের ডিলার নিয়োগে সুপারিশের কথা ছিল। এরা যাদের জন্য সুপারিশ করতো তাদের সাথে একটা বোঝাপড়া থাকতো। এভাবে ১০ টাকা মণ এর চাল ১৮ টাকায় বিক্রি করে ১ লক্ষ মণ এ ৮ লক্ষ টাকা লাভ হতো। এই লাভের অর্ধেক-অর্ধেক ভাগ করতো এমপিএ ও ডিলাররা। ১৯৫৬ সালের আগস্টের শেষের দিকে (স্পিকার ছিলেন আব্দুল হাকিম) তিনি পরিষদে বৈঠকে ডাকতে বাধ্য হন জনমতের চাপে। এসময় চালের মণ ৩৫ টাকায় উঠে যায়। আওয়ামী লীগ ভাড়া করা লোক দিয়ে ভুখা মিছিল বের করে। আবু হোসেন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবপন্থী আওয়ামী লীগের সদস্যরা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পিকেটিং করে চাল বেপারিদের নৌকা থেকে চাল তোলা বন্ধ করে দেয়। তাদের আরেকটি ভুখা মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলেও ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ গুলিবর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে তারা লাশ নিয়ে পরিষদ ভবনের চারদিকে মিছিল করেছিল নিজেদের স্বার্থেই। এভাবে আবু হোসেনের মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ক্ষমতায় আসে। ১৯৪৮ সালে ভাসানীর নেতৃত্বে কর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল। প্রগতিশীলরা দলটিতে যোগ দিতে শুরু করে ১৯৫৩ সাল থেকে। সংখ্যালঘুদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। সমর্থনের বিনিময়ে কংগ্রেস নেতা মনোরঞ্জন ধরকে অর্থমন্ত্রীর পদ দিতে হয়। আর ১২ই সেপ্টেম্বর মাত্র ১৩ জন আওয়ামী লীগের সদস্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার রিপাবলিকান পার্টির সাথে কোয়ালিশন করে সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদকে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী বানিয়ে দেয়া হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে লিখিত ভাষণে মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন "কেন্দ্রীয় সরকার যদি পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে না নেয় তাহলে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে আচ্ছালামু আলায়কুম বলতে বাধ্য হবো।" সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব কর্তৃক গুন্ডাদের ভুয়া কাউন্সিলর সাজিয়ে আপত্তিকর প্রস্তাবগুলো পাশের পর মাওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের খান আব্দুল গাফফার খান, জি۔ এম۔ সৈয়দ, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, ওসমানী প্রমুখকে তারবার্তা পাঠান ঢাকায় আসার জন্য। সিদ্ধান্ত হয় স্বাধীন নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অন্যান্য প্রগতিশীল দাবি নিয়ে নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করা হবে। আওয়ামী লীগের গুন্ডারা তখন থেকেই ন্যাপের কর্মীদের উপর বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করতো। ক্ষমতায় যাওয়ার পর কেন্দ্র কর্তৃক ছুড়ে মারা উচ্ছিষ্টের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ থেকে কয়েকজন বের হয়ে যাওয়ায় তাদের আর মেজরিটি রইলো না। তখন তারা ন্যাপের সদস্যদের তোষামোদ করা শুরু করে গদি বাঁচাতে। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের মেজরিটি না থাকার অজুহাতে (৩১ মার্চ, ১৯৫৮) তার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে আবু হোসেন সরকারকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয়। ঐদিন কেন্দ্রীয় সরকার শেরে বাংলাকে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে চীফ সেক্রেটারি হামিদ আলীকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। নতুন গভর্নর ১লা এপ্রিল আবার আতাউর রহমানকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানায়। এর কিছুদিন পর হামিদ আলীর জায়গায় সুলতান উদ্দীনকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দুই মাস পর বাজেট অধিবেশন শুরু হলে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভা হতে তাদের নেতারা সমর্থন প্রত্যাহার করে। বাজেটের উপর ছাটাই প্রস্তাবে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। আতাউর রহমান ১৯৫৮ সালের ১৮ই জুন পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। গভর্নরের আমন্ত্রণক্রমে ২০শে জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিন্তু ২৩শে জুন তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হয়। এরপর কেন্দ্র কর্তৃক প্রদেশে ১৯৩ ধারা জারি হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত ৫ দফা দাবি মেনে নেয়। যেগুলো ছিল- আশু সাধারণ নির্বাচন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীন বৈদেশিক নীতি, ২১ দফার বাস্তবায়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিল। ন্যাপ কর্তৃক আওয়ামী লীগকে সমর্থনের আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তারা এবং আবু হোসেনের দল সদস্য ভবনে হাজির হয়। ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটি পাঁচ দফা দাবি না মানলে আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে দলীয় নেতাদের নিষেধ করে। ১৮ই জুন এজন্য তারা ভোট দেয়নি। দুই মাস পর ১৯৩ ধারার মেয়াদ শেষ হলে আগস্টে আতাউর রহমানকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলা হয়। তাকে ২৫শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পূরক বাজেট পেশ করানোর নির্দেশ দেয়া হয়। বলা হয়, অন্যথায় পুনরায় ১৯৩ ধারা জারি করা হবে। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে এই বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। বাজেট পাশ করাতে না পারলে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিত্ব হারাতো। এই নিয়ে আবু হোসেনের দলের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়। ২০শে সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে স্পিকার আব্দুল হাকিম পরিষদ কক্ষে ঢুকলে আওয়ামী লীগের নেতারা তার উপর আক্রমণ করে। পরিষদে আসার আগে তাকে ফোনে ভয় দেখানো হয়। তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করে চলে যান। তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হয়। আওয়ামী লীগ আবু হোসেনের দলভুক্ত ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হাত করে আসনে বসায়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে স্পিকার হাকিমের তারবার্তা-

Dacca

20.9.58

STE 160

Mujibur Rahman over telephone several times threatened me with violence of the worst sort saying I will not be allowed to enter the Assembly. Will be bodily removed adding that no local police will be of help to me. Relation of mine was assaulted last evening. I seek your advice.

[Justice Asir Commission Report, 9th April, 1959]

২০শে সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট মির্জার কাছে আবু হোসেন সরকারের ফোনোগ্রাম-

Mujibur Rahman and other leaders attacked Speaker with spears, rods and microphone stands. Imported armed goondas by Awami Leaders rushed inside Assembly from outside attacked Speaker and opposition members encircling Speaker to save his life were molested and beaten. Despite frantic appeal police refused to help. Some opposition members wrongfully confined in Awami Minister's house. Others threatened with attack anywhere any time. 

[Justice Asir Commission Report]

২৩শে সেপ্টেম্বর সকালে আবু হোসেন সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলেও ন্যাপের সমর্থনের কারণে তারা টিকে যায়। বিনিময়ে তারা ন্যাপের দু'টি দাবি মেনে নেয়- বাকি খাজনার সুদ মাফ এবং সার্টিফিকেট অফিসার দিয়ে বাকি খাজনা আদায় না করে মুন্সেফ কোর্টের রায় অনুযায়ী বাকি খাজনা কিস্তিতে পরিশোধ। ১৯৫৮ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর সম্পূরক বাজেট পেশের সাথে সাথে মোহন মিয়া, নান্না মিয়া, নবী চৌধুরী প্রমুখ আবু হোসেন দলের নেতারা সামনে থাকা সবকিছু স্পিকার শাহেদ আলীর দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলো। আওয়ামী লীগও পাল্টা আক্রমণ চালাতে লাগলো। সেখানে উপস্থিত আই۔ জি۔ ইসমাইল ও এসেম্বলি মার্শালরা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। ২৫শে সেপ্টেম্বর বেলা ১-২০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহেদ আলীর মৃত্যু হয়। পরদিন গিলোটিন করে বাজেট পাশ করার পর অধিবেশন মূলতবি হয়। এরপর মার্শাল ল' জারি করে আবুল মনসুর আহমদের বিরুদ্ধে ৩টি ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা দায়ের হলেও সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়। এজন্য তিনি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে তদবির চালিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৮ই জুন সামরিক শাসনের অবসান হয় এবং ২৪শে জুন নূরুল আমীন, আতাউর রহমান সহ ৯ জন নেতা আইয়ুবের শাসনতন্ত্র, মৌলিক গণতন্ত্র ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নয়া শাসনতন্ত্র রচনার দাবিতে যুক্ত বিবৃতি দেন। অথচ সোহরাওয়ার্দী জেল থেকে বের হয়ে এই দাবি সমর্থন না করে প্রচলিত শাসনতন্ত্র বাতিলের পরিবর্তে শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রায়নের দাবি উত্থাপন করেন [পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর]।

...........................................................................

"আমি যদি আপনার কথা মত কাজ করি তাহলে ছাত্রনেতারা আমাকে গুলি করবে, আর যদি আমি ছাত্রনেতাদের কথা মত চলি তাহলে আপনি আমাকে গুলি করবেন। বলুন তো এখন আমি কি করি?"

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ মুজিব প্রকাশ্যে উপরের উক্তিটি করেছিলেন, যিনি ছাত্রনেতাদের চাপে ৭ই মার্চের ভাষণে 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম' জাতীয় বাক্যগুলো বললেও 'অপারেশন সার্সলাইট' এর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সাথে বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করে গেছেন।

.................................................................................

বাংলাদেশের ইতিহাস বইয়ে দাবী করা হয় শের এ বাংলা নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। আসল সত্যটা হচ্ছে নাজিমুদ্দিনের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সময় জিন্নাহ তাকে সমর্থন না করায় হিন্দু মহাসভার সভাপতি উগ্রপন্থী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন, যা মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার আন্দোলনের চাপে ভেঙে যায়। তৎকালীন পূর্ব বাংলার ১৬৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর নেয়ার জন্য পরিষদ সদস্য ও ছাত্র নেতৃত্বরা শের এ বাংলা'র সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বলেছিলেন তিনি মোসাদ্দেক হতে চান না (ইরানের মোসাদ্দেক সরকার)। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব বাংলায় এসে ৯২-ক ধারা জারি করে হাজার হাজার যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল। অথচ এসময় শের এ বাংলা'র গলা দিয়ে কোনো গর্জন বের হয়নি! ইস্কান্দার মির্জা বলেছিল "I shall shoot Bhasani". অন্যদিকে 'বাংলার বাঘ' রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন ভয়ে। যুক্তফ্রন্টের আরেক নেতা সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী বানানো হলো কর্মীরা জেলে নিষ্পেষিত হওয়ার সময়ে, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের স্বায়ত্বশাসন বিলুপ্ত করে একটি ইউনিটের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি আইনমন্ত্রীর পদ থেকে কিছুদিন পর সরে গেলে শের এ বাংলা হয়ে যান কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের মেজরিটি আমলে না নিয়ে উভয় পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যা সাম্যের নীতি মেনে নিয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগকে মানতে বাধ্য করেছিলেন। ১২ ই সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে মাত্র ১৩ জন আওয়ামী লীগ সদস্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার রিপাবলিকান পার্টির সাথে কোয়ালিশন করে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন! ক্ষমতায় এসে তিনি আগের পাক সরকার কর্তৃক সম্পাদিত পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি আওয়ামী লীগকে দিয়ে অনুমোদনের চেষ্টা করেন। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাগমারি'তে লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এই ব্যাপারে নিজেদের মধ্যেই তীব্র মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। ১৯৫৭ সালের ১৩ ই জুন ভুয়া কার্ড ইস্যু করিয়ে ঢাকার কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব কয়েকশ কাউন্সিলর ঢুকিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে। এভাবে সোহরাওয়ার্দী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি অনুমোদন করিয়েছিলেন। অথচ গৃহপালিত বামেরা ঠিকই এই অনুমোদনকে সমর্থন দিয়ে গেলো। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দীর চামচা ইত্তেফাক পত্রিকার মানিক মিয়া বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লেখালেখি চালিয়ে গেছে সমান তালে। ঐ পত্রিকায় ভাসানীকে 'তালের আঁশের টুপিওয়ালা', 'চার আনার মোল্লা' ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা হতো! ভাসানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৫৭ সালের বাজেট অধিবেশনে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পেশ করলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা পরিষদ কক্ষ থেকে সুর সুর করে বের হয়ে যায়। চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের পূর্ব পরিকল্পিত দাঙ্গায় অনেক বাঙালিকে ফাঁসানো হলে ৪৭ জন এমপিএ এর স্বাক্ষর দেয়া স্বারকলিপি নিয়ে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন ও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সামাদ (তিনি পরে ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী হয়েছিলেন) সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করলে তার জবাব ছিল "Law cannot be altered." ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি করাচীতে বসে আরাম করছিলেন এবং আন্দোলনে নির্যাতিতদের স্বপক্ষে একটাও বিবৃতি দেননি। নোয়াখালী গিয়ে উর্দুতে ভাষণ দেয়ার পর তিনি সাধারণ মানুষকে গরু, ছাগল তাড়ানোর মতো শিষ বাজিয়ে আর হাততালি দিয়ে উঠে যেতে ইঙ্গিত করেছিলেন।

...............................................................................

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১২ নাম্বার অনুচ্ছেদে লেখা আছে:

ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য-

ক) সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বিলোপ করা হবে

খ) রাষ্ট্রের দ্বারা কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করা হবে না

গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করা হবে

ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর নির্যাতন, নিপীড়ন, বিলোপ করা হবে

অথচ শেখ মুজিব ঈদে মিলাদুন্নবী, শব এ কদর, শব এ বরাত এর জন্য সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করেছিলেন! তিনি জনগণের কষ্টের ট্যাক্স এর টাকার সরকারি তহবিল থেকে হজ করতে যাওয়াদের জন্য অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলেন! তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন! তিনিই বিশ্ব ইজতেমার জন্য জায়গা দিয়েছিলেন! তিনিই ইসলামী ফাউন্ডেশন তৈরী করেছিলেন! মুসলমানদের নবীর দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭৬ সালে! অথচ উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারক আর ভারতীয় ভার্সনের সমাজতন্ত্রের জগাখিচুড়ির আমদানিকারক শেখ মুজিব স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই বাংলাদেশীদের হজ করতে পাঠানোর কারণে সবাইকে বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল তার সময়ে।

অন্যদিকে তার কন্যা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সারা দেশের কোনায় কোনায় মডেল মসজিদ, মডেল মাদ্রাসা তৈরী করেছে! ক্ষমতাসীনদের জোটে অনেকগুলো ইসলামী দল আছে যারা শরিয়া ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী জানায় নিয়মিত! ক্ষমতাসীনদের শাসনামলেই ইসলামাইজেশন হয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং পাঠ্যবইগুলোতে এর প্রতিফলন ঘটেছে! একই মঞ্চে হেফাজতে ইসলাম আর ক্ষমতাসীনরা পাশাপাশি বসার ঘটনা ঘটেছে! বাংলাদেশ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কেবল ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নবী মুহাম্মদের জন্মদিন অর্থাৎ ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী'র দিনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক! 

.....................................................................................

'ভারত কি করে ভাগ হলো' বইটিতে বীরেন শাসমল এর পুত্র বিমলানন্দ শাসমল লিখেছেন-

"আজকে যে কারণে আমরা শেখ মুজিবকে মালা দেই, সেই একই কারণে শেখ আবদুল্লাহকে জেলে পাঠাই।"

...............................................................................

"জনগণ বিপ্লব চান, বিপ্লবীরা জনগণেরই সন্তান, জনগণের উপরই নির্ভরশীল এবং আত্মদানের সবচাইতে বড় হাতিয়ারই বিপ্লবীদের প্রধান অবলম্বন।"

- মনিরুজ্জামান তারা, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক

(যাকে আওয়ামী লীগের গুন্ডারা নির্মম অত্যাচার করে মায়ের কবরের পাশে লাশ ফেলে রেখে যায়)

...............................................................................

মহিউদ্দিন আহমেদ তার ‘লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’ বইয়ে সিরাজ সিকদার ও তার নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা, মূল্যায়নের পাশাপাশি তৎকালীন পার্টির সাথে যুক্ত এবং নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সিরাজ সিকদার বিপ্লবের অগ্রসর মতবাদ মাওবাদকে কমিউনিস্ট মতবাদের বিকাশে তৃতীয় বা উচ্চতর স্তর হিসেবে গ্রহণ করেন। এই মতবাদের আলোকে পূর্ব বাংলায় বিপ্লবের স্তর হিসেবে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পথ হিসেবে পার্লামেন্টারী পথ বর্জন করে গ্রাম ভিত্তিক দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের রাজনীতি গ্রহণ ও গোপন পার্টি গঠন করে দেশব্যাপী বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলেন। শাসক শ্রেণির ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারি গ্রেফতার হন এবং ২রা জানুয়ারি তিনি বন্দি অবস্থায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন। লেখক নিজে একসময় আওয়ামী ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে জাসদের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এরপর তিনি বিভিন্ন দাতা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। ‘লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারার রাজনীতি’ বইটির মধ্য দিয়ে লেখক এই পার্টির রাজনীতি ও তার নেতৃত্বের ভূমিকার মূল্যায়ন টেনেছেন। তার এই মূল্যায়নকে শক্ত ভিত্তি দিতে তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৎকালীন সময়কার পার্টির নেতৃত্বের একাংশ এবং পার্টির সাথে যুক্ত শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিবর্গের। যাদের অধিকাংশই পার্টি বিপ্লব ত্যাগকারী, অধ:পতিত, বুর্জোয়া জীবনে প্রতিষ্ঠিত। লেখকের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী বইটি মূলত একঝাঁক মেধাবী তরুণের স্বপ্নযাত্রা ও স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। জনগণ এখানে অনুপস্থিত। অর্থাৎ লেখক আজকে যেখানে পৌঁছেছেন সেসব তরুণরাও জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে লেখকের পথ অনুসরণ করে সেখানে পৌঁছাতে পারতেন! সেই সুযোগ হেলায় বিসর্জন দিয়ে সমাজ বদলের লড়াইয়ে আত্মাহুতি লেখকের কাছে জীবনের বড় ধরনের অপচয়! ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা, সচ্ছলতা, পাওয়া আর না পাওয়ার জায়গা থেকে তিনি সমাজ বিপ্লবকে দেখেছেন। বুর্জোয়া রাজনীতির মোহজালে তিনি বিপ্লবী রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলেছেন। এসব এসেছে লেখকের আওয়ামী, জাসদীয় রাজনীতির চোখে সিরাজ সিকদারের রাজনীতিকে দেখার কারণে।

"বিপ্লব কোনো ভোজ সভা বা প্রবন্ধ রচনা বা চিত্র অঙ্কন কিংবা সূচিকর্ম নয়; এটা এতো সুমার্জিত, এতো ধীরস্থির ও সুশীল, এতো নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারে না। বিপ্লব হচ্ছে বিদ্রোহে উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে পাল্টে দেয়।"

- মাও সে তুঙ

বিপ্লবে রক্তপাত অনিবার্য। মার্কসবাদের এই অমোঘ সত্যকে সত্যিকার কোনো বিপ্লবী অস্বীকার করে না। লেখক সমগ্র লেখায় এই সত্যকে অস্বীকার করেছেন বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতাবাদ দ্বারা চালিত হয়ে। সারা বিশ্বের তাবৎ বুর্জোয়ারা মুখে গণতন্ত্রের ফেনা তুললেও তারাই এর বড় হন্তারক। লেখক সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লবের পর রেড আর্মি ও হোয়াইট আর্মির সংগঠিত কার্যকলাপকে একই মাপকাঠিতে মেপেছেন। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণি বৈষম্যমূলক বিশ্ব ব্যবস্থায় যুদ্ধ অনিবার্য। সেই অন্যায় যুদ্ধের বিপরীতে কমিউনিস্টরা ন্যায় যুদ্ধকে ন্যায্য বলে মানে। সমাজতন্ত্র তথা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লবী যুদ্ধ শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। তার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ ও রক্তপাতের অবসান ঘটবে। এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করা ইতিহাসের সাথে মিথ্যাচারের সামিল। লেখক সে পথেই হেটেছেন। তাই সিরাজ সিকদার ও তার পার্টির রাজনীতির ইতিহাসকে তিনি খুনোখুনির ইতিহাস বলতে চেয়েছেন। লেখককে বেশি ব্যথিত করেছে তার ছাত্র জীবনের বন্ধু রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাকে পার্টি কর্তৃক হত্যাকান্ড। শাসকশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার রাষ্ট্রের বাহিনী। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। সিরাজ সিকদার সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের সেবাদাস গণবিরোধী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই জারি করেছিলেন শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী জনগণের রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে। এ লড়াইয়ে উভয় পক্ষের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি অনিবার্য ছিল। লেখকের বন্ধু রক্ষীবাহিনীর মতো গণনিপীড়ক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী জনমনে তীব্র হতাশা আর আওয়ামী ফ্যসিবাদী সরকারের নেতৃত্বে দেশব্যাপী অত্যাচার, নির্যাতন, দখল, লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা, সন্ত্রাসের বীভৎস পরিস্থিতি। এসব অপকর্মের প্রধান সারথী ছিল রক্ষীবাহিনী। তারা শুধু হাজার হাজার বামপন্থী নেতা-কর্মীদের হত্যা করেনি, এই নৃশংসতার শিকার হয় অগণিত সাধারণ জনগণ। লেখক ইতিহাসের সেই সময়ের কিছু কিছু বিষয়কে ছুঁয়ে গেলেও রক্ষীবাহিনীর দু:শাসনের ব্যাপারে একেবারেই নীরব থেকেছেন। সমাজের অস্থিরতা, অসন্তোষকে দেখেছেন জনগণের আকাশচুম্বী স্বপ্ন হিসেবে। এসব থেকে শেখ মুজিব সরকারকে রক্ষা করেছেন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ গঠনে পর্যাপ্ত সময়ের অভাব বলে! লেখকের ভাষায় জনগণের এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে নাকি 'কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী' গণবিচ্ছিন্নভাবে দেশব্যাপী থানা, ফাঁড়ি, ব্যাংক, খাদ্য গুদাম লুট করেছে! জনগণ প্রস্তুত নয় বা গণবিচ্ছিন্নতার কথা বলে গণযুদ্ধের রাজনীতিকে খারিজ করা সংশোধনবাদীদের পুরানো রোগ। সিরাজ সিকদার সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশব্যাপী সফলভাবে হরতাল পালন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে সেই হরতালে সমর্থন দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। তথাকথিত বিজয়ের মাসে জনগণের জীবনমান আর মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির অঢেল বিত্ত-বৈভব ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে সিরাজ সিকদার তথাকথিত স্বাধীনতার পর যে অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন তা সর্বৈব সত্য বলে প্রতিভাত হয়। বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল দক্ষিণ এশীয় প্রতিক্রিয়ার প্রধান খুঁটি ভারতের লুটপাট, নিপীড়ন, নিয়ন্ত্রণের অধীনস্ত রাজ্যে পরিণত হয়। লেখক মুক্তিযুদ্ধকালীন সিরাজ সিকদার ও তার পার্টির ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে কোনো বিদেশি শক্তির সহায়তা ছাড়া সিরাজ সিকদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন। লেখক বিষয়টি সামনে আনলেও উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে মুজিবের স্বেচ্ছায় ধরা দেয়ার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেছেন। এসময় আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে ভারত যান। ভারতের মদদ ও ব্যবস্থাপনায় গঠিত হয় আওয়ামী প্রবাসী সরকার। লেখকের কাছে বিষয়টি ইতিবাচক হলেও সিরাজ সিকদার সঠিকভাবে ধরতে পেরেছিলেন পূর্ব বাংলা আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ভারত যেখানে নিজ দেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারকে টুঁটি চেপে ধরেছে, সেখানে পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের প্রশ্নে এ ধরনের ‘সহযোগিতা’ তাদের গোপন অভিসন্ধির প্রকাশ। ভারতে প্রশিক্ষিত মুজিবাহিনীকে সজ্জিত করা হয়েছিল মাওপন্থী দমনে। লেখক বিষয়টিকে হেঁয়ালিপূর্ণভাবে দেখাতে চেয়েছেন যেন মাওপন্থীদের শ্রেণিশত্রু বা জাতীয় শত্রু খতমের রাজনীতির কারণেই তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর সাথে মাওপন্থীদের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল! ১৯৭১ সালের বিশেষ পরিস্থিতিতে বরঞ্চ উল্টোটাই সত্য। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাদের অনুপস্থিতিতে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাওপন্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারত ফেরত আওয়ামী মুক্তিবাহিনী দেশে ফিরে মাওপন্থীদের আগে টার্গেট করে। আওয়ামী নেতৃত্ব কখনো মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের সার্বিক শোষণ মুক্তির লড়াই হিসেবে দেখেনি, দেখেছে তাদের গোষ্ঠিগত ক্ষমতার লড়াই হিসেবে। এজন্য সত্যিকার কমিউনিস্টদের প্রতি তারা এতো বিরূপ। সিরাজ সিকদার ও তার পার্টির আওয়ামী লীগের প্রতি খোলা চিঠি মারফত যৌথ কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানানো সত্ত্বেও কোনো সাড়া মেলেনি। লেখকের কাছে এসবের কোনো রাজনৈতিক মূল্য নেই। কমিউনিস্ট নিধনে বিশেষত বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী ও দেশের ভিতরে অবস্থানরত কাদেরীয়া বাহিনী ছিল এ প্রশ্নে সবচেয়ে সরস। লেখক নিজেও বিএলএফ এর সদস্য ছিলেন বলে ভারতের সেবাদাসদের দ্বারা কমিউনিস্টদের হত্যাকে বিশৃঙ্খলা দমন হিসেবে দেখেছেন। তিনি এসব তথ্যকে তুলে ধরেছেন আওয়ামী পন্থীদের অপরাধ এড়িয়ে। লেখক জাসদের রাজনীতিকে সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী রাজনীতির সাথে মেলানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। অথচ জাসদ নেতৃত্ব বিপ্লব ধ্বংসের জন্য আওয়ামী লীগের সশস্ত্র বি-টিম হিসেবে কাজ করেছিল। এই সংগঠনের শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের গণক্ষমতা তথা নয়াগণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচি ছিল না। সেখানে কর্নেল তাহেরের মতো বিপ্লব আকাঙ্খী বিভ্রান্ত বীরের আত্মত্যাগ এবং দেশপ্রেমিক ও সমাজতন্ত্রমনা অসংখ্য ছাত্র-তরুণ-বুদ্ধিজীবীদের সংযুক্তি থাকলেও তার রাজনীতি, মূল নেতৃত্ব ও কর্মসূচি কখনো বিপ্লবী ছিল না। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান, তার হাত দিয়ে রচিত হয়েছিল বাকশালের কর্মসূচি। যখন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বাহিনী দ্বারা বিপ্লব আকাঙ্খী জাসদের তরুণরা আত্মাহুতি দিচ্ছে তখন সিরাজুল আলম খানের সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ ছিল শেখ মুজিবের। তাকে ভারতে পালাতে সাহায্য করে শেখ মুজিব। লেখকের তথ্য থেকে এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আর তাকে লেখক তুলনা করেছেন সিরাজ সিকদারের সাথে! তিনি সর্বহারা পার্টির চক্র-উপদল সংক্রান্ত ভুল লাইন ও পদ্ধতিকে সমালোচনা করতে গিয়ে পার্টি ও বিপ্লবের রাজনৈতিক লাইন ও মতাদর্শকে বাতিল করে দিয়েছেন। সেজন্য তিনি দেখেছেন সিরাজ সিকদারসহ পার্টি নেতাদের স্বৈরাচারী পরিচালনা পদ্ধতি, ভোগ-বিলাস, যৌন বিচ্যুতি, খুনোখুনি ও নেতৃত্ব দখলের লোভে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পিচ্ছিল পথ! অথচ এই বইয়ে উল্লেখ আছে সিরাজ সিকদারসহ অগ্রসর বিপ্লবীগণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও পরিবারের ভোগ বিলাসের জীবন ত্যাগ করে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য দৈহিক শ্রম থেকে শুরু করে কতো কষ্টকর জীবনযাপন করেছেন। স্বল্প সময়ের বিপ্লবী অনুশীলনে প্রেম, বিয়ে, যৌন প্রশ্নকে বিপ্লবী স্বার্থের অধীনে রেখেছেন। একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখার বিরোধিতা করেছেন। প্রয়োজনীয় বিবাহ বিচ্ছেদকে সহজতর করেছেন। যারা পুনর্গঠন হতে পারেনি তারাই পার্টি ও নেতৃত্বকে আক্রমণ করেছে। বিপ্লব ত্যাগকারীদের লেখক হাতিয়ার বানিয়েছেন। পুঁজিবাদী-সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় একাধিক স্ত্রী রাখা, হোটেল ও পতিতালয়ে গমন, স্ত্রী নিপীড়ন, হত্যা-ধর্ষণ, বাল্য বিবাহের নরক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে এসে পার্টি ও বিপ্লবী স্বার্থের অধীনে নারী-পুরুষের ভালবাসার স্বেচ্ছামূলক সম্পর্কের সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়াস নিঃসন্দেহে অনুসরণযোগ্য। এক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতিকে বিপ্লবী সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেই সারসংকলন করা যায়। সিরাজ সিকদার এভাবেই ব্যক্তিগত সব কিছুকে দেখেছেন। এখানে যৌন কাতরতা, ভোগ-বিলাসের কিছু নেই। তিনি সিরাজ সিকদার পরবর্তী পার্টির স্বল্পকালীন প্রধান নেতা মতিনকে সিরাজ সিকদার এর গ্রেফতারের জন্য দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। অথচ তিনি বহু সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও সংকটময় পরিস্থিতিতে পার্টির বিপ্লবী ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তত্ত্ব ও অনুশীলনে অতীতের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে অগ্রসর হতে না পারলেও তিনি বিপ্লব ত্যাগ করেননি। তিনি আমৃত্যু সিরাজ সিকদার ও মাওবাদের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। যাদের মুখ দিয়ে কমরেড মতিনকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে তারাই পার্টি ও বিপ্লব ত্যাগ করেছেন, পার্টি ভাঙার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেছেন এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে শাসক শ্রেণির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছেন। রইসউদ্দিন আরিফের কথা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি সিরাজ সিকদার পরবর্তী মাওবাদ বর্জন করে হোক্সাপন্থা গ্রহণ করে রাষ্ট্রের সহায়তায় ব্যক্তি জীবনে পুনর্বাসিত হন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেন। লেখক সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর তার পার্টির বিভক্তি ও বিভক্ত অংশগুলোর বর্ণনায় একটি মাত্র পক্ষের বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন, যারা পরবর্তীতে সিরাজ বিরোধী রাজনীতির প্রচারকে পরিণত হয়। সিরাজের মৃত্যুর পর তার রাজনীতির অনুসারী তার পার্টি এবং অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এখনো সক্রিয়। তাদের কোনো বক্তব্য সংগ্রহের চেষ্টা লেখক করেননি। এ থেকে লেখকের রাজনৈতিক মতাবস্থান বোঝা যায়, যা প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণে অসততা ছাড়া আর কিছু নয়। লেখক শেখ মুজিব, পুলিশ ও রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তাদের অভিযোগ থেকে রক্ষার জন্য মিথ্যা তথ্যের অবতারণা করেছেন। সেজন্য সংসদে দাঁড়িয়ে "কোথায় আজ সিরাজ সিকদার" বলে মুজিব যে সিরাজ সিকদারের হত্যার দায় স্বীকার করেছিলেন সে অভিযোগ থেকে তাকে দায়মুক্ত করে লেখক শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বের করেছেন "তোরা ওকে বাঁচতে দিলি না"। এই 'তোরা' কারা, লেখক সেটা আবিষ্কার করেননি। শেখ হাসিনার বয়ানে পুলিশ বাহিনীর মধ্যকার মুজিব বিরোধীদের ক্রসফায়ারে সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর নতুন কাহিনী সাজিয়েছেন তিনি। লেখক মূলত সিরাজ সিকদার গ্রেফতার ও হত্যায় জড়িত রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তা-ব্যক্তিদের তথ্যকে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন। লেখক সমগ্র বইতে সিরাজ সিকদার ও তার পার্টির মতবাদ, রাজনীতি ও কর্মসূচি হালকা চালে নিয়ে এসেছেন। তার বইতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে সিরাজ সিকদার ও তার উত্তরাধিকারদের ব্যক্তিগত জীবনাচারণ, প্রেম, বিয়ের নানা কেচ্ছাকাহিনী। বুর্জোয়ারা যেভাবে তাদের বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করতে নানা গল্প সাজিয়ে চরিত্র হননের চেষ্টা করে, লেখক সেই নোংরা পথ অনুসরণ করেছেন। সিরাজ সিকদার এর অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে এমন চারিত্রিক কালিমা লেপন রাজনৈতিক বা সামাজিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। সারা বিশ্বে যখন পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার কদর্য ফ্যাসিবাদী রূপের কারণে জনগণ এ ব্যবস্থার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন মহান এক বিপ্লবী নেতৃত্ব সম্পর্কে এ ধরনের কালিমা লেপনে লেখকের উদ্দেশ্য স্পষ্ট।
......................................................................

হাফেজ ক্বারী আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ ছাইফুর রহমান নিজামী শাহ'কে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে একুশে পদক দিয়েছিল ইসলাম বিষয়ক গবেষণার (!) জন্য। গৃহপালিত এই মোল্লাকে দিয়ে শেখ মুজিব চট্টগ্রাম বেতারে দোআ পড়িয়েছেন স্বাধীনতার পর।
.......................................................................

মেজর জলিল, আহমদ ছফা থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি হাফেজ্জী হুজুর নামে যেই টাউটের পাল্লায় পড়েছিলেন তাকে প্রাক্তন ক্ষমতাসীনদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ফ ম মোজাম্মেল হক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী ১০ এপ্রিল, ২০১৪ সালে মরেণোত্তর সম্মাননা ও ক্রেষ্ট প্রদান করেছিলেন। অথচ এই উগ্রপন্থী মোল্লা বাংলাদেশে শরীয়াপন্থী সরকার বাস্তবায়নের কথা বলতো বিভিন্ন ভাষণে এবং তার নাম স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকায় আছে! উল্লেখ্য, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে 'নানা' বলে সম্বোধন করতেন।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]