একজন ইরোম শর্মিলা

 

ইরোম শর্মিলা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের রাষ্ট্রীয় দমন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং তার রক্ষাকবচ গণবিরোধী আইন AFSPA বাতিলের দাবিতে ১৫ বছর যাবৎ অনশন ধর্মঘটের মাধ্যমে সংগ্রাম করেছিলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Armed_Forces_(Special_Powers)_Act

ইরোম শর্মিলার দীর্ঘ অনশন ধর্মঘটের কারণে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বর্বরোচিত হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ড (মালোম হত্যাকান্ড) ইরোম শর্মিলার চিত্তে ঝড় তোলে।

https://caravanmagazine.in/vantage/the-massacre-in-manipur-that-prompted-irom-sharmilas-fast-unto-death-sixteen-years-ago

সেদিন বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত ১০ জন যাত্রীকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। যে গণবিরোধী আইনের জোরে সেনাবাহিনী এই হত্যাকান্ডটি নির্বিকারে ঘটিয়েছিল ইরোম শর্মিলা সেই আইন (AFSPA) বাতিলের দাবিতে সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ৫ নভেম্বর মালোম পৌঁছান। সেখানে শুরু হয় তার অনশন ধর্মঘট। এই অনশন শুরু করার তিনদিন পর পুলিশ তাকে 'আত্মহত্যার' চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে একই অভিযোগে তাকে আটক করে এবং জোরপূর্বক অনশন ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলেও মুখে কোনো খাবার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাকে নাকের মাধ্যমে তরল খাবার, পানীয় ও ভিটামিন দেয়া হতো। শর্মিলার উপর আনীত অভিযোগের মামলায় দিল্লীর এক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে প্রেরণ করে। ভারত রাষ্ট্রের যে গণবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ইরোম শর্মিলা সংগ্রাম করেছিলেন সে আইনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে যেকোনো নাগরিক হত্যা করার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ভারতীয় শাসকশ্রেণি ফ্যাসিস্ট এই আইনকে বৃহৎ 'গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রের আইন এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালিয়েছিল। মাধ্যমিক পড়ার সময়েই স্কুলের পাঠ্যপুস্তক শর্মিলার কাছে অর্থহীন মনে হয়। কারণ বইয়ে তিনি তার আশেপাশের মানুষের জীবন সংগ্রামের কোনো ইতিহাস দেখতে পাননি। স্কুলে ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান পড়েও তিনি তার অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন। তার মনে প্রশ্ন জাগে মণিপুরসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো কি ভারতের অংশ? তাহলে ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় কেন এই ভূখন্ড এতো পিছিয়ে? এমন সব চিন্তা থেকে শর্মিলার আগ্রহ জন্মায় রাজনীতির প্রতি। মণিপুর রাজ্য জুড়ে বিদ্রোহী মুক্তিকামী সংগঠনগুলোর প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। তিনি নুপি লানের গণআন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সাথে এবং 'মেইরা পাইবি' সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে পরিচিত হন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nupi_Lan

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Meira_Paibi

মাধ্যমিক পড়ার পর তিনি সাংবাদিকতার কোর্সে ভর্তি হন, এসময় তার চেতনার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তিনি উপলব্ধি করেন ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে মণিপুর রাজ্যের যোজন যোজন পার্থক্য। মনিপুর কখনোই ভারত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। এটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা মণিপুর দখল করে। মণিপুরের শ্রমজীবী নারীরা ১৯০৪ সালে যে আন্দোলন শুরু করেন তা ধারাবাহিকভাবে চলে। যার মধ্যে ছিল ইংরেজ বাহিনীতে জোরপূর্বক নিয়োগ, বাজার বয়কট, অস্বাভাবিক পানির কর ধার্য, খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তর, কৃষকদের থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদদারী এবং মণিপুরের বাইরে চাল রপ্তানির বিরুদ্ধে আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ১১ আগস্ট মহারাজা বোধচন্দ্র আর মাউন্টব্যাটনের মধ্যে চুক্তির মধ্য দিয়ে মণিপুর রাজ্যকে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেয়া হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bodhchandra_Singh

১৫ আগস্ট মণিপুর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ভারত তার সম্প্রসারণবাদী চরিত্রের দ্বারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে দখলে নেয়। ১৯৪৯ সালে ১৫ অক্টোবর মহারাজা বোধচন্দ্রের সাথে ভারত সরকারের চুক্তির মাধ্যমে মণিপুর ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই চুক্তিতে মহারাজাকে জোরপূর্বক রাজি করানো হয়েছিল। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান রচনাকালে মণিপুরকে তৃতীয় শ্রেণির অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালে মণিপুরকে ভারত সরকার পূর্ণ রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও মূলত ভারতের অধীনে একটি পরাধীন রাজ্য হিসেবে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। বিগত দিনে জনগণের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। বরং আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের লুটপাট, কালোবাজারী, মাদক ব্যবসার কালো থাবায় মণিপুর রাজ্যকে গ্রাস করেছে। সেখানে মদ্যপান মহামারী আকার ধারণ করেছে। সেই সাথে মিয়ানমার থেকে চোরা পথে আসে হিরোইন, ইয়াবা, মরফিন, পেথিডিনের মতো মাদক দ্রব্য। ১৯৭৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মণিপুরের নারীদের উদ্যোগে গঠিত হয় 'নিশা বন্ধ নামে সংগঠন। এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ১৯৭৬ সালের ২১ এপ্রিল সমমনা সংগঠনগুলো সমাবেশের মাধ্যমে গঠন করে কেন্দ্রীয় সংগঠন 'অল মণিপুর উইমেনস সোশ্যাল রিফরমেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি'। ১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল মদ ও মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধকরণের দাবিতে রাজ্যব্যাপী হরতাল পালিত হয়। ১৯৪৯ সালে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ কর্তৃক মণিপুর রাজ্য দখলের পর নিপীড়িত জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগঠন ও সংগ্রাম গড়ে উঠে যা সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। জাতীয়তাবাদী সংগঠনের পাশাপাশি সেখানে মাওবাদী বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠে। এই সংগঠনগুলো মণিপুর রাজ্যকে ভারত রাষ্ট্র থেকে স্বাধীন করার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৭৮ সালে সশস্ত্র সংগ্রামরত পার্টিগুলো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জোরদার সংগ্রাম গড়ে তোলে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমূলে উচ্ছেদের জন্য ভারত সরকার মণিপুরে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়। ১৯৮০ সালে সরকার আইন-শৃঙ্খলার অবনতির দোহাই দিয়ে মূলত জনগণের বিদ্রোহ দমনে রাজ্যে সামরিক শাসন জারি করে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী হত্যা-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের তান্ডব ঘটিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যাতে জনগণ বিদ্রোহীদের সহযোগিতা না করে। সেনাবাহিনী দ্বারা মণিপুরের হাজার হাজার নারী-পুরুষ হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ২০০০ সালে মালোম হত্যাকান্ডের পর ২০০৩ সালে ৪ অক্টোবর নান্দৈবম সঞ্জিতার উপর ভারতীয় সেনারা পাশবিক নির্যাতন চালায়। ২০০৪ সালে ১১-১২ জুলাই সেনারা ঘরের দরজা ভেঙ্গে মা ও দুই ভাইকে আহত করে মনোরোমার দুই চোখ বেঁধে তার উপর নির্যাতন চালায় কয়েক ঘণ্টা ধরে। তাকে সারা শরীরে বেয়োনেট ও ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের অভিযোগ ছিল মনোরোমা বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন পিএলএ’র সাথে জড়িত।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/People%27s_Liberation_Army_of_Manipur

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Thangjam_Manorama

এহেন পৈশাচিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গণবিক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। এর অংশ হিসেবে কাংলা দুর্গের সিংহদ্বারে বারোজন 'মেইরা পাইবি' আন্দোলনকারী নারী প্রতিবাদ জানান।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kangla_fort

দুর্গে অবস্থানকারী আসাম রাইফেলসের বিভিন্ন রেজিমেন্টের সামনে এই নারীরা তাদের পরনের যাবতীয় বস্ত্র খুলে ব্যানার সামনে রেখে বিক্ষোভ করেন। ব্যানারে লেখা ছিল “এসো ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের ধর্ষণ করো - আমরা সবাই মনোরোমার মা!” ২০১৬ সালের মাঝামাঝি খবরে প্রকাশ ইরোম শর্মিলা তার শান্তিপূর্ণ অনশন ভঙ্গ করে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি বুর্জোয়া সংসদীয় নির্বাচন করবেন এবং সংসদীয় পদ্ধতিতে তার চলমান প্রতিবাদ জানাবেন। ইরোম শর্মিলা কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন বা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী গান্ধীবাদী অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকামী। ফলে তার দৃষ্টিভঙ্গি বিপ্লবী ছিল না এবং তার সংগ্রামে বিপ্লবী দিশা ছিল অনুপস্থিত। রাষ্ট্র সর্বদা তার নৈতিক স্খলন ঘটাতে প্ররোচিত করেছে এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেছে। অবশেষে উদারনৈতিক মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দিকভ্রান্ত সংগ্রামের পথ শর্মিলাকে বুর্জোয়া সংসদীয় পথে চালিত করেছে।




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]