বাম রঙ্গ [পর্ব-এক]
দুনিয়ার দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। দুনিয়ার বুকে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা কমিউনিস্টদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এর আগে সমাজতন্ত্রের ধাপ তাদের পেরিয়ে আসতে হবে। দেশে দেশে এ মতবাদীরা যুগপৎ কমিউনিস্ট' ও ‘সােশ্যালিস্ট' হিসেবে পরিচিত। বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টদের আরেকটি পরিচয় হচ্ছে 'বামপন্থী'। এর বিপরীতে রয়েছে ডানপন্থী’ (এরা দক্ষিণপন্থী নামেও পরিচিত)। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগে ও পরে দুনিয়াজুড়ে কমিউনিস্টরা 'বামপন্থী' পরিচয়ে পরিচিতি পেয়ে আসছে। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের আইন সভায় স্পিকারের ডান পাশে বসেছিলেন রক্ষণশীল মনােভাবের সংসদ সদস্যরা, আর বাম পাশে বসেছিলেন অপেক্ষাকৃত বিপ্লবী মনােভাবাপন্ন সদস্যরা। সেখান থেকেই সারাবিশ্বে 'বামপন্থী' ও 'ডানপন্থী' শব্দ দু'টো চালু হয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে ‘বামপন্থা’ বর্তমানে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের রচনা সমগ্রে অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, তারা তাদের লেখার কোথাও নিজেদের 'বামপন্থী' বলে পরিচয় দেননি। 'কমিউনিস্ট ইশতেহার' এর কোথাও 'বামপন্থী' বা 'বামপন্থা' শীর্ষক কোনাে শব্দ নেই। সর্বত্র রয়েছে 'সমাজতন্ত্রী’ কিংবা বিরােধী শক্তি হিসেবে ‘ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রী' শব্দ। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস লিখেছেন তিনি এবং মার্কস যখন কমিউনিস্ট ইশতেহার রচনা করেন, তখন সমাজতন্ত্রী বলতে কমিউনিস্টদেরও বােঝানো হতো না। এঙ্গেলস লিখেছেন-
"কিন্তু লেখার সময়ে একে সমাজতন্ত্রী ইশতেহার বলা সম্ভব ছিল না। ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্রী নামে বােঝাতো একদিকে বিভিন্ন ইউটোপীয় মতবাদের অনুগামীদের, অন্যদিকে বােঝাতো অতি বিচিত্র সব সামাজিক হাতুড়েদের। এরা নানাবিধ তুকতাককে পুঁজি ও মুনাফার কোনাে ক্ষতি না করে সর্বপ্রকার সামাজিক অভিযােগের প্রতিকার করার প্রতিশ্রুতি দিতো। উভয় ক্ষেত্রের লোকেরাই ছিল শ্রমিক আন্দোলনের বাইরে, উভয়েরই চোখ ছিল ‘শিক্ষিত' সম্প্রদায়ের সমর্থনের দিকেই। শ্রমিক শ্রেণির যেটুকু অংশ নিতান্ত রাজনৈতিক বিপ্লবের অপর্যাপ্ততা বুঝেছিল, সমাজের সম্পূর্ণ বদলের প্রয়ােজনীয়তা ঘােষণা করেছিল, সেই অংশ তখন নিজেদের কমিউনিস্ট নামে পরিচয় দিতো। তাই ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র ছিল বুর্জোয়া আন্দোলন আর কমিউনিজম শ্রমিক শ্রেণির, অন্তত ইউরােপ মহাদেশে সমাজতন্ত্র ছিল ‘ভদ্রস্থ', আর কমিউনিজম ছিল ঠিক তার বিপরীত।"
বামপন্থী তাে দূরের কথা, উনিশ শতকের অন্তত মাঝামাঝি পর্যন্ত কমিউনিস্টরা সমাজতন্ত্রী হিসেবেও পরিচিত ছিল না। তখন পর্যন্ত সমাজতন্ত্রী ছিল কল্পনাবিলাসীরা, দোদুল্যমানতা ও সুবিধাবাদিতা ছিল যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ১৮৩০ এর দশকে মার্কস নিজে পরিচিত ছিলেন 'বামপন্থী হেগেলিয়ান’ বলে। 'বামপন্থী' শব্দটি ছিল ১৮০০ সাল থেকেই, যদিও তা জড়িয়ে ছিল দার্শনিক হেগেলের মতবাদের সঙ্গে। তখন বামপন্থী হেগেলবাদী ও ডানপন্থী হেগেলবাদী নামে দু'টো ধারা ইউরােপে পরিচিত ছিল। তবে সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে ব্যাপারটা তখনাে কোনােভাবেই সম্পৃক্ত ছিল না। 'বামপন্থী' নামে একটি শব্দ প্রথম সরাসরি পাওয়া যায় লেনিনের আমলে। বিভিন্ন বক্তৃতায় ও লেখালেখিতে লেনিন 'বামপন্থা' ও 'বামপন্থী’ প্রসঙ্গে বিভিন্ন কথা বলেছেন। কমরেড লেনিন সমসাময়িক বিপ্লবী, অতিবিপ্লবী, জারপন্থী ইত্যাদির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতেন নিয়মিত। 'কমিউনিজমে বামপন্থার শিশুরােগ' নামে একটি বই লেনিন লেখেন আদর্শগত সংগ্রাম চালাতে গিয়ে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেস উদ্বোধনের আগে বইটি রুশ ভাষায় ছাপা হয়ে বের হয়। ১৯২০ সালের জুন-জুলাই মাসে তা প্রকাশিত হয় ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের হাতে বইটি দেয়া হয়েছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_International
এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও মতামতের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত হতাে সােভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত। 'বামপন্থা' ও 'বামপন্থী' সম্পর্কে লেনিনের কয়েকটি উদ্ধৃতি দেখা যাক-
"সােশ্যালিস্ট রেভ্যুলশনারিদের কাছে 'বামপন্থা'র অর্থ ছিল জার্মান সােশ্যাল-ডেমােক্রেসির অপেক্ষাকৃত ছােট ছােট সুবিধাবাদী পার্টি নিয়ে হাসাহাসি, অথচ সে সঙ্গে দৃষ্টান্তস্বরূপ ভূমি সমস্যায় বা প্রলেতারীয় একনায়কত্বের প্রশ্নে সেই পার্টির চরম সুবিধাবাদীদেরই অনুসরণ।"
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Social_Democratic_Party_of_Germany
"বলশেভিকবাদ তার নিজ পার্টির 'বামপন্থী' বিচ্যুতির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালায় তা দু'বার বিশেষ রকমের বৃহৎ আয়তন লাভ করে: ১৯০৮ সালে একান্ত প্রতিক্রিয়াশীল পার্লামেন্টে এবং একান্ত প্রতিক্রিয়াশীল আইনে সঙ্কুচিত আইনসঙ্গত শ্রমিক সমিতিগুলােতে অংশ নেয়ার প্রশ্নে আর ১৯১৮ সালে (ব্রেস্ত শান্তি) কোনাে রকম 'আপোস' করা যাবে কিনা এ প্রশ্ন নিয়ে।"
লেনিনের দৃষ্টিতে বামপন্থী হলাে ছােট ছােট সুবিধাবাদী গােষ্ঠী অথবা চরম সুবিধাবাদীদের অনুসরণকারী। কমিউনিস্টরা (বলশেভিকরা) পার্টির একটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল, সে বিচ্যুতিকে লেনিন নাম দিয়েছিলেন 'বামপন্থী বিচ্যুতি’। এ বামপন্থীরা একটা সময় পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টিতেই ছিল। লেনিন বলেন-
"বামপন্থী কমিউনিস্টরা তখন আমাদের পার্টির ভিতরে একটা বিশেষ গােষ্ঠী বা 'ফ্যাকশন'ই শুধু গড়ে তােলে, তা-ও বেশি দিনের জন্য নয়। ওই ১৯১৮ সালেই 'বামপন্থী' কমিউনিজমের বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা, যথা রাদেক ও বুখারিন প্রকাশ্যেই নিজেদের ভুল স্বীকার করেন।"
১৯০৩ সালের রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় থেকে লেনিনের অনুগামীদের অভিহিত করা হয় বলশেভিক বলে, পার্টির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে এরা সংখ্যাধিক্য (বলশিনস্তভো) অর্জন করেছিলেন। আর লেনিনের বিরােধী সুবিধাবাদীরা (মেনশিনস্তভাে) ‘মেনশেভিক’ নামে খ্যাত হয়। বলশেভিক ও মেনশেভিকরা দীর্ঘসময় ধরে রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক শ্রমিক পার্টির দুই উপদল হিসেবে থাকলেও কার্যত তারা দু'টি পৃথক পার্টি হিসেবেই চলে। চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে, রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক শ্রমিক পার্টির ষষ্ঠ সম্মেলনে। সুবিধাবাদী মেনশেভিকদের তখন পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Russian_Social_Democratic_Labour_Party
রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক শ্রমিক পার্টির (বলশেভিক) ৭ম কংগ্রেস বসে ১৯১৮ সালের মার্চে, এতে 'রুশ কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)' নামটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সােভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর পার্টির ১৪তম কংগ্রেসে (ডিসেম্বর, ১৯২৫) 'রুশ কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)' নামের বদলে গৃহীত হয় 'নিখিল ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)'।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_Party_of_the_Soviet_Union
১৯৫২ সালের অক্টোবরে পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে পার্টির নাম বদল করে রাখা হয় 'সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি'। 'সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি' নামে রাশিয়ার পেটি বুর্জোয়া পার্টি গড়ে ওঠে ১৯০১ সালের শেষ ও ১৯০২ সালের গােড়ায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Socialist_Revolutionary_Party
জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ এবং সমসাময়িক ভূমিভোগের নীতিতে গ্রামগােষ্ঠীর বিশেষ ব্যবস্থায় ভূমি হস্তান্তরের দাবি করে তারা। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও তাদের হাতে উৎপাদনের সমস্ত মূল উপায় (ব্যাংক, বৃহৎ কারখানা, রেলপথ) হস্তান্তর না করলে শুধু জমির ব্যক্তিগত মালিকানা লোপে পুঁজিবাদী শােষণ দূর হওয়া সম্ভব ছিল না। সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিরা প্রলেতারিয়েত ও কৃষক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি পার্থক্য দেখতো না, কৃষকদের অভ্যন্তরে মেহনতী চাষিদের মধ্যে শ্রেণিগত স্তর বৈষম্য ও বিরােধ চাপা দেয়ার চেষ্টা করতো এবং বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতদের নেতৃত্ব মানতে রাজি ছিল না। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিরা মেনশেভিকদের সঙ্গে এক হয়ে যায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mensheviks
প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়া জমিদার-সামরিক সরকারে তাদের নেতারা যােগাযােগ করে। জমিদারি জমির মালিকানা উচ্ছেদের জন্য কৃষকদের দাবি সমর্থন করতে চায়নি সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি পার্টি। বরং সামরিক সরকারের সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি মন্ত্রী জমিদারির জমি দখলকারী কৃষকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেছিল। এসময় সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি পার্টির অভ্যন্তরে 'বামপন্থী' বলে একটি অংশ গড়ে ওঠে ও ১৯১৭ সালের নভেম্বরের শেষে তারা 'স্বাধীন বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি পার্টি' গঠন করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Left_Socialist-Revolutionaries
রাশিয়ায় বৈদেশিক হস্তক্ষেপে গৃহযুদ্ধের সময় এসব বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিরা প্রতিবিপ্লবী যড়যন্ত্রে অংশ নেয় এবং সােভিয়েত রাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালাতে থাকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Russian_Civil_War
অতজোভিস্টরা তৃতীয় রাষ্ট্রীয় দুমা থেকে বলশেভিক প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার এবং ট্রেড ইউনিয়ন, সমবায় প্রভৃতি সংগঠনগুলােতে কাজ বন্ধ করার দাবি জানায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Factions_of_the_Russian_Social_Democratic_Labour_Party
অতজোভিজমের আরেক নাম ছিল চরমপত্ৰবাদ। চরমপত্রবাদীরা প্রস্তাব করে দুমার সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক গ্রুপের কাছে চরমপত্র পেশ করা হােক এবং চরমপত্রের দাবি না মানলে তাদের দুমা থেকে প্রত্যাহার করা হােক। বামপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধ বাধে সােভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক ব্রেস্ত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Brest-Litovsk
১৯১৭ সালের নভেম্বরে বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য জার্মানি ও তার সহযােগীদের সঙ্গে আলােচনা শুরু করার জন্য সােভিয়েত রাষ্ট্রের প্রস্তাব ফ্রান্স, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করার পর সােভিয়েত সরকার রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে বের করে আনার জন্য অস্ট্রো-জার্মান ব্লকের সঙ্গে আলােচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ নভেম্বর ব্রেস্ত-লিতােভস্ক শহরে শান্তি সম্মেলন শুরু হয়। জার্মান প্রতিনিধিদলের দেয়া শর্ত অনুযায়ী জার্মান সৈন্যদল কর্তৃক অধিকৃত পােল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া ও বেলোরাশিয়ার একাংশ জার্মানির নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিতে হতো এবং ইউক্রেনকে জার্মানির অধীনস্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে হতো। লেনিন লক্ষ্য করলেন তাদের সৈন্যরা যুদ্ধ চালাতে অক্ষম এবং চার বছরের নিষ্ঠুর ও অর্থহীন যুদ্ধে অবসন্ন জনগণ শান্তি চাইছিল। সােভিয়েতকে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে নামতে হলে শান্তিপূর্ণ অবকাশ প্রয়ােজন বলে ভেবেছিলেন লেনিন। লেনিন ও তার মতাবলম্বীদের এ বিষয়ে বিরােধিতা করে ট্রটস্কি ও 'বামপন্থী' কমিউনিস্ট গ্রুপগুলাে। আলােচনা ভেঙে দিয়ে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দাবি করে 'বামপন্থী কমিউনিস্ট'রা। ট্রটস্কি ও বামপন্থী কমিউনিস্টদের নীতি মেনে নিলে সােভিয়েত রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে- এমনটাই মনে করতেন কমিউনিস্ট পার্টি ও লেনিনপন্থীরা। জার্মানির সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ। ব্রেস্ত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সােভিয়েত রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ অবকাশ লাভ করে, সমাজতান্ত্রিক নির্মাণে নামা সম্ভব হয় এবং প্রতিবিপ্লব ও বৈদেশিক হস্তক্ষেপকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মতাে শক্তি সঞ্চয় করা সহজ হয়। জার্মানিতে ১৯১৮ সালের নভেম্বর বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতনের পর ব্রেস্ত শান্তি চুক্তি নাকচ হয়ে যায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/German_Revolution_of_1918%E2%80%931919
আবার বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি পার্টি থেকে বহির্গত এবং ১৯১৮ সালের জুলাইয়ে বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি বিদ্রোহের পর তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগী নারােদনিক মতবাদের আরেক তথাকথিত 'বিপ্লবী কমিউনিস্ট' গ্রুপের জন্ম হয়েছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Narodniks
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রুপটি তথাকথিত ‘বিপ্লবী কমিউনিজমের পার্টি' রূপে সংগঠিত হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সহযােগিতা ও সােভিয়েত সরকারকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করে। অন্যদিকে বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি পার্টির (আন্তর্জাতিকতাবাদী) সাংগঠনিক জন্ম হয় ১৯১৭ সালের ১৯-২৮ নভেম্বরে (২-১১ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত তাদের প্রথম সর্ব রুশ কংগ্রেসে। দীর্ঘকাল দ্বিধার পর বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিরা কৃষকদের ওপর প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টায় বলশেভিকদের সঙ্গে সহযােগিতার পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রথমাবধি বলশেভিক পার্টি ও 'বামপন্থী' সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিদের মধ্যে আলােচনার ফলে সরকারে বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিরা স্বীয় কার্যকলাপে সােভিয়েত রাজের সাধারণ নীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং জনকমিসার পরিষদে ও কয়েকটি জন কমিসারিয়েতের মণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/People%27s_Commissariat
১৯১৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে 'বামপন্থী' সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ব্রেস্ত শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু করে এবং চুক্তিটি স্বাক্ষরিত ও ১৯১৮ সালের মার্চে চতুর্থ সােভিয়েত কংগ্রেস কর্তৃক অনুমােদিত হওয়ার পর তারা জন কমিসার পরিষদ পরিত্যাগ করে। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে 'বামপন্থী' সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারিদের কেন্দ্রীয় কমিটি মস্কোয় জার্মান রাষ্ট্রদূত মিরবাখের প্ররােচনামূলক হত্যাকাণ্ড ও সােভিয়েতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Wilhelm_von_Mirbach
ঘটনার প্রতিটি মােড় ফেরাতে যারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে লেনিন এমন সব পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবীদেরই 'বামপন্থী সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি' বলে অভিহিত করেন। রুশ বিপ্লবের কাছাকাছি সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রাথমিক অবস্থাতে 'বামপন্থী' বলে কথিত একদল কমিউনিস্ট উপদল গঠন করে কাজ করছিল। লেনিন তখন তথাকথিত এই বামপন্থী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম করছিলেন। বামপন্থীরা তাদের হঠকারী কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছিল। তাদের কার্যকলাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, মনে হচ্ছিলো এরাই বুঝি আসল সমাজতন্ত্রী। ভালাে ভালাে বিপ্লবী এদের মধ্যে ছিল, লেনিন তাদের বলেছিলেন ‘চমৎকার বিপ্লবী', কিন্তু সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকে বাঁচাতে তাদের আগেই পার্টি থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। লেনিন বলেছিলেন-
"একান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ‘পার্লামেন্টে' অংশগ্রহণের আবশ্যিকতা কোনােক্রমেই বুঝতে না চাওয়ার ফলে ১৯০৮ সালে 'বামপন্থী' বলশেভিকরা আমাদের পার্টি থেকে বহিস্কৃত হয়। 'বামপন্থী'দের মধ্যে অনেকেই ছিলেন চমৎকার বিপ্লবী, পরে সসম্মানে তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন (ও এখনাে আছেন)। এই 'বামপন্থীরা' বিশেষ করে নির্ভর করছিলেন ১৯০৫ সালের বয়কটের সার্থক অভিজ্ঞতার ওপর।"
মতাদর্শগত বিরোধ ও বহিষ্কারের ঘটনাগুলো সার্বিকভাবে ঘটছিল রুশ বিপ্লবের দশ বছর আগে থেকেই। রুশ বিপ্লব পর্যন্ত এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে যায়নি, ১৯১৮ সালে তারা পার্টির মধ্যে উপদল গড়ে তােলার অভিযােগে অভিযুক্ত হয়। লেনিন বলেছেন-
"ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তিকার উদ্ধৃতি থেকে আমরা দেখেছি কী দৃঢ়তায় বামপন্থীরা স্লোগান দিচ্ছেন। নিজেদের নি:সন্দেহেই মার্কসবাদী বলে ভাবেন ও মার্কসবাদী হতে চান এমন লােকেরা মার্কসবাদের মূল সত্যগুলাে ভুলে গেছেন দেখে কষ্ট হয়।"
এসব বামপন্থীর একটি উপদল 'কমিউনার-ব্ল্যাঙ্কিপন্থী' বলে পরিচিত ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Louis_Auguste_Blanqui
লেনিন বলেছেন এরা মনে করতাে দিনকয়েকের মধ্যে বিপ্লব শুরু করে দিতে হবে, এতে তাদের হাতে ক্ষমতা এসে যাবে, আর ‘তাহলে পরশুই কমিউনিজম চালু হয়ে যাবে।' লেনিন এদের বলেছেন 'অধৈর্যবাদী' এবং এরা 'ছেলেমানুষ’। জার্মানের বামপন্থীদের ব্যাপারে লেনিন বলেছেন 'জার্মান কমিউনিস্টরা' কমিউনিস্ট, কিন্তু তাঁর আপত্তি জার্মান বামপন্থীদের নিয়ে। কারণ ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তিকায় জার্মান বামপন্থীরা লিখেছিল-
"অন্যান্য পার্টির সঙ্গে যতকিছু আপােস, এদিক-ওদিক করা ও বােঝাপড়ার যতকিছু পলিসি দৃঢ়সংকল্পে বর্জন করা চাই।"
জার্মানিতে 'স্বাধীন সােশ্যাল ডেমােক্রেটিক পার্টি ছিল, তবে তা ছিল ১৯১৭ সালের এপ্রিলে গঠিত একটি মধ্যপন্থী পার্টি। এরা সােশ্যাল-শােভিনিস্টদের সঙ্গে ঐক্যের প্রচার চালায় ও শ্রেণি সংগ্রাম পরিহারের দিকে সরে যায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Social_patriotism
পার্টির মূল অংশটা ছিল কাউৎস্কিপন্থী সংগঠন নিয়ে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Karl_Kautsky
১৯২০ সালের অক্টোবরে স্বাধীন সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক পার্টির কংগ্রেসে ভাঙন ঘটে; ‘স্বাধীন'দের বড়াে একটা অংশ ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যােগ দেয়। দক্ষিণপন্থীরা আলাদা পাটি গড়ে তুলে ও জার্মানির স্বাধীন সােশ্যাল ডেমােক্রেটিক পাটি পুরনাে নামটাই গ্রহণ করে। এই পার্টি টিকে থাকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত। স্পার্টাকাসপন্থী নামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বামপন্থী সােশ্যাল-ডেমােক্রেটদের বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Spartacus_League
স্পার্টাকাসপন্থীরা জনগণের মধ্যে বিপ্লবী প্রচার চালায়, যুদ্ধ বিরােধী গণঅভিযান সংগঠন করে, ধর্মঘট চালায়, বিশ্বযুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ও সুবিধাবাদী বাম সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাট নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা ফাঁস করে দেয়। ১৯১৭ সালের এপ্রিলে স্পার্টাকাসপন্থীরা জার্মানির স্বাধীন সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক পার্টিতে যােগ দিলেও নিজেদের সাংগঠনিক স্বাধীনতা বজায় রাখে। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে জার্মানিতে বিপ্লবের সময় স্পার্টাকাসপন্থীরা ‘স্পার্টাকাস লীগ' গঠন করে। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর নিজেদের কর্মসূচি ঘােষণা করে 'স্বাধীন’দের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে। ১৯১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে স্পার্টাকাসপন্থীরা স্থাপন করে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি। 'ফ্রাঙ্কফুর্ট-অন-মেইল' নামক জার্মান কমিউনিস্টদের একটি গ্রুপ কর্তৃক প্রকাশিত জার্মান পুস্তিকা 'বামপন্থী বিরােধিতা'য় এ তাদের মতামত ঘােষিত হয়। 'কমিউনিজমে বামপন্থার শিশুরােগ' পুস্তকের বিভিন্ন পরিচ্ছেদে লেনিন এসব মতের সমালােচনা করেন। 'বামপন্থী বিরােধিতা’ কিংবা 'নীতিগত বিরােধিতা'র গ্রুপ (তারা নিজেদের যা বলে অভিহিত করতো) ১৯১৯ সালের অক্টোবরে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়। ১৯২০ সালের এপ্রিলে বহিষ্কৃতরা নিজেদের বামপন্থী সুবিধাবাদী পার্টি গঠন করে ও এটির নাম দেয় 'জার্মানির কমিউনিস্ট শ্রমিক পার্টি'। পরে জার্মানির কমিউনিস্ট۔শ্রমিক পার্টি একটি সংকীর্ণতাবাদী গােষ্ঠীতে অধঃপতিত হয়, শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তাদের কোনাে ভিত্তি থাকেনি। ১৯শ শতকের শেষে জার্মান সােশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির মধ্যে যে একটি মার্কসবাদ বিরােধী সুবিধাবাদী ধারা দেখা দেয়, তারা সংশােধনবাদের সবচেয়ে প্রকাশ্য প্রবক্তা জার্মান সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাট বের্নষ্টাইন এর নামে পরিচিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eduard_Bernstein
সামাজিক বিপ্লবের পার্টি থেকে সামাজিক সংস্কারের পার্টিতে পরিণত করার জন্য বের্নষ্টাইনপন্থীরা মার্কসবাদকে বদলে নিয়েছিল। লেনিন ইউরােপের নানা দেশের বামপন্থীদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে গিয়ে লিখেছেন-
#১৯০৭ সালে বলশেভিকরা দুমায় নির্বাচনের সময় অল্প সময়ের জন্য ‘সােশ্যালিস্ট রেভুলেশনারি'দের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক জোট বাঁধে।
#১৯০৩ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত মেনশেভিকদের সঙ্গে আমরা মাঝে মাঝে কয়েক বছর ধরে একই সােশ্যাল-ডেমােক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরে থেকেছি।
#যুদ্ধের সময় আমরা কিছু কিছু আপােস করি 'কাউৎস্কিপন্থী'দের সঙ্গে।
#বামপন্থী মেনশেভিকদের সঙ্গে/এবং ‘সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি'দের একাংশের সঙ্গে...আমরা তাদের সঙ্গে একত্রেই বসেছি।
#অক্টোবর বিপ্লবের ঠিক মুহুর্তটাতেই আমরা শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জোট স্থাপন করি পেটি বুর্জোয়া কৃষকদের সঙ্গে।
#কোনাে রকম বদল না করে পুরােপুরি গ্রহণ করি সােশ্যালিস্ট-রেভ্যুলশনারি কৃষি কর্মসূচি।
#একই সময়ে আমরা বামপন্থী সােশ্যালিস্ট রেভ্যুলশনারিদের সঙ্গে সরকারে অংশগ্রহণ সমেত আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক ব্লকের প্রস্তাব দিই।
এসব থেকে বােঝা যায়, বামপন্থীদের কাজ ছিল কমিউনিস্ট ভাব ধরে সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজমকে ক্ষতি করা, বিতর্কিত করা। এসব তথাকথিত সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট বামপন্থীরা রাশিয়াতে যেমন কমিউনিস্টদের ভুগিয়েছে, তেমনটা ইউরােপের অনেক দেশেও ভুগিয়েছিল। জার্মানিতে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি কাউৎস্কিপন্থী স্বাধীন সােশ্যাল ডেমােক্রেটিক পার্টির সঙ্গে জোট করেছিল, আর সেই ঘটনাকে জার্মান বামপন্থী বলে পরিচিতরা সমালােচনা ও আক্রমণ করেছিল। লেনিন বলেছেন-
"জার্মান বামপন্থীদের আক্রমণগুলাে আমাদের কাছে একেবারেই চাপল্য বলে এবং বামপন্থীদের বেঠিকতার জাজ্বল্যমান প্রমাণ বলে মনে হয়।"
রাশিয়া ও জার্মানিতে কমিউনিস্ট বলে পরিচিত কথিত বামপন্থীরা আন্দোলন-সংগ্রামে যেসব ভুল করেছিল, লেনিন এগুলােকে 'বামপন্থী শিশুরােগ' বলে চিহ্নিত করেছেন। এসব বামপন্থী শিশুরােগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বালখিল্যতা, জেদ, উগ্রতা ইত্যাদির সংমিশ্রণ। তাদের এমন অপরিপক্ক ছেলেমানুষিকে উদ্দেশ্য করে লেনিন বলেছেন-
"জার্মানিতে 'বামপন্থী'দের নিঃসন্দেহে একটি ভুল হলাে ভার্সাই শান্তি চুক্তি অস্বীকারের জন্য তাদের একমুখী জেদ।"
লেনিন আরও বলেছেন-
"বামপন্থী কমিউনিস্টরা ছেলেমানুষের মতাে সেই পাতা ফাঁদেই পা দিচ্ছে। এটা বিপ্লববাদ নয়, বােকামি।"
বামপন্থীদের তিনি ‘অপদার্থ' বলেও তিরস্কার করেছেন। বামপন্থীরা কখনােই কমিউনিস্ট ছিল, বরং এরা ছিল কমিউনিস্টদের জন্য আপদ স্বরূপ। জার্মানির মতাে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে শ্রমিক প্রতিনিধি পাঠানাের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক সংগঠন ও গ্রুপগুলােকে সম্মিলিত করে ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডের লেবার পার্টি, দলটি প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই পার্টির নেতারা বুর্জোয়াদের সঙ্গে শ্রেণি সহযােগিতার নীতি চালায়। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) লেবার পার্টির নেতারা সােশ্যাল-শােভিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে সরকারে যােগ দেয়। শ্রমিকবিরােধী বহু আইন ইংল্যান্ডে গৃহীত হয় লেবার পার্টির নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে। ফ্রান্সেও বামপন্থার ছিল একই ধারা। এদের মধ্যে যারা ছিল গেদপন্থী, তারা ১৯শ শতকের শেষ ও ২০শ শতকের গােড়ায় ফরাসি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অভ্যন্তরে জুল গেদের নেতৃত্বে বিপ্লবী মার্কসবাদী ধারার জন্ম দেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jules_Guesde
১৯০১ সালে গেদপন্থীরা ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক পার্টি গঠন করে। ১৯০৫ সালে জোরেসপন্থীদের প্রতিষ্ঠিত ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টির সঙ্গে গেদপন্থীরা মিলিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jean_Jaur%C3%A8s
১৯১৪-১৯১৮ সালের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় এ পার্টির নেতারা শ্রমিক শ্রেণির অভীষ্টের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে সােশ্যাল শােভিনিজমের দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে। আর জোরেসপন্থীরা ১৯০২ সালে সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টি গঠন করে। এছাড়া ব্রুসপন্থী কিংবা পসিবিলিস্টরা ছিল ১৯শ শতকের ৮০-র দশকে ফরাসি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে পেটি বুর্জোয়া সংস্কারবাদীদের ধারা।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Paul_Brousse
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Possibilism_(politics)
পসিবিলিস্টরা প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী কর্মসূচি ও বিপ্লবী রণকৌশল বর্জন করে, শ্রমিক আন্দোলনের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যটা ঝাপসা করে তােলে এবং শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম সীমাবদ্ধ করতে চায় সম্ভবপরের পরিধিতে। পরের দিকে পসিবিলিস্টদের বেশির ভাগ সংস্কারবাদী ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টির মধ্যে মিশে যায়। ইতালিতে ইন্টেগ্র্যালিস্ট নামে ইতালীয় সােশ্যালিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে একটি ধারা ছিল। পুরােপুরি পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হলেও ইন্টেগ্র্যালিস্টরা ২০শ শতকের গােড়ার দিকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের সহযোগী চূড়ান্ত সুবিধাবাদী সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে বহু প্রশ্নে সংগ্রাম চালায়, এরাও বামপন্থী বলে পরিচিত ছিল। আরো একটি ধারা 'বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিজম', যা ছিল পেটি বুর্জোয়া ও আধা-নৈরাজ্যবাদী ধারা। উনিশ শতকের শেষ দিকে পশ্চিম ইউরােপে বহু দেশের শ্রমিক আন্দোলনে এটি দেখা যায়। শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সগ্রাম ও প্রলেতারীয় একনায়কত্বের প্রয়ােজনীয়তা অঙ্গীকার করে সিন্ডিক্যালিস্টরা পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকায় আপত্তি করে। এরা ভাবতো ট্রেড ইউনিয়নগুলােই শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘট মারফত বিনা বিপ্লবে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ করে স্বহস্তে উৎপাদন পরিচালনার ভার নিতে পারে। এরাও সমাজে বামপন্থী বলে পরিচিত ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Syndicalism
বামপন্থার আড়ালে পেটি বুর্জোয়া তত্ত্বকে সামনে রেখে লেনিন লিখেছেন-
"পেটি বুর্জোয়া যে শিথিলতা মাঝে মাঝে 'বামপন্থী’ ধ্বনির আড়াল নেয়, তা সমর্থনের সমগ্র বাতুলতার জাজ্বল্যমান প্রমাণ রাজনৈতিক সাহিত্যে এর বেশি আশা করা যায় না। 'বামপন্থী কমিউনিস্টদের' যুক্তিগুলির বিচার হিতকর ও আবশ্যক, কেননা এটা চলতি মুহূর্তটার বৈশিষ্ট্য; এগুলিতে অসাধারণ স্পষ্টতা নেতিবাচকভাবে ফুটে উঠেছে এ মুহূর্তটার 'মূলকথা'; যুক্তিগুলি শিক্ষাপ্রদ, কেননা এ লােকগুলি হলাে বর্তমান মুহূর্তটা যারা বুঝছে না তাদের মধ্যকার সেরা লােক, উদার ও নিষ্ঠার দিক থেকে ওরা একই ভুলের মামুলি প্রতিনিধিদের চেয়ে..."
বামপন্থীদের সম্পর্কে লেনিন উপহাস করে লিখেছেন-
"রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে অথবা রাজনৈতিক ভূমিকার দাবিদার হিসাবে বামপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপ তাদের বর্তমান মুহূর্তের থিসিস দিয়েছে এবং এই উত্তম মার্কসবাদী রীতিটি থেকেই আমাদের 'বামপন্থীদের' ভুল উদ্ঘাটনে সাহায্য হচ্ছে। ব্রেস্ত শান্তি চুক্তি করা সঠিক ছিল কি? এই প্রশ্নটা সরাসরি হাজির করতে 'বামপন্থীরা' সাহস পায় নি এবং হাস্যকরভাবে হোঁচট খেয়েছে তারা, যুক্তির পর যুক্তির পাহাড় গড়েছে, সর্বতােভাবে বিশ্লেষণ করেছে যত রকমের ‘একদিক থেকে এই' এবং 'অন্যদিক থেকে ওই' এবং কীভাবে নিজেরাই নিজেদের পরাস্ত করছে সেটা না দেখবার চেষ্টা করছে।"
লেনিনের সময় বামপন্থীরা ছিল তত্ত্বের কচকচানিওয়ালা এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, যারা কাজের চেয়ে তত্ত্ব নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে ভালবাসতাে এবং নিজেরা কিছু করতে পারুক বা না পারুক অন্যের সমালােচনায় সিদ্ধহস্ত ছিল। রাশিয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশে এ রােগে আক্রান্ত বামপন্থীদের খুব প্রকোপ ছিল এবং বর্তমানেও আছে। তত্ত্বসর্বস্ব বামপন্থীদের কটাক্ষ করে লেনিন বলেছেন-
"তত্ত্ব বানানো হয়েছে এই যে শান্তিটা নাকি কার্যকরী করে ক্লান্ত ও শ্রেণিচ্যুতরা, এতে না হেসে পারা যায়? শান্তির পক্ষে যে ভোট পড়েছিল সে সম্পর্কে (বামপন্থীদের) টু শব্দটি নেই, সামাজিক ও শ্রেণিচরিত্র নিয়ে কথাটি নেই। 'বিজ্ঞান সম্মত' মজাদার সব ব্যাখ্যা দিয়ে বিশুদ্ধ ছেলেমানুষি কায়দায় চাপা দেওয়া হয়েছে নিজেদের ভরাডুবি, চাপা দেওয়া হয়েছে এমনসব প্রত্যক্ষ ঘটনা, যার সরল খতিয়ান টানলেই দেখা যেত যে ঠিক শ্রেণিচ্যুত, বুদ্ধিজীবী পার্টির 'শীর্ষ' ও চূড়োটাই বিপ্লবী পেটি বুর্জোয়া বুলিবাগীশ ধ্বনি দিয়ে শান্তিতে আপত্তি করেছিল।"
লেনিন 'বামপন্থী' নামক এই পরজীবীদের বিরুদ্ধে কতটা আপোসহীন ছিলেন, তা তাঁর ভাষা প্রয়োগের কঠোরতার দিকে দেখলে অনুধাবন করা যায়-
"যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে 'বামপন্থীদের' উল্লিখিত সবকিছু ঘোষণা ও কথার প্যাঁচের মধ্যদিয়েও কিন্তু সাদামাটা ও পরিষ্কার সত্যটা ফুটে বেরোয়।"
বামপন্থীরা যে কমিউনিস্ট ছদ্মবেশে আছে, তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে লেনিন বলেছেন-
"আমাদের 'বামপন্থী' কমিউনিস্টরা, যারা আবার নিজেদের 'প্রলেতারীয়' কমিউনিস্ট বলতেও ভালোবাসে-প্রলেতারীয়ত্ব তাদের মধ্যে খুবই কম এবং পেটি বুর্জোয়াত্ব খুবই বেশি বলেই শক্তি অনুপাত নিয়ে, শক্তি অনুপাতের খতিয়ান নিয়ে ভাবতে পারে না। মার্কসবাদ ও মার্কসবাদী রণকৌশলের এইটাই হলো মূলকথা, কিন্ত সে 'মূলকথাটা' তারা পাশ কাটিয়ে যায় 'সগর্ব' সব বুলি দিয়ে।"
বামপন্থীদের প্রকৃত স্বরূপটি আরো তুলে ধরতে গিয়ে লেনিন বলেছেন-
"একেবারেই হীরের টুকরো! তিন বছরের একান্ত জবা জ্বালিয়ে মারা ও একান্ত প্রতিক্রিয়াশীল এক যুদ্ধের পর সোভিয়েত রাজ ও তার সঠিক, বুলিবাগীশিতে পা না দেওয়া রণকৌশলের কল্যাণে জনগণ পেয়েছে ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র, একেবারে অল্প, নড়বড়ে ও একান্ত অপূর্ণ একটা দম নেবার অবকাশ, আর 'বামপন্থী' পুঁচকে বুদ্ধিজীবীরা আত্মপ্রেমী নার্সিসাসের মহিমা নিয়ে ভাবগম্ভীর বাণী দিচ্ছে। পার্টি কংগ্রেসে আমি বলেছিলাম যে, 'বামপন্থীদের' পত্র পত্রিকায় কমিউনিস্ট নাম দিলে চলবে না।"
কী কারণে লেনিন বামপন্থীদের কমিউনিস্ট মনে করেন না সে বিষয় লেনিন উল্লেখ করেছেন-
"মেহনতীদের শোষিত জনগণের জীবনাবস্থা ও মনোবৃত্তি খানিকটা বোঝে এমন কোনো কমিউনিস্ট কি কখনো এক নবাব বা স্লিয়খতিচের মেজাজওয়ালা টিপিক্যাল বুদ্ধিজীবী, পেটি বুর্জোয়া, শ্রেণিচ্যুতের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সরে যেতে পারে যাতে 'শান্তির মনোবৃত্তিকে' ঘোষণা করা হয় নিষ্ক্রিয় বলে আর পিচবোর্ডের তরবারি আস্ফালনটাকে মনে করা হয় সক্রিয়তা? এই ঘটনাটা যখন আমাদের 'বামপন্থীরা' এড়িয়ে যায় তখন সেটা নিতান্তই পিচবোর্ডের তরবারি আস্ফালন। 'কমিউনিস্ট' পত্রিকায় প্রতি পদেই আমরা দেখেছি যে আমাদের 'বামপন্থীরা' প্রলেতারীয় লৌহ শৃঙ্খলা ও তার প্রস্তুতির কথাটা একদম বোঝে না, শ্রেণিচ্যুত পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর মনোবৃত্তিতে তারা একেবারে আচ্ছন্ন।"
বামপন্থীদের নিয়ে যে বিপদ, তা দেখানোর জন্য লেনিন তাদের টিপিক্যাল বুদ্ধিজীবী, পেটি বুর্জোয়া ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। বামপন্থীদের যুদ্ধের তরবারিটা 'পিচবোর্ডের তৈরি' বলে উপহাস করতে লেনিন ছাড়েননি৷ লেনিন বামপন্থীদের ব্যাপারে আরও বলেছেন-
"প্রিয়বর 'বামপন্থী কমিউনিস্ট', কী অপার তাঁদের দৃঢ় সংকল্প আর কী অল্পই না তাঁদের চিন্তাশীলতা! আমাদের 'বামপন্থীদের' বিপদ এই যে তারা একান্ত দৃঢ় সংকল্প...তাঁরা সমস্যাটির মূলকথা, বর্তমান মুহূর্তের মূলকথা কিছুই বোঝেননি।"
বড় বড় কথা তারা বলতো এবং লিখতো। পড়লে মনে হবে এরাই সঠিক। তাদের মুখপত্রে একবার তারা লিখলো-
"প্রতিষ্ঠানগুলির সংগঠন ও পরিচালনার সমস্ত উদ্যোগ থাকবে 'ট্রাস্ট সংগঠকদের' হাতে: আমরা তো তাদের শেখাতে চাই না, সাধারণ কর্মীতে তাদের পরিণত করতে চাই না, চাই তাদের কাছ থেকেই শিখতে।"
('কমিউনিস্ট', প্রথম সংখ্যা, ৪ এপ্রিল ১৯১৮)
কথাগুলো তারা লিখেছিল লেনিনের একটি প্রবন্ধকে সামনে রেখে, যেখানে লেনিন ট্রাস্ট সংগঠকদের কাছ থেকে সমাজতন্ত্র শেখার কথা বলেছিলেন। তিনি এ রকম আপ্ত বাক্য ও বুলি কপচানোর বিরুদ্ধে সবসময়ই সংগ্রাম করেছেন। বামপন্থীদের করুণা করে লেনিন তাই লিখেছেন-
"আপনাদের বুঝিয়ে বলি, প্রিয় বন্ধু কেন আপনাদের কপালে এই দুর্ভোগ ঘটেছে: কেননা বিপ্লবের ধ্বনিগুলো ভেবে বার করার চাইতে তা আপনারা মুখস্থ ও ঠোঁটস্থ করে রাখেন। সেই জন্যই আপনারা 'সমাজতান্ত্রিক পিতৃভূমি রক্ষা' কথাটা উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে দেন, তাতে নিশ্চিতই আপনাদের ব্যঙ্গ প্রচেষ্টাই বোঝানো উচিত, কিন্তু আসলে তাতে আপনাদের মাথায় গোবরের প্রমাণই মিলছে।"
এখনো দেশে দেশে ওইসব 'মাথায় গোবর'ওয়ালা বামপন্থীদের বংশধররা তত্ত্ব নিয়ে নিরন্তর বকবকানি করে যাচ্ছে, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। বামপন্থীরা লেনিন পরবর্তী যুগে যে এভাবে বিভিন্ন দেশেও আবির্ভূত হবে, লেনিন সেটাও বুঝেছিলেন। তাই বামপন্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করে লেনিন বলেছেন-
"বামপন্থীরা পরিণত হয় দোলায়মানতার মেরুদন্ডহীন প্রচারকে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের তত্ত্ব সাহায্য করছে সাম্রাজ্যবাদীদের।"
যদিও লেনিন মনে করতেন 'বামপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে তর্কে নামা দরকার', তবু তিনি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত টেনেছেন এভাবে-
"বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলশনারিদের সঙ্গে তর্ক করারও প্রয়োজন হয় না, বাক্যবাগীশিদের একটা বিরক্তিকর দৃষ্টান্ত হিসেবে তাদের দিকে আঙুল দেখানোই যথেষ্ট।"
বামপন্থীরা সমাজতন্ত্রের কেমন শত্রু, সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যে বামপন্থীদের কোনো সম্পর্ক নেই, উল্টো রয়েছে বিরোধ এবং সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে বামপন্থীরা একটি বাধা, ওপরের উদ্ধৃতিগুলো তার-ই প্রমাণ। সুতরাং বামপন্থা ও সমাজতন্ত্র এক জিনিস নয়।
Comments