স্তালিন ও সোভিয়েত ভাষাবিজ্ঞান

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাষাবিতর্ক প্রথম স্তালিনের নজরে আনেন সোভিয়েত জর্জিয়ার সেন্ট্রাল কমিটির প্রধান সম্পাদক ক্যানদিদ শার্কভিয়ানী।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kandid_Charkviani

যার মাধ্যমে এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল, সেই নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nikolai_Marr

তিনি ১৯২৪ সাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে গেছেন ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞানের’ কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে।

নিকোলাই মার ভাষাকে দেখেছিলেন আইডিওলোজি'র একটি ফর্ম হিসেবে। তিনি বলেছিলেন-

"ভাষা অবকাঠামোর অংশ, প্রতিনিধিত্ব করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা শ্রেণিসমূহের।"

সমাজের মূল কাঠামোর বিভিন্ন আদর্শ ও ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য, বহমান রাখার জন্য অবকাঠামোর অংশ হিসেবে ভাষার ভূমিকা নির্ধারণ করেন তিনি। মার এর 'শ্রেণিভাষা'র ধারণা ভাষাবিজ্ঞানে পরিচিত ‘জ্যাফেটিক তত্ত্ব’ নামে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Japhetic_theory#:~:text=In%20linguistics%2C%20the%20Japhetic%20theory,languages%20of%20the%20Middle%20East.

জ্যাফেটিক শব্দটি নিকোলাই নেন নোয়াহ'র এক ছেলে জ্যাফেথের নাম থেকে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Japheth

ককেসাস অঞ্চলের কার্টভেলীয় ভাষাগুলোর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক ভাষাগুলোর সম্পর্ক দেখানোর লক্ষ্যে তিনি এ তত্ত্বায়ন করেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kartvelian_languages

কার্টভেলীয় ভাষাগুলির মধ্যে জর্জিয়ার ভাষা ছিল একমাত্র লিখিত ভাষা। এজন্যই প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে চোখে পড়ে শার্কভিয়ানীর। মার ধারণা দেন ককেশীয়, সেমেটিক-হামিটিক এবং বাস্ক ভাষার উৎস অভিন্ন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Afroasiatic_languages

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Basque_language

এই তত্ত্বের আংশিক রূপরেখা তিনি তৈরি করেন অক্টোবর বিপ্লবের আগে। কিন্তু তা ভিন্ন পরিণতির দিকে এগোয় অক্টোবর বিপ্লবের পর। মার তার তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করেন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মূল ভিত্তির সন্ধানে, দাবি করেন এসব ভাষা আসার আগে ইউরোপ জুড়ে চালু ছিল জ্যাফেটিক ভাষাগুলো।

"খুঁজলে এসব ভাষাকে এখনও পাওয়া যাবে - এগুলো টিকে রয়েছে ভাষার উপস্তর হিসেবে, যার ওপর প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো।"

ভাষার এই মডেল ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে মার উদ্যোগী হন ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রয়োগের এবং মত দেন যে ভাষার বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি এমন দাবিও করেন যে ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে বিভিন্ন দেশের একই ধরনে বিন্যস্ত সামাজিক শ্রেণির ব্যবহৃত ভাষার কথ্য সংস্করণ অনেকটাই কাছাকাছি, যদিও তা অন্যান্য শ্রেণিগুলোর ভাষার কথ্য সংস্করণের চেয়ে দূরবর্তী। ঠিক তেমনি বিভিন্ন দেশের অন্যান্য শ্রেণির ভাষাগুলোর কথ্য সংস্করণ আবার অনেকটাই কাছাকাছি। এইভাবে মার একটি জনগোষ্ঠীর শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষের অভিন্ন ভাষার ধারণাটিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আবারও বিষয়টি নিয়ে তর্ক বাধে এবং কোরিয়া যুদ্ধ চলাকালীন এ ব্যাপারে বক্তব্য রাখেন স্তালিন।
নিকোলাই মার এর অনুসারী জর্জিয়ার ভাষাবিদ আরনল্ড শিকোবাভার ভাষাবিষয়ক কয়েকটি নিবন্ধ স্তালিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন সোভিয়েত জর্জিয়ার সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম সম্পাদক ক্যানদিদ শার্কভিয়ানী।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Arnold_Chikobava

লেখাগুলোর সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত উদ্বেগ - ভাষাকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিকোলাই এর পদ্ধতি কি সত্যিই মার্কসবাদ সম্মত? প্রশ্ন তুলেছিলেন শার্কভিয়ানী-

"সব ভাষা যদি শ্রেণিভিত্তিকই হয়, তাহলে কিভাবে বিশ্লেষণ করা হবে শ্রেণিহীন সময়ের, আদিম সাম্যবাদী পর্ব বিকাশের সময়কার ভাষা ব্যবহারকে? প্রধান উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে, পৃথক পৃথক জাতীয় সংস্কৃতিগুলোর সঙ্গে ভাষার সংশ্লিষ্টতাকেই বা ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে?"

এরকম প্রশ্নের মুখে স্তালিন ডেকে পাঠান শিকোবাভা এবং ক্যানদিদ শার্কভিয়ানীকে। দুই পক্ষের ভাষ্য শোনার পর স্তালিন শিকোবাভাকে বলেন, ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে তার এ ধারণা প্রাভদা'র মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Pravda

৯ মে, ১৯৫০ সালে প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশ পায় শিকোবাভার অভিমত। প্রাভদা পত্রিকা এ নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য প্রতি সপ্তাহে বরাদ্দ করে দু’টি পাতা। সম্পাদকের পক্ষ থেকে এ বিভাগের ব্যানারহেডিং এর সঙ্গে নোট রাখা হয়, ‘সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ভাষাবিজ্ঞান বিকাশের প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে প্রাভদায় আয়োজিত মুক্ত আলোচনা।’ কয়েক সপ্তাহ নিকোলাইয়ের ঐ তত্ত্বের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে পত্রিকাটিতে। ২০ জুন, ১৯৫০ সালে একদল সোভিয়েত ছাত্রের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে ’মার্ক্সসিজম এন্ড প্রব্লেমস অব লিঙ্গুয়িস্টিকস’ লেখাটির মধ্য দিয়ে এ বিতর্কে অংশ নেন স্তালিন।

https://www.marxists.org/reference/archive/stalin/works/1950/jun/20.htm

স্তালিন বলেন-

"ভাষা সামাজিক ভিত্তির কোনও অবকাঠামো নয়। সমাজের ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক, দার্শনিক, আইনগত, ধর্মীয়, শিল্প-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন মত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ সেই অর্থনৈতিক কাঠামোর অবকাঠামো। এ কারণে কাঠামো যখন পাল্টায়, তখন অনিবার্য কারণেই অবকাঠামোও পাল্টায় বা পর্যায়ক্রমে অপসৃত হয়। নতুন কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে নতুন এক অবকাঠামো। কিন্তু ভাষা এরকম পরিবর্তনশীলতার স্রোতে পড়ে না, কেননা ভাষা অবকাঠামোর চেয়ে রেডিক্যালি আলাদা।"

তিনি ভাষার এই রেডিক্যাল দিক তুলে ধরেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজ বিপ্লবের উদাহরণ দিয়ে। তিনি আরও বলেন-

"এখানে বিপ্লব হয়েছে, বিপ্লবপূর্ব পুঁজিবাদী কাঠামো ও অবকাঠামোগুলোও অপসৃত হয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার ভাষার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য কোনও ভাষার। নতুন এক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং নতুন সামাজিক সম্পর্ক ও নৈতিকতার কারণে, তাছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্তি ঘটায় বিভিন্ন ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে অবশ্য অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক শব্দ, নতুন অনেক প্রকাশ ভঙ্গিমা। সামাজিক বিপ্লবের ফলে সমাজের শব্দ ভাণ্ডারে সংযুক্ত এসব নতুন শব্দের মধ্য দিয়ে সমাজ সমৃদ্ধ হয়েছে, যোগাযোগের মাধ্যম খুঁজে পেয়েছে। ঠিক একইভাবে এর ফলে অনেক শব্দ ও প্রকাশ ভঙ্গিমার অর্থ পাল্টে গেছে, অনেক শব্দ নতুন করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং কিছু শব্দ বাদও পড়ে গেছে শব্দের ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু তার মানে এই নয় ভাষা বদলে গেছে, কেননা ভাষার বুনিয়াদ নির্মিত হয় তার মৌলিক শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে; যা সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের পরও কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়াই নিজের সামগ্রিকতা সংরক্ষণ করতে পারে।"

অবকাঠামের সঙ্গে ভাষার পার্থক্য খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি বিভিন্ন দিক থেকে এবং দেখেছেন অন্তত তিনটি দিক থেকে ভাষা রেডিক্যালি আলাদা। প্রথমত ভাষা কোনও সুনির্দিষ্ট সমাজের নতুন অথবা পুরানো এক অথবা একাধিক ভিত্তির উৎপাদন নয়। ভাষা সৃষ্টি হয় বহু শতাব্দী ধরে সমাজ ও তার কাঠামোসমূহের ইতিহাসের সামগ্রিক ধারা থেকে। কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণি একে সৃষ্টি করে না; তাকে সৃষ্টি করে পুরো সমাজ, সৃষ্টি করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগুলো আর তা সৃষ্টি হয় শত শত প্রজন্মের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। ঠিক তেমনি এটি কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণির প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়; বরং পুরো সমাজের জন্য, সমাজের সকল শ্রেণির প্রয়োজন মেটানোর জন্যই সৃষ্টি হয়ে থাকে। কারণ ভাষার সৃষ্টি সমাজের জন্য। সমাজের সকল সদস্যের একক ও অভিন্ন ভাষা হিসেবেই তা সৃষ্টি হয়ে থাকে। একটা শ্রেণি আরেকটা শ্রেণির ওপর প্রভুত্ব করবে, কর্তৃত্ব করবে - এজন্য ভাষা গড়ে ওঠে না। ভাষা গড়ে ওঠে জনগণের মধ্যে যোগাযোগের সংযোগ হিসেবে, সমানভাবে গোটা সমাজের ও সমাজের সকল শ্রেণির সেবার করতে। এ কারণেই এটি কোনও আদর্শগত অবকাঠামোর অন্তভুক্ত হতে পারে না। নিজেকে আদর্শগত অবকাঠামোর বাইরে রাখতে সক্ষম বলেই ভাষা পারে একই সঙ্গে পুরনো ও মরমর ব্যবস্থা এবং নতুন ও উঠতি ব্যবস্থার, পুরনো ও নতুন কাঠামোর এবং শোষক ও শোষিত উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ-সংযোগ ঘটাতে। ভাষার অস্তিত্ব নির্ভর করছে সমগ্র সমাজকে সেবা করার ওপর, জনগণের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কার্যকর থাকার ওপর, সমাজের সকল সদস্যের কাছে সাধারণ ও একক একটি ভাষা হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে শ্রেণি অবস্থান ও শ্রেণি মর্যাদা নির্বিশেষে সমাজের সকল সদস্যের সমান সেবা করার ওপর। স্তালিন বলেছেন-

"ভাষা তার এই অবস্থান থেকে, সমগ্র মানুষের সাধারণ ও একক ভাষা হয়ে ওঠা থেকে বিচ্যুত হয় তখন যখন এটি বিশেষ কোনও গোষ্ঠীকে সমাজের অপরাপর সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয় ও সমর্থন করে। তখন সে তার শক্তি হারায়, সমাজের জনগোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগের উপায় না হয়ে প্রতিবন্ধক হয় এবং বিশেষ কোনও সামাজিক গোষ্ঠীর অপভাষা বা জার্গনে পরিণত হয়।"

ভাষার দ্বিতীয় রেডিক্যাল দিক হলো এর দীর্ঘস্থায়িত্ব। অবকাঠামো সম্পৃক্ত সেটির অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে। এই দিক থেকে তা একটি বিশেষ যুগের উৎপাদন, একটি বিশেষ অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিপূরক। ঐ অর্থনৈতিক কাঠামোটি যখন পাল্টে যায়, তখন অনিবার্যভাবে অবকাঠামো পাল্টায়। স্তালিন দেখেছেন ভাষা এসবের বিপরীতে, গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে; দিনের পর দিন তা সমৃদ্ধ হয়, বিকশিত হয়। কাজেই কোনও ভাষার স্থায়িত্ব কোনও অবকাঠামোর চেয়ে অনেক বেশি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন-

"সামাজিক জীবনে চূড়ান্ত এক নৈরাজ্য সংঘটনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব হতে পারে একটি ভাষাকে বিনাশ করা এবং ডন কুইক্সোট ছাড়া আর কেউই নিজেকে এ ধরনের কাজে জড়াবে না।"

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Don_Quixote

ভাষার তৃতীয় রেডিক্যাল দিক হলো উৎপাদনের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সংযুক্তি। স্তালিন দেখতে পান ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে, মানুষের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত; অন্যদিকে অবকাঠামো উৎপাদন ও মানুষের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত থাকে না। এসবের সঙ্গে তার সংযুক্তি ঘটে অপ্রত্যক্ষভাবে; অর্থনীতির মাধ্যমে, কাঠামোর মাধ্যমে। ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত বলে এর শব্দের ভাণ্ডার নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। কেননা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে, শিল্পে ও কৃষিতে, বাণিজ্য ও পরিবহনে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে এবং সেই পরিবর্তন তাদের কার্যক্রমের জন্যে প্রতিনিয়ত ভাষার কাছে নতুন নতুন শব্দ ও প্রকাশ ভঙ্গিমা দাবি করে। ভাষাকে তাদের সেই প্রয়োজন সরাসরি মেটাতে হচ্ছে ব্যাকরণগত পদ্ধতিকে আরও যথাযথ করে তুলে, শব্দ ভাণ্ডারে নতুন নতুন শব্দ সংযুক্তির মাধ্যমে। অবকাঠামোর অংশ হিসেবে ভাষার অস্তিত্ব নাকচ করার মধ্য দিয়ে স্তালিন নাকচ করে দিয়েছিলেন ভাষার শ্রেণি চরিত্রের প্রশ্ন, শ্রেণিভাষার প্রশ্ন। ক্ল্যান ভাষা থেকে ট্রাইব ভাষা, ট্রাইব ভাষা থেকে জাতিসত্তাসমূহের ভাষা এবং জাতিসত্তাসমূহের ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা - ভাষা বিকাশ ও উত্তরণের প্রতিটি পর্বে সমাজের জনগণের মধ্যকার যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষা ছিল ঐ সমাজের সাধারণ ও একক ভাষা যা তাদের সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সকল সদস্যের সমানভাবে সেবা করবে। শ্রেণি ভাষার প্রশ্নটিকে নাকচ করতে গিয়ে স্তালিন ভাষার সর্বশ্রেণিগামিতাকে সামনে নিয়ে আসেন। তবে স্তালিন এটাও জানান, ভাষা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় হিসেবে সকল শ্রেণির প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণ ভাষার প্রতি সমভাবাপন্ন না-ও হতে পারে। এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়, কেননা মানুষ চায় ভাষাকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করতে এবং তাই বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও গোষ্ঠী ভাষার ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করে তাদের বিশেষ ভাষাবাক্য, বিশেষ পদবাচ্য, বিশেষ প্রকাশ ভঙ্গিমা। জনগণ থেকে বিচ্যুত বিত্তবানদের উচ্চতর স্তরের ব্যক্তিরা, অভিজাত ও বুর্জোয়ার স্তরভুক্ত ব্যক্তিরা ভাষার বিভিন্ন মানদণ্ড হাজির করে নিজেদের পৃথকসত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এভাবেই স্তালিনের মতে দেখা দেয় বহুল আলোচিত ‘শ্রেণি’ ডায়ালেক্ট, অপভাষা, উঁচু শ্রেণির ভাষা ইত্যাদি এবং এসব ডায়ালেক্ট আর অপভাষাগুলো প্রায়সময় সাহিত্যে চালিয়ে দেয়া হয় ভাষা হিসেবে - কখনো অভিজাত অথবা বুর্জোয়া ভাষা হিসেবে, কখনো আবার এর বিপরীতে প্রেলেতারিয়েত কিংবা কৃষকের ভাষা হিসেবে, গণমানুষের ভাষা হিসেবে। এ ধরণের ডায়ালেক্ট বা উপভাষা ও অপভাষাকে ভাষা হিসেবে দেখতে রাজি হননি স্তালিন। তিনি বলেছেন, এ ধরণের ডায়ালেক্ট ও অপভাষার কোনও ব্যাকরণগত পদ্ধতি থাকে না এবং নেই কোনও মৌল শব্দের ভাণ্ডার - এ কারণে তাদের নির্ভর করতে হয়, প্রতিনিয়ত ধার করতে হয় জাতীয় ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দের ভাণ্ডারকে। তিনি দেখেছেন, এ ধরণের ডায়ালেক্ট ও অপভাষাসমূহ সংকীর্ণ পরিসরে সীমাবদ্ধ, একটি শ্রেণীর উঁচু স্তরে ঘূর্ণায়মান এবং সমগ্র সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনুপযোগী। উপভাষা ও অপভাষাসমূহের স্বাধীন ভাষা হিসেবে বিকাশের প্রচেষ্টা স্তালিনের কাছে মনে হয়েছে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রবণতা। বুর্জোয়াদের ভাষা আলাদা, প্রলেতারিয়েতের ভাষা আলাদা - এরকম যারা বলতেন, তাদের অন্যতম সহায় ছিল মার্কসের নিবন্ধ ‘সেইন্ট ম্যাক্স’ - যাতে তিনি লিখেছেন বুর্জোয়াদের ‘নিজস্ব এক ভাষার’ কথা; লিখেছিলেন যে বুর্জোয়াদের ঐ ভাষা ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপাদন’।

https://www.marxists.org/archive/marx/works/1845/german-ideology/ch03a.htm

কিন্তু স্তালিন বুর্জোয়াদের ‘নিজস্ব ভাষা’র অস্তিত্ব নাকচ করে দিয়েছেনতার মতে, এ ধরণের ভাষা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তা ভাষার চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেছে ‘বাণিজতন্ত্র ও ফেরিওয়ালার স্পিরিট নিয়ে।’ তিনি লিখেছেন-

"মার্কসের এ লেখা থেকে যারা উদ্ধৃত করতে ভালবাসেন, তারা একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পেতেন একই নিবন্ধেই মার্কস একক জাতীয় ভাষাসমূহের উত্থানের প্রসঙ্গ স্পর্শ করেছেন, কথা বলেছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতার ফলে ডায়ালেক্টসমূহের একটি একক জাতীয় ভাষায় কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে।"

মার্কস ‘সেইন্ট ম্যাক্স’ লেখাটিতে একক জাতীয় ভাষার আবশ্যকতাকে উচ্চতর পর্যায়ে এবং ডায়ালেক্টকে তার অধীনস্থ নিম্নবর্তী স্তর হিসেবে সনাক্ত করেছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় মার্কস বুর্জোয়াদের ভাষাকে ‘বুর্জোয়াজি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপাদন’ বলে আসলে সেটির অপভাষাগত দিকটি তুলে ধরেছেন। স্তালিনের এই বোধগম্যতায় কোনও ভুল নেই যে মার্কস বুঝাতে চেয়েছেন, তাদের এই বাণিজ্যতান্ত্রিক ও ফেরিওয়ালার চেঁচামেচি জাতীয় ভাষা দিয়ে একক জাতীয় ভাষাকে নোংরা করে চলেছে। বুর্জোয়াদের উত্থানের ইতিহাস ও রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বুর্জোয়াদের এই ভাষা আর ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান জাতীয় কিছু মনে হয় না, বরং তার অপভাষাগত দিকটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। স্তালিনের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে, এঙ্গেলসের একটি লেখাকেও শ্রেণিভাষার সমর্থকরা যুক্তি হিসেবে টেনে নিয়ে আসেন। এঙ্গেলস তার একটি লেখায় ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন-

"ব্রিটেনে শ্রমজীবী শ্রেণিটি ক্রমান্বয়ে ইংরেশ বুর্জোয়াজির (মধ্যশ্রেণি) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি রেস হয়ে উঠছে।"

তিনি আরও লিখেছিলেন-

"শ্রমিকরা কথা বলছে ঐসব বুর্জোয়াজি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেয়ে আলাদা ডায়ালেক্টে; তাদের চিন্তা ও আইডিয়ালসমূহ আলাদা, আলাদা তাদের কাস্টমস ও নৈতিকতার নীতিগুলো, আলাদা হয়ে পড়ছে ধর্মের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে।"

এঙ্গেলসের এই কথাগুলোকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে, দাঁড় করানো হয় শ্রেণিভাষার সপক্ষের যুক্তি হিসেবে। এঙ্গেলসের এই বাক্যগুলোকে ভিত্তি করে দাবি করা হয় তিনি একটি সাধারণ, জাতীয় ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ভাষার ‘শ্রেণিচরিত্রে’র কথা বলেছেন। কিন্তু এঙ্গেলসের বাক্যগুলো মন দিয়ে পড়লে দেখা যায় তিনি এখানে ভাষার কথা বলেননি, ডায়ালেক্টের কথা বলেছেন। এর পেছনে এই উপলব্ধি কাজ করেছে যে, জাতীয় ভাষার প্রশাখা হওয়ার কারণে ডায়ালেক্ট বা উপভাষা জাতীয় ভাষার স্থান অধিকার করতে পারে না। তাছাড়া এই পরিস্থিতি বর্ণনার সময় এঙ্গেলসের মূল বিবেচনা ভাষা ছিল না; ছিল মূলত শ্রেণিচিন্তা, শ্রেণিআদর্শ, নৈতিকতা, ধর্ম ও রাজনীতি। একইভাবে শ্রেণিভাষাপন্থীরা যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছেন লেনিনের লেখা থেকে, পল লাফার্গের লেখা থেকে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Paul_Lafargue

দাবি করা হয়, পল লাফার্গ তার প্যাম্পলেট ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য রেভ্যুলুশান ’ এ ভাষার শ্রেণিচরিত্র সনাক্ত করেন। লাফার্গের ঐ প্যাম্পলেট বিশ্লেষণ করেন স্তালিন। তিনি দেখান, লাফার্গ প্রকারান্তরে একটি সাধারণ ভাষার অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথাই বলে গেছেন। যারা তাকে ভাষা বিতর্কের মধ্যে টেনে এনেছিলেন তারা এটি বিবেচনায় নেননি যে, লাফার্গ কথা বলেছেন অভিজাতদের ভাষাদম্ভ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ‘অপভাষা’ নিয়ে। ভাষা ও অপভাষার মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে লাফার্গ আগ্রহ দেখাননি। ভাষার কৃত্রিমতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। লাফার্গ তার লেখায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলো দিয়ে তুলে ধরেছিলেন একটি বিশেষ সময়কে; যখন ইংল্যান্ডে সামন্ত শ্রেণির মানুষরা কথা বলতো ফরাসি ভাষায়, যদিও ইংরেজ জনগণ কথা বলতো ইংরেজি ভাষাতে। কিন্তু এর মানে এই দাঁড়ায় না যে শোষকের ভাষা আর শোষিতের ভাষা আলাদা। যুক্তি হিসেবে এই পরিস্থিতিকে উপস্থাপনের চেষ্টা নাকচ করে দিয়েছিলেন স্তালিন। তিনি বলেছিলেন-

"এটি কোনও যুক্তি নয়, এটি বরং অ্যানিকডট।"

কেননা প্রথমত, সব সামন্তই তখন ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন না, কোর্ট এবং কাউন্টির আসনগুলোর ইংরেজ সামন্ত লর্ডদের একটি ক্ষুদ্র উচ্চতর অংশই কেবল ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন। দ্বিতীয়ত, যে ভাষায় তারা কথা বলতেন সেটি কোনও বিশেষ ‘শ্রেণিভাষা’ নয়, বরং সেটি ফরাসি জনগণের সাধারণ ভাষা। তৃতীয়ত, সামন্তদের ব্যবহৃত ঐ ফরাসি ভাষা কালক্রমে সমগ্র ইংরেজ জনগণের সাধারণ ভাষার মধ্যে কোনও গভীর চিহ্ন না রেখে হারিয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে রাশিয়ার উদাহরণ স্তালিনের পক্ষে ছিল। এক সময় রাশিয়ার অভিজাতরাও সমাজের বিশেষ উঁচু স্তরে এবং জারের কোর্টে শখ করে ফরাসি ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ক্ষমতাধরদের ভাষা হওয়াতে তখন রাশিয়ায় সর্বপ্রচলিত রুশ ভাষা অবদমিত হয়েছিল, ফিকশনে পরিণত হয়েছিল এবং ‘শ্রেণি ভাষা’ হয়ে উঠেছিল বাস্তবতা। শ্রেণিভাষা, শ্রেণিব্যাকরণ এসব প্রত্যয় দিয়ে নিকোলাই মারের অনুসারীরা ভাষাসংক্রান্ত যে সংশয়াচ্ছন্নতা তৈরি করেছিলেন, তার সপক্ষে আরও একটি যুক্তি ছিল লেনিন বর্ণিত বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত সংস্কৃতি। বুর্জোয়া আর সর্বহারার সংস্কৃতি ভিন্ন সংস্কৃতি - এই উপসংহারের সূত্র ধরে শ্রেণিভাষাপন্থীরা তখন বলেছিলেন-

"পুঁজিবাদের অধীনে জাতীয় সংস্কৃতির শ্লোগান একটি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান, ঠিক তেমনি যারা জাতীয় ভাষা বা ভাষাসমূহের পক্ষে কথা বলছে তারাও প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে রয়েছেন। কেননা বুর্জোয়া ও সর্বহারার সংস্কৃতি যেমন ভিন্নরকম, তাদের ভাষাও ভিন্নরকম।"

এ যুক্তির উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্তালিনকে যেতে হয়েছিল লেনিনের লেখার কাছে:

"ভাষা হলো মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। একটি মুক্ত ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আলাদা আলাদা শ্রেণির বিভিন্ন অংশের জন্য, আধুনিক পুঁজিবাদের উপযোগী প্রকৃতই মুক্ত ও ক্রমবর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য ভাষার ঐক্য এবং এর অব্যাহত বিকাশ একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করে।"

এ কারণেই নাৎসিপন্থী বানডারাইটরা যখন লেনিনকে জাতীয় ভাষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার এবং সংস্কৃতিকে ‘না-জাতীয়’ হিসেবে দেখার জন্য অভিযুক্ত করেছিল, তখন লেনিন জোর দিয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, জাতীয় ভাষার বিরুদ্ধে নয় - তিনি সংগ্রাম করছেন বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Banderite

এমনকি খোদ স্তালিনকে যুক্তি হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছিল জ্যাফটিক তত্ত্বানুসারীদের পক্ষ থেকে। কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়ন (বলশেভিক) এর ১৬তম কংগ্রেসে দেয়া স্তালিনের একটি লাগসই বক্তব্য খুঁজে এনেছিলেন তারা। ঐ বক্তব্যে স্তালিন বলেছিলেন-

"যখন সমাজতন্ত্র সুসংহত হবে এবং প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠবে তখন জাতীয় ভাষাগুলোও অপরিহার্যভাবে একটি অভিন্ন সাধারণ ভাষায় পরিণত হবে, যেটি নিঃসন্দেহে রুশ অথবা জার্মান না হয়ে নতুন কোনও ভাষাই হবে।"

https://www.marxists.org/reference/archive/stalin/works/1930/aug/27.htm

এর উত্তরে স্তালিন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মার্কস এবং এঙ্গেলসের বিভিন্ন উপসংহারও যে নাকচ হয়ে গেছে, তা তুলে ধরে বলেন-

"সোভিয়েত রাশিয়ার রুশ, ইউক্রেনিয়, বেলারুশিয় এবং অন্যান্য সব সংস্কৃতিই এখন কনটেন্টের দিক থেকে সমাজতন্ত্রী; কিন্তু ফর্মের দিক থেকে উদাহরণত ভাষার দিক থেকে জাতীয়।"

ভাষাচিন্তাকে সমৃদ্ধ করতে স্তালিন যে ভারত, চীন ও তৎকালীন পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন সেটি জানা যায় স্তালিন ও ভারতের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে ১৯৫০ সালের কয়েকটি কথোপকথনের বিবরণ থেকে। ভারতের রাষ্ট্রদূত সরভেপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৫ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে স্তালিনের সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্ত:সম্পর্ক এবং বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে লন্ডনে নেহেরুর পুনর্ঘোষণা সম্পর্কে আলোচনা করতে যান।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sarvepalli_Radhakrishnan

ঐসময় স্তালিন কথা প্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে পাকিস্তানের অধিবাসীদের ভাষা প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি ভারতের ভাষা নিয়েও কথা বলেন। জানতে চান, ভারতের ভাষাগুলোর মধ্যে কোনটির বেশি প্রাধান্য। হিন্দি একটি ফোনেটিক ভাষা - তা জেনে স্তালিন আশ্বস্ত হন এবং জানান হায়রোগ্লিফিক ভাষা হলে চীনের জনগণের মতো খবরের কাগজ পড়া শিখতেই পাঁচ বছর লেগে যেতো! কৃষ্ণনের বিবরণ থেকে জানা যায়, আলোচনার শেষদিকে গিয়ে তিনি আবারও জানতে চাইছেন, ভারতের আদালতের ভাষার সঙ্গে ভারতীয় কোনও ভাষার সাদৃশ্য বা সম্পর্ক আছে কিনা। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত কে পি এস মেনন যখন স্তালিনের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন স্তালিন আবারও কথা তোলেন ভারত ও তৎকালীন পাকিস্তানের ভাষা নিয়ে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/K._P._S._Menon

স্তালিন মেননের কাছে জানতে চান, ভারতের প্রধান ভাষা কোনটি - উর্দু না হিন্দি? সবগুলো ভাষাই একই উৎস থেকে আসা কিনা? কিভাবে সেগুলোর ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক বিকাশ ঘটেছে? আলোচনার শেষদিকে পাকিস্তান প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্তালিন আবার ভাষা প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি মেননের কাছে জানতে চান, এটি কি সত্যি যে পাকিস্তান তাদের একটি নিজস্ব ভাষার উদ্ভাবন ঘটিয়েছে? জবাবে মেনন বলেন, উর্দু ভারতের ভাষাগোত্রের একটি ভাষা হিসেবেই বিকশিত হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান এতে অনেক ফারসি ও আরবি শব্দ যুক্ত করেছে। শুনে স্তালিন বলেছিলেন-

"তাহলে এটি সত্যিকারের জাতীয় ভাষা হতে পারে না।"

স্তালিনের পর ভাষাবিজ্ঞান আরও বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। যেমন- দেরিদা রুশো ও লেভি স্ট্রাউস পাঠের মধ্য দিয়ে, তাদের তীক্ষ্ণ ও কোনও কোনও সময় বিদ্রুপাত্মক সমালোচনার মধ্য দিয়ে অবনির্মাণবাদী কৌশলের বিকাশ ঘটান।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Levi_Strauss

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jacques_Derrida

তার বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েন ফেনোমেনোলোজির দার্শনিক এডমান্ড হুসের্ল এবং ফার্ডিনান্ড দ্য স্যসুর।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Edmund_Husserl

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ferdinand_de_Saussure

অবনির্মাণবাদী মতাদর্শের রাজনৈতিক রক্তপ্রবাহ লুকিয়ে রেখে দেরিদাকে পশ্চিমে বাজারজাত করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু ভাষাকে প্রতিনিয়ত সময়ের ফাক গলে বিচরণে সক্ষম অস্থির বিচিত্রময়ী হিসেবে উপস্থাপন করায়, অতীতের সত্যরূপ হিসেবে ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় অবনির্মাণবাদী মতাদর্শ দ্রুতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রাক-সক্রেটিস ও সক্রেটিস যুগের সোফিস্টদের সঙ্গে অবনির্মাণবাদীদের গভীর মিল, দার্শনিক ঐতিহ্যকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে তাদের অভিন্নতা তাদের ভিত্তি টলোমলো করে দেয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sophist

এইভাবে নয়া নিউ ক্রিটিসিজমের ব্যর্থতা ও সংশয়াচ্ছন্নতার পর অবনির্মাণবাদকে ঘিরে তত্ত্বের জগতে যে আশাবাদ জেগে উঠেছিল তা মিলিয়ে যায়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/New_Criticism

ইতিহাসের চোখে শিল্পকে না দেখে শিল্পের চোখে ইতিহাসকে দেখার এসব অস্বাভাবিকত্ব সমাজের একটি অংশকে গ্রাস করলেও সত্যের সন্ধানে নিয়ত মানুষকে কব্জায় নিতে পারেনি। স্তালিন ইতিহাসের চোখেই সমগ্র বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন। তাই নিজের পূর্বাবস্থানকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। ভাষাবিতর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে আসলে ভাষার প্রতি বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণের সমভাবাপন্ন না হওয়াটা প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে। শব্দের ভাণ্ডার ভাষাকে গঠন করে না; যেমনটি স্তালিন বলেন, শব্দের ভাণ্ডার বরং নির্মাণ করে ভাষার ম্যাটেরিয়াল। একটি ভাষার শব্দভাণ্ডার তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন তা ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণে আসে - ব্যাকরণ নির্ধারণ করে বাক্য বা বাক্যসমূহে বিভিন্ন শব্দের সংমিশ্রণ ঘটবে কোন নিয়মে, শব্দসমূহের অর্থকে বিশেষিত করা হবে কোন নীতির ভিত্তিতে। এই নীতিমালাগুলো ভাষাকে সক্ষম করে তোলে সম্মিলিত ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজে। ব্যাকরণ হলো স্তালিনের ভাষায় সুদীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মনের মধ্যে উপস্থাপিত বিমুর্তায়ন প্রক্রিয়ার ফসল। এ কারণে স্তালিন এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন জ্যামিতির সঙ্গে। ভাষা ও শব্দের ভাণ্ডারের নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের কথা তিনি অস্বীকার করেননি; কিন্তু ভাষার ওপর প্রভুত্ব তৈরির জন্য, ভাষাকে ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিশেষ গোষ্ঠী যে অপভাষা বা সাধারণ জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন ডায়ালেক্ট এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে থাকে, সেটি বলেছেন। কোনও সাহিত্যিক কোনও ডায়ালেক্ট অথবা জার্গন সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হলে তা ভাষার শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হতে পারে, কিন্তু তা জীবন্ত শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত না-ও হতে পারে। শক্তিমান সাহিত্যিক কোনও ডায়ালেক্টকে সামগ্রিক সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে জীবন্ত করে তুললে মানুষ কিছুদিন তা বলাবলি করতে পারে রাস্তাঘাটে, আড্ডায় আর পানশালাতে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তা সমগ্র জনগোষ্ঠীতে সুদীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠবে। ডায়ালেক্টকে এখন সাহিত্যে কিংবা নাটকে ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। দেশে কর্পোরেট পুঁজির দাপট বাড়ছে, কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার স্বভাব আর প্রবণতাও বাড়ছে। এই আচরণকে বৈধতা দেয়ার জন্য দোহাই দেয়া হচ্ছে জনগণের ভাষার - জনগণের সেই ডায়ালেক্টকে, তাদের জীবনযাত্রাকে গভীর তলদেশ থেকে তুলে আনার লক্ষ থেকে নয়; বরং ব্যবহার করা হচ্ছে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে বসে হাসাহাসি করার কাজে। সাহিত্যে কিছু আঞ্চলিক শব্দ বা ব্যবহারিক জীবনের কিছু শব্দ যুক্ত করলে, ক্রিয়াপদকে বিচিত্র কথ্যরীতিতে লিখলে কিংবা নিজের পছন্দ অনুযায়ী বানানরীতি ব্যবহার করলেই ভাষাকে পাল্টে দেয়া যায় না। 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]