সাম্রাজ্যবাদীদের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনরা
‘হামাস’ এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘হারাকাত আল মুকাওয়ামা আল ইসলামিয়া’, যা বাংলায় অনুবাদ করলে হয় ‘ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন’। যে ফিলিস্তিনি আন্দোলন মূলত ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ছিল, জর্জ হাবাশের মতো ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান যে আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন সেই আন্দোলনের রাশ ক্রমশ হামাসের মতো কট্টর ইসলামী সংগঠনের হাতে চলে যাওয়া ছিল অবাক করার মতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/George_Habash
হামাসের সৃষ্টি পুরনো ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে। ১৯২৮ সালে হাসান আল বান্না মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hassan_al-Banna
এই সংগঠন পশ্চিমা সংস্কৃতিকে প্রতিহত করার জন্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দ্রুত সমগ্র আরব দুনিয়ায় বিস্তার লাভ করে। রাজনীতি থেকে প্রথমদিকে এই সংগঠন দূরে থাকতো। এর ফলে একদিকে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের অনেক দমন পীড়ন এদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, অন্যদিকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বিশেষ অংশগ্রহণ না করার কারণে ঔপনিবেশিক যুগের অবসানে রাজনৈতিক প্রভাব তারা বিশেষ বিস্তার করতে পারেনি। একই বিষয় ফিলিস্তিনের মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আরব দুনিয়ায় যে রাজনৈতিক মতাদর্শ জনপ্রিয় হতে শুরু করে তা রাজনৈতিক ইসলাম নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ প্যান আরব মতাদর্শ এবং সমাজতন্ত্রী বাথিস্ট ও নাসেরিস্ট চিন্তাভাবনা।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Pan-Arabism#:~:text=Pan%2DArabism%20(Arabic%3A%20%D8%A7%D9%84%D9%88%D8%AD%D8%AF%D8%A9,to%20as%20the%20Arab%20world.
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ba%27athism
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nasserism
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে গামাল আবদেল নাসেরকে এই সংগঠন কর্তৃক হত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর প্রেসিডেন্ট নাসের ইসলামিক ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের উপর নানা প্রকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই সময় CIA মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেয়, ওয়াশিংটনের হিসাবে চূড়ান্ত মার্কিন বিরোধী নাসেরকে উৎখাত করার ক্ষমতা ব্রাদারহুডের ছিল। এসময় গাজা ভূখণ্ড মিশরের অধীনে ছিল এবং নাসের সেখান থেকে ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডকে মূল থেকে উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা করেন। এসময় গঠিত PLO এই উগ্র সংগঠনটির প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিল। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে মিশরের শোচনীয় পরাজয় এবং গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ ইজরায়েলের হাতে চলে যাওয়ার পর। ইজরায়েল নাসেরের নীতির বিপরীত নীতি গ্রহণ করে। তাদের কাছে ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড প্রধান সমস্যা ছিল না, বরং PLO এবং তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম চিন্তার বিষয় ছিল। এই কারণে ইজরায়েল ধর্মনিরপেক্ষ PLO-র উপর একদিকে চূড়ান্ত দমন পীড়ন নামিয়ে আনে, অপরদিকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রত্যক্ষ সমর্থন প্রদান করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল PLO বিরোধী একটি সংগঠন যেন ফিলিস্তিনের সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে ও তাদের জনভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে তা নিশ্চিত করা। এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন ব্রাদারহুড নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ahmed_Yassin
মুসলিম ব্রাদারহুডের ‘মুজামা আল ইসলামিয়া’ নামক সংগঠন ইজরায়েলের কল্যাণে খোলামেলাভাবে কাজ করতে সচেষ্ট হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mujama_al-Islamiya
প্রাথমিকভাবে ইজরায়েলের লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছিল। গাজায় PLO-র প্রভাব হ্রাস পায় এবং ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড সমাজসেবা, মসজিদ নির্মাণ, ইসলামিক শিক্ষা প্রদানকারী স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্যে নিজেদের কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রাখে। এসময় ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাংকে মুসলিম ব্রাদারহুড সক্রিয় ছিল, কিন্তু সেখানে PLO-র সংগঠনের শিকড় আরও গভীরে ছিল বলে এই অঞ্চলে ব্রাদারহুডের পক্ষে তেমন প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয়নি। গাজায় চিত্র ছিল একদম বিপরীত। এখানে স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্রাদারহুড নিয়ন্ত্রিত মসজিদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থিত মুজাহিদিনদের সোভিয়েত সেনা ও আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সাফল্য এই জনপ্রিয়তাকে আরও বৃদ্ধি করে। ১৯৮০-র দশকে ফিলিস্তিনে, বিশেষ করে গাজায় Fatah তথা PFLP-র মতো সংগঠনের পরিবর্তে ক্রমশ ব্রাদারহুড শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফিলিস্তিনের মুসলিম ব্রাদারহুড যেখানে শুধুই ফিলিস্তিনি সমাজের ইসলামীকরণের প্রচেষ্টার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল, গাজায় ধীরে ধীরে ব্রাদারহুডের সংগঠনগুলো মূল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের রাজনৈতিক ধারাতেও অংশগ্রহণ করছিল। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইন্তিফাদার সময় ব্রাদারহুডের গাজা শাখা প্রথম সামাজিক সংগঠন থেকে সরাসরি রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পদক্ষেপ নেয়। শেখ আহমেদ ইয়াসিন, মাহমুদ আল জাহারের মতো নেতাদের হাত ধরে জন্ম নেয় হামাস।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mahmoud_al-Zahar
হামাস আত্মপ্রকাশ করার পর ঘোষণা করে তারা জর্ডন নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করার লক্ষে সংগ্রাম করবে! কিন্তু এই রাষ্ট্রের চরিত্র ও সংগ্রামের ধরণ প্রসঙ্গে হামাস বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সংগঠনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য রাখে। অপর সকল ফিলিস্তিনি সংগঠন তাদের সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হিসাবে চিহ্নিত করে এসেছে এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে আরব ও ইহুদি উভয়ের অধিকার সমানভাবে রক্ষিত হবে। এই প্রসঙ্গে ইজরায়েল রাষ্ট্রের জায়নবাদী ধর্মভিত্তিক ‘Promised Land’ এর ধারণাকে চিরকাল ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনাকারী দলগুলো আক্রমণ করে এসেছে। PFLP-এর নেত্রী লায়লা খালেদের বিখ্যাত উক্তি-
“Do you think God has a real estate agency? God promises to give land to those people and that people?”
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Leila_Khaled
অন্যান্য ফিলিস্তিনি নেতারাও চিরকাল বলে এসেছেন ইজরায়েলের মত কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তারা গঠন করতে আগ্রহী নন। হামাস এই অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ সরে আসে। তারা ফিলিস্তিনকে মুসলিমদের পবিত্রভূমি ও দৈবসম্পত্তি বা ‘ওয়াকফ’ এবং এটি মুক্তি করার সংগ্রামকে 'জিহাদ' হিসেবে চিহ্নিত করে। কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চরিত্র হবে ইসলামিক, এই মর্মে বক্তব্য রাখে হামাস। এর ফলে হামাস যত শক্তি অর্জন করতে শুরু করে, আন্তর্জাতিক মহলে ফিলিস্তিনের সংগ্রামের যে উচ্চ নৈতিক ভূমি ছিল তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ঘাসান কানাফানির ভাষায়-
“A liberation movement fighting for justice.”
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ghassan_Kanafani
হামাস ক্রমে এই সংগ্রামকে জায়োনিস্ট ধর্মভিত্তিক যুক্তির প্রতিপক্ষের আসনে বসিয়ে দেয়। প্রথম ইন্তিফাদা চলাকালীন সময়ে পর্যন্ত হামাস আর ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ বজায় ছিল। ইজরায়েলের দৃষ্টিতে হামাস তখনও ছিল 'lesser evil' এবং ইজরায়েল কর্তৃপক্ষ গোপনে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। এই যোগাযোগ শুধু নিচের স্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না। হামাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদ আল জাহার এসময় ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইৎজহাক রাবিনের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতেন। PLO ইজরায়েলের অস্তিত্ব ও দুই-রাষ্ট্র সমাধান মেনে নিয়ে সংশোধনবাদী আচরণ প্রদর্শন করলে হামাসের উগ্রবাদী অবস্থান সাধারণ মানুষের অনেকের কাছে 'আপোষহীন সংগ্রামী মানসিকতা' হিসাবে ধরা দেয়। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে PLO এবং ইজরায়েলি সরকারের মধ্যে অনুষ্ঠিত Oslo Accords এর তীব্র সমালোচনা করে হামাস এবং ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদি সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা হেব্রনের মসজিদে প্রার্থনার সময় ফিলিস্তিনিরা আক্রান্ত হলে সেই সমালোচনাকে তারা প্রতিযোগিতামূলক সন্ত্রাসবাদে রূপান্তরিত করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Oslo_Accords
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cave_of_the_Patriarchs_massacre
ইজরায়েল ও ফিলিস্তিন - দুই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেই আপোষমুখী ও শান্তিকামী PLO এবং Labour Zionist-রা ক্রমশ রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হতে থাকে এবং প্রতিযোগিতামূলক চরমপন্থী অবস্থান নিয়ে সেই স্থান দখল করে ইজরায়েলে লিকুদ এবং ফিলিস্তিনে হামাস।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Labor_Zionism
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Likud#:~:text=Likud%20(Hebrew%3A%20%D7%94%D6%B7%D7%9C%D6%B4%D6%BC%D7%99%D7%9B%D6%BC%D7%95%D6%BC%D7%93%2C%20romanized,with%20several%20right%2Dwing%20parties.
৯০-এর দশকে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ হামাসকে প্রথম সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে নিয়ে আসে, অধিকাংশ ফিলিস্তিন জনতা কখনই এই পন্থাকে সঠিক বলে মনে করেনি এবং আরাফত ও PLO-র দিকে তখনও জনসমর্থনের পাল্লা ভারি ছিল। এছাড়া হামাসের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া, জোর করে হিজাব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা প্রভৃতি কার্যকলাপ ফিলিস্তিনের জনতা ভালো চোখে দেখেনি। এজন্য হামাস ক্রমে মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে প্রাপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি সমাজের ইসলামীকরণের প্রকল্প ৯০-এর দশকের শেষ থেকে মুলতবি রেখে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য 'সশস্ত্র জিহাদ' এবং বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচীর দিকে জোর দেয়। ২০০০ সাল থেকে যে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূচনা হয়, সেখানে হামাস বিভিন্ন সশস্ত্র কার্যকলাপ পরিচালনা করেছে। Oslo Accords এর ব্যর্থতা ও Palestinian Authority-র দুর্নীতি সাধারণ মানুষের মনে PLO সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় তাদের নরমপন্থী ও আপোষমুখী অবস্থানে সেই মনোভাব আরও বৃদ্ধি পায়। ২০০৫ সালে গাজা থেকে ইজরায়েলের একতরফা সরে যাওয়ার ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে হামাসের সশস্ত্র জিহাদের পন্থার তথাকথিত যথার্থতা প্রমাণ করে। এই ঘটনা ও আরাফতের মৃত্যু পরবর্তী যে রাজনৈতিক শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের সংসদের নির্বাচনে ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৪টি আসনে জয়লাভ করে। ইজরায়েলের ক্ষেত্রে এটা ছিল তাদের সৃষ্ট ও মদতপুষ্ট ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মুখোমুখি হওয়া। হামাস ও PLO-র সংঘাত ২০০৭ সালে প্রত্যক্ষ গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে PLO ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে এবং ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে হামাস গাজার দখল নেয়। গাজা ভূখণ্ডে ক্ষমতা দখলের পর হামাস দ্বৈত সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করে। সাধারণত কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ক্ষমতায় এলে শাসনের বাস্তবতা তাদের উগ্রতাকে বহুলাংশে প্রশমিত করে। হামাসের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে তা হয়নি। হামাস একইসঙ্গে শাসনের বাস্তবতা বজায় রেখেছে এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক ‘জিহাদ’ চালিয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ ছিল সিরিয়া ও ইরানের তরফ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্রের সহায়তা লাভ। এছাড়া হামাস তাদের সশস্ত্র শাখা ‘ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড’কে ক্রমশ সমান্তরাল সংগঠন হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Izz_ad-Din_al-Qassam_Brigades
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Izz_ad-Din_al-Qassam
এর ফলে সিরিয়া ও ইরানের সহায়তায় হামাস গাজায় রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসাবে কাজ করতে পেরেছে, অন্যদিকে ‘ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড’ এর মাধ্যমে অরাষ্ট্রীয় শক্তি হিসাবে তাদের সশস্ত্র কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছে। প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতিতে হামাস সাফল্য অর্জন করলেও ২০১০ সালের পর তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তাদের আসাদ বিরোধী অবস্থান এবং ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ইরান বিরোধী অবস্থান সিরিয়া ও ইরান সরকারকে হামাসের প্রতি ক্ষুব্ধ করে এবং দুই দেশের তরফ থেকে সাহায্য তলানিতে ঠেকে। মিশরে সাময়িকভাবে মুরসির মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারের প্রতিষ্ঠা হামাসকে উজ্জীবিত করলেও সিসি তাকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে। সিসি সরকার শুধু মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করেনি, গাজার যে অংশ মিশরের সীমান্ত সংলগ্ন তা অবরোধ করে। গাজার ইজরায়েল সংলগ্ন সীমান্ত এর আগে ইজরায়েল অবরোধ করে রেখেছিল, দক্ষিণের মিশর সংলগ্ন সীমান্ত অবরোধের পর গাজার অবস্থা হয় কার্যত জেলখানার মতো। হামাসের আর্থিক সমস্যা এতো বেড়ে যায় যে, সরকারী কর্মচারীদের বেতন দেয়ার মতো অর্থ তাদের ছিল না। এই পরিস্থিতিতে খালেদ মাশালের নেতৃত্বে হামাস PLO-র সঙ্গে আলোচনা চালাতে বাধ্য হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Khaled_Mashal
গাজায় তাদের ইসলামীকরণ প্রকল্প সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তারা রকেট নিক্ষেপ (যেগুলোর অধিকাংশ আয়রন ডোম মিসাইল সিস্টেম দিয়ে ইজরায়েল প্রতিহত করে) আর কিছু বিক্ষিপ্ত আক্রমণ ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারেনি।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Iron_Dome
বিকেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব থাকার জন্য মোসাদ PLO-র মতো হামাসের নেতাদের হত্যা করে সংগঠনকে দুর্বল করতে পারেনি, কিন্তু বিকেন্দ্রীভূত সংগঠনের জন্যই হামাস কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশেষ করে ‘ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড’ এর সঙ্গে হামাস নেতৃত্বের বারংবার মতৈক্যের অভাব দেখা গেছে। ফাটল দেখা গেছে ফিলিস্তিনের মধ্যে এবং ফিলিস্তিনের বাইরে বসবাসকারী নেতৃত্বের মধ্যেও। ২০১৭ সালে হামাস যে নতুন চার্টার প্রকাশ করে সেখানে হামাস কার্যত ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান মেনে নিয়েছে এবং ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hamas_Charter#:~:text=The%202017%20charter%20accepted%20for,liberation%20of%20all%20of%20Palestine%22.
.........................................................................
যুক্তরাষ্ট্রের র্যান্ড কর্পোরেশন তাদের এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছিল আইএসআইএল (Islamic State of Iraq and the Levant) জঙ্গিদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই রিপোর্টে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত ছিল তুরস্ক ও ইজরায়েল। ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর অধ্যাপক মিশেল চসুদভস্কি একটি প্রবন্ধে দেখান সিআইএ কিভাবে আল কায়েদার জন্ম দিয়েছিল। সিআইএ তখন এই কাজে সহযোগিতা পেয়েছিল পাকিস্তানের আইএসআই এবং সৌদি আরবের জিআইপি এর।
"....কিন্তু এই যুদ্ধ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিযেছে। যে সিরিয়া ছিল খাদ্যে ও উৎপাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ, সেই দেশটি এখন খাদ্য ও পণ্য আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বেকার সমস্যা যেখানে যুদ্ধের আগে তেমন একটা ছিল না, এখন তা শতকরা ৬০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের আগে তেল উৎপাদিত হতো দৈনিক ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল প্রতি দিন, সেখানে এখন উৎপাদিত হয় মাত্র ২০ হাজার ব্যারেল। শুধু তেল উৎপাদনেই ক্ষতির পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলার। সিরিয়ার মুদ্রার (পাউন্ড) ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আগে ডলারে পাওয়া যেত ৪৭ পাউন্ড, এখন ২৫০ পাউন্ডে পাওয়া যায় ১ ডলার। জনসংখ্যার শতকরা ৭৯ ভাগ গরিব হয়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। অথচ যুদ্ধের আগে গরিব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক ভাগেরও কম ছিল। স্বাস্থ্যসেবা পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশের ৭৫টি হাসপাতালের মাঝে এখন চলছে মাত্র ৩০টি। একসময় সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্যে সাবসিডি দিত, যার পরিমাণ ছিল বছরে ৬ মিলিয়ন ইউরো। এখন তা শূন্যের কোটায়। যুদ্ধের আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৮ মিলিয়ন ডলার। এখন তা এক রকম শূন্য (ইকোনমিস্ট, ১০ এপ্রিল, ২০১৩)। তাই যুদ্ধ না হলে, এখানে মার্কিন কনট্রাক্টররা আসবেন না, তেল উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। 'আরেকটি ইরাক'ও তৈরি হবে না।۔۔۔۔"
- 'বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি', ড. তারেক শামসুর রেহমান
- 'বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি', ড. তারেক শামসুর রেহমান
....................................................................
ফটোর বই দুইটি বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বাংলা অনুবাদের পর হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। হামাস সংক্রান্ত বইয়ের লেখক রাজাকার মুজাহিদের ছেলে। আর দ্বিতীয় বইয়ের লেখক এর কুকীর্তি নিচের লিংকগুলোতে দেয়া হয়েছে। হামাসের অনেক নীতিমালা ফোর্ড নামক বদমাইশের মনগড়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে হুবহু নেয়া হয়েছে। এদেশের ওয়াজগুলোতে মোল্লারা এসব কাল্পনিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দিচ্ছে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে। হাসিনা সরকারের পতনের পর এই ধরনের বই বিক্রির উৎসব শুরু হয়েছে পুরো বাংলাদেশে। মুসলমান সম্প্রদায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জ্ঞানবিমুখ এবং বইবিমুখ সম্প্রদায়। কিন্তু এই ধরণের বই তারা গোগ্রাসে গিলে এবং আরও উগ্র কিংবা সাম্প্রদায়িক হয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। উল্লেখ্য, ফোর্ড এর দাবি অনুসারে রুশ বিপ্লব ছিল ইহুদিদের ষড়যন্ত্র!
https://www.thehenryford.org/collections-and-research/digital-resources/popular-topics/henry-ford-and-anti-semitism-a-complex-story
https://www.washingtonpost.com/national/religion/the-dark-legacy-of-henry-fords-anti-semitism-commentary/2014/10/10/c95b7df2-509d-11e4-877c-335b53ffe736_story.html
https://www.myjewishlearning.com/article/henry-ford-invents-a-jewish-conspiracy/
https://history.hanover.edu/hhr/99/hhr99_2.html
https://www.wsws.org/en/articles/2003/04/ford-a18.html
https://www.bridgemi.com/michigan-government/henry-ford-and-jews-story-dearborn-didnt-want-told
..............................................................................
মিশরের সাম্প্রদায়িক দল 'মুসলিম ব্রাদারহুড' নাৎসিবাদ গ্রহণ করেছিল ব্যাপকভাবে। ৩০ ও ৪০ এর দশকে এরা হিটলারের 'মাইন ক্যাম্ফ' এর প্রচুর কপি দলের কর্মীদের মাঝে বিতরণ করেছিল। আল কায়েদার নেতা আইমান আল জাওয়াহিরি এর আগে মুসলিম ব্রাদারহুড এর নেতা ছিল।
প্রচন্ড সাম্প্রদায়িক 'ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট' নামের দলটি আলজেরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সেক্যুলার সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশটিকে নরকে পরিণত করেছিল আফগানিস্তানের মতোই।
সূত্র: 'বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি', ড. তারেক শামসুর রেহমান
Comments