সমাজতন্ত্র বনাম উত্তর কোরিয়ার জুচে তত্ত্ব
কিম ইল সাং এর শাসনামলে অল্প কিছু পণ্য মুক্তভাবে ক্রয়-বিক্রয় করা যেতো। ১৯৫৭ সালে চাল ও শস্যের বেসরকারি বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এসব খাদ্য সরকারি বিতরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের কাছে সরবরাহ করা হতো। প্রত্যেক নাগরিক একটি টোকেনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্যের রেশন পেতো। রেশনের পরিমাণ নির্ভর করতো পেশার ওপর। প্রাপ্তবয়স্ক গড়পড়তা কর্মজীবীরা দৈনিক ৭০০ গ্রাম শস্যের রেশন পেতো। গৃহিণীদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০০ গ্রাম। খনি শ্রমিকরা পেতো দৈনিক ৯০০ গ্রাম। নাগরিকরা কী পরিমাণ চাল রেশন পাবে, তা অনেকটা নির্ভর করতো নাগরিকদের বাসস্থানের ওপর। সত্তরের দশক পর্যন্ত পিয়ং ইয়ংয়ের অভিজাতরা তাদের রেশনের অর্ধেকের বেশি অংশ পেতো চাল। গ্রামবাসীদের ক্ষেত্রে প্রায় পুরো রেশন থাকতো ভুট্টা আর আটা দিয়ে। তাদের চাল শুধু বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় দেয়া হতো। ১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মতো রেশন কমানো শুরু হয়। যারা ৭০০ গ্রাম রেশন পেতো, তাদের দেয়া হলো ৬০৭ গ্রাম করে। পরবর্তীতে রেশন কমানো হয় ১৯৮৭ সালে। তখন রেশনের পরিমাণ নিয়ে আসা হয় ৫৪৭ গ্রামে। আনুষ্ঠানিকভাবে একে দেখানো হয় সরকারের কাছে নাগরিকদের ‘স্বেচ্ছা দান’ হিসেবে। ডিম, সয়া সস, বাঁধাকপি এবং ঐতিহ্যবাহী কোরীয় খাবারের মৌলিক উপাদানগুলোও রেশনে দেয়া হতো। মাংস বছরে কয়েকবার অনিয়মিতভাবে দেয়া হতো। বড় কোনো উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকলে মাংস দেয়া হতো। মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার নিয়মিত পাওয়া যেতো। শরতের সময় আপেল, তরমুজ ও অন্যান্য ফল বিতরণ করা হতো। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো রেশনের মাধ্যমে বিতরণ করা হতো। ষাট ও সত্তরের দশকে ভোগবাদের অন্যতম মাধ্যম ছিল হাতঘড়ি ও সাদা-কালো টেলিভিশন। এগুলো নাগরিকদের কর্মস্থল থেকে বিতরণ করা হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দামি পণ্যগুলো সরবরাহ করা হতো ‘মহান নেতার উপহার’ হিসেবে। এভাবে উত্তর কোরিয়াকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য নাগরিকদের কঠোর পরিশ্রমের মূল্য দেয়া হতো। উত্তর কোরিয়ায় কখনো বেসরকারি বাজার নিষিদ্ধ ছিল না। স্বল্প পরিসরে কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এটির বিস্তৃতি ছিল। কিন্তু কিম ইল সাং এর সময়ে সাধারণ নাগরিকরা খুব কমই এসব দোকানপাট থেকে কেনাকাটা করতো। সেখানকার পণ্য খুব ব্যয়বহুল ছিল। আশির দশকে বেসরকারি বাজারে একটা মুরগির দাম ছিল সাধারণ চাকরিজীবীদের মাসিক বেতনের অর্ধেকের বেশি। এজন্য তারা সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় যা পেতো, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতো। উত্তর কোরিয়ার শারীরিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক পুরুষ নাগরিককে রাষ্ট্রের নিযুক্ত চাকরি করতে হতো। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত ছোট কারখানাগুলো জাতীয়করণ করা হয়। সকল কৃষক কৃষি সমবায়ে যোগ দেয়। এ সকল সমবায়গুলো ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানার কৃষিজমির। কৃষকদের দৈনিক ৭০০ গ্রাম হিসেবে করে রেশন দেয়া হতো। শহরবাসীদের যেখানে মাসে দুই বার করে রেশন করে দেয়া হতো কৃষকদের ক্ষেত্রে সেটা দেয়া হতো বছরে একবার করে, ফসল কাটার পর। স্তালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষকরা এক হাজার বর্গমিটারের বেশি জমি পেতো নিজেদের ব্যক্তিগত চাষাবাদের জন্য। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার কৃষকরা ১০০ বর্গমিটারের বেশি পেতো না। সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকদের নিজেদের জন্য উপযুক্ত চাকরি খুঁজে নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এমন মনোভাবকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখে। স্কুল জীবন শেষে প্রত্যেক নাগরিককে চাকরিতে পাঠানো হতো। যাদের একাডেমিক দিক দিয়ে ফলাফল ভালো ছিল এবং রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, কেবল তাদের ক্ষেত্রে কলেজে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ মিলতো। চাকরি পরিবর্তনের সুযোগ ছিল, তবে তা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া সাপেক্ষে সম্ভব হতো। নারীদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা শিথিল ছিল। বিয়ের পর তাদের অনেকে পুরোদস্তুর গৃহিণী হয়ে যেতো। নাগরিকদের বাসস্থান পরিবর্তন করার এখতিয়ার কেবল কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাসস্থান ত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। সরকার যদি মনে করতো দেশের অর্থনীতির জন্য নাগরিকদের ভিন্ন কোনো স্থানের কর্মস্থলে পাঠানো উচিত, সেক্ষেত্রে তাদের স্থান পরিবর্তন করার সুযোগ ছিল। নারীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কিছুটা শিথিল ছিল। তারা বিয়ের পর স্বামীর বাসস্থান অনুযায়ী স্থান পরিবর্তন করতে পারতো।
অস্থায়ীভাবেও তাদের এক শহর থেকে অন্য শহরে ভ্রমণ করার সুযোগ সীমিত ছিল। একজন নাগরিক নিজের শহর বা গ্রাম থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি ছাড়া বের হতে পারতো না। কেবলমাত্র ব্যতিক্রম ছিল যেসব শহর বা গ্রামের সাথে তাদের নথিভুক্ত করা বাসস্থানের শহর বা গ্রামের সাধারণ সীমানা থাকতো, সেগুলোর ক্ষেত্রে। যদি কোনো নাগরিককে ভ্রমণের অনুমতিপত্র ছাড়া নিজের শহর বা গ্রামের বাইরে পাওয়া যেতো, সেক্ষেত্রে তাকে গ্রেপ্তার করে তৎক্ষণাৎ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হতো তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য। এই ভ্রমণের অনুমতির জন্য প্রথমে আবেদন করতে হতো কর্মস্থলের পার্টি সচিবের কাছে। এরপর আবেদনপত্র যাচাই করে দেখতো স্থানীয় সরকারের সেকেন্ড ডিপার্টমেন্ট, যেখানে পুলিশ অফিসাররা কাজ করতো। অনুমতিপত্রে নির্দিষ্ট করে দিন-তারিখ উল্লেখ করা থাকতো, নাগরিকরা কত দিন কোথায় থাকবে। এর সাথে ক্রয় করা টিকিট এবং কোন হোটেলে বা কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের বাসায় থাকবে, সেই তথ্যও দেয়া থাকতো। সীমান্তের বেসামরিকীকৃত এলাকার কাছাকাছি জেলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Demilitarized_zone
এর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে আসা লাগতো।
'ইনমিনবান' বা ‘জনতার জোট’ নামে উত্তর কোরিয়ার প্রশাসনে আরেকটি ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রতিটি ইনমিনবান বিশ থেকে চল্লিশটি পরিবার নিয়ে গঠিত হতো। উত্তর কোরিয়ার বেশিরভাগ বাসস্থান ছিল একটি এলাকায় আলাদাভাবে থাকা বাড়ি। এক্ষেত্রে প্রতি ব্লকে যে কয়টি বাড়ি থাকতো, তাদের সদস্যরা একটা ইনমিনবানের অন্তর্ভুক্ত হতো। অন্যদিকে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিটি ভবনের বাসিন্দারা একেকটা ইনমিনবানের অন্তর্ভুক্ত হতো। তবে অ্যাপার্টমেন্টগুলো ছোট হলে পাশাপাশি দুই থেকে তিন অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দারা একটা ইনমিনবানের সদস্য হতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Inminban
প্রতিটি ইনমিনবানের প্রধান একজন নারী। তার দায়িত্বগুলোর মধ্যে থাকে প্রতিবেশীরা ঠিকমতো দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঠিকভাবে ময়লা পরিষ্কার করে কিনা। ইনমিনবান প্রধানদের অধীনে থাকা সকল সদস্যের আয়, সম্পদের পরিমাণ এবং তাদের খরচের প্রবণতা এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। ইনমিনবানের কার্যক্রম তদারকি করে থাকে পুলিশবাহিনী। প্রতিটি ইনমিনবানের দায়িত্বে থাকে একজন আবাসিক পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি নিয়মিত ইনমিনবান প্রধানের সাথে যোগাযোগ রাখেন। প্রতি সন্ধ্যায় ইনমিনবান প্রধানকে একটা রেজিস্টার খাতায় রেকর্ড তুলতে হয়, সেখানে বাইরের এলাকা থেকে আসা কোনো নাগরিক রাত কাটাবে কিনা। যদি কোনো বাড়ির সদস্যদের আত্মীয় বা বন্ধু তাদের বাড়িতে থাকতে আসে, তবে সেই বাড়ি থেকে ইনমিনবান প্রধানের কাছে মেহমান সম্পর্কে তথ্য দিতে হয়। ইনমিনবান প্রধান মেহমানের পরিচয়পত্র যাচাই করে সব তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখে। বছরে কয়েকবার ইনমিনবান প্রধানের সাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশবাহিনী মাঝরাতে বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়িতে গিয়ে যাচাই করে দেখে সেখানে রাত কাটানো লোকদের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা। এছাড়া তারা রেডিও সেটগুলো পরীক্ষা করে দেখে সেখানে বিদেশি স্টেশন থেকে অনুষ্ঠান শোনার ব্যবস্থা আছে কিনা।
উত্তর কোরিয়ায় ‘সাংগঠনিক জীবন’ এর ধারণা অনুযায়ী প্রত্যেক উত্তর কোরীয় নাগরিককে কোনো না কোনো সংগঠনের সদস্য হতে হবে, যার মাধ্যমে তাদের সামাজিক কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা সম্ভব হবে। উত্তর কোরীয় নাগরিকদের ১৪ বছর বয়সে পার্টির যুব সংগঠনে যোগ দিতে হয়। এর মাঝে অল্প সংখ্যকের জায়গা হয় ওয়ার্কার্স পার্টিতে। কিম ইল সাং এর আমলে ক্যারিয়ারে যেকোনো অগ্রগতির জন্য পূর্বশর্ত ছিল পার্টির সদস্য হওয়া। ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্যরা প্রায় সকল খাতে পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পেতেন। যারা ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য হতে পারতেন না, তাদের ক্ষেত্রে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত যুব সংগঠনে থাকতে হতো। এরপর তারা কর্মক্ষেত্রের শ্রমকল্যাণ সমিতির সদস্য হতেন। কৃষকদের ক্ষেত্রে আলাদা কৃষি সংস্থার সদস্য হতে হতো। যদি কোনো নারী বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিতেন, তাহলে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহিলা সংস্থার সদস্য হয়ে যেতেন। 'সাংগঠনিক জীবনে' সদস্যদের সভায় অংশ নিতে হতো। প্রতি সপ্তায় তিনটি করে সভা অনুষ্ঠিত হতো। প্রতিটি সভার সময়কাল ছিল দুই থেকে তিন ঘণ্টা। দু'টি সভা বরাদ্দ থাকতো সদস্যদের আদর্শগত দীক্ষা দেয়ার জন্য। এতে অংশগ্রহণকারীরা কিম ইল সাং ও তার পরিবারের মহত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতো। কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টির সমৃদ্ধ অর্জন আর উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির ঈর্ষণীয় সাফল্য নিয়েও আলোচনা হতো। এছাড়া আমেরিকার পৈশাচিক সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতি আর তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা প্রচার করা হতো। সাপ্তাহিক তিনটি বৈঠকের একটি ছিল বাকি দুইটি থেকে আলাদা। একে বলা হতো ‘সাপ্তাহিক জীবন পর্যালোচনা অধিবেশন’। একে সহজভাবে আত্মসমালোচনা ও পারস্পরিক সমালোচনা বৈঠক বলা ভালো। এই বৈঠকে থাকা সকল অংশগ্রহণকারী ঐ সপ্তাহে নিজেদের সকল অপকর্ম নিয়ে জনসম্মুখে সমালোচনা করতো। একইসাথে ঐ সংগঠনের অন্য সদস্যরা ঐ ব্যক্তিকে নিয়ে ঐসকল অপকর্ম বা ভিন্ন কোনো অপকর্ম নিয়ে সমালোচনা করতো। বাস্তবে এই বৈঠকগুলোতে কেউই এমন কোনো অপরাধের কথা প্রকাশ্যে বলতো না, যার কারণে তাকে কঠিন সাজা ভোগ করতে হবে। সদস্যরা সাধারণত কর্মক্ষেত্রে দেরিতে যাওয়া কিংবা 'মহান নেতা'র ছবি যত্ন করে রাখার ব্যাপারে অলসতার কথা স্বীকার করতো। কখনো কখনো এতে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগত বিচ্যুতি ধরা পড়ে যেতো।
কিম ইল সাং এর শাসনামলে প্রতিটি গোত্রের সুযোগ-সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিল। এটাকে অনেকটা হিন্দুদের জাত প্রথার সাথে তুলনা করা যায়। ১৯৫৭ সালে কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক নাগরিকের পারিবারিক ইতিহাস পরীক্ষা করে দেখা শুরু করে। এই প্রকল্প ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে শেষ হয়। প্রথাটি সংবান নামে পরিচিত।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Songbun#:~:text=Based%20on%20the%20political%2C%20social,classifications%2C%20and%20determine%20whether%20an
সংবান নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক তিনটি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে বিশ্বস্ত, অস্থিতিশীল ও শত্রুপক্ষীয় শিবির। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাগরিকদের পিতার বংশের লোকেরা ১৯৪০ এর দশকে বা ১৯৫০ এর দশকে কেমন অবস্থায় ছিল তা বিবেচনা করা হয়। সাবেক জমিদারদের সন্তান বা নাতি-নাতনিরা, খ্রিস্টান আর বৌদ্ধ পাদ্রীরা, ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী, জাপানি উপনিবেশীয় যুগে কাজ করা কর্মচারীরা বা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা শত্রুপক্ষীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া কিছু সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত লোকজন, যেমন- পতিতা বা মহিলা ওঝা হিসাবে যারা কাজ করতো তাদের এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই শ্রেণির নাগরিকরা অনেক বৈষম্যের শিকার হতো। উদাহরণস্বরূপ, এই শ্রেণির নাগরিকদের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা কিংবা বড় শহরগুলোতে থাকার সুযোগ নেই, যদিও তারা অপরাধীদের নাতি-নাতনি! অন্যদিকে যাদের পিতার বংশের লোকেরা কিম পরিবারের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাদের ‘বিশ্বস্ত’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। এই বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত নাগরিকদের মধ্যে আছে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, কোরীয় যুদ্ধে শহীদ হওয়া যোদ্ধাদের বংশধররা এবং যাদের কার্যক্রম কিম রেজিমের প্রশংসা কুড়িয়েছে তারা। কেবল এই শ্রেণির লোকেরাই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চাকরিগুলো করতে পারে। উত্তর কোরিয়ার আরেকটি আইন হচ্ছে, এখানে কেউ স্বেচ্ছায় নিজের বা নিজের সন্তানদের সংবান বদলাতে পারে না। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে। নিম্ন শ্রেণির সংবানে থাকা কারো কোনো কার্যক্রমে যদি কর্তৃপক্ষ খুশি হয়, তাহলে তাকে ‘পদোন্নতি’ দিয়ে উপরের সংবানে নিয়ে আসা হতে পারে। যেমন- কোনো নিম্ন শ্রেণির নাগরিকের বাড়ির সকল জিনিসপত্র বন্যার পানিতে ভেসে গেলেও সে যদি কিম শাসকদের ছবি অক্ষত অবস্থায় বের করে আনার মতো 'বীরোচিত' কোনো কাজ করতে পারে, তাহলে তাকে কর্তৃপক্ষ পুরস্কৃত করতে পারে! ‘অস্থিতিশীল’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন। উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যায় এদের অনুপাত সবচেয়ে বেশি। সংবান বিবেচনা করা হয় কেবল পিতার বংশকে বিবেচনা করে। কোনো নারী যদি বিপ্লবী যোদ্ধার বংশধর হয়ে থাকে, কিন্তু বিয়ে করে ‘শত্রুপক্ষীয়’ শ্রেণির কাউকে তাহলে তাদের সন্তানও শত্রুপক্ষীয় শ্রেণির হয়ে বেড়ে ওঠবে! এজন্য উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের বিয়ের ক্ষেত্রে সংবান প্রথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উত্তর কোরিয়া একমাত্র দেশ, যারা শান্তিকালীন পরিবেশে টিউনযোগ্য রেডিও ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৬০ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া কেবল নির্দিষ্ট কিছু টিউনযুক্ত রেডিও আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রি শুরু করে। এতে শুধুমাত্র অল্প কিছু রাষ্ট্রীয় চ্যানেল শোনার সুযোগ ছিল। কেউ যদি বিদেশ থেকে রেডিও কিনে আনতো (বৈধ ছিল), তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ পুলিশের কাছে রেডিওটি দিতে হতো। সেখানে কারিগররা রেডিওর টিউনিং প্রক্রিয়া স্থায়ীভাবে অকেজো করে দিতো। যেহেতু কারিগরি দিক দিয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা টিউনিং প্রক্রিয়া বদলে ফেলার সুযোগ ছিল, তাই সকল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন রেডিওকে সিলগালা করে দেয়া হতো। ইনমিনবান প্রধান ও পুলিশরা হঠাৎ করে যখন বসতবাড়িতে গিয়ে রেডিও পরীক্ষা করতো, তখন তারা দেখতো সিলগুলো অক্ষত অবস্থায় আছে কিনা।
ষাটের দশকের শেষ দিকে কিম ইল সাং এর সরকার প্রচারণা চালায় উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বিদেশি বই ধ্বংস করার ব্যাপারে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল সোভিয়েত ও জাপানি বই। পাঠাগারে থাকা কারিগরি বিষয় বাদে যেসব বিষয়ের বিদেশি প্রকাশনার বই ছিল, সেগুলো বিশেষ সেকশনে রাখা হয়। শুধুমাত্র নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স পাওয়া বিশেষ ব্যক্তিদের এসব বই পড়ার অনুমতি দেয়া হতো। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পত্রিকার ব্যাপারেও এর কোনো ব্যত্যয় ছিল না। মস্কোর প্রাভদা আর পিকিং এর পিপল’স ডেইলি পত্রিকাকেও ওয়াশিংটন পোস্ট বা সিউলের চোসান ইলবো’র মতো ভয়ংকর মনে করা হতো! কর্তৃপক্ষ মনে করতো বিপজ্জনক তথ্য কেবল রেডিও বা পত্রিকার মতো মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না, বরং উত্তর কোরীয় নাগরিকদের সাথে বিদেশিদের সংস্পর্শ থেকেও তথ্যের বিচরণ ঘটবে। সরকারি দায়িত্বের বাইরে থাকা উত্তর কোরীয় নাগরিকদের বার্তা দেয়া হতো বিদেশিদের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গেলে পরিণাম ভালো হবে না।সোভিয়েত আমলে সেখানকার অনেক শিক্ষার্থী পিয়ংইয়ং এ পড়তে আসতো। তাদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হতো। এমনকি দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছু নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হতো। যেমন- হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মতো বিষয়গুলোতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাদের উত্তর কোরীয় ছাত্রদের সাথে এক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা হতো না। তারা কোনো উত্তর কোরীয় নাগরিকের ব্যক্তিগত বাড়িতে যেতে পারতো না। তাদের কিছু নির্দিষ্ট জাদুঘরে যাওয়া নিষেধ ছিল। এমনকি বড় লাইব্রেরিগুলোর ক্যাটালগ রুমে তাদের প্রবেশের অনুমতি ছিল না। বেশিরভাগ উত্তর কোরীয় প্রাপ্তবয়স্করা তাদের সাথে কথা বলা এড়িয়ে চলতো। উত্তর কোরিয়া তাদের নিজেদের পূর্ববর্তী বছরগুলোর প্রকাশনাও গায়েব করে দিতো। উত্তর কোরিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলীর ওপর প্রকাশিত খবরগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত লাইব্রেরিগুলো থেকে নিয়মিতভাবে সরিয়ে ফেলা হতো। কেবল বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে সেগুলো পড়ার সুযোগ মিলতো। ১০ থেকে ১৫ বছর আগে প্রকাশিত সকল পত্রিকা ধ্বংস করে দেয়া হতো। এটা করা হয়েছিল রেজিমের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে আনা পরিবর্তনগুলো জনসাধারণের নজরে না আসার জন্য। সত্তর ও আশির দশকে উত্তর কোরিয়ার মিডিয়া চাইতো না চল্লিশের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিনের বিজয়গাথা নিয়ে কিম ইল সাং এর প্রশংসাসূচক বক্তব্যগুলো প্রকাশ পেয়ে যাক। আবার ষাটের দশকে সোভিয়েত সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে দেয়া তার বক্তব্যগুলো সাধারণ উত্তর কোরীয় নাগরিকদের কাছ থেকে অন্ধকারে রাখা হতো।
Comments