সোভিয়েতদের শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
ধনী ও দরিদ্রে বিভক্ত এ সমাজে শিক্ষা ও শিক্ষার উদ্দেশ্য একই রকম থাকে না। প্রবাদে আছে ‘বড় হও, মানুষ হও বাবা’। প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে উঠাই কি বড় হওয়া? সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই ইংরেজরা শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে শিখিয়েছিল লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। দুনিয়া জুড়ে আজ একথার পেছনে সবাই ছুটছে। লেখাপড়া শেষ করে বড় হয়ে কেউ চাকরি করবে, অনেক টাকা আয় করবে; বাড়ি, গাড়ি ধনদৌলত বানাবে। আজ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা এ চিত্রই পাবো। শিক্ষার এ দর্শনের পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে মুষ্টিমেয় মালিকশ্রেণি মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। পুঁজিপতিরা তাদের নিয়ম নীতি, আইন কানুন দিয়ে এ ধরনের সমাজের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই মালিক এবং শ্রমিকে বিভক্ত এ সমাজে মালিকশ্রেণি ততটুকু শিক্ষা দেয় যতটুকু তাদের মুনাফার জন্য প্রয়োজন। তাই সকল মানুষের স্বার্থে মানবজাতির সঞ্চিত জ্ঞানকে সে কাজে লাগাতে পারে না। মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, কুসংস্কারমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মন গড়ে তুলতে সে ব্যর্থ হয়। দুনিয়াজুড়ে পুঁজিবাদ আজ শিক্ষার মহত্তম উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে একে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করেছে। কেড়ে নিয়েছে শিক্ষার অধিকার। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র শুধু শিক্ষার অধিকার দেয়নি; কর্মে, সৃজনে, মননে সৃষ্টি করেছে একেবানে নতুন মানুষ। সেই শিক্ষা ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা পুরো দুনিয়ার সামনে আজও শ্রেষ্ঠ আসন নিয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। একেবারে গরীব, মজুর, মেহনতী, চাষাভূষা, যাদের চালচুলো নেই; হাজার বছরের কুসংস্কারের অন্ধকারে যাদের বাস, গতর খাটানোই জীবন, সুস্থ সুন্দর জীবন যাদের কাছে ভাগ্যের বঞ্চনা- সেই নীচুতলার মানুষদের আবার লেখাপড়া! পুরো দুনিয়ার সামনে যা ছিল অকল্পনীয়, তাই ইতিহাসে বাস্তব করে তুলেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।
জারের অধীনে শিল্প কারখানার দিক থেকে রাশিয়া ছিল অনুন্নত দেশ। বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। জারের মন্ত্রী, আমলা, সেনাবাহিনী, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আর ধনী জমিদার, শিল্পপতি মিলে পুরো দেশের শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ, লুণ্ঠণ, অত্যাচার চালাতো। জারের ক্ষমতার আগ্রাসন ক্রমে আশেপাশের রাজ্যগুলোকে দখল করে নিল। সেগুলোকে প্রদেশ বানিয়ে দুর্বল জাতিগুলোকে বছরের পর বছর শাসন-শোষণ চালাতো। সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠার আগে সেখানে সার্বজনীন শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তাই লক্ষ লক্ষ শিশু কখনোই স্কুুলে যায়নি। বেশিরভাগ কৃষক ছিল অজ্ঞ, মূর্খ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অবস্থা আরও করুণ। রাশিয়ার ১৭৫টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১২৪টির কোনো লিখিত হরফ ছিল না। ইউক্রেনীয়, জর্জিয়ানরা সংবাদপত্র, বই, এমনকি আদালতে পর্যন্ত নিজেদের ভাষা ব্যবহার করতে পারতো না। রুশ ভাষায় তাদের পড়ালেখা শিখতে হতো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭৩ শতাংশ প্রাপ্ত বয়ষ্ক জনগণ ছিল অশিক্ষিত। কিছু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার ৫ শতাংশের কম ছিল। (যেমন- কাজাখস্তানে ২%, উজবেকিস্তানে ১%, তাজিকিস্তানে ০.৫%)।
জার আলোকজান্ডারের নির্দেশনা মন্ত্রী মেনশিকভের একটি বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যাবে সেসময় শিক্ষা সর্ম্পকে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি -
“জ্ঞান হলো লবনের মতো, যা জনগণের অবস্থা এবং চাহিদা অনুসারে অল্প পরিমাণে ব্যবহার এবং প্রদান করা হয়। সকলকে এমনকি বেশিরভাগ মানুষকে শিক্ষিত করলে ভালোর চেয়ে অনিষ্ট হয় বেশি।”
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Alexander_Sergeyevich_Menshikov
ফলে স্কুল-কলেজগুলো ছিল বড়লোকের সন্তানদের জন্য। স্কুল কলেজের পড়াশুনা ছিল ভয়ংকর চাপের, একঘেঁয়ে, আনন্দহীন। পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল যে, বাচ্চাদের আত্মহত্যার ঘটনা হর-হামেশায় ঘটতো। হেবে স্পাউলের ‘দি ইউথ অব রাশিয়া’ বইটির মতে, এই প্রবণতা এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে ছাত্রদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণ উদ্ঘাটন করতে সরকারের Ministry of Public Instruction কে একটি কমিশন গঠন করতে হয়েছিল।
https://www.amazon.co.uk/Youth-Russia-day-Hebe-Spaull/dp/B0017ZQMV8
১৯১৭ সালে শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখল করলো। এর মাধ্যমে শত শত বছরের গভীর অন্ধকার ভেদ করে আলোর দরজা খুলে গেলো। পরিস্থিতি যত কঠিন হোক, জনগণের দাবি পূরণের কাজ শুরু হলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার সরকার অংশ নেয়ার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বহু তরুণ-যুবককে এতিম, সম্বলহীন, গৃহহীন করে দেয়। বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধ ও ১৯২১ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে পরিস্থিতি আরও সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিপ্লবের আগেই কিশোরদের একটা অংশ বিভিন্ন অপরাধ চক্র গড়ে তুলে নানা আইনবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। অনেকে চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো এবং নিয়মিত খুন-খারাবি করে গ্রামে ও শহরে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতো। তারা বসবাস করতো সুরিখানা ও নালা-নর্দমার ধারে। এজন্য তারা শারীরিক-মানসিকভাবে ছিল প্রচন্ড অসুস্থ। এই শিশুদের কেবল শিক্ষা নয়, নৈতিক মুক্তিরও প্রয়োজন ছিল। এসব শিশুদের স্কুলের আওতায় আনা আর বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার মহান ব্রত নিয়ে শুরু হয় বিপ্লবী সরকারের কাজ।
সোভিয়েত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২১ এ বলা হয়েছে-
"ইউএসএসআর এর নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার হবে সুরক্ষিত। সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, বুনিয়াদী শিক্ষার দ্বারা এই অধিকার নিশ্চিত করা হবে। অবৈতনিক উচ্চশিক্ষাসহ ; উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর রাষ্ট্রীয় উপবৃত্তি প্রদান করা হবে। স্কুল শিক্ষা স্থানীয় মাতৃভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রীয় খামার, ট্রাক্টর স্টেশন এবং যৌথ খামারে পরিশ্রমী ও মেহনতিদের বৃত্তিগত, প্রযুক্তিগত ও কৃষি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অবৈতনিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে।"
বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্য পরিপূরক প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামের অভাব; তীব্র সংকট ছিল প্রয়োজনীয় শিক্ষক, বিল্ডিং, বইপত্রের। এজন্য বহু বছর ধরে মস্কোর মতো ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকার স্কুলগুলোতে বিভিন্ন শিফটে পড়াতে হতো। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পূর্বে শোষিত হওয়া জাতিদের মধ্যে থাকা প্রবল অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞতা যেটি শিক্ষকদের পাঠদানে সরাসরি বাধা প্রদান করতো, তাকেও অতিক্রম করতে হয়েছিল।
শৈশব থেকে ৮ বছর পর্যন্ত: Creches (কর্মরত মায়েদের শিশুদের দেখাশোনার জন্য সাধারণ শিশুভবন), কিন্ডারগার্টেন, প্লে গ্রাউন্ড, নার্সেরি স্কুল।
৭ বছরের স্কুল শিক্ষা: সকলের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। ৮-১৫ বছর পর্যন্ত।
১০ বছরের স্কুল শিক্ষা: ৮-১৮ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছিল। পরে সেটি ১৫ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়।
শিল্প কারখানায় শিক্ষা: ফ্যাক্টরি এবং ব্যবসায় শিক্ষা স্কুল।
পেশাগত শিক্ষা: পেশাগত শিক্ষার স্কুল ও একাডেমিসমূহ।
উচ্চশিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল এবং বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটসমূহ।
প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষা: ক্লাব, বিভিন্ন সহযোগী কোর্স, সিনেমা ইত্যাদি।
প্রাক-স্কুল শিক্ষা: জন্মের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে শিশুকে পুরো সমাজের সম্পদ গণ্য করা হতো। শিশুদের জন্য এখানে চালু করা হয়েছিল শিশু সদন বা Creches। বিভিন্ন কাজের এলাকা যেমন- ফ্যাক্টরি, যৌথখামার বা কতকগুলো বাসভবনকে কেন্দ্র করে শিশু ভবনগুলো গড়ে উঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সকল নারী কাজের সুযোগ পেতো। যেসব কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের ছেড়ে কাজে যেতে হয়, তারা যেন সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় পান সেজন্য শিশু ভবনগুলো ছিল তাদের কর্মক্ষেত্রের কাছে। কেবল পিতামাতা নয়; বিভিন্ন ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা ও ট্রেড ইউনিয়নের কমিটিসমূহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই শিশু ভবনগুলো সচল রাখতে সচেষ্ট থাকতো।
Beatrice King এর বর্ণনায় -
“কক্ষগুলো অনেক প্রশস্ত ও উঁচু যাতে প্রচুর আলো-বাতাস ঘরে আসতে পারে। প্রত্যেকটি রুমের একটি বারান্দা আছে যেখানে গ্রীষ্মে ও শীতে শিশুরা ঘুমায়। বিশাল রান্নাঘরে প্রধান খাবারগুলো প্রস্তুত করা হয়, ধোলাইখানাও আছে। ভ্রমণকালে আমি দেখেছি শিশু ভবনগুলোতে খেলার জন্য বিশাল মাঠ, ফুলের বাগান আছে। প্রত্যেক গ্রুপের (১২-১৫ জন) তত্ত্বাবধানের জন্য একজন যোগ্য ব্যক্তি নিযুক্ত থাকেন। শিশু ভবনগুলো মা-বাবাকে যোগ্য করে তোলার জন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠান।”
৮ বছর পর্যন্ত প্রাক স্কুল শিক্ষা চালু ছিল। নার্সারি স্কুলগুলো শিশু সদনের ধারাবাহিকতায় পরিচালিত হতো। এখানে শিশু ভর্তির ব্যাপারটি ছিল ঐচ্ছিক। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের ভর্তির সংখ্যা ১৯২৮ সালে ছিল ৮ লক্ষ, ১৯৩৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ালো ১৫ লক্ষে এবং ১৯৪০ সালে তা আরও বেড়ে হলো ৩৫ লক্ষ। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাক স্কুল বয়ষ্ক ছেলেমেয়েদের জন্য পদার্থবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র এবং ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানদানের বিষয় শুরু হয়েছিল। এরকম শিক্ষা কার্যক্রম শিশুর স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত না করে তার মনন শক্তির বিকাশ ঘটাতো। বিশেষ করে খেলাধুলা, বিভিন্ন জিনিসপত্র, ছবি আর মডেলের মাধ্যমে এসব শিক্ষা দেয়া হতো। এই শিক্ষাব্যবস্থায় বাবা মা-র ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাবা-মা এবং স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রতি মাসে স্কুলের স্টাফদের সাথে Parents Council এর একটি মিটিং হতো। নিয়মিত স্কুলে আসার জন্য মা-বাবাকে উৎসাহ দেয়া হতো, তেমনি শিক্ষকদের উৎসাহ দেয়া হতো বাচ্চাদের বাসায় যাওয়ার জন্য। বাচ্চারা বয়স অনুযায়ী কিছু পড়াশুনা আর প্রচুর খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানোর সুযোগ পেতো। প্রতিটি স্কুলে স্টাফ হিসেবে একজন ডাক্তার ও নার্স নিযুক্ত থাকতেন। ছোট বেলা থেকেই স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম-নীতিগুলো শেখানো হতো। নানা কর্মকান্ড, এমনকি খেলাধূলা পর্যন্ত এমনভাবে সাজানো হতো যেন একটি শিশুর সামাজিক অভ্যাসগুলো উন্নত হয়; তারা আত্মনির্ভরশীল এবং দায়িত্ববান হয়ে গড়ে উঠে। উদাহরণ হিসেবে শিশুদের একটি জনপ্রিয় খেলা রঙ্গিন ইট সাজানোর কথা বলা যায়। এই ইটগুলো এত বড় যে শিশুদের একার পক্ষে নাড়ানো এবং কিছু তৈরি করা সম্ভব হতো না। তাই ইট দিয়ে কিছু তৈরি করতে হলে তাকে অবশ্যই অন্য সাথীদের কাছে সাহায্য চাইতে হতো। এই সহয়োগিতা আর মিলেমিশে থাকার মধ্যেই গড়ে উঠতো ভবিষ্যতের সোভিয়েত প্রজন্ম।
ক্রেশ ও কিন্ডারগার্টেন শেষ করে ছেলেমেয়েদের যেতে হতো স্কুলে। আট থেকে পনের বছর পর্যন্ত হলো বাধ্যতামূলক মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষা। পনেরো বছর পর্যন্ত স্কুলজীবন শেষ করে আগ্রহীরা আরও দু’বছর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো।
বিপ্লব পরবর্তী স্কুল শিক্ষা নিয়ে লেনিন বলেছিলেন-
“জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবলমাত্র স্কুলের গন্ডির মধ্যেই যা বন্দী তেমনি শিক্ষাদান, ট্রেনিং বা বিদ্যায় আমরা বিশ্বাস করি না। আমাদের স্কুল থেকে তরুণদের পাওয়া উচিত জ্ঞানের মূল সূত্রগুলো, স্বাধীনভাবে সাম্যবাদী মতবাদ গড়ে তোলার ক্ষমতা এবং শিক্ষিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারা।”
নতুন যুগের ছেলে-মেয়েদের গড়ে তোলার জন্য লেনিন বলেছিলেন-
"তরুণদের শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের মিলন ব্যতীত ভবিষ্যৎ সমাজের কল্পনা অসম্ভব।"
সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন মানুষ গড়ে তোলা। সোভিয়েত শিক্ষাবিদদের মতে সততা, শ্রমশীলতা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মোৎসর্গের মনোভাব - এই গুণাবলিগুলো নিয়ে কেউ জন্মায় না। তা অর্জিত হতে পারে সুশিক্ষার মাধ্যমে। বিপ্লবের আগে বহু বিজ্ঞানী প্রমাণ করতে চাইতেন শিশুদের সবাই লেখাপড়া করতে, এমনকি প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যসূচি আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। কিন্তু ১৯৩০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বজনীন শিক্ষা চালুকরণের অভিজ্ঞতায় ‘ছেলে মেয়ে মানুষ করা প্রসঙ্গে’ বইতে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন এ ধারণা সর্ম্পূণ ভ্রান্ত।
https://drive.google.com/file/d/0B_YaosR26qWjVnc5bWlIek1KaU0/view?resourcekey=0-Ss6hUz41t2riVVHsS_9LvA
তারা দেখিয়েছেন, কেবল কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রতিভাহীন লোক সাধারণত হয় না এবং সব মানুষই কোনো না কোনো নৈপুণ্যের অধিকারী। স্কুল এবং পরিবারের কর্তব্য হচ্ছে সেই নৈপুণ্যের আবিষ্কার ও বিকশিত করা। মানুষ গড়া হচ্ছে বহুমূখী এক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার দুটি দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ, অনুভূতি আর হৃদয় গড়ে তোলা এবং বুদ্ধির উন্মেষ ঘটানো। আর সর্বাঙ্গীন বিকশিত মানুষের অপরিহার্য গুণ হলো শ্রমশীলতা তৈরি করা। কিন্তু হিতোপদেশ দিয়েই এই শ্রমশীলতা বা মানবিক নৈতিকতা তৈরি করা যায় না। একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং ছাত্র শিক্ষক, বাবা-মা, স্কুলের পরিবেশ, রাষ্ট্রের অংশগ্রণের মাধ্যমে এ কাজটি করতে হয়। তাই বাইরে রাজনীতি, অর্থনীতির সাথে ও সময়ের সাথে সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে জড়ানো ছিল। শিক্ষা বলতে সেখানে শিল্প, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা, কাজ, খেলা, নৈতিক চরিত্র, আচার-আচরণ সবই বোঝাতো। শিক্ষা আর সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছিল সেখানে।
আমাদের মতো দেশে শিক্ষার সাথে জীবনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দেশপ্রেম বা শ্রমের মর্যাদা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা রচনা লেখার পরও একজন ছাত্র এগুলো শুধু পরীক্ষা পাসের বস্তু মনে করে। হৃদয়কে তা কখনো প্রভাবিত করে না। পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কৌশলে সমাজকে অবহেলা করে নিজেকে বড় হতে শেখায়, সবাইকে নিজ নিজ ভবিষ্যৎ আর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শেখায়। সোভিয়েত শিক্ষা কাঠামো তোতা পাখির মতো মুখস্ত করা শেখাতো না। কী শেখানো হচ্ছে, কেন শেখানো হচ্ছে, শেখার পর সমাজে তাদের কি অবস্থা হবে এবং কী তাদের ভবিষ্যৎ এসব তাতে স্পষ্ট ছিল। তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস পড়ানো হতো। বুর্জোয়া ইতিহাস যেখানে কিছু ঘটনার তারিখ, সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি মিলে একটা জগাখিচুরি তৈরি করে, তাতে সমাজ পরিবর্তনের কোনো প্রকৃত ধারণা গড়ে উঠে না। সোভিয়েতদের স্কুলে প্রথম ক্লাস থেকে আরম্ভ হতো ইতিহাসের পাঠ। যেমন - এসিরিয়া, ব্যাবিলন, ভারত, মিশর, চীন, গ্রীস ও প্রাচীন সভ্যতা এবং শতাব্দী ধরে কীভাবে সামন্তবাদের বৃদ্ধি হয়েছে। এক একটি দেশ ধরে তাদের বিশ্লেষণ করে দেখানো হতো। এভাবে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর একজন ছাত্র পৃথিবীকে স্বচ্ছভাবে বুঝতে শিখতো। সাধারণ জ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক জ্ঞানও তাকে অর্জন করতে হতো। প্রত্যেক স্কুলে সিনেমা যন্ত্র, স্লাইড শো, যন্ত্রপাতি ছিল। শিক্ষকরা ইতিহাস, ভুগোল বা বিজ্ঞানের যেকোনো শাখা সম্পর্কে ফিল্মের সাহায্যে তাদের পাঠকে চিত্রিত করতেন। প্রত্যেক স্কুলে ছিল প্রাণি বিভাগ। যাতে শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষভাবে জীব জন্তুদের জন্ম, বৃদ্ধি, উৎপাদন ক্রিয়া প্রভৃতি সর্ম্পকে জানতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যেকটি প্রজাতন্ত্রের ছেলেমেয়েরা তাদের মাতৃভাষায় সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী হতে শিখতো। স্কুলের দেয়াল পত্রিকা, বিভিন্ন শিশু পত্রিকার তারা ছিল নিয়মিত লেখক ও পাঠক। স্কুলের পড়াশোনার বাইরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিগত আগ্রহ বা রুচি মাফিক তারা অন্য কাজে যুক্ত থাকতো। তবে তা সবার জন্য বাধ্যতামুলক নয়। আগ্রহী ছাত্ররা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর গ্রুপ তৈরি করে স্কুল ছুটির পর এসব কাজে সময় দিতো। যার নাটক ও সাহিত্য সম্বন্ধে আগ্রহ তারা সাহিত্য চক্রে, যারা সঙ্গীতজ্ঞ হতে ইচ্ছুক তারা শিল্পী চক্রে যোগ দিতো। যারা বিজ্ঞানে আগ্রহী তারা পদার্থ বা রসায়ন চক্রে যোগ দিতো। ইঞ্জিনিয়ারিং বা নির্মাণ কাজের জন্য টেকনিক্যাল বিষয় শিখার ব্যবস্থা ছিল। এসব চক্র বিশেষ উৎসবে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের পরিবেশনা করতো।
নভেম্বর বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ার স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল যৎসামান্য এবং তা অতি সাধারণ মানের৷ যেটুকু ছিল তা ভোগ করতো জার এবং অভিজাত শ্রেণি৷ গরিবের ভরসা ছিল গ্রাম্য চিকিৎসক, পাদ্রী এবং ঈশ্বর! রোগ হলে ঈশ্বরের কাছে চোখের পানি ফেলা আর প্রিয়জনের শেষযাত্রায় যোগ দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না তাদের৷ কলেরা, স্মলপক্স, টাইফাস, যক্ষ্মা ও সূতিকা জ্বরে লক্ষ লক্ষ মানুষ জারশাসিত রাশিয়ায় অসহায়ভাবে প্রাণ হারাতো৷ শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ২৬০ জন৷ মানুষের মৃত্যুর হার ছিল হাজার প্রতি ২৯.৪ জন৷ ১৯১৩ সালে ৪,৩৬৭টি গ্রাম্য মেডিকেল স্টেশনে ৪,৫৩৯টি স্বাস্থ্য সহকারী (ফেল্ডশের) জাতীয় পদ ছিল এবং ৮ কোটি গ্রামের জনসাধারণের জন্য ছিল ৪৯০৮৭টি হাসপাতাল শয্যা৷ সারা দেশের শয্যা সংখ্যা ছিল ২,০৭,৩০০টি৷
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Feldsher
প্রতি হাজারে ১.৩টি শয্যা৷ ঐ সালের হিসাবে সমগ্র রাশিয়ার ১৫ কোটি ৯২ লক্ষ লোকের জন্য মাত্র ২৩,১৪৩ জন চিকিৎসক ছিল, অর্থাৎ গড়ে ৬৯০০ লোক প্রতি ১ জন ডাক্তার৷ গ্রামে ১৮৫০০ জনে ১ জন ডাক্তার৷ ফেল্ডশের সংখ্যা ছিল ২৯,০০০ জন, ছিল ১০,০০০ নার্স এবং ১৫,০০০ মিডওয়াইফ৷ হাসপাতালগুলির অবস্থান ছিল পরিকল্পনাবিহীন, এলোমেলো৷ ৩৫ শতাংশ শহরে কোনও হাসপাতাল ছিল না৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় এই নগণ্য স্বাস্থ্য কাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস ও অকেজো হয়ে যায়৷
১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ব্যবস্থায় চিকিৎসা মানুষের অধিকারে পরিণত হয়৷ সোভিয়েত সমাজে মায়েদের জন্যে দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রতি এলাকায় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷ অন্ত:সত্ত্বা মায়েদের চিকিৎসার সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, ভয় দূর করা, হাসপাতালে প্রসব করানো প্রভৃতি এই কেন্দ্রগুলো করতো৷ বিনামূল্যে সর্বদা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার পরিষেবা ছিল৷ এসময় ছিল মায়েদের চাকরি থেকে ৭৭ দিন সবেতন ছুটি৷ ডাক্তার পরামর্শ দিলে তবেই কাজে যোগদান৷ অন্ত:সত্ত্বা অবস্থার চতুর্থ মাস থেকে ওভারটাইম কাজ বন্ধ৷ প্রসবের পর প্রত্যেক মাকে কাজের সাড়ে তিন ঘন্টা অন্তর আধঘন্টা ছুটি দেয়া হতো শিশুকে স্তন্যপান করানোর জন্য৷ মাকে রাতের শিফটে কাজ দেয়া বন্ধ থাকতো৷ অন্ত:সত্ত্বা অবস্থার ছয় মাস থেকে প্রসবের পর চার মাস পর্যন্ত প্রত্যেক মায়ের রেশন দ্বিগুণ করে দেয়া হতো৷ শিশুর জামাকাপড় কেনার জন্য এবং এক বছর বয়স পর্যন্ত খাওয়ার জন্য মাকে নগদ টাকা সাহায্য করা হতো৷ ২ মাস থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ক্রেশে রাখার ব্যবস্থা ছিল৷
https://www.marxists.org/reference/archive/field-alice/protect/ch07.html
শিশুদের এই ক্রেশগুলো ছিল অতুলনীয়৷ শুধু রোগ প্রতিরোধ আর চিকিৎসাই নয়, প্রতিটি শিশুর সার্বিক বিকাশের অভূতপূর্ব বন্দোবস্ত করেছিল সোভিয়েতরা৷ সারা দেশে শিশুদের দেখার জন্য শিশু বিশেষজ্ঞ এবং ডিসপেনসারি ও পলিক্লিনিক ছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই শিশুমৃত্যুর হার, পুষ্টি, টিকাকরণ সহ সব মাপকাঠিতে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোকে ধরে ফেলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ ক্রস ইনফেকশন রুখতে ছিল সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথমেই জোর দেয়া হয়েছিল অধিক সংখ্যায় উপযুক্ত মানের ডাক্তার তৈরিতে৷ পাশাপাশি নার্স এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফেল্ডশের তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া হতো৷ ১৯৮০ সালে কেবল সোভিয়েত রাশিয়াতেই ৮৩টি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ হিসাবে আরও ৯টি মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে যায়৷ ১৯৮৬ সালে চিকিৎসক সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লক্ষ (অন্য প্রজাতন্ত্রগুলোর পরিসংখ্যান এখানে দেয়া হয়নি)৷ ১ লক্ষ জনসাধারণ পিছু ৪৩০ জন ডাক্তার, যা বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় ছিল ১ লক্ষ মানুষ পিছু ১৪.৫ জন মাত্র৷ পড়াশোনার কোনও খরচ ছিল না৷ নিত্য নতুন মেডিকেল চিকিৎসা, প্রযুক্তি, ওষুধপত্রের জ্ঞানার্জনের জন্য প্রত্যেক সোভিয়েত চিকিৎসকের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল৷ সোভিয়েত স্বাস্থ্য পরিষেবায় হাসপাতালের ভূমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক সিস্টেমে গড়ে ওঠা বহু স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে৷ ১৯৮৩ সালে কেবল সোভিয়েত রাশিয়াতেই ২৩,৫০০টি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র এবং ৩৬,৬০,০০০টি শয্যা সংখ্যা ছিল৷ সোভিয়েতের সর্বত্র সাধারণের জন্য হাসপাতাল পরিষেবা ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে৷ অঞ্চলভিত্তিক হাসপাতালে গড়ে ১০০০০ লোকের জন্য ৩৫-৫০টি বেড ছিল৷ এখানে সার্জন সহ কয়েক ধরনের বিশেষজ্ঞ থাকতো৷ জেলা স্তরে ৮০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ মানুষ প্রতি হাসপাতালে ১৪-১৬ জন বিশেষজ্ঞ এবং ১০০-৩০০ বেড থাকতো৷ প্রাদেশিক হাসপাতালে ৬০০-১২০০ বেড থাকতো এবং সেগুলো প্রযুক্তিগতভাবে ছিল অনেক উন্নত৷ এগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও কাজ করতো৷ এছাড়া শিশুরোগ, প্রসূতি, ক্যানসার, মানসিক রোগ, টিবি, সংক্রমণ, ট্রমা, হার্ট, চক্ষুরোগ ইত্যাদির জন্য বিশেষ বড় হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র ছিল৷ এর বাইরে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে ১৩০০টি বিশ্রাম আবাস এবং তাতে ২১ লক্ষ বেড ছিল৷ পৃথিবীর আর কোনও দেশে এত বিস্তৃত স্বাস্থ্যনিবাস ছিল না৷ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শুধুমাত্র ফেল্ডশের-নার্স পরিচালিত মেডিকেল স্টেশন ছিল৷ তার উপরে ছিল ৪,০০০ লোক প্রতি পলিক্লিনিক ব্যবস্থা যেখানে জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন দন্ত চিকিৎসক এবং সাথে নার্স, ক্লার্ক প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল৷ সাধারণ পলিক্লিনিক ছাড়াও শুধু শিশুদের জন্য ১৩,০০০টি পলিক্লিনিক ছিল৷ প্রসূতি, শ্রমিক, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের জন্য বিশেষ পলিক্লিনিক সারা দেশে ছড়ানো ছিল৷ ১৯৮৬ সাল নাগাদ কেবল সোভিয়েত রাসাতেই সব মিলিয়ে প্রায় ৪০,১০০টি পলিক্লিনিক ছিল (গড়ে ৭০০০ লোকের জন্য একটি)৷ ১৯৩৬ সালের গৃহীত সংবিধানে (স্তালিন সংবিধান) নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত ১২০ নম্বর ধারাতে বলা হয়েছিল সোভিয়েত নাগরিকদের বার্ধক্যে, অসুস্থতায় এবং অক্ষম অবস্থায় সম্পূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা আছে৷
https://en.m.wikipedia.org/wiki/1936_Constitution_of_the_Soviet_Union
https://www.marxists.org/history/ussr/government/constitution/1936/1936-constitution.pdf
সরকারি অর্থে বিস্তৃতভাবে শ্রমিক এবং অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য ইনসিওরেন্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল৷ শ্রমজীবী মানুষদের জন্য সমস্ত প্রকার চিকিৎসা পরিষেবা বিনামূল্যে সুনিশ্চিত করা হয়েছিল এবং তাদের জন্য সোভিয়েতের প্রত্যেকটি প্রজাতন্ত্রে স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলা হয়েছিল৷ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজের একটি অভিনব ব্যবস্থা ছিল ইএমএস৷ ফোন কল করলে সেন্ট্রাল সুইচ বোর্ডের মাধ্যমে নিকটবর্তী কেন্দ্র থেকে অ্যাম্বুলেন্সসহ ডাক্তার এবং ফেল্ডশের বা নার্স হাজির হয়ে যেতো৷ তারা প্রাথমিক চিকিৎসা করে প্রয়োজনে হাসপাতালে পাঠাতো৷ আর ইমার্জেন্সি মনে না করলে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো৷ কেবল সোভিয়েত রাশিয়ায় গ্রাম-শহর মিলিয়ে এরকম ৫,১০০টি ইর্মাজেন্সি মেডিকেল সার্ভিস অ্যাম্বুলেন্স স্টেশন ছিল৷ নতুন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জ্ঞান, স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে গবেষণা এবং প্রযুক্তি কৌশল বাড়ানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে নিরলস প্রচেষ্টা ছিল৷ মেডিকেল রিসার্চের কাজ বিশেষভাবে পরিচালনার জন্য ৭০০টি গবেষণাকেন্দ্র ছিল৷ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পাভলভের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সোভিয়েত সরকার সমস্ত সহযোগিতা প্রদান করে এবং তাকে অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সে উত্তীর্ণ করে৷
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ivan_Pavlov
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Academy_of_Sciences_of_the_Soviet_Union
রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালনায় এবং অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স ও ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সের তত্ত্বাবধানে অর্থদান করা হতো৷
https://en.m.wikipedia.org/wiki/USSR_Academy_of_Medical_Sciences
গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল এবং বইপত্র স্বল্পমূল্যে হাজার হাজার কপি ছাপানো হতো৷ তার দামও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম ছিল৷ লেনিনের শিক্ষা অনুযায়ী সোভিয়েতরা ঘোষণা করেছিল ‘আমরা শুধু অর্থনৈতিক ভিত্তিতে মানবসমাজ পুনর্গঠিত করছি না, আমরা বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম অনুযায়ী মানবসমাজকে ভেঙে গড়ছি’৷ সোভিয়েতরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে শিরোধার্য করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এই সমস্ত অসুখকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মুল করে৷ ১৯২৫ সালে সোভিয়েত সরকার ‘পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কর্মসূচি’ গ্রহণ করে৷
https://www.marxist.com/the-sexual-revolution-in-russia.htm
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Prostitution_in_the_Soviet_Union
পতিতাদের বিরুদ্ধে জার সরকারের সমস্ত দমনমূলক আইন বাতিল, এই বৃত্তি থেকে মুনাফাভোগীদের বিরুদ্ধে ক্ষমাহীন যুদ্ধ এবং যৌনরোগাক্রান্ত মানুষের কাছে বিনাপয়সায় চিকিৎসা পৌঁছে দেয়ার কর্মসূচি গৃহীত হয়৷ ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ঘোষণা করে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে আর পতিতাবৃত্তির অস্তিত্ব নেই’৷ যৌনরোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৬,০০০টি ক্লিনিক ও ১০,০০০টি ছোট ডিসপেনসারি ছিল৷ ১৯৪০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিফিলিস নির্মূল হয়৷ বিশ্বখ্যাত থোরাসিক সার্জন ডাঃ নর্মান বেথুন ১৯৩০ এর দশকে ডাক্তারদের এক সভায় উল্লেখ করেন, আমেরিকার কম রোজগারের ৩৮.২% মানুষের কোনও চিকিৎসার সুযোগ নেই৷ বর্তমানে আমেরিকায় ৫০-৬০ মিলিয়ন মানুষের কোনও মেডিকেল ইনসিওরেন্স নেই৷ দেশটির প্রায় ১০-১৫% কর্মক্ষম মানুষ বেকার৷ এর থেকে বোঝা যায় সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থার পার্থক্য কত বিশাল৷
স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন অযোগ্য নেতৃত্ব সমাজতন্ত্র থেকে সরে এসে পুঁজিবাদ কায়েম করায় বর্তমান পুঁজিবাদী রাশিয়ার স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে গর্ব করার মতো বিশেষ কিছু নেই৷ জন্মের পরে আয়ুর যে মাত্রা নির্ধারিত হয় তাতে গর্বাচভ - ইয়েলৎসিনের রেখে যাওয়া রাশিয়া নেপাল,বাংলাদেশের সাথে তুলনীয়৷ স্বাস্থ্যে অর্থ বরাদ্দ ভীষণভাবে হ্রাস করা হয়েছে৷ চালু করা হয়েছে ম্যান্ডেটরি হেলথ ইনসিওরেন্স, যার প্রিমিয়াম ব্যক্তিকেই দিতে হবে৷ পুঁজিবাদী রাশিয়ায় মানুষের অধিকার নেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার৷ যদিও সংবিধানে স্বাস্থ্য নাগরিকের অধিকার হিসাবে স্বীকৃত, কিন্তু তার ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন রকমের ইনসিওরেন্সের মাধ্যমে৷ সরকার সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে৷ টাকা বা সাজ-সরঞ্জামের অভাবের কথা বলে এই ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে নাগরিকদের প্রায়শই বঞ্চিত করে৷ পুঁজিবাদী রাশিয়াতে গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ডিসপেনসারি ও পলিক্লিনিকগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে৷ অর্থ ও সরবরাহের অভাবে পরিষেবা ধুঁকছে৷ গ্রামের সাথে শহরের বহু হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে৷ কমানো হয়েছে শয্যা সংখ্যা৷ আউটডোর প্রেসক্রিপশনের ওষুধ কোথাও সরবরাহ করা হয় না সামান্য কিছু প্রান্তিক মানুষদের ছাড়া৷ পকেটের টাকা খরচ করে কিনে নিতে হয় সেগুলো৷ ২০১২ সালের ‘মে ডিক্রি’-তে পুতিন স্বাস্থ্য কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধি এবং সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ধীরে ধীরে বেসরকারি হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন৷ যেই দেশ পৃথিবীতে যৌনরোগকে নির্মূল করেছিল এবং পতিতাবৃত্তিকে সমাজজীবন থেকে বিনাশ করেছিল সেই দেশে এখন এইডস রোগের রমরমা৷ পুঁজিবাদী রাশিয়ায় শুধু নয়, পৃথিবীর প্রায় সব শহরে রুশ যুবতীদের দেহ বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে৷ সমাজতন্ত্র থেকে সরে আসায় যক্ষ্মা সংক্রমণ এবং তা থেকে মৃত্যু দুটোই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে৷ বেড়েছে শিশুমৃত্যু, প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু৷ জারের আমলের জরাগ্রস্ত চিন্তাভাবনা ও জঘন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে লেনিন-স্তালিনের নেতৃত্বে সর্বাধুনিক এবং সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দর্শন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রয়োগ করে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বলশেভিকরা রাশিয়ার সমাজে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল, তার প্রভাবে সারা দুনিয়ার বুকে সোভিয়েত স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল শীর্ষস্থানীয় এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ৷ বিশ্বের মানুষের, বিশেষত ধনতান্ত্রিক পশ্চিমী দেশগুলোর কাছে যা ছিল বিস্ময় সৃষ্টিকারী এবং ঈর্ষার বস্তু৷ পুঁজিবাদে ফিরে আসা রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থার দৈন্যদশা আবার প্রমাণ করল সমাজতন্ত্রই সবার জন্য সুনিশ্চিত স্বাস্থ্যের শেষ কথা৷
Comments