সমাজতান্ত্রিক লাওসে মার্কিনী বর্বরতা
পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত বোমাবর্ষণ হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছিল লাওস। ১৮৯৩ সালে ফ্রান্স তাদের ইন্দোচীন উপনিবেশের অংশ হিসেবে লাওসকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফরাসিদের কাছে লাওস ছিল গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ, কারণ এখান থেকে মেকং নদী নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। মেকং নদী ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসিদের হাত থেকে জাপানিদের হাতে লাওসের কর্তৃত্ব চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা পরাজিত হলে কিছুদিন লাওস স্বাধীন দেশ হিসেবে মানচিত্রে স্থান পেয়েছিল। পরে আবার ফরাসিরা লাওসের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ১৯৫৪ সালে ফরাসিদের বিতাড়িত করে তারা ভিয়েতনামের পাশাপাশি স্বাধীনতা অর্জন করে। ভিয়েতনামে হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্টদের সাথে যখন ফরাসিদের তীব্র সংঘর্ষ চলছিল, তখন ভিয়েত মিনের মূল কার্যালয়ে ‘প্যাথেট লাও’ নামে একটি বিপ্লবী দল গঠিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Viet_Minh
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Pathet_Lao
ফরাসিদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভিয়েতনামে দ্রুত দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। দলটির নেতা ছিল প্রিন্স সৌফানৌভোং, যাকে ডাকা হতো ‘রেড প্রিন্স’ নামে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Souphanouvong
ভিয়েতনামে পড়াশোনা করার সময় তিনি হো চি মিনের কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হন এবং প্যাথেট লিও প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি পশ্চিমা সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিস্ট ভাবধারার সরকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্যাথেট লাও তৎকালীন পশ্চিমা সমর্থিত সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে যায়। আমেরিকার আশঙ্কা ছিল যদি লাওসে কোনোভাবে কমিউনিস্টরা বিজয়ী হতে পারে, তাহলে এই বিজয়ের ডোমিনো ইফেক্টের কারণে পূর্ব এশিয়ার আরও বেশ কিছু দেশে কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়তে পারে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Domino_effect
এজন্য তারা ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। লাওসের সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জেনারেল ভাং পাওয়ের দ্বারস্থ হয় মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকতারা।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Vang_Pao
পাও ছিলেন ‘মোং’ নামে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্য। তার জনগোষ্ঠীর সাথে সমতল ভূমির সংখ্যাগরিষ্ঠ লাও জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিরোধ ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hmong_people
আমেরিকা লাওসের এই নৃতাত্ত্বিক বিভেদকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মোং জনগোষ্ঠীকে প্যাথেট লাও দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য গোপনে পাহাড়ি অঞ্চলে সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। একদিকে ছিল সিআইএ-র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোং ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং কমিউনিস্টবিরোধী রয়্যাল লাওস সরকার। অপরদিকে ছিল প্যাথেট লাও। প্যাথেট লাওয়ের মূল সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা আসছিল ভিয়েতনামের কাছ থেকে। লাওসের সীমার ভেতর দিয়ে একটি সরবরাহকারী পথ তৈরি করা হয়েছিল। এই পথকে বলা হতো ‘হো চি মিন ট্রেইল’।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ho_Chi_Minh_trail
এই পথের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল উত্তর ভিয়েতনামি সেনাবাহিনী। উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর একটি অংশ লাওসে পশ্চিমা সমর্থিত সরকার উৎখাতের জন্য সামরিকভাবে প্যাথেট লাওকে সহায়তা করছিল। আবার দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অনেক সময় লাওসের সীমান্তবর্তী অঞ্চল ব্যবহার করছিল উত্তর ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা। লাওসের প্রায় সত্তর ভাগ এলাকা উঁচু-নিচু পাহাড় ও টিলায় পরিপূর্ণ। প্রচুর নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে পুরো দেশে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি লিখেছিলেন-
“সামরিক ক্যাম্পেইন শুরু করার জন্য লাওস হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিকূল জায়গা।"
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, হো চি মিন ট্রেইল বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করার পর প্যাথেট লাও এবং উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। ১৯৬৪ সালের দিকে মার্কিন সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণের গোপন অভিযান শুরু করে। এসি-১৩০ এবং বি-৫২ বোমারু বিমান দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে ক্লাস্টার বোমা বর্ষণ করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lockheed_AC-130
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Boeing_B-52_Stratofortress
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cluster_munition
হামলা পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে থাইল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করা হয়। হো চি মিন ট্রেইল এবং শেপোন গ্রামকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/X%C3%A9p%C3%B4n
শেপোন গ্রামটিতে উত্তর ভিয়েতনামি বাহিনী এবং প্যাথেট লাওয়ের কমিউনিস্টরা মার্কিন বোমা হামলার বিরুদ্ধে তীর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। ডেভ বার্নস নামের এক মার্কিন পাইলটের ভাষ্য অনুযায়ী, মার্কিন পাইলটরা যেকোনো মূল্যে শেপোন গ্রাম এড়াতে চাইতো। এখানে বিমান ধ্বংসের সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে থাকতো কমিউনিস্টরা। এই গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার অর্থ ছিল বিমানবিধ্বংসী গোলার নিশ্চিত আঘাত পাওয়া। লাওসের গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। আমেরিকার নির্মম বোমা হামলায় প্রাণ হারায় দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ। বোমা হামলায় মৃত ব্যক্তিদের ৯৮ শতাংশ ছিল বেসামরিক ব্যক্তি। প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ বোমাবর্ষণে আহত হয়। চার ভাগের এক ভাগ মানুষ শরণার্থী হয়েছিলেন বোমা হামলার কবল থেকে বাঁচতে। আনুমানিক দুই মিলিয়ন টন বোমা নিক্ষেপ করা হয় এই অভিযানে। নিক্ষেপকৃত বোমার একটি বড় অংশ অবিস্ফোরিত থেকে গিয়েছিল প্রাথমিকভাবে। সেসব বোমার কবলে পড়ে পরবর্তীতে বিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সিআইএ আকাশপথে প্রায় পাঁচ লাখ আশি হাজার বার অভিযান পরিচালনা করে। আল জাজিরার মতে, নয় বছর ধরে প্রতিদিন গড়ে প্রতি আট মিনিট পর পর বোমা হামলা চালানো হয় দেশটিতে। সিআইএ-র অধীকৃত বিমান ব্যবস্থা ‘এয়ার আমেরিকা’ মার্কিনিদের সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Air_America_(airline)
https://www.history.com/news/laos-most-bombed-country-vietnam-war
https://www.thecollector.com/war-in-laos-most-heavily-bombed-country-in-history/
https://www.peoplesworld.org/article/laos-a-land-still-scarred-by-the-bombs-of-u-s-imperialism/
Comments