রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়

 

ইরাকের বসরা থেকে কুয়েত পর্যন্ত যে রাস্তাটি ছিল, তার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘হাইওয়ে এইট্টি’।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Highway_of_Death

১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ইরাকি সেনারা এই সড়ক ব্যবহার করে কুয়েত আক্রমণ করলে রাজপরিবারের সদস্যরা সৌদি আরবে পালাতে বাধ্য হয়। আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইরাকি দখলদারিত্ব উৎখাতের জন্য ন্যাটোকে আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার পক্ষ থেকে বার বার কুয়েতের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেয়ার শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব দেয়ার পরও ইরাক কর্ণপাত করেনি। একপর্যায়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকি দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করতে ‘যেকোনো পদক্ষেপ’ গ্রহণ করার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এরপর মূলত ন্যাটোর যৌথ সেনাবাহিনী ইরাকি দখলদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে শুরু করে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gulf_War

যুদ্ধের শেষ দিকে যখন ইরাকের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেলে দেশটির দখলদার সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ছয় মাস আগে তারা যে ‘হাইওয়ে এইট্টি’ দিয়ে কুয়েতের রাজধানী দখলের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করেছিল, সেই পথেই তারা স্বদেশে ফিরে আসতে শুরু করে। ফিরে আসার পথে তারা পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করছিল। এখানেই ওঁৎ পেতে ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী। ইরাকি সেনাবাহিনীর সমস্ত যানবাহন যখন রাস্তায় চলাচল করতে শুরু করে, তখন প্রথমে গাড়িবহরের শুরুর ও শেষের ভারি যানবাহনগুলোর উপর বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করা হয়। এতে প্রায় ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট শুরু হয়। পরের দশ ঘন্টা ধরে চলে অবিরাম বোমাবর্ষণ। উপর থেকে একটানা ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপের ফলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় রাস্তাটি। যে সামরিক ব্যক্তিরা বোমাবর্ষণের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। এদের একজন ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-

“আমার ভেতরের একটি অংশ বলছে, এই বোমাবর্ষণ ঠিক আছে। এটা যেন পুকুরে সাঁতার কাটা হাঁসের দিকে তাক করে বন্দুক চালনার মতো। তারপরও এটা কি আমাকে অস্বস্তি এনে দেয়? মোটেও না। কিন্তু অপর এক অংশ বলছে- এই মানুষরা কেন মারা যাচ্ছে? একজন মানসিক ভারসাম্যহীন শাসকের স্বার্থ পূরণের জন্য? এটা কি ঠিক? যা-ই হোক, আমরা যুদ্ধ করছি। এটা যুদ্ধের একটি বিয়োগান্তক অংশ, কিন্তু আমরা আমাদের দায়িত্বই তো পালন করছি।”

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এই বোমা হামলায় মৃত ইরাকি সৈন্যের সংখ্যা ছিল ছয় হাজার থেকে দশ হাজারের মতো। ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। কিছু সৈন্য পালাতে সমর্থ হলেও বেশিরভাগই মৃত্যুবরণ করেন। সকালে সাংবাদিকরা যখন সেই রাস্তায় যান, তখন হতাহতের সংখ্যা দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন। হাজার হাজার পুড়ে যাওয়া যানবাহন পড়ে ছিল মরুভূমির বুক চিরে যাওয়া সেই রাস্তায়।

https://www.middleeastmonitor.com/20220225-remembering-the-iraqi-withdrawal-from-kuwait-and-the-highway-of-death/

পড়ে থাকা লাশগুলোর অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সাংবাদিকদের তোলা বেশিরভাগ ছবি পরবর্তীতে গণমাধ্যমে ছাপানোর উপযুক্ত ছিল না। মরুভূমির মাঝখানে রাতের বেলায় আটকে পড়া সেনাবাহিনীর উপর বোমাবর্ষণের সাথে যারা জড়িত ছিল, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর এই যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে কখনোই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িতদের যেভাবে অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য করা হয়, এক্ষেত্রে এরকমও কিছু দেখা যায়নি কখনও।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]