কেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারা একটি বিজ্ঞান? - স্কট এইচ [পর্ব-এক]
আপনি বলেন যে মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান। কিন্তু অধিকাংশ অ-মার্ক্সবাদীদের কাছে এটি একটি বিজ্ঞান নয়, এটি একটি আপ্তবাক্য। তাহলে আপনি কেন বলেন যে এটি একটি বিজ্ঞান?
বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেয়াটা কোনও মামুলি ব্যাপার নয়। পদার্থবিদ্যা কেন বিজ্ঞান? বা জীববিদ্যা কেন বিজ্ঞান? কেন জ্যোতির্বিদ্যা একটি বিজ্ঞান, কিন্তু জ্যোতিষবিদ্যা নয়? অভিধান বিজ্ঞানকে এই মর্মে সংজ্ঞায়িত করে, অধ্যায়নের বিষয় হিসাবে সুসংবদ্ধ জ্ঞানের একটি বিভাগ এবং জ্ঞান বা জ্ঞানের একটি পদ্ধতি যা সাধারণ সত্যকে ব্যাপ্ত করে অথবা সাধারণ নিয়মাবলীর গবেষণা করে, বিশেষত সেইসব সাধারণ নিয়মাবলী যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আহিত হয়েছে।
[Merriam-Webster's Collegiate Dictionary, 10th ed. (1993)]
এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে আবার এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, জ্ঞানান্বেষণের নিয়মানুগ প্রক্রিয়ার নীতিগুলি এবং প্রক্রিয়াগুলি, যা সমস্যার স্বীকৃতি এবং সুত্রায়নে রত হয়, পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এবং প্রকল্পগুলিকে পরীক্ষা ও সূত্রায়িত করে।
[Merriam-Webster's Collegiate Dictionary, 10th ed. (1993)]
অর্থাৎ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা পরোক্ষভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমার বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বাস্তবতার নিরিখে গৃহীত সত্যের পরীক্ষা এবং তার থেকে গড়ে ওঠা তত্ত্ব, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কেন্দ্রীয় উপাদানগুলির উপর নিবদ্ধ। মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান কারণ, এটি সামাজিক প্রপঞ্চের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, সেই সমস্ত সামাজিক প্রপঞ্চগুলিকে, যত্ন সহকারে গড়ে তোলা তত্ত্বের সাহায্যে সুসংবদ্ধ করে, ঐ তত্ত্ব থেকে বহুবিধ ঘটনাকে সূত্রবদ্ধ করে এবং সেই সমস্ত তত্ত্বগুলিকে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাস্তবের মাটিতে সমাজ এবং ব্যক্তি মানুষকে বদলানোর লড়াইয়ের মাধ্যমে যাচাই করে। যেকোনো বিজ্ঞানের মতই এটি দুনিয়াকে বদলানোর শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে; যদিও অন্যান্য সকল বিজ্ঞানের মতই তার নিজস্ব ক্ষেত্র সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য তাকে এখনও দীর্ঘ পথ পেরোতে হবে। আর পাঁচটা বিজ্ঞানের মতই এটি বাস্তবতার নিরিখে, পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিবর্তিত ও বিকশিত করেছে। ১৮৪০ সাল থেকে শুরু করে...
*এটি, প্রধান এবং অপ্রধান বিভিন্ন নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে নিজেকে বিপুলভাবে বিস্তৃত ও বিকশিত করেছে এবং নতুন বহু বাস্তব বিষয় সেই সকল তত্ত্বের আলোকে স্পষ্টতর হয়েছে;
*এটি কিছু ভ্রান্ত তত্ত্ব এবং বিভ্রান্তিমূলক বিষয়কে বাতিল করেছে এবং অন্যান্য বহু বিষয়কে, ভ্রান্তির উপাদানগুলিকে বাতিল করে ও সত্যের উপাদানগুলিকে রক্ষা করবার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে;
*যথেষ্ট সফলতার সাথে এটিকে বিবিধ সামাজিক অবস্থার নিরিখে, বিশেষত রাশিয়া এবং চীনে দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা গেছে এবং এক্ষেত্রে এটি অপরাপর বিকল্প তত্ত্বগুলির তুলনায় বহুগুণে সফল থেকেছে;
*এটি চিহ্নিত করেছে যে, এখনও কিছু সমস্যা আছে
যার সম্পূর্ণ সমাধান এটি করতে পারেনি এবং এটি সেই সমাধানের লক্ষ্যে আন্তরিকতার সাথে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে;
*এটি সেই সমস্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে কষ্টকর সংগ্রাম চালাচ্ছে যেগুলি মার্ক্সবাদকে একটি আপ্তবাক্যে পরিণত করতে চায় এবং মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিকভাবে পরিক্ষিত মূলগত সারৎসার থেকে মার্ক্সবাদকে বিচ্যুত করতে চায়; এবং
*এটি তার নিজের নীতিসমূহ এবং পদ্ধতির উপর বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনাকে প্রয়োগ করেছে এবং এটি তা করেছে পরম আন্তরিকতার সাথে। প্রকৃতপক্ষে, এইক্ষেত্রকে এটি যেকোনো বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক গুরুত্ব দিয়েছে এবং এতে করে এটি সাধারণভাবে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বা অন্যভাবে বললে বৈজ্ঞানিক দর্শনকে, মার্ক্সবাদের একটি উপাদানে পরিণত করেছে।
অতএব আপনি বলছেন মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান, কারণ এর সাথে ভৌত বিজ্ঞানের কিছু মিল আছে?
বিজ্ঞান হিসাবে বিবেচিত হতে হলে যেকোনও শৃঙ্খলাকে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির মতো হতে হয়। যেভাবে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা বিজ্ঞান, সেই একই ভাবে মার্ক্সবাদও বিজ্ঞান। অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথে বহু প্রাসঙ্গিক মিলের দ্বারা এটিকে দেখানো যেতে পারে এবং এটিও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে কেন কিছু আপাত অমিল অপ্রাসঙ্গিক। অবশ্যই কোনো দু'টি আলাদা শৃঙ্খলার বিজ্ঞান হুবহু একরকম নয়, এমনকি তাদের বিকাশের পদ্ধতিগুলিও সম্পূর্ণ একরকম নয়। বিজ্ঞানের শৃঙ্খলা ভেদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও বিভিন্ন হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আপনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে 'অন্ধত্ব নিবারণ' সংক্রান্ত কিছু শুনতে পাবেন না যদিও এটি খুবই সাধারণ একটি সমস্যা এবং জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সমাজবিজ্ঞান এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদ রয়েছে, ঠিক যেরকম প্রভেদ রয়েছে ভৌত বিজ্ঞান এবং জীব বিজ্ঞানের মধ্যে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে প্রাসঙ্গিক মিলও, যা তাদের সকলকেই বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রেও এটি সত্য।
আপনি কি এরকম বলতে চাইছেন যে, মার্ক্সবাদ এবং সমাজবিজ্ঞান একই এবং সকল প্রকৃত সমাজ বিজ্ঞানগুলি প্রকৃতপক্ষে মার্ক্সবাদের অংশ?
মোটামুটি সঠিকই ধরেছেন। যদিও মার্ক্সবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো দর্শন, যাকে বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যা সমাজবিজ্ঞানকে ছাপিয়ে আরও বহু ব্যাপ্ত। প্রকৃতপক্ষে এই দর্শন নিজেই একটি সবচেয়ে সাধারণীকৃত এবং বিমূর্ত বিজ্ঞান, যা সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত বিজ্ঞানের সাধারণ, বিমূর্ত সত্যের একীকরণের মধ্য দিয়ে। এটা বলাও পাশাপাশি বোধহয় উচিত হবে যে, সমাজের এবং সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কিছু বিশেষজ্ঞ দিক রয়েছে যা মার্ক্সবাদের অংশ নয়; যেমন সমাজ-মনোবিদ্যা বা সমাজ-ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি। যদিও আমাদের মতে, সমাজবিজ্ঞানের প্রধান অংশগুলির অধিকাংশই মার্ক্সবাদের সাথে সমবিস্তৃত। প্রকৃত সমাজবিজ্ঞানের গুপ্ত ক্ষেত্রগুলি, যা সরাসরিভাবে মার্ক্সবাদের অংশ নয়, সেটিও মার্ক্সবাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত এবং শিক্ষিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সমসাময়িক বুর্জোয়া সমাজ-মনোবিদ্যার দ্বারা উত্থাপিত বহু বিষয়ের যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্লেষণ মার্ক্সবাদের মধ্যেই সম্ভব হয়। যেমন, মানুষের সামাজিক কাজের প্রাথমিক চালিকা শক্তি কি? মার্ক্সবাদের উত্তর হচ্ছে, এটি হলো মানুষের নিজের গোষ্ঠীর বিকাশের তাগিদ, যা কিনা শ্রেণী বিভক্ত সমাজের ক্ষেত্রে তার শ্রেণী স্বার্থ। এটি মার্ক্সবাদের একটি একেবারে মূলগত উপাদান। এজন্যই আমি বলি যে, যদি সমাজ-মনোবিদ্যার এমন কোনও অংশ থেকে থাকে যা মার্ক্সবাদের অংশ নয় বা অন্তত সরাসরিভাবে মার্ক্সবাদের উপর নির্ভরশীল নয়, তাহলে তা অবশ্যই একটি গুপ্ত অংশ। এই একই কথা সমাজ-ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতির ক্ষেত্রেও সত্য।
সমাজবিদ্যা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যা পড়ানো হয়?
বর্তমানে সমাজবিদ্যা যেভাবে আমরা পাই তা বাস্তবে একটি তামাশা এবং এভাবেই বিজ্ঞানের অন্য শাখার মানুষেরা একে দেখে থাকে। একজন একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, সমাজবিদ্যার মূলগত পদ্ধতি হলো “সুস্পষ্টকে অস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করা”।
[Samuel T. Williamson, "How to Write Like a Social Scientist", Rule 4, Saturday Review [date unknown]. Quoted in R. John Brockmann & William Horton, The Writer's Pocket Almanack (Santa Monica, CA: InfoBooks, 1988), p. 8]
এখন প্রশ্ন হলো, সমাজবিজ্ঞানীরা কেন এই ধরণের দুর্বোধ্য বা রহস্যময় ভাষার ব্যবহার করেন? কারণ তারা বিষয়ের স্পষ্টীকরণের বদলে তাকে রহস্যে ঢেকে রাখতে চেষ্টা করেন। যখন তারা অস্পষ্টকে ঘোষণা করেন, তারা সর্বদাই গালভরা শব্দ ব্যবহার করেন, যাতে করে তাদের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি ভুল ধারণাকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এবং প্রায়শই যখন তারা প্রকৃত সত্যকে লুকাতে চান তাদের স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহার করতে হয় বেশি বেশি করে দুর্বোধ্য ভাষা এবং দোমড়ানো মোচড়ানো যুক্তিমালা। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, যখন তাদের উত্তর দিতে হয়, কিভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীগুলি নিজের দেশে এবং বিদেশে অধিকাংশ জনগণকে শোষণ করে, তখন তারা প্রশ্নগুলিকে সম্বোধন না করে তাকে জটিল ও অবান্তর শব্দ দিয়ে আড়াল করেন। ফলে বুর্জোয়া সমাজবিদ্যা একটি মূল্যহীন বিষয় এবং এই শৃঙ্খলাটি গড়ে উঠেছে মার্ক্সবাদের বিরোধিতায় এবং মার্ক্সবাদের প্রতি ভীতিকে কেন্দ্র করে। এর টিকে থাকার কারণ হলো মার্ক্সবাদকে আক্রমণ করা এবং শাসক শ্রেণীর পছন্দের একটি মনগড়া বিকল্প তৈরি করা। সমাজের প্রকৃত বিজ্ঞান, প্রকৃত সমাজবিদ্যা হলো মার্ক্সবাদ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সমাজবিদ্যা নামটি বুর্জোয়া ছদ্ম বিজ্ঞানের দ্বারা দখল হয়ে গেছে।
অর্থনীতির বিষয়ে কি বলবেন? প্রায় সমস্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা মার্ক্সীয় অর্থনীতিকে দেখামাত্র বাতিল করেছেন।
তারা এটাই করেন! এভাবেই তাদের শিক্ষা দেয়া হয় এবং এই কারণেই তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় অর্থাৎ শাসক পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা এবং কেন শ্রমের শোষণ চিরকাল জরুরি - এটা বোঝানো। তারা প্রকৃতপক্ষে নিষিদ্ধ শব্দবন্ধগুলি, যেমন শ্রমের শোষণ প্রভৃতি ব্যবহার করেন না; পরিবর্তে তারা কিছু কোড ব্যবহার করেন। এমনকি পুঁজিবাদকেও তারা নরম করে বলেন 'মুক্ত উদ্যোগ ব্যবস্থা' বা 'গণতন্ত্র' নামক আরও উদ্ভট শব্দে। বুর্জোয়া সমাজবিজ্ঞানের কাজই হলো সত্যকে প্রকাশ করার বদলে লুকিয়ে রাখা। আমি দু'টি কারণে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে শাসকরা যে গণতন্ত্র বলে থাকে, তাকে উদ্ভট বলেছি: প্রথমত, পুঁজিবাদের ইতিহাসে মাত্র কিছু পুঁজিবাদী দেশ গণতান্ত্রিক; ফ্যাসিবাদী বা অন্যান্য স্বৈরাচারী দেশগুলিও পুঁজিবাদী (যদিও, প্রায়শই তারা সেটিকে লুকিয়ে রাখতে চায়)। দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, সাধারণ মানুষের সাপেক্ষে বুর্জোয়া গণতন্ত্র সর্বদাই একটি প্রতারণা, এটি শুধুই একটি শব্দ। প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে বোঝায়, জনগণের নিজের জীবন-জীবিকার উপর নিয়ন্ত্রণ যেটি কিনা সব দেশের উচ্চ শ্রেণীর নাগরিকদের বাদ দিলে কোথাও নেই। সমাজবিদ্যার মতই বুর্জোয়া অর্থনীতিও প্রকৃতপক্ষে একটি ছদ্ম বিজ্ঞান। আজ পর্যন্ত এটি একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সংজ্ঞা দিতে পারলো না যে, কেন পুঁজিবাদের মধ্যে বানিজ্য চক্র পরিচালিত হয়? কেন বাজারে চড়া এবং পতন আসে? কেন মন্দা আসে? প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবার বাজার চড়লেই বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা বলতে শুরু করেন যে, বানিজ্য চক্র একটি অতীতের বিষয় - কিন্তু তাদের এই দাবি ঠিক তার পরের মন্দাতেই ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়। এটা সবাই জানে যে, তাদের অর্থনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন জনের ব্যাখ্যা একে অন্যের সাথে প্রায়শই মেলে না। তাই এটিকে একটি বিজ্ঞান বলার থেকে,
একটি অনুমানধর্মী কাজ বলাটাই উচিত। এরা আসলে প্রাচীনকালের রাজ-জ্যোতিষীদের আধুনিক প্রতিনিধি! বুর্জোয়া অর্থনীতির প্রকৃত সারবত্তা হলো শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে, বেকারদের বিরুদ্ধে এবং গরীবদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী শ্রেণীকে রক্ষা করা, তাকে তুলে ধরা এবং তার অধিকার এবং স্বার্থকে মজবুত করা। অপরদিকে মার্ক্সীয় অর্থনীতি, যাকে আমরা রাজনৈতিক অর্থনীতি বলে থাকি, তার রাজনৈতিক চরিত্রকে সোচ্চারে ঘোষণা করে। মার্ক্সীয় রাজনৈতিক অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে শ্রমিক শ্রেণী এবং তার মিত্র শ্রেণীগুলির স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেয়। আমরা আমাদের পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে প্রকাশ্যে এবং সততার সাথে অবস্থান গ্রহণ করি, কারণ আমরা বৃহত্তর জনগণের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু বুর্জোয়া অর্থনীতি এই বিষয়টিকে লুকিয়ে রাখতে চায় যে, তারা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাই তারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে মিথ্যাচার করেই থাকে।
বিজ্ঞান পূর্বাভাস দেয়। আমাদের মনে হয় মার্ক্সবাদের করা পূর্বাভাসগুলির কিছুই প্রায় মেলে নি!
কে বলে? মুলত মার্ক্সবাদের বুর্জোয়া শত্রুরা বা যারা এইসকল মানুষদের থেকে শিক্ষা পেয়েছেন তারা, তাইতো? আচ্ছা, একটা উক্তিকে কোট করছি উদাহরণস্বরূপ, দেখুন:
“যেহেতু মার্ক্সের করা পূর্বাভাসগুলির একটিও মেলে নি (ব্যাতিক্রম The German Ideology-তে উক্ত, অনুন্নত দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রকে আরোপ করলে সেই সকল দেশের বিকাশ ঘটে), তাই মার্ক্সবাদ যে একটি বিজ্ঞান - এরকম ভানও আর কেউ করেন না। এটি তার অনুগামীদের কাছে একটি অভিজ্ঞতাবাদী বাস্তবতার বদলে একটি গুপ্ত ব্যবস্থায় (মধ্যযুগীয় কাবালার মতন) পরিণত হয়েছে যা আমাদের মতন বাদবাকিদের চিন্তার বিষয় নয় - অন্তত এখন পর্যন্ত নয়।“
[George Sim Johnson, "Everything Goes, Nothing Matters", Image magazine supplement, San Francisco Examiner, Feb. 3, 1991]
এটি একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে, জর্জ সিম জনসন বলে একজনের করা মন্তব্য। এখন প্রশ্ন হলো, কে এই জর্জ সিম জনসন? তিনি কি মার্ক্সবাদের কোনও বিশেষজ্ঞ? আসলে, তিনি হলেন একটি প্রধান বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং National Review-এর মতন একাধিক দক্ষিণপন্থী সাময়িক পত্রিকার লেখক। এবং উপরে উল্লেখিত তার বক্তব্যের প্রতিটি মন্তব্যই ভুল - এমনকি শাসক শ্রেণী মার্ক্সবাদকে নিয়ে আর চিন্তিত নয় বা চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই - এই বাক্যটিও ভুল। (আসল ঘটনা হলো, তার ঐ লাইনটি লেখাই, তার কথাটি যে ভুল তা প্রমাণ করে)। আমরা মার্ক্সবাদীরা, মার্ক্সবাদ যে একটি বিজ্ঞান, এই বিষয়ে কোনও ভনিতা করি না; আমরা দৃঢ়তার সাথে বলি যে, মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান হিসাবেই এর বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এমনকি তিনি যখন অনুন্নত দেশে (রাশিয়া, চীন) সমাজতন্ত্রের প্রভাব নিয়ে বলেন, সেটিও ভুল; এই দেশগুলিতে অধিকাংশ জনগণের কল্যাণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি হলেও (যা অধিকাংশ অ-মার্ক্সবাদী অথরিটিরাও স্বীকার করেন) তারা কোনও ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির জীবনধারণের মানকে স্পর্শ করতে পারে নি। এবং মার্ক্স এবং অন্যান্য অনেক মার্ক্সবাদীদের (অবশ্যই সকলে নন) করা পূর্বাভাস সম্পর্কে বলা যায় যে, তাদের পূর্বাভাস প্রায়োগিকভাবেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের রেকর্ড মার্ক্সবাদকে যারা বাতিল করেছে, তাদের তুলনায় বহুগুণে ভালো। একজন আমেরিকান সাংবাদিক কার্ল মার্ক্স এর বৃদ্ধ বয়সে তার কাছে যান এবং জানতে চান, তিনি (মার্ক্স) ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি পূর্বাভাস করছেন। 'গভীর এবং আত্মস্থ কণ্ঠে' তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “সংগ্রাম”;
[John Swinton, reporting on an interview with Karl Marx for the New York Sun, Sept. 6, 1880]
এর বিপরীতে, ভিক্টোরিয়া যুগের শিক্ষিত বুর্জোয়াদের সেই সর্বজনীন আচরণ, যেখানে অগ্রগামী ইউরোপীয় সভ্যতা এতটাই আশ্বস্ত ছিল যে, তারা এই বিষয়টিকে (সংগ্রাম) নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করেন নি। সেইসময় বুর্জোয়া প্রত্যাশার প্রায় কাছাকাছি ছিল শান্তিপূর্ণ প্রগতি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রবল অভিঘাতই সেই প্রত্যাশার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল। একবার ফিরে দেখো ১২০ বছর আগে মার্ক্সের করা পূর্বাভাসগুলি; বিশ্বযুদ্ধ, আক্রমণ/বহিরাক্রমণ, গণহত্যা, হিংস্র শ্রেণী সংগ্রাম, বিপ্লব, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, ধর্মীয় সংগ্রাম এবং এইরকম আরও অনেক কিছু। কে ঠিক ছিল? মার্ক্স নাকি ভিক্টোরীয় যুগের বুর্জোয়াদের সামাজিক শান্তির দৃশ্য? মার্ক্সের এই পূর্বাভাসগুলিকে, যেগুলি সম্পর্কে ভিক্টোরীয়দের কোনও ধারণাই ছিল না, সেগুলিকে কি খুব অসার মনে হচ্ছে তোমার? বেশ, তাহলে লেনিনের করা একটি ভীষণ নির্দিষ্ট পূর্বাভাসকে দেখা যাক, যা মার্কিন লিবারেল সাংবাদিক জর্জ সেলডেস এর ১৯১৯ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
“আরেকটি ক্ষেত্রে তিনি (লেনিন) সেই একই জেদি ধারণা প্রকাশ করেছিলেন, যে জেদি আচরণ সমস্ত বিপ্লবী নেতাদের সাধারণ চরিত্র ছিল।"
“জাপান এবং আমেরিকার মধ্যকার যুদ্ধ কবে নাগাদ আসন্ন”, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাকে (লেনিন) আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, কোনও যুদ্ধ হবে না কারণ যুদ্ধের কোনো কারণ নেই। “কিন্তু যুদ্ধ অবশ্যই হবে”, তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, “কারণ বুর্জোয়া দেশগুলি যুদ্ধ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না”।
[George Seldes, You Can't Print That! (Garden City, NY: Garden City Publishing Co., 1929), p. 221.]
অবশ্যই এটার মজা তা নয় যে, মার্ক্সবাদী লেনিন জাপান এবং আমেরিকার মধ্যকার ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা আগাম বলে দিয়েছিলেন (যখন গুটিকয়েক মানুষ, যদি অবশ্য কেউ থেকে থাকেন, এটি ঘটতে চলেছে বুঝেছিলেন), মজা হলো বুর্জোয়া সাংবাদিক সেলডেস দৃঢ় নিশ্চিত ছিলেন যে, লেনিন এই ক্ষেত্রে অবশ্যই ভুল প্রমাণিত হবেন। শুধুমাত্র লেনিন নন, সাধারণভাবে মার্ক্সবাদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময় পূর্বাভাস করেছিলেন, যখন বহু বুর্জোয়া আদর্শবাদীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে “সেই যুদ্ধ যা সমস্ত যুদ্ধকে সমাপ্ত করেছে” বলে দাবি করতেন। বহু ক্ষেত্রে আমরা মার্ক্সবাদীরা পূর্বাভাস করেছি এবং এখনও করি ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের, যখন অনেক লিবারেলরা শান্তির যুগের পূর্বাভাস দেন। বহু ক্ষেত্রে আমরা পূর্বাভাস করেছি এবং এখনও করি, সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের শ্রমিক এবং পুঁজিবাদীদের মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রামের যখন পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের মানুষেরা, এই ব্যবস্থায় সামাজিক শান্তির কল্পনা করেন।
বেশ, হয়তো মার্ক্সবাদীরা বিগত শতাব্দীতে চলমান সংগ্রামের যুগ, যুদ্ধ এবং বিপ্লবের ক্ষেত্রে সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছিলেন; কিন্তু আর কি কি সফল পূর্বাভাসের উদাহরণ আপনি দিতে পারেন?
বড় ছোট মিলিয়ে মার্ক্সের করা বহু পূর্বাভাস সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে কয়েকটা, যা মনে আসছে সেগুলি হলো:
*একচেটিয়া পুঁজির ঝোঁক ক্রমশ বাড়বে এবং তীব্র হবে;
*পুঁজিবাদের চড়া-মন্দার চাকা চলতেই থাকবে এবং পুঁজিবাদ কোনদিনই এটিকে নির্মূল করতে পারবে না (যার কারণ মার্ক্স গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন);
*কৃষক নির্ভর চাষ (আধা-সামন্ততান্ত্রিক) ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থাকে পথ ছেড়ে দেবে;
*পুঁজিবাদ আরও বেশি বেশি করে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হয়ে উঠবে;
*শ্রেণী সংগ্রাম চলবে এবং গড়ে উঠবে;
*মার্কিন গৃহযুদ্ধে ইউনিয়ন জিতবে (কারণ উত্তরের অতি অগ্রসর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা);
*প্যারি কমিউনের ক্ষমতা শ্রমিকরা ধরে রাখতে পারবে না (১৮৭১-এর প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব);
*শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা দখল করার পর পরাজিত বুর্জোয়াদের উপর প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়েই একমাত্র ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে (যে শিক্ষা মার্ক্স প্যারি কমিউনের পর যুক্ত করেছিলেন এবং যা পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে);
*প্রথম সফল প্রোলেতারিয় বিপ্লব হয়তো ঘটবে রাশিয়াতে।
Comments