কেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারা একটি বিজ্ঞান? - স্কট এইচ [পর্ব-দুই]

 

কিন্তু মার্ক্সবাদীরা কি ভুল পূর্বাভাসও করেন নি? উদাহরণস্বরূপ মার্ক্স কি শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান দুর্দশার কথার পূর্বাভাস করেন নি যেখানে বাস্তবে  শ্রমিকরা এই সময়কাল ধরে তাদের জীবন মানের অনেক উন্নতি ঘটিয়েছেন? 

এটা সত্যি যে, মার্ক্সবাদীরা ভ্রান্ত পূর্বাভাসও করেছেন। কিন্তু এটা বলা সঠিক হবে না যে, যেহেতু মার্ক্সবাদীরা মাঝে মধ্যে, অংশত বা সম্পূর্ণত ভ্রান্ত পূর্বাভাস করেছেন, তাই এটি বিজ্ঞান নয়। কারণ  এরকমভাবে দেখলে পদার্থবিজ্ঞানকেও বিজ্ঞান বলা  যাবে না, কারণ প্রখ্যাত পদার্থবিদরাও মাঝে মধ্যে ভ্রান্ত পূর্বাভাস দিয়েছেন! লর্ড কেলভিনের দু'টি এরকম উদাহরণ দেখে নেয়া যাক। লর্ড কেলভিন ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন মহান বিজ্ঞানী এবং রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি। তিনি বলেছিলেন, “বাতাসের থেকে ভারি বিমানযান অসম্ভব” এবং “বেতারের কোনও ভবিষ্যৎ নেই”। এই ধরণের এতো মন্তব্য পাওয়া যায় যে, আর্থার সি ক্লার্ক একটি সাধারণী বানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “যখন একজন খ্যাতনামা এবং বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী বলেন যে, কোনও কিছু সম্ভব, তখন তিনি  নিশ্চিতভাবেই সঠিক; কিন্তু যখন তিনি বলেন, কোনও কিছু অসম্ভব, তখন তিনি খুব সম্ভবত ভুল”।

[Arthur C. Clarke, Profiles of the Future (1973)]

কোনও বিজ্ঞান সম্পূর্ণ নয় এবং কোনও বিজ্ঞানীর কোনওকালেই তার বিশেষ ক্ষেত্রের উপর সম্পূর্ণ দখল থাকে না। তাই প্রতিটি বিজ্ঞানে সর্বদাই কিছু ভ্রান্ত  প্রত্যাশা, পূর্বাভাস এবং সাধারণীকরণ থাকবেই। তথাপি, যাদের নিজ নিজ বিজ্ঞানের উপর যত ভালো দখল  থাকবে, ততই তাদের প্রত্যাশা এবং পূর্বাভাস অন্যদের তুলনায় সঠিক হবে। উপরন্তু, যদি সেই শৃঙ্খলাটি প্রকৃত বিজ্ঞান হয়, তাহলে সেই সমস্ত ভ্রান্ত প্রত্যাশা এবং পূর্বাভাসগুলি সেই সেই তত্ত্বের পুনঃমুল্যায়নের দিকে নিয়ে যাবে, যাতে করে সেই সেই ক্ষেত্রে সফল পূর্বাভাস দেয়া যায়। আজ হতে বহু আগে মার্ক্স ইউরোপে সমাজ বিপ্লবের প্রত্যাশা করেছিলেন। এটি ছিল তার একটি সন্দেহাতীত পূর্বাভাস, যদিও আমি মনে করি না যে তিনি অমুক  তিথিতে অমুক সময়ে বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইরকমভাবে তিনি ভেবেছিলেন যে, ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশা অনেক বেশি ধারাক্রমে এবং অনেক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে যা ছিল বাস্তবে যা হয়েছে তার থেকে বেশি। এই ভুল প্রত্যাশার বা ভুল পূর্বাভাসের পিছনে একটি মাত্র ভ্রান্তি ছিল আর তা ছিল তিনি পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিকরণ এর বিশিষ্টতার বহু দিককে পুরোপুরি বিবেচনার মধ্যে  আনেন নি। (এটি পরবর্তীতে লেনিন করেছিলেন; মার্ক্সবাদ যে তার চলার পথের ভ্রান্তিগুলিকে সংশোধন করে, এটি তার একটি উদাহরণ)। এইজন্য, পূর্বাভাসের মুলগত নির্যাস সঠিক থাকলেও  প্রধান বিপ্লবগুলি প্রকৃতপক্ষে ঘটলো ইউরোপের দূরতম পরিধিতে (রাশিয়া) বা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে, যে দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা সবচেয়ে হিংস্র শোষণ ও নিপীড়নের শিকার ছিল (চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি)। একইভাবে, আ-বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশার যে অনুমান/পূর্বাভাস, তাও যথেষ্ট সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০০ কোটি মানুষ জীবনধারণ করেন দৈনিক ১৩৬ টাকারও ($2) কম টাকায়।

[Mentioned by the prominent bourgeois economist, Jeffrey Garten, in an "Economic Viewpoint" column in Business Week, Sept. 6, 2004, p. 28. Garten is dean of the Yale School of Management.] 

এই কথা সত্য যে, জীবনযাপনের খরচ পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন; কিন্তু যেখানেই তুমি থাকো না কেন, এটা সূর্যের আলোর মতন স্পষ্ট যে, তোমার আয় যদি দৈনিক ১৩৬ টাকা বা তার কম হয়, তাহলে তুমি চূড়ান্ত দারিদ্রের মধ্যেই অবস্থান করছো। যেকোনো প্রকারেই হোক, চরমতম দারিদ্র অবশ্যই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা শোষিত ও নিষ্পেষিত দেশগুলিতে; প্রধানত এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায়। বুর্জোয়ারা তাদের নিজেদের দেশে তুলনামূলক শান্তি এবং শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে কিছু পদক্ষেপকে অনুমোদন দেয় (যদিও তা তারা দেয় ভীষণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং প্রবল চাপের কারণে); যেমন মজুরি বাড়ানো এবং তলার শ্রেণীর কাছে পৌঁছায় এমন সুবিধাগুলি; এটিই হলো 'New  Deal' এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের আসল কথা। শাসক শ্রেণী জোসেফ কেনেডির সেই অবস্থানকে গ্রহণ  করেছিলেন যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি তার  'সৌভাগ্যের' একটি অংশ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত বাকিদের মুখ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু তাদের চোখে এই ছাড় একটি অস্থায়ী প্রয়োজন ছাড়া কিছু নয়। এবং বর্তমানে পুঁজিবাদী শ্রেণী এবং তাদের রাজনীতিবিদরা কল্যাণকামী রাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ও শ্রমিক শ্রেণী ও মধ্যবিত্ত বর্গের উপর আবার আক্রমণ শানাচ্ছে। তারা এটিকে এখন সম্ভব ভাবছে, কারণ সমাজতন্ত্র এই মুহূর্তে অন্তত একটি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসাবে শ্রমিকদের সামনে উপস্থিত নেই এবং পুঁজিবাদ আরও বেশি বেশি করে যেহেতু আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে তাই তাদের নিজেদের মধ্যে 'প্রতিযোগিতার' জন্য শ্রমিকদের মজুরিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিচে নামিয়ে আনাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই যদিও এটি সত্য যে, প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি আগের থেকে ভালো অবস্থায় যাচ্ছিল, কিন্তু বিগত ২৫/৩০ বছর ধরে তা আবার ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী এবং ধীরে ধীরে তাদের দেয়া সমস্ত ছাড় আবার ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এবং শ্রমিকদের দুর্দশা সারা পৃথিবী জুড়ে আবার দ্রুত বাড়ছে। মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান এবং সেই কারণেই আমরা তার পরিবর্তন এনেছি এবং এই কারণেই মার্ক্সের কিছু ধারণা এবং প্রত্যাশা যে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সত্য প্রতিপন্ন  হয় নি, সেই বিষয়কে আমরা পাত্তাই দিই না। গ্যালিলিও, নিউটন বা ডারউইনের কিছু ধারনাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু তার জন্য এই ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এতটুকুও কমে না; না এতে এটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, পদার্থবিদ্যা বা জীববিদ্যা বিজ্ঞান নয়। আসলে ঘটনাটি ঠিক এর বিপরীত।

অধিকাংশ বিকশিত বিজ্ঞানেরই একটি কেন্দ্রীয় সংগঠক ধারণা রয়েছে; উদাহরণস্বরূপ, রসায়নের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স, প্রাকৃতিক ইতিহাসের রয়েছে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব এবং ভূ-পদার্থবিদ্যার রয়েছে টেক্টোনিক প্লেট। মার্ক্সবাদের কি এরকম কোনও কেন্দ্রীয় সংগঠক ধারণা রয়েছে? এবং থাকলে তা ঠিক কি?

সাধারণভাবে (অর্থাৎ দার্শনিকভাবে), মার্ক্সবাদ - লেনিনবাদ - মাও চিন্তাধারার কেন্দ্রীয় সংগঠক তত্ত্বটি   হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। সমাজের নিরিখে নির্দিষ্ট করে বললে, মার্ক্সবাদ - লেনিনবাদ - মাও চিন্তাধারার কেন্দ্রীয় সংগঠক তত্ত্বটি হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যা কিনা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে প্রয়োগের ফল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কয়েকটি প্রধান প্রধান বিষয় হলো:

*মানব সমাজকে এবং ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে     বোঝা সম্ভব;

*যেকোনো বস্তুগত উৎপাদনই হলো সামাজিক জীবনের  ভিত এবং সামাজিক চেতনা হলো সমাজবদ্ধ জীবের     পরিণাম;

*সমাজ এবং ইতিহাসের নির্মাতা হলো মানব সমাজের   অন্তর্গত মানুষেরা;

*সমাজের বর্তমান উৎপাদক শর্ত তার পরিবর্তনের  সীমাকে নির্ধারণ করে, যা সমাজের মধ্যে সংঘটিত করা যায়;

*উৎপাদন সম্পর্কের সাথে মানুষের বিভিন্ন সম্পর্কের কারণেই সামাজিক শ্রেণীগুলি টিকে থাকে (উদাহরণস্বরূপ তারা কারখানা এবং যন্ত্রপাতির মালিকানাকে ধারণ করে কি না);

*মানব সমাজের ইতিহসাস যখন থেকে শ্রেণী বিভক্ত সমাজ হয়েছে, তা হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস;  

*বিকাশের একটি পর্যায়ে সমাজের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তি উৎপাদন সম্পর্কের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে;

[Karl Marx, Preface to a Contribution to the Critique of Political Economy, (Peking: 1976), pp. 3-4.]

*সেই সময় থেকেই সমাজ বিপ্লবের যুগ শুরু হয়; 

[Karl Marx, Preface to a Contribution to the Critique of Political Economy, (Peking: 1976), pp. 3-4.]

*মানব সমাজ নিশ্চিত এবং অবধারিতভাবেই কমিউনিজমে পৌঁছাবে, যেখানে শ্রেণীর বিলোপ ঘটবে;

*পুঁজিবাদ এবং কমিউনিজমের মধ্যে একটি অবশ্যম্ভাবী উত্তরণ পর্ব (সমাজতন্ত্র) থাকবে যেটি কেবলমাত্র হবে বুর্জোয়াদের উপর প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র।

যদি মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান হয়, তাহলে তার এত সমালোচনা কেন হবে? আমার অনুমান, আপনি বলবেন, এই দেশের শাসকেরা এটিকে তাদের নিজেদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করেন এবং হাজার হাজার 'বেশ্যা' বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক মদত দেয় একে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন যে, এত এত সমালোচকের সকলেই অর্থের বিনিময়ে এগুলি করেন?

কিনে ফেলার মতো এত সহজ নয় বিষয়টি, যদিও এরকমটিও হয়। কোনও যুগের কর্তৃত্বপূর্ণ ধারনাটি হলো শাসকের ধারণা এবং এটি শুধু এই কারণে নয় যে, তারা অন্যান্য সমস্ত ধারণাকে কড়া হাতে দমন করতে চায় বা তারা প্রচুর লোককে অর্থের বিনিময়ে এটিকে প্রচার করতে বলে। মূল কারণ হলো অধিকাংশ মানুষ, এমনকি তাদের পয়সার বিনিময়ে নিয়োগ করা প্রচারকরাও শাসকের পক্ষের মতবাদকে বা চিন্তাকে প্রচার করে এই জন্য যে, তারা তাদের শাসকের দর্শনকে ছড়িয়ে দেয়ার পরিবেশের মধ্যেই কোনও না কোনও ভাবে বেড়ে ওঠে। তারা তাদের মায়ের কোল থেকেই ধনী মানুষের আচরণের ছড়িয়ে থাকা ধারণা, বিকৃত তথ্য, অবৈজ্ঞানিক সামাজিক তত্ত্ব, সাথে আগাপাশতলা মিথ্যার মধ্যে বেড়ে ওঠে। কচি বাচ্চার টিভি-র কার্টুন থেকে সমাজবিদ্যার জার্নাল, কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়, খেলার মাঠ, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন্স - বুর্জোয়া দর্শনকে মানুষের ভিতরে পুরে দেয়া হয়। কোনও খেলা পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে যায়, যদি না তা শাসকের প্রশস্তি ব্যতিরেকে আরম্ভ হয় (The Pledge of Allegiance)। সর্বোপরি, আমরা মার্ক্সবাদীরা মনে করি যে, মানুষ তাই বিশ্বাস করার দিকে এগিয়ে যায়, যা তাদের নিজেদের স্বার্থের অনুকুল (যদি না তাকে প্রবলভাবে বিপরীত চিন্তার দ্বারা শিক্ষা দেয়া হয়)। তুমি যদি এটিকে সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, প্রফেসরদের কাছে স্পষ্ট করে দাও যে, তাদের নিজেদের ক্যারিয়ারের বিকাশ নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার ঘোষণার উপর, তাহলে আশ্চর্যজনকভাবে সেই চিন্তাধারা তাদের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হবে।

কিন্তু আপনি একথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে মার্ক্সবাদ অন্যান্য বিজ্ঞানের তুলনায় অনেক বেশি বিতর্কিত।

আমরা এটিকে একেবারেই অস্বীকার করি না; তবে এটিকে ব্যাখ্যা করা খুবই সোজা, লেনি উলফ তার অসাধারনণ বই The Science of Revolution এ বলেন, “কেউ কেউ মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিক চরিত্রকে অস্বীকার করতে উদ্যত হয়েছেন এই কারণে যে, এটিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র বিতর্ক একটি তত্ত্বকে অবৈজ্ঞানিক বলে নিদান হাঁকতে পারে না। ডারউইন এর বিবর্তনবাদের তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মহলে একটি প্রলয় এনেছিল; ঠিক যেভাবে আইনস্টাইন এর আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব এনেছিল। অবশিষ্ট সমাজ তথা বৈজ্ঞানিকেরা দু'টি যুযুধান শিবিরে ভেঙে গিয়েছিল এই তত্ত্বগুলিকে নিয়ে; দু'টি ক্ষেত্রেই আনকোরা নতুন তত্ত্বের, যে তত্ত্বগুলি গভীরভাবে সমাজে শিকড় গেড়েছিল, প্রচারকরা জয়ী হয়েছিলেন সংগ্রামের পর......(মার্ক্সবাদ) সমাজকে গভীরভাবে বিভাজিত করেছে এবং একে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে - এই কারণে এটি অবৈজ্ঞানিক হতে পারে না। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যা বুর্জোয়া সমাজের সবচেয়ে নরম তন্তুতে সরাসরি আঘাত হেনেছে - এর শোষণমূলক শ্রেণী সম্পর্ক এবং এর প্রোলেতেরিয় বিপ্লবের প্রতি ঝোঁককে প্রকাশ  করেছে - সে যে বহু বিস্তৃত বিতর্কের জন্ম দেবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।" 

[Lenny Wolff, The Science of Revolution: An Introduction (Chicago: RCP Publications, 1983), pp. 12-13]

প্রথম প্রবর্তিত হওয়ার সময় শুধুমাত্র বিবর্তন বা আপেক্ষিকতাবাদই বিতর্কিত ছিল, বিষয়টি এরকম নয়। কিন্তু কার্যত সেই সমস্ত মহান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলি, যেগুলি একটি বিস্তৃত প্রপঞ্চকে ব্যাপ্ত করেছে, সেটাই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কোপারনিকাসের তত্ত্ব, যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমণ করে (সূর্য পৃথিবীর চারদিকে পাক খায় এর বিপরীত) একটি দীর্ঘ সময় ধরে অবশ্যই বিতর্কিত ছিল। এই কারণেই জিওরদানো ব্রুনোকে চার্চের নির্দেশে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এবং গ্যালিলিও-র কপালেও প্রায় সমগোত্রীয় শাস্তি জুটেছিল। বেশ কিছু শতাব্দী ধরে কিছু অঞ্চলে এই তত্ত্বকে বেআইনি করে রাখা হয়েছিল! ভূ-পদার্থবিদ্যায় যখন আলফ্রেড ওয়েগনার মহাদেশীয় প্লেটের সঞ্চালনের উপর দারুন দারুন যুক্তি ও প্রমাণ হাজির করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, তখন থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ভূ-পদার্থবিদরা তার তত্ত্বকে বাতিল করেছিলেন, যারা এটি বিশ্বাসই করতে পারেন নি যে, মহাদেশের মতন এত বিশাল কিছু নড়েচড়ে বেড়াতে পারে। বর্তমানে টেকটোনিক প্লেটের তত্ত্ব সর্বজনীনভাবে গৃহীত। অতএব, বিতর্ক এবং বাতিল করা বিজ্ঞানের গোঁড়াপন্থীদের কাছে খুবই স্বাভাবিক এবং এটা বরাবরই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষের বিজ্ঞানের সাথে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা ধারাবাহিক বিতর্কের সাথে পরিচয় নেই। আমরা বিজ্ঞানের যা কিছু শিখি তা মূলত শিখি স্কুল পাঠ্যবই থেকে, যেখানে বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলিকে একটি মিটমাট হয়ে যাওয়া বিষয় হিসাবে পড়ানো হয় এবং শুধুমাত্র সর্বশেষ সম্মতিকে চিত্রিত করা যেটি একসময় খুবই বিতর্কিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে আর তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।

কিন্তু এটা তো নিশ্চিত যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমস্ত কমিউনিস্ট জমানার পতনের পর মার্ক্সবাদ আর বিজ্ঞান নেই; বরঞ্চ তা একটি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ, মহান কাল্পনিক পরীক্ষা মাত্র?

আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে পরে কোথাও বিস্তারিত আলোচনা করবো, কিন্তু এখন আমি এইটুকুই বলবো যে, ১৯৯১ সালে যার পতন হয়েছে তা কোনভাবেই মার্ক্সীয় ছিল না বা সমাজতান্ত্রিক  ছিল না; কমিউনিস্ট দেশের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল ১৯৫৩-১৯৫৭ সালে, খ্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে। এবং সেই সময় সমাজতন্ত্রের পতন হয় নি - সেটি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে ক্ষমতাসীন হওয়া একটি নতুন গোষ্ঠীর দ্বারা সমাজতন্ত্রের উৎপাটন। এটা সত্যি যে, পার্টির ভিতরে এই নব্য উত্থিত রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদীদের দ্বারা একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল সম্ভব ছিল না, যদি না সোভিয়েত সমাজের ভিতরে কিছু মারাত্মক দুর্বলতা থাকতো। কিন্তু এই দুর্বলতাগুলি অর্থনীতির নয় - যেরকমটা তোমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে। (অর্থনৈতিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক বন্ধা দশা, এমনকি গোপন মন্দা সবই গড়ে উঠেছিল সংশোধনবাদী যুগে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রবর্তনের সাথে সাথে)। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৫৫ সালে সোভিয়েতের শিল্প উৎপাদন ছিল ১৯১৩ সালে রাশিয়ার শিল্প উৎপাদনের পঁচিশ গুণ।

[Emile Burns, An Introduction to Marxism (NY: International Publishers, 1966), p. 78. The author was a British revisionist, and you may dismiss him as biased—though other books I've read, both by friends of the Soviet Union and by enemies, suggest that this figure is in the right ball park. Even most rabid anti-communist authorities admit that Soviet industrial production increased at a very rapid overall pace during its first three decades (what we, the followers of Mao - TseTung thoughts, count as  the socialist period)]

এবং এটি ঘটেছিল নিজের মাটিতে, দু-দু'টি বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধ সত্ত্বেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও, বিপ্লবের দরুন প্রবল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও, বিপ্লবের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও প্রবল ক্ষতিকারক গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও এবং ১৩টি পুঁজিবাদী দেশের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ) উপদ্রব সত্ত্বেও। এতো কিছু বিরূপতা সত্ত্বেও ১৯১৩ সালের ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়া দেশটি ১৯৫০ সাল নাগাদ একটি শক্তিশালী শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা যাই বলুক না কেন, সোভিয়েতের শ্রমিক শ্রেণী স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কাজ করে এবং এটি পুঁজিবাদের থেকে অনেক ভালোভাবে কাজ করে। তাহলে কোথায় ছিল সেই ভয়ঙ্কর দুর্বলতা যার পরিণতিতে ঘটলো সংশোধনবাদী ক্ষমতা দখল? এর একাধিক প্রকারের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে, কিন্তু আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যেভাবে স্তালিন এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর বকলমে শাসন করতে চেয়েছিল, শ্রমিক শ্রেণীকে সরাসরি সমাজকে শাসন করতে দেয়ার বদলে এবং তাদের যৌথ স্বার্থকে রক্ষা না করতে শিখিয়ে। এই পিতার ন্যায় আচরণ জনগণকে নিরস্ত্র করেছে এবং যখন ক্ষমতা দখল হয়েছে সংশোধনবাদীদের দ্বারা, তখন তারা প্রথমে তা বুঝতেই পারে নি। এবং যখন অবশেষে তারা তা  বুঝতে পেরেছে, তারা দখলদারদের উচ্ছেদ করেছে; তবে তা ঘটেছে ৩৫ বছর পর, যার অনেক আগেই  সমাজতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তের যেটা বক্তব্য সেটা হলো, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কোনভাবেই এটা প্রমাণ করে না যে, মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়েছে। বরঞ্চ এটা আরও ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয়তাকেই প্রমাণ করে। সমাজতন্ত্র একটি সমানতালে পরিবর্তনশীল এবং উদ্বর্তনমূলক ব্যবস্থা যা জন্মগতভাবেই ভীষণ অস্থির; হয় এটি অধঃপতিত হয়ে পুঁজিবাদে ফিরে যাবে আর নয়তো সেটি কমিউনিস্ট সমাজের দৃঢ় স্থায়িত্বের দিকে এগিয়ে যাবে।

এটি যদি বিজ্ঞান হয় তাহলে মার্ক্সবাদ বা মার্ক্সবাদ - লেনিনবাদ - মাও চিন্তাধারা গোছের এরকম অদ্ভুত নাম কেন? আর কোনও বিজ্ঞান তো কোনও ব্যক্তির নামে নেই!

এটা পুরোপুরি সত্য নয়; উদাহরণস্বরূপ বিবর্তনবাদকে অনেক সময়ই ডারউইনবাদ বলেও ডাকা হয়। কোনও বিজ্ঞানের উপর যত বেশি বিতর্ক হবে ততই ব্যক্তির নাম, তার সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে যুক্ত হবে বা সেই বিজ্ঞানের নাম সেই ব্যক্তির নাম অনুযায়ী হবে। এবং অবশ্যই এটি সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য যেখানে সামাজিক তত্ত্বের দ্বারা একটি গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব বা বিরোধিতা করা হয়। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস তাদের তত্ত্বকে বলেছেন 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র', যাতে করে এটিকে বিভিন্ন পূর্ববর্তী প্রাক - বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের (কাল্পনিক সমাজতন্ত্র) থেকে আলাদা করা যায়। যেকোনো ভাবেই হোক, আজকের দিনে এই বিজ্ঞানের একটি ভালো নাম নেই, এমনকি আমাদের অর্থাৎ মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকেও নেই। এর কারণ হলো, বিগত শতাব্দীতে সমাজতন্ত্র বলতে মার্ক্স বুঝিয়েছিলেন 'সমাজতন্ত্রের প্রথম ধাপ' যার অন্তিম লক্ষ্য হলো, (যাকে মার্ক্স 'সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয়  স্তর' বলে উল্লেখ করেছেন) যাকে আমরা এখন বলি ‘কমিউনিজম'। উপরন্তু 'সমাজতন্ত্র' নামটি শ্রমিক শ্রেণী বিরোধী যারা নিজেদের ‘সমাজতন্ত্রী’ বলতেন, তাদের আচরণের ও কর্মকাণ্ডের দ্বারা কিছুটা নিন্দিত হয়েছে। যদি পৃথিবীটা আরও একটু রযুক্তিবাদী হতো, তাহলে মার্ক্সবাদ - লেনিনবাদ - মাও চিন্তাধারার স্পষ্ট নাম হতে পারতো ‘সমাজবিজ্ঞান’ বা ‘সমাজবিদ্যা’। কিন্তু আমি আগেই যেরকমটি বলেছি, ইতিমধ্যেই শাসক শ্রেণীর পক্ষে, সমাজবিদ্যা নামক ছদ্ম বিজ্ঞানের দ্বারা এই নাম নেয়া হয়ে গেছে। যেহেতু শাসক শ্রেণী তার মিডিয়ার উপর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ভাষার উপর প্রভুত্ব করে, তাই আমাদের ‘মার্ক্সবাদ - লেনিনবাদ - মাও চিন্তাধারা’ বা আরও সংক্ষেপে শুধু ‘মার্ক্সবাদ’ এই নামেই ফিরে যেতে হয়েছে। এতে আমরা অন্তত এইটুকু নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, শাসক শ্রেণী তাদের ঘৃণিত তিন মহান বিপ্লবীর নামাঙ্কিত বিজ্ঞানকে অন্তত তাদের নিজেদের মধ্যে ঢুকিয়ে নেবে না!   

https://www.massline.org/Philosophy/ScottH/MLM_sci.htm



Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]