নৈরাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্র - স্তালিন [পর্ব-দুই]

 


“মানুষের চেতনা তার বাস্তব অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না, পক্ষান্তরে তার সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে।"

- কার্ল মার্কস

পৃথিবীতে সব জিনিসের পরিবর্তন ঘটে, পৃথিবীতে সব কিছুই গতিশীল; কিন্তু কীভাবে এই পরিবর্তনগুলো সংগঠিত হয়, এই গতিশীলতা কী রূপ পরিগ্রহ করে এটাই হলো প্রশ্ন। উদাহরণস্বরূপ আমরা জানি, এই পৃথিবী একদিন ছিল জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড, তারপর তা ক্রমে ক্রমে ঠাণ্ডা হলো; তারপর জীবজন্তুর রাজ্যের অভ্যুদয় হলো, বিকাশ ঘটলো, তারপর আবির্ভাব ঘটলো এক জাতের বানরের যা থেকে পরবর্তীকালে হলো মানুষের উদ্ভব। কিন্তু এই বিকাশ কীভাবে ঘটেছিল? কেউ কেউ বলে থাকে, প্রকৃতি ও তার বিকাশের পূর্বে ছিল বিশ্ব চৈতন্য যা পরবর্তীকালে এই বিকাশের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল। ফলে বলতে গেলে প্রকৃতির ঘটনার বিকাশ এই চৈতন্যের বিকাশের বাইরের রূপ। এই লোকগুলোকে বলা হয় ভাববাদী, যারা পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রবণতায় বিভক্ত হয়ে পড়লো এবং বিভিন্ন ধারা অনুসরণ করলো। অন্যরা বলে একেবারে গোড়া থেকেই এই জগতে পরস্পরের নেতিবাচক দু'টি শক্তি আছে- ভাব এবং বস্তু এবং অনুরূপভাবে ঘটনাসমূহও দুই শ্রেণিতে বিভক্ত - ভাবগত ও বস্তুগত, যারা প্রতিনিয়ত পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এইভাবে দেখা যায় প্রকৃতির ঘটনাসমূহের বিকাশ হলো ভাবগত ও বস্তুগত ব্যাপারের মধ্যে নিরন্তর সংগ্রাম। এই লোকগুলোকে বলা হয় দ্বৈতবাদী এবং ভাববাদীদের মতো তারাও বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। মার্কসের বস্তুবাদী তত্ত্ব, দ্বৈতবাদ ও ভাববাদ উভয়কেই চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য, ভাবগত ব্যাপার ও বস্তুগত ব্যাপার দুই-ই এই পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই না যে, তারা পরস্পরকে নিরাকরণ করে। বিপরীত পক্ষে, ভাবগত ও বস্তুগত দিক হলো একই ব্যাপারের দু'টি বিভিন্ন রূপ। তারা একত্রে বিকশিত হয়, তাদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এরকম অবস্থাতে আমাদের মনে করার কোনো যুক্তিই নেই যে, তারা পরস্পর পরস্পরকে নিরাকরণ করে। অতএব, দ্বৈতবাদ ভুল বলে প্রমাণিত হয়। এক ও অবিভাজ্য প্রকৃতি দু'টি বিভিন্ন রূপে অভিব্যক্ত - বস্তুগত ও ভাবগত, এইভাবেই প্রকৃতির বিকাশকে আমাদের গণ্য করতে হবে। এই হলো মার্কসের বস্তুবাদী তত্ত্বের অদ্বৈতবাদ। সঙ্গে সঙ্গে মার্কস ভাববাদকেও প্রত্যাখ্যান করেন। এই ভাবা ভুল হবে যে, ভাবগত দিক এবং সাধারণভাবে চেতনা তার বিকাশের প্রকৃতি তথা সাধারণভাবে বস্তুগত দিকের পূর্ববর্তী। তথাকথিত বাহ্য প্রাণহীন প্রকৃতি জীবন্ত সত্তাসমূহে অস্তিত্বের পূর্বেই বিদ্যমান ছিল। প্রথম জীবন্ত বস্তু প্রোটোপ্লাজম জীবকোষের মূল উপাদান - তার কোনো চেতনা ছিল না। তার ছিল কেবলমাত্র উত্তেজনা ও সংবেদনার অঙ্কুর। পরবর্তীকালে ক্রমে ক্রমে প্রাণিদের সংবেদন শক্তি ধীরে ধীরে চেতনায় রূপান্তরিত হলো। বানর যদি চিরকাল চার হাত পায়ে হেঁটে বেড়াত, সে যদি কোনদিনই সোজা হয়ে না দাঁড়াত, তাহলে তার বংশধর মানুষ ফুসফুস ও স্বরতন্ত্রীসমূহ অবাধে ব্যবহার করতে পারতো না এবং সেজন্য কথাও বলতে সক্ষম হতো না এবং তা বহুলাংশে তার চেতনার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতো। অর্থাৎ বানর যদি তার পেছনের পা দু'টির ওপর ভর করে না হাঁটতে পারতো তাহলে তার বংশধর মানুষ চিরকাল নিচের দিকে তাকাতে বাধ্য হতো এবং শুধু সেখান থেকেই তার সব ধারণা লাভ করতো। এখন যেমন সে তাকায় তখন সে উপরে এবং তার চারপাশে তাকাতে পারতো না এবং সেজন্য যার মস্তিষ্ক একটি বানরের মস্তিষ্কের চেয়ে বেশি ধারণা অর্জন করতে পারতো না এবং তা তার চেতনার বিকাশকে বহু পরিমাণে পিছিয়ে দিতো। এর থেকে এটাই আসে যে চেতনাগত দিকের বিকাশ, ভাবের বিকাশ দেহের কাঠামো এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশের ওপর নির্ভরশীল। এ থেকে আসে যে চেতনাগত দিকের বিকাশ ভাবের বিকাশের পূর্ববর্তী হলো বস্তুগত দিকের বিকাশ, সামাজিক অস্তিত্বের বিকাশ। স্পষ্টত প্রথমে বাইরের অবস্থা বদলায়, প্রথমে বস্তুর পরিবর্তন হয় - ভাবগত দিকের বিকাশ বস্তুগত দিকের বিকাশের পেছনে পড়ে থাকে। বস্তুগত দিককে, বাইরের পরিবেশকে, সামাজিক অস্তিত্ব ইত্যাদিকে যদি আমরা বলি বিষয়বস্তু তাহলে ভাবগত দিক চেতনা এবং এই রকমের ব্যাপারকে আমাদের বলতে হবে রূপ। এ থেকেই উদ্ভুত হয়েছিল সুবিদিত বস্তুবাদী তত্ত্ব; ক্রমবিকাশের গতিধারায় বিষয়বস্তু রূপের পূর্ববর্তী থাকে, রূপ বিষয়বস্তুর পেছনে পড়ে থাকে। সামাজিক জীবন সম্পর্কে একটি কথা বলতে হবে, সেখানেও বস্তুগত পরিবর্তন পূর্ববর্তী, এখানেও রূপ বিষয়বস্তুর পিছনে পড়ে থাকে। এমনকি যখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করাও হয়নি, তার আগে থেকেই ধনতন্ত্র বিদ্যমান ছিল এবং একটি ভীষণ শ্রেণি সংগ্রাম প্রচণ্ডভাবে চলছিল। সমাজতান্ত্রিক ধারণার উদ্ভবের অনেক আগেই উৎপাদনের প্রক্রিয়া একটি সামাজিক চরিত্র ধারণ করেছিল। এখানেই মার্কস বলেন-

"আমাদের চেতনা তার বাস্তব অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না; পক্ষান্তরে তার সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে।"

[এ কন্ট্রিবিউসন টু দি ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনোমি - কার্ল মার্কস]

মার্কসের মতে অর্থনৈতিক বিকাশ হলো সামাজিক বিকাশের বস্তুগত ভিত্তি; তার বিষয়বস্তু, তার আইনগত, রাজনৈতিক ও ধর্মগত দার্শনিক বিকাশ হলো এই বিষয়বস্তুর ভাবাদর্শগত রূপ, তার উপরিকাঠামো। সেজন্য মার্কস বলেন-

"অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সমগ্র বিরাট উপরিকাঠামো কম বেশি দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হয়।"

[এ কন্ট্রিবিউসন টু দি ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনোমি - কার্ল মার্কস]

সামাজিক জীবনেও প্রথমে উপরের বস্তুগত অবস্থা পরিবর্তিত হয় এবং তারপর মানুষের চিন্তা তাদের বিশ্ববিক্ষা বদলায়। বিষয়বস্তুর বিকাশ রূপের উদ্ভব ও বিকাশের পূর্ববর্তী। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, মার্কসের মতে রূপ ছাড়াই বিষয়বস্তু সম্ভব - যেমন এস এইস জি. মনে করেন। রূপ ছাড়া বিষয়বস্তু অসম্ভব; কিন্তু বিষয়টি হলো এই যে, যেহেতু একটি নির্দিষ্ট রূপ তার বিষয়বস্তুর পিছনে পড়ে থাকে, সেহেতু রূপটি কখনও এই বিষয়বস্তুর পুরোপুরি অনুরূপ হয় না এবং নতুন বিষয়বস্তুটি প্রায়শই কিছুকালের জন্য পুরনো রূপে আবৃত থাকতে বাধ্য হয় এবং তার ফলে তাদের মধ্যে নতুন বিষয়বস্তু ও পুরাতন রূপের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান সময়ে উৎপন্ন বস্তুর আত্মসাতের ব্যক্তিগত চরিত্র উৎপাদনের সামাজিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং আজকের দিনের সামাজিক সংঘর্ষের এই হলো ভিত্তি। অন্যপক্ষে ভাব বাস্তব সত্তার একটি রূপ - এই প্রকৃতিগতভাবে ধারণার অর্থ এই নয় যে, তার চেতনা ও বিষয়বস্তু একই জিনিস। এই মত পোষণ করতেন কেবলমাত্র স্থূল বস্তুবাদীরা। তাদের তত্ত্বসমূহ মার্কসের বস্তুবাদকে মূলগতভাবে অস্বীকার করে এবং এঙ্গেলস তার লুডউইগ ফয়েরবাখে এদের সঠিকভাবে বিদ্রুপ করেছিলেন। মার্কসের বস্তুবাদী চেতনা ও বাস্তব সত্তা মন এবং বস্তু, একই ব্যাপারের দু'টি বিভিন্ন রূপ, যাকে মোটামুটিভাবে বলা হয় প্রকৃতি। সুতরাং তারা পরস্পর পরস্পরকে নিরাকরণ করে না, কিন্তু তারা আবার এক ব্যাপারও নয়। একমাত্র বিষয় হলো এই যে, প্রকৃতি ও সমাজের বিকাশে চেতনা অর্থাৎ যা আমাদের মাথার মধ্যে ঘটে একটি তদনুরূপ বস্তুগত পরিবর্তন, অর্থাৎ যা আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা নিরপেক্ষ। কোনো নির্দিষ্ট বস্তুগত পরিবর্তনকে শীঘ্র কিংবা দেরিতে একটি অনুরূপ ভাবগত পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই অনুসরণ করে। এই জন্যই আমরা বলি একটি ভাবগত পরিবর্তন হলো তদনুরূপ একটি বস্তুগত পরিবর্তনের রূপ। সাধারণভাবে এই হলো মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অদ্বৈতবাদ। কেউ কেউ আমাদের বলবেন: প্রকৃতি ও সমাজের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এ সমস্ত প্রযুক্ত হলে সেসব সত্য হতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নির্দিষ্ট বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা এবং ভাব কীভাবে আমাদের মাথার মধ্যে জাগে? তথাকথিত বাইরের অবস্থাগুলো কী সত্য সত্যই বিদ্যমান, না এইসব বাইরের অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের ধারণাগুলোই শুধু বিদ্যমান এবং যদি বাইরের অবস্থার অস্তিত্ব থাকেই, তাহলে কোন মাত্রা পর্যন্ত তারা প্রত্যক্ষ এবং পরিজ্ঞেয়? এই বিষয়টি সম্পর্কে আমরা বলি: বাইরে অবস্থা যতখানি বিদ্যমান থেকে আমাদের অহং এর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, আমাদের ধারণা আমাদের অহংও ঠিক ততখানি বিদ্যমান। যে কেউই না ভেবে, না চিন্তে বলে যে, আমাদের ধারণা ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই, তাকেই সমস্ত বাইরের অবস্থা অস্বীকার করতে বাধ্য হতে হয় এবং সেই কারণেই তার নিজের অহং ছাড়া অন্য সমস্ত লোকের অস্তিত্ব তাকে অস্বীকার করতেই হয়। এটা বিজ্ঞান এবং জীবন্ত বাস্তবের প্রধান প্রধান নীতিসমূহের মূলগতভাবে বিরোধী। হ্যাঁ, বাইরের অবস্থা সত্যই বিদ্যমান; এই অবস্থাগুলো আমাদের আগেও ছিল, আমাদের পরেও থাকবে এবং যত ঘন ঘন এবং যত প্রবলভাবে আমাদের চেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তত সহজে তারা প্রত্যক্ষ ও পরিজ্ঞেয় হয়। বর্তমান সময়ে নির্দিষ্ট বস্তু সম্পর্কে কীভাবে বিভিন্ন ধারণা ও ভাব আমাদের মাথার মধ্যে জাগে, সে বিষয় সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে যে, প্রকৃতি ও সমাজের ইতিহাসে যা ঘটছে এখানে আমরা তারই সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি পাই। এ ব্যাপারেও আমাদের বাইরের বস্তু আমাদের ধারণার পূর্ববর্তী; এ ব্যাপারেও আমাদের ধারণা অর্থাৎ রূপ বস্তুর পেছনে অর্থাৎ বিষয়বস্তুর পিছনে পড়ে থাকে। যখন আমি একটা গাছের দিকে তাকিয়ে গাছটিকে দেখতে পাই - তা কেবল দেখিয়ে দেয় যে, আমার মাথার মধ্যে একটি গাছের ধারণা জন্মাবার পূর্বেই গাছটির অস্তিত্ব ছিল; দেখিয়ে দেয় যে, এই গাছটিই আমার মাথার মধ্যে অনুরূপ ধারণা জাগিয়ে তুলেছিল। মানব জাতির ব্যবহারিক কার্যকলাপে মার্কস ও এঙ্গেলসের অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদের গুরুত্ব সহজেই বোঝা যায়। যদি আমাদের বিশ্ববীক্ষা আমাদের অভ্যাস, আমাদের রীতি-নীতি বাইরের অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়; যদি আইনগত, রাজনীতিগত রূপের অনুপযোগিতা একটি অর্থনৈতিক বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট যে অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহে একটি মূলগত পরিবর্তন ঘটাতে আমরা অবশ্যই সাহায্য করবো যাতে এই পরিবর্তনের সাথে, জনসাধারণের অভ্যাসে, রীতিনীতিতে এবং তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি মূলগত পরিবর্তন ঘটানো যায়। এই বিষয়ে কার্ল মার্কস বলেছিলেন-

“বস্তুবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের আন্ত:সংযোগ প্রত্যক্ষ করার জন্য খুব বিরাট একটা বিচারশক্তির দরকার হয় না। যদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকে মানুষ তার সমস্ত জ্ঞান, প্রত্যক্ষ ইত্যাদি গঠন করে তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় যে, অভিজ্ঞতা গোচর এই পৃথিবীকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে সে এর ভিতর সত্যিকারের যা মানবিক তার অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে, যাতে সে একজন মানুষ হিসাবে অভিজ্ঞতা অর্জনে অভ্যস্ত হয়। বস্তুবাদী অর্থে মানুষ যদি স্বাধীন না হয় - অর্থাৎ এটা বা ওটা এড়িয়ে চলতে সমর্থ হওয়ার নেতিবাচক শক্তির কারণে স্বাধীন নয়, সে স্বাধীন হয় তার প্রকৃত ব্যক্তিসত্তাকে স্বপ্রতিষ্ঠা করার ইতিবাচক ক্ষমতার কারণে, তাহলে অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তি মানুষকে শান্তি দেয়া উচিত নয়, বরং উচিত অপরাধের সমাজ বিরোধী প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে ধ্বংস করা। মানুষ যদি অবস্থার দ্বারা গঠিত হয়, তাহলে অবস্থাকেও অবশ্যই মানবিকভাবে গঠন করতে হবে।"

[লুডউইগ ফয়েরবাখ, অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি বস্তুবাদের ইতিহাস সম্পর্কে কার্ল মার্কস]

বস্তুবাদ ও মানুষের ব্যবহারিক কার্যকলাপের ভিতর এই হলো সম্পর্ক। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির উদ্ভব হেগেল থেকে আর তার বস্তুবাদী তত্ত্ব হলো ফয়েরবাখের তত্ত্বের আরও বিকাশ। নৈরাজ্যবাদীরা এটা ভালভাবেই জানে এবং তারা মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে অপদস্থ করার জন্য হেগেল ও ফয়েরবাখের ত্রুটির সুবিধা গ্রহণ করার চেষ্টা করে। আমরা হেগেল সম্পর্কে আলোচনায় এর আগেই দেখিয়েছি যে, নৈরাজ্যবাদীদের এই সমস্ত চাতুরি তাদের নিজেদের তার্কিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই প্রমাণ করে না। ফয়েরবাখ সম্পর্কেও ঐ একই কথা বলতে হয়। উদাহরণস্বরূপ তারা জোরের সঙ্গে বলে, ‘ফয়েরবাখ ছিলেন একজন সর্বেশ্বরবাদী’, বলে যে তিনি মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ করেছিলেন, যে ফয়েরবাখের মতে, মানুষ যা খায় সে তাই…. তারা অভিযোগ করেছে, এ থেকে মার্কস নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন: সুতরাং প্রধান ও প্রাথমিক জিনিস হলো অর্থনৈতিক অবস্থাসমূহ ইত্যাদি। সত্য বটে ফয়েরবাখের সর্বেশ্বরবাদ, মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ এবং তার একই রকমের অন্যান্য ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে কারও কোনো সন্দেহ নেই।পক্ষান্তরে মার্কস ও এঙ্গেলসই সর্বপ্রথম ফয়েরবাখের ভুলভ্রান্তি উদঘাটিত করেছিলেন। তা সত্ত্বেও নৈরাজ্যবাদীরা আগেই উন্মোচিত ফয়েরবাখের ভুলভ্রান্তিকে পুনরায় উদঘাটিত করা প্রয়োজন মনে করে। কেন? খুব সম্ভবত এই জন্য যে, ফয়েরবাখকে গালাগালি করে তারা বস্তুবাদকে অপদস্থ করতে চায়, কারণ মার্কস ফয়েরবাখের কাছ থেকেই বস্তুবাদের তত্ত্বটি ধার করেছিলেন এবং তারপর তাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিকশিত করেছিলেন। ফয়েরবাখের কী একই সঙ্গে কিছু ঠিক কিছু ভুল ধারণা থাকতে পারে না? আমরা বলছি যে এই ধরনের চাতুরির দ্বারা নৈরাজ্যবাদীরা অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদকে এতটুকুও টলাতে পারবে না, তারা যা করতে পারবে তা হলো নিজেদের ব্যর্থতা প্রমাণ করা। মার্কসের বস্তুবাদ সম্পর্কে নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যেই মতের মিল নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমাদের যদি মি: চেরকেজিশভিলির বক্তব্য শুনতে হয় তাহলে মনে হবে মার্কস ও এঙ্গেলস অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদকে ঘৃণা করতেন; তার মতে, তাদের বস্তুবাদ হলো স্থূল এবং তা অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ নয়: প্রকৃতিবিদদের মহান বিজ্ঞান তার বিবর্তনের প্রণালী, রূপান্তরবাদ এবং অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ - যা এঙ্গেলস এত আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতেন …. সে সব দ্বন্দ্ববাদকে পরিহার করেছে ইত্যাদি। সুতরাং এ থেকে এটাই আসে যে, চেরকেজিশভিলি কর্তৃক অনুমোদিত এবং এঙ্গেলস কর্তৃক ঘৃণিত প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ ছিল অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ। কিন্তু আর একজন নৈরাজ্যবাদী আমাদের বলছে যে, মার্কস ও এঙ্গেলসের বস্তুবাদ হলো অদ্বৈতবাদী এবং সেজন্যই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। মার্কসের ইতিহাসের ধারণা হেগেলের ধারণাতেই প্রত্যাবর্তন। সাধারণভাবে পরম বিষয়মুখীতার অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ এবং বিশেষভাবে মার্কসের অর্থনৈতিক অদ্বৈতবাদ প্রকৃতিগতভাবে অসম্ভব এবং তত্ত্বগতভাবে অযৌক্তিক। অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ হলো অক্ষমভাবে প্রচ্ছন্ন দ্বৈতবাদ এবং অধিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটি আপস। সুতরাং এ থেকে আসে যে অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ গ্রহণীয় নয়, কারণ মার্কস ও এঙ্গেলস একে ঘৃণা তো করতেনই না, বরং তারা নিজেরাই ছিলেন অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদী। যদি মনে করেন একে নৈরাজ্যবাদ বলতে পারেন! তারা এখনও মার্কসের বস্তুবাদের সারমর্মই উপলব্ধি করতে পারেনি, তারা এখনও বোঝেনি যে, মার্কসের বস্তুবাদ অদ্বৈতবাদী কী না, এর গুণাগুণ সম্পর্কে তারা নিজেদের মধ্যেই একমত হতে পারেনি, কিন্তু তারা এর মাঝেই এই উদ্ধৃত দাবিতে আমাদের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে যে, আমরা সমালোচনা করে মার্কসের বস্তুবাদকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি! এ থেকেই বোঝা যায় যে, তাদের সমালোচনার কী ভিত্তি থাকতে পারে। আরও দেখা যাক। মনে হয় যে কিছু নৈরাজ্যবাদী এই সত্য সম্পর্কেও অজ্ঞ যে বিজ্ঞানশাস্ত্রে বিভিন্ন ধরনের বস্তুবাদ আছে, যারা পরস্পর থেকে বহু পরিমাণে পৃথক: উদাহরণস্বরূপ আছে স্থূল বস্তুবাদ (প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে এবং ইতিহাসে), যা ভাববাদী দিকের গুরুত্বকে এবং বস্তুবাদী দিকের ওপর এর ফলাফলকে অস্বীকার করে। কিন্তু আবার তথাকথিত অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদও আছে যা বস্তুবাদী ও ভাববাদী দিকের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ককে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার করে। কিন্তু নৈরাজ্যবাদীরা এসবের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং সেইসঙ্গে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জাহির করে: তোমরা পছন্দ করো আর নাই করো, আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বস্তুবাদকে সমালোচনা করে উৎসন্ন করে দিচ্ছি। শুনুন তাহলে: এঙ্গেলস ও কাউৎস্কির মতে, মার্কস অন্যান্য জিনিস ছাড়াও বস্তুবাদী ধারণা আবিষ্কার করে মানবজাতির বিরাট কল্যাণ করেছেন। এটা কি সত্য? আমরা তা মনে করি কী না, কেননা আমরা জানি যে সমস্ত ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক এই মতের অনুগামী যে, সমাজব্যবস্থা ভৌগলিক, আবহাওয়াগত, জাগতিক, মহাজাগতিক, নৃতাত্ত্বিক এবং জীবতাত্ত্বিক অবস্থাবলী দ্বারা গতিশীল- তারা সকলেই বস্তুবাদী (২নং নোভাতি, এস এইস জি.)। এইসব লোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলা চলে! তাহলে এ থেকে আসে যে, এরিস্টোটল ও মন্তেস্কুর বস্তুবাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, পার্থক্য নেই মার্কস ও সেন্ট মাইমনের বস্তুবাদের মধ্যে। প্রতিপক্ষকে বুঝে তাকে সমালোচনা করে ভূমিস্যাৎ করে দেয়ার চমৎকার দৃষ্টান্তও বটে! কোনো কোনো নৈরাজ্যবাদী কোথাও হয়তো শুনেছেন যে মার্কসের বস্তুবাদ হলো একটি পৈটিকতত্ত্ব এবং তক্ষুণি তারা এই ধারণাকে ব্যাপকভাবে জন সাধারণ্যে প্রচার করতে লেগে গেলেন - সম্ভবত নোবাতি অফিসে কাগজের দাম শস্তা এবং কাজে খরচও বিশেষ পড়ে না। শুনুন তাহলে, ফয়েরবাখের মতে মানুষ যা খায়, সে তাই। এই সূত্র মার্কস ও এঙ্গেলসের ওপর ঐন্দ্রজালিক প্রভাব বিস্তার করলো এবং নৈরাজ্যবাদীদের মতে, এ থেকে মার্কস এই সিদ্ধান্ত টানলেন যে, সুতরাং প্রধান ও প্রাথমিক জিনিস হলো অর্থনৈতিক অবস্থা উৎপাদন সম্পর্ক। এবং তারপর নৈরাজ্যবাদীরা এগিয়ে এলেন দার্শনিক ভঙ্গিতে আমাদের শিক্ষা দিতে: এটা বলা ভুল হবে যে সমাজ জীবনে এই উদ্দেশ্য সাধনের একমাত্র উপায় হলো খাওয়া এবং অর্থনৈতিক উৎপাদন। অদ্বৈতবাদী মতানুযায়ী যদি ভাবাদর্শ প্রধানত নির্ধারিত হতো খাওয়া এবং অর্থনৈতিক অস্তিত্বের দ্বারা তাহলে কিছু পেটুক ব্যক্তিই প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি হতো। তাহলে দেখছেন মার্কসের বস্তুবাদকে সমালোচনা করা কত সহজ। রাস্তায় কোনো স্কুল বালিকার কাছ থেকে মার্কস ও এঙ্গেলস সম্পর্কে চুটকি কথা শোনাই যথেষ্ট, যথেষ্ট রাস্তার সেই চুটকি কথাকে দার্শনিক আত্মবিশ্বাসে মুড়ে নোভাতির মতো সংবাদপত্রের পাতায় পুনরাবৃত্তি করা এবং মার্কসের সমালোচক হিসাবে হঠাৎ খ্যাতি অর্জন করা। কিন্তু ভদ্রলোকেরা একটা কথা বলুন: কোথায় কখন কোন দেশে মার্কসকে বলতে শুনেছেন যে খাওয়া ভাবাদর্শকে নির্ধারিত করে? আপনাদের অভিযোগের সমর্থনে মার্কসের রচনাবলী থেকে একটি মাত্র উদ্ধৃত করলেন না কেন? অর্থনৈতিক অবস্থা এবং খাওয়া কি একই জিনিস? এই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণার মধ্যে তালগোল পাকানোর জন্য বড় জোর একটি স্কুল বালিকাকে ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু এটা কেমন যে আপনারা, সোস্যাল ডেমোক্রাসির পরাভবকারীরা, বিজ্ঞানের নব জন্মদাতারা এত অসতর্কভাবে স্কুল বালিকার ভুলকে পুনরাবৃত্তি করছেন? বাস্তবিক পক্ষে খাওয়া কীভাবে সামাজিক ভাবাদর্শকে নির্ধারিত করতে পারে? আপনারা নিজেরাই যা বলেছেন তা ভেবে দেখুন: খাওয়া, খাওয়ার ধরণ বদলায় না; এখন যেভাবে করা হয় পুরাকালে ঠিক সেইভাবে মানুষ খেতো, চিবোতো এবং খাদ্য হজম করতো। কিন্তু ভাবাদর্শের রূপ সবসময় বদলায়, বিকশিত হয়। প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক, বুর্জোয়া এবং শ্রমিক শ্রেণির এইগুলি হলো ভাবাদর্শের রূপ। এটা কি কল্পনীয় যে যা সাধারণভাবে বলতে গেলে বদলায় না, তা যা প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে তাকে নির্ধারণ করতে পারে? সত্য, মার্কস বলেছেন যে অর্থনৈতিক অস্তিত্ব ভাবাদর্শকে নির্ধারণ করে এবং তা উপলব্ধি করা সহজ, কিন্তু খাওয়া এবং অর্থনৈতিক অস্তিত্ব কী একই জিনিস? আপনারা আপনাদের ব্যর্থতা মার্কসের স্বন্ধে আরোপ করাটা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলেন কেন? আরও দেখা যাক আমাদের নৈরাজ্যবাদীদের মতে, মার্কসের বস্তুবাদ হলো সমান্তরালবাদ। অথবা পুনরায়: অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদ হলো অক্ষমভাবে প্রচ্ছন্ন দ্বৈতবাদ এবং অধিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটা আপোস। মার্কস দ্বৈতবাদের মধ্যে পড়ে যায়, কেননা তিনি উৎপাদন সম্পর্ককে বস্তুগত হিসাবে এবং মানুষের প্রচেষ্টা এবং সঙ্কল্পকে একটি মায়া তথা কল্পনা হিসাবে চিত্রিত করেছেন, তা যদি থেকেও থাকে তবুও তার কোনো গুরুত্ব নেই। প্রথমত, নির্বোধ সমান্তরালবাদের সঙ্গে মার্কসের অদ্বৈতবাদী বস্তুবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বস্তুগত দিক বিষয়বস্তু অবশ্যই ভাবগত দিক তথা তার রূপের পূর্ববর্তী। কিন্তু সমান্তরালবাদ এই মতকে অস্বীকার করে এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে, বস্তুগত ও ভাবগত কোনোটিই কারো আগে আসে না; তারা যুগপৎ পাশাপাশি বিকশিত হয়। দ্বিতীয়ত, মার্কসের অদ্বৈতবাদ এবং দ্বৈতবাদের মধ্যে কী মিল থাকতে পারে যখন আমরা পুরোপুরি ভালোভাবেই জানি (এবং অন্যান্য নৈরাজ্যবাদী মশাইরা একথা জানবেন যদি অবশ্য আপনারা মার্কসীয় সাহিত্য পড়েন) যে অদ্বৈতবাদ একটি মূলনীতি অর্থাৎ প্রকৃতি, যার একটি বস্তুগত ও একটি ভাবগত রূপ আছে, তা থেকে উদ্ধৃত তদ্বিপরীতে দ্বৈতবাদ দু'টি মূলনীতি- বস্তুগত ও ভাবগত থেকে উদ্ভুত যারা দ্বৈতবাদ অনুযায়ী পরস্পর পরস্পরকে নিরাকরণ করে।তৃতীয়ত, কে বলেছেন যে মানুষের প্রচেষ্টা ও সংকল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়? আপনার জায়গাটা দেখিয়ে দেন না কেন, যেখানে মার্কস একথা বলেছেন? মার্কস কী তার এইটিনথ ব্রুমেয়ার অব লুই বোনাপার্ট, তার ক্লাস স্ট্রাগলস ইন ফ্রান্স আর সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স এবং অন্যান্য পুস্তিকায় প্রচেষ্টা ও সংকল্পের গুরুত্বের কথা বলছেন না? তবে কেন মার্কস সর্বহারা শ্রেণির সংকল্প ও প্রচেষ্টাকে সমাজতান্ত্রিক ধারায় বিকশিত করতে চেয়েছিলেন; যদি তিনি প্রচেষ্টা ও সঙ্কল্পের ওপর গুরুত্ব দিয়ে না থাকেন, তাহলে কেন তিনি তাদের মধ্যে প্রচার আন্দোলন চালিয়েছিলেন অথবা এঙ্গেলস তার ১৮৯১-৯৪ এর সুবিদিত প্রবন্ধগুলোতে কী সম্পর্কে বলেছিলেন যদি প্রচেষ্টা ও সংকল্পের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে থাকেন? সত্য বটে মানুষের প্রচেষ্টা ও সংকল্প অর্থনৈতিক অবস্থাবলী থেকে তাদের বিষয়বস্তু অর্জন করে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিকাশের ওপর তারা কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। সত্য সত্যই কী নৈরাজ্যবাদীদের পক্ষে এমন একটি সরল ধারণা বুঝতে পারা এতই কঠিন? এটা সঠিকই বলা হয় যে, সমালোচনার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা এক জিনিস আর কার্যক্ষেত্রে সমালোচনা করা অন্য জিনিস

নৈরাজ্যবাদী মশাইরা আর একটি অভিযোগ উত্থাপন করেন: ‘বিষয়বস্তু ছাড়া রূপ অকল্পনীয়…’, সুতরাং বলা যায় না যে, রূপ বিষয়বস্তুর পেছনে পড়ে থাকে… তারা সহঅবস্থান করে, তা না হলে অদ্বৈতবাদ হয়ে পড়ত একটি অসম্ভব ব্যাপার’ (১নং নোভাতি, এস-এইস জি.)। নৈরাজ্যবাদী মশাইরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। রূপ ছাড়া বিষয়বস্তু অকল্পনীয় সত্য, কিন্তু বিদ্যমান রূপ বিদ্যমান বিষয়বস্তুর সঙ্গে কখনও হুবহু একরূপ হয় না। নতুন বিষয়বস্তু কিছুদূর পর্যন্ত সব সময়ে পুরানো রূপে আবৃত থাকে। এর ফলে সব সময়ে পুরাতন রূপ এবং নতুন বিষয়বস্তুর মধ্যে একটা সংঘর্ষ বাধে। ঠিক এই কারণেই বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এটাও একটি যা মার্কসের বস্তুবাদের মূলনীতিকে প্রকাশ করে। কিন্তু নৈরাজ্যবাদীরা এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং রূপ ছাড়া বিষয়বস্তু নেই, এ কথাটা জেদের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করছে। এই হলো বস্তুবাদ সম্পর্কে নৈরাজ্যবাদীদের মত। আমরা আর কিছু বলবো না। এটা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে যে নৈরাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের মার্কসকে উদ্ভাবন করেছে, নিজেদের উদ্ভাবিত একটি বস্তুবাদী তত্ত্ব তার মুখে আরোপ করেছে এবং তারপর সেই বস্তুবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু তাদের একটি বুলেটও সত্যিকার মার্কস ও সত্যিকার বস্তুবাদকে আঘাত করতে পারবে না।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]