শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের প্রশ্নে রোজা লুক্সেমবার্গের ভ্রান্তি
লেনিন রোজা লুক্সেমবার্গকে ‘বিপ্লবী সর্বহারা ও অবিকৃত মার্কসবাদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি’ বলে বর্ণনা করেন। রোজাও রুশ বিপ্লবের প্রধান পুরোধা হিসাবে লেনিনকেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু লেনিনের সঙ্গে বহু বিষয় নিয়ে তার তীব্র মতপার্থক্য ছিল। অক্টোবর বিপ্লবকে লুক্সেমবার্গ মানুষের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করেন। রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরই রোজেনবমকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি ঐ বিপ্লবকে তার জীবনের মৃতসঞ্জীবনী সুধা বলে অভিহিত করেছেন। কাউটস্কি মনে করতেন, রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে এতো পিছিয়ে পড়া এবং এতো বেশি কৃষিপ্রধান যে সেখানে সমাজ বিপ্লব ও সর্বহারা একনায়কত্ব সম্ভব নয়। সেখানে একমাত্র বুর্জোয়া বিপ্লবই সম্ভব। একইভাবে মেনশেভিক আক্সেলরড এবং ড্যান মনে করতেন, জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার পরই শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির থেমে যাওয়া উচিত।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Pavel_Axelrod
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fyodor_Dan
এসব সুবিধাবাদী তত্ত্বকে পরাস্ত করে রুশ বিপ্লব যেভাবে বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের ও শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের নিশান তুলে ধরলো তাতে তিনি আপ্লুত হয়েছিলেন। যে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে পৃথিবীর প্রথম সর্বহারার একনায়কত্ব নিয়ে পরীক্ষা শুরু হলো তাতে যে এর গতিপথ মসৃণ হওয়ার কথা নয় তা তিনি উল্লেখ করেন। একটি মাত্র দেশে সমাজতন্ত্র যে ‘দ্বন্দ্ব ও ভ্রান্তির জালে’ জড়িয়ে পড়বে তা-ও তিনি জানিয়েছেন।
১৯১৮ সালে লিখিত রোজা লুক্সেমবুর্গের নিবন্ধ ‘রুশীয় বিপ্লব’ এ শুরু হয় এক বছরের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তার নানা পর্যবেক্ষণ এবং সমালোচনা। বলশেভিকদের ভূমিনীতি যাতে কৃষকদের দ্বারা সরাসরি জমি দখল ও মালিকানা ন্যস্ত হওয়া ছিল মূল কর্মসূচি, তাকে তিনি সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী পদক্ষেপ মনে করে তার তীব্র সমালোচনা করেন। বলশেভিকদের ভূমি নীতির মতো তাদের অনুসৃত জাতিসত্তা সংক্রান্ত নীতি বিশেষত ‘জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ দানকে তিনি সমাজতন্ত্রের বিরোধী আদর্শ বলে সমালোচনা করেন-
‘‘শ্রেণী সমাজে জাতিসত্তার অন্তর্গত প্রতিটি শ্রেণী স্ব স্ব পদ্ধতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে জাতীয় স্বাধীনতার অবস্থান সম্পূর্ণভাবে তার শ্রেণী শাসনের অধীন।’’
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে বলশেভিকদের দ্বারা রাশিয়ার গণপরিষদকে লুপ্ত করে দেয়ার সমালোচনা করেন রোজা। তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননি, যে সংবিধান সভার জন্য অক্টোবর পর্যন্ত লেনিন ও তার কমরেডরা আকূল হয়ে উঠেছিলেন, ক্ষমতা দখলের পরই তা ভেঙে দিতে হবে কেন? সংবিধান সভা বাতিলের পক্ষে ট্রটস্কির যুক্তি তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ট্রটস্কি বলেছিলেন ঐসময় যে তীব্রতায় রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং পার্টিগুলোর নতুন নতুন বিন্যাস গড়ে উঠেছিল, সংবিধান সভা তার তুলনায় একেবারেই পিছিয়ে পড়ছিল। রোজার বক্তব্য হলো, সেক্ষেত্রে খুবই যুক্তিগ্রাহ্য হতো পুরানো সংবিধান সভা ভেঙে দিয়ে নতুন সংবিধান সভা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এরপর তিনি এই ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক সভার কার্যকারিতা বর্ণনা করেন-
‘‘জনগণের মেজাজের এক জীবন্ত স্রোত এই প্রতিনিধিমূলক সংস্থার চারপাশে প্রবাহিত হতে থাকে, তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়, তাকে পরিচালিত করে।’’
১৬৪২ সালে গঠিত ইংল্যান্ডের ‘লং পার্লামেন্ট’ সাত বছরের নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কীভাবে বিপ্লবের চরম পর্যায়ে পৌঁছালো, যাতে ‘হাউস অব লর্ডস’ এর পতন ঘটলো, চার্লস এর প্রাণদণ্ড হলো এবং রিপাবলিক ঘোষণা হলো তিনি তার বর্ণনা দেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Long_Parliament
ফ্রান্সের লুই ফিলিপ এর পার্লামেন্ট কেবল নয়, রাশিয়ার ১৯০৯ সালের চতুর্থ দুমা কীভাবে বিপ্লবের দুয়ার খুলে দিতে সহায়ক হয়েছিল তা তিনি দেখিয়েছেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Louis_Philippe_I
https://en.m.wikipedia.org/wiki/State_Duma_(Russian_Empire)#:~:text=The%20Fourth%20Duma%20of%2015,1913%20to%2014%20June%201914.
এভাবে তিনি দেখাতে চেয়েছেন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশোধনকারী ভূমিকাকে। তিনি আক্ষেপের সুরে বিষয়টি শেষ করেছেন এই বলে যে, যেকোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের থাকে নানা ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা, কিন্তু রুশ বলশেভিকরা তার সমাধান খুঁজেছেন ‘গণতন্ত্রে’র বিলুপ্তির মধ্যে।
যে বলশেভিকরা সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জন প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করেন, তারাই আবার সোভিয়েতগুলোতে কেন সার্বজনীন ভোটাধিকারের কথা বলেন তা রোজার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছে। সোভিয়েত সরকার যে ভোটাধিকারের কথা বলেছে তা পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পর্যায়ের জন্য, তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের পর্বের জন্য। অথচ লেনিন একনায়কত্বের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে ভোটাধিকার শুধু তাদেরই প্রাপ্য যারা নিজের শ্রমের উপার্জনে বেঁচে থাকে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় যে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল তাতে শ্রমজীবী মানুষের বৃহৎ অংশ ঐ টালমাটাল সময়ে উপার্জনশীল হয়ে উঠতে পারেনি। এরকম পরিস্থিতিতে রোজার মনে হয়েছে, সার্বজনীন ভোটাধিকারের কথা বলা উদ্ভট কল্পনার ফসল; তাই এটি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের হাতিয়ার হতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পুরোপুরি কার্যকরী হয়ে গেলে যে ব্যবস্থা উপযোগী তা অনেক আগে টেনে আনা অর্থহীন। এ প্রসঙ্গে তিনি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের পর্যায়ে সমস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী, যারাই শ্রমিক শ্রেণীর সরকারের বিরোধিতা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে নেয়া কঠিন ব্যবস্থাগুলোর (রাজনৈতিক অধিকার হরণ, অর্থনৈতিক বঞ্চনা ইত্যাদি) সমালোচনা করেন। জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে সার্বজনীন ভোটাধিকারের যে আইন তা কিছুতেই ‘একনায়কত্বের’ পক্ষে প্রয়োজনীয় বিষয় হতে পারে না। এটি বড়জোর এমন একটি কৌশল হতে পারে, যাকে জীবনে প্রয়োগ করা যায় না। সোভিয়েত ব্যবস্থায় সার্বজনীন ভোটাধিকার একমাত্র সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের স্তরে হতে পারে। সেখানে পৌঁছাতে গেলে একনায়কত্বের যে স্তর অতিক্রম করতে হয় সে পর্যায়ে বরং প্রয়োজন সংবিধান সভা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শ্রমজীবী মানুষের অবাধ রাজনৈতিক কার্যকলাপ, জমায়েত হওয়ার স্বাধীনতা। সোভিয়েত ব্যবস্থা এসব হরণ করে।
এরপর রোজা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে একনায়কত্বের সমস্যাটি ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, বুর্জোয়া শ্রেণী শাসনের জন্য ব্যাপক জনতার রাজনৈতিক শিক্ষা ও ট্রেনিংয়ের দরকার হয় না। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের সেটিই হলো প্রাণ। কিন্তু জনজীবনকে অবদমনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলশেভিকরা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রস্রবণের উৎস মুখটিকে চাপা দিয়ে দিচ্ছেন। তার প্রশ্ন - তবে কি এসবেরই প্রয়োজন কেবলমাত্র ক্ষমতা দখলের আগে পর্যন্ত? অথচ বাস্তব জীবন তো অন্য কথা বলে। বলশেভিকরা যে পৃথিবীর ইতিহাসে এক তুলনাহীন, পর্বতপ্রমাণ কাজ হাতে নিয়েছেন তাতে তো জনগণের তীব্রতম রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ন সবচেয়ে জরুরি বিষয়। কিন্তু কেবলমাত্র সরকারের সমর্থকদের জন্যই, একটিমাত্র পার্টির লোকের জন্যই স্বাধীনতাকে তো স্বাধীনতাই বলা যায় না। যে অন্যভাবে চিন্তা করে তার জন্য স্বাধীনতাই হলো আসলে সত্যিকারের স্বাধীনতা। এটা বলশেভিকরা বুঝতে ভুল করছেন, কারণ তাদের কাছে একনায়কত্ব যেন এক প্রস্তুত ফরমুলা। তারা ধরতে পারছেন না অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন নিহিত রয়েছে ভবিষ্যতের কুয়াশাময় গর্ভে, তার কোনো রূপরেখা পাঠ্যসূচির বইয়ে পাওয়া যাবে না। এটাই সমাজতন্ত্রের শক্তির উৎস। এটার জন্য কাল্পনিক সমাজতন্ত্র থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অনেক বেশি উন্নত।
এরপর রোজা লুক্সেমবুর্গ তার বক্তব্যের সমর্থনে বলেন-
‘‘সমাজের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবল হওয়া উচিত বা কেবল হতে পারে এমন একটি ঐতিহাসিক ফসল যার জন্ম তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বিদ্যায়তনে, যার জন্ম তার নিজস্ব গতিধারার মধ্যে, জীবন্ত ইতিহাসের বিকাশের ফলশ্রুতিতে। শেষ বিচারে, এ নিজেও যার অংশ সেই জৈব প্রকৃতির মতোই এর এক সুন্দর অভ্যাস আছে; তা হলো এ সবসময়েই প্রকৃত সামাজিক প্রয়োগগুলোর সাথে সাথে তা মেটাবার উপকরণগুলোও তৈরি করে, কর্তব্যকর্ম সৃষ্টি করার সাথে সাথে তার সমাধানও সৃষ্টি করে। যাই হোক, এটাই যদি ঘটনা হয়, তবে এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃতিগতভাবেই সমাজতন্ত্রকে ডিক্রি জারি করে বা ঘোষণার মাধ্যমে কায়েম করা সম্ভব নয়।’’
রোজার মনে হয়েছে, বলশেভিকদের এই ইতিহাস চেতনা না থাকার ফলে তারা ডিক্রি, ফ্যাক্টরি ওভারসিয়ারের একনায়কত্ব, আইন এবং সন্ত্রাসের শাসনের ওপরই বেশি নির্ভর করছেন। সাধারণ নির্বাচন, সংবাদপত্র ও সমাবেশের অবাধ স্বাধীনতা, বিভিন্ন মতামতের মুক্ত সংঘর্ষ ছাড়া জনজীবন হয়ে যায় মৃত। আমলাতন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক ডজন পার্টি নেতা তাদের অফুরন্ত ক্ষমতা এবং বিপুল অভিজ্ঞতার জোরে সবকিছু চালিয়ে নিয়ে যান। শ্রমিকদের মধ্যে কিছু বাছাই লোককে মাঝে মাঝে মিটিংয়ে ডাকা হয়। নেতাদের বক্তৃতায় তারা হর্ষধ্বনি দেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। ‘একনায়কত্ব’ - তবে শ্রেণীর নয়, হাতে গোনা কিছু পার্টি নেতার। রোজার মতে লেনিনের এই একনায়কত্ব আসলে পুঁজিবাদী মডেলের একনায়কত্ব। শ্রেণীর নামে আসলে এটি অগ্রণী সংখ্যালঘুর ‘একনায়কতন্ত্র’। কিন্তু ‘একনায়কতন্ত্র’ হওয়া উচিত সমগ্র শ্রেণীর; যার অর্থ ব্যাপক জনসাধারণের সবচেয়ে সক্রিয়, বাধাহীন অংশগ্রহণের ওপর ভিত্তি করে প্রশস্ততম গণ-আঙ্গিকের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত ‘একনায়কত্ব'।
কিন্তু তার গণতন্ত্রের জন্য এই আবেগপূর্ণ আকুতি কোনো সমাধান দিতে পারেনি। সাবধানবাণী হিসেবে তার সকল বক্তব্যই অনুধাবনযোগ্য; সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্যিই আমলাতন্ত্র এবং ‘শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব’ এর জায়গায় পার্টির একনায়কত্ব প্রাধান্যকারী জায়গায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু বুর্জোয়া বিপ্লবে পার্লামেন্টের ভূমিকাকে স্মরণ করে তিনি ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ এর যুগে ঐ একই ধরনের অবাধ গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও বুর্জোয়া গণতন্ত্র, রাষ্ট্র ও একনায়কত্বের থেকে সর্বাহারার গণতন্ত্র, রাষ্ট্র ও একনায়কত্বের যেখানটায় গুণগত পার্থক্য সে জায়গায় যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। এ প্রশ্নে লেনিনের অবস্থান ছিল অধিক বিজ্ঞানসম্মত। লুকাচ তার ‘ইতিহাস ও শ্রেণী চেতনা’ গ্রন্থে যে দৃষ্টিকোণ থেকে রোজার অবস্থানকে সমালোচনা করেছেন তা অনেক বেশি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্মত।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gy%C3%B6rgy_Luk%C3%A1cs
‘শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব’ এর পর্বে শ্রমিক রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বুর্জোয়া বিপ্লবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ভূমিকার সঙ্গে সমতুল্য করে দেখার এই ভাববাদী ভ্রান্তির উৎসের ব্যাপারে আমাদের আলোচনা করতে হবে।
রোজা জোর দিয়ে বলেন সমাজতন্ত্র ডিক্রি জারি করে হয় না, কারণ সমাজের প্রকৃত প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেটাবার উপকরণও তা একই সঙ্গে সৃষ্টি করে, কর্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে সমাধানও সৃষ্টি করে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এ ক্ষেত্রে অ-দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছেন। ইতিহাসের গতিপথের স্বয়ংক্রিয়তার ওপর এই একপেশে জোর রোজার স্বতঃস্ফূর্ততার উৎস। এ কারণে তার ঝোঁক হচ্ছে ইতিহাসের জৈব উপাদানকে বাড়িয়ে দেখা। রোজার চোখে সমাজতন্ত্রও একটি মতাদর্শগত জৈব বিকাশের পরিণতি। বিপ্লবের শক্তিসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত, প্রকৃতিজ শক্তিকে বাড়িয়ে দেখলেই অনিবার্যভাবে এই সিদ্ধান্তে আসতেই হবে যে ইতিহাস যে শ্রেণী বা শ্রেণীগুলোকে নেতৃত্ব করতে আহ্বান জানিয়েছে তাদের অগ্রগতির পথ অমোঘ এবং অবাধ। তাই লেনিন যে সংবিধান সভাকে তৎকালীন পরিস্থিতির অনুপযুক্ত বলে ভেঙে দিলেন তাকে রোজার মনে হলো এক ‘অনমনীয় পরিকল্পনাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি’।
ইতিহাস নির্দিষ্ট অমোঘ গতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের পার্লামেন্ট এর সংস্থাগুলোর বিবর্তনকে উল্লেখ করেছেন, যদিও তিনি বুর্জোয়া পার্লামেন্টের গণ্ডীর মধ্যেই যে বলপ্রয়োগের ঘটনাগুলো ঘটতো কিংবা ফরাসি পার্লামেন্টের বাইরের উপাদানগুলোর ফরাসি বিপ্লবে কী ভূমিকা ছিল তা উল্লেখ করেননি। এমনকী বুর্জোয়া পার্লামেন্টের ভূমিকাতেই একটি বিবর্তনধারা চোখে পড়ে। রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রে সংবিধান সভা ভেঙে দেয়াটা এক গুণগত উল্লম্ফন যা রোজা বুঝতে পারেননি। তিনি পার্লামেন্টারি সংস্থাগুলোর অতীত বিবর্তনের অ-জৈব চরিত্র অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন; সমাজতান্ত্রিক উৎক্রমণের পর্যায়ে রূপান্তরের প্রধান অস্ত্র সোভিয়েতগুলো যে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা নয়, এটাই তিনি বিশ্বাস করতেন না। তার মনে হতো, সোভিয়েত এর সার্বজনীন ভোটাধিকার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরের ‘উপরিকাঠামো’। তাই এগুলোকে তিনি সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণ কালের হাতিয়ার বলে মানতে পারেননি।
রূপান্তর পর্বের সমাধানটি তার কাছে অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত (বুর্জোয়া রূপান্তরের স্বতঃস্ফূর্ততার মতো)। বুর্জোয়া বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর বুর্জোয়া রাষ্ট্রের যে সামাজিক কাজ, ক্ষমতা দখলের পর সর্বহারার রাষ্ট্রের কী একই ধরনের কাজ? অর্থনীতিতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের পর উপরিকাঠামোতে যে স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাধান্য থাকে (যা বুর্জোয়া বিপ্লবের পর দেখা গিয়েছিল), প্রলেতারীয় বিপ্লবের পরও যদি তাই ঘটে তবে সেখানেও সচেতনতার তুলনায় স্বতঃস্ফূর্ততার ভূমিকা বেশি থাকে। আর্থ-সামাজিক ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটা এবং তার ফলস্বরূপ উপরিকাঠামো হিসেবে যদি প্রলেতারীয় রাষ্ট্র ও সোভিয়েত ব্যবস্থা গড়ে উঠতো তবে রোজার যুক্তি সঠিক বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের সূচনা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে। এখানে নবজাত প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটিকে শূন্য থেকে গড়ে তোলার একশ ভাগ সচেতন কাজে হাত লাগানো।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির দীর্ঘকালের লালিত জগৎ থেকে এক পা এক পা করে জমি দখল করতে গিয়ে শক্তির বিচারে কিছুমাত্র ভুল হয়ে গেলে ফিরে আসবে পুরানো ব্যবস্থা। এই পর্যায়ে চেতনার ভূমিকা নির্ণায়ক। এই কঠিনতম সময়ের দুরূহ কাজটিই করবে সোভিয়েত। সোভিয়েতের তাৎপর্য হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক নানান সংঘাতের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে যা দাঁড়াবে তারই বর্তমান রূপ। বর্তমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ সমাজের গুণাবলীর মেলবন্ধন হচ্ছে সোভিয়েত। তাই ভবিষ্যতের জন্য সোভিয়েতকে মুলতুবি রাখা যাবে না। ভবিষ্যতের প্রবেশ পথই হচ্ছে সোভিয়েত। বিষয়টি রোজা বুঝতে ব্যর্থ হলেন, কারণ বুর্জোয়া বিপ্লব এবং প্রলেতারীয় বিপ্লবের প্রক্রিয়া যে গুণগতভাবে ভিন্ন তা নিয়ে তিনি যথেষ্ট মনোযোগ দেননি।
সামন্তবাদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে। আরও বেড়ে ওঠার যে ঐতিহাসিক প্রবণতা তার আইনি বাধা দূর করা হয় বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে। বুর্জোয়া বিপ্লবের পর বিকাশমান পুঁজির সামাজিক শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত নিয়ম সর্বদা বুর্জোয়াদের পক্ষে সহায়ক হয়। অপরপক্ষে প্রলেতারীয় বিপ্লবে বিপ্লবের আগে কেবল বিপ্লবের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়, অর্থনীতিতে বস্তুগত অবস্থা পরিপক্ব হয় আর সৃষ্টি হয় বিপ্লবের কারিগর শ্রমিক শ্রেণী। তাছাড়া পুঁজিবাদ বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেলেও পুরানো ব্যবস্থার মধ্যে নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কণামাত্র গড়ে তোলা যায় না। ক্ষমতা দখলের পর শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়াদের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অনুকূল অবস্থায় পড়ে না। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শূন্য থেকেই চালু করতে হয়। আপন গতিতে তা বিকশিত হতে থাকে না। এই বিশেষ অবস্থা বরং পরাজিত পুঁজিপতিদের পক্ষে কিছুটা অনুকূল বলে তাদের মধ্যে ক্ষমতা পুনর্দখলের স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয়। এই প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করার জন্য শ্রমিক শ্রেণীকে রাজনৈতিকভাবে কঠোর হতেই হবে, তাকে একনায়কত্ব প্রয়োগ করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে আর তার রাজনৈতিক রূপকে সোভিয়েত ধরনের কিছু হতে হবে। সংবিধান সভা, পূর্ণ গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের এবং সম্মেলনের অবাধ স্বাধীনতা ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয় বিকাশের পথ তখনই খুলে দেয়া যায় যখন প্রতি মুহূর্তে বুর্জোয়াদের দ্বারা ক্ষমতা পুনর্দখলের আশঙ্কা থাকে না। বিষয়টি রোজ লুক্সেমবার্গের বুঝতে ভুল হয়েছিল বলে তিনি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের পর্যায়ে সোভিয়েতের তুলনায় সংবিধান সভার ওপর বেশি নির্ভর করতে চেয়েছিলেন।
রোজার দৃষ্টিভঙ্গিতে এই ভাববাদী উপাদানগুলো থেকে যাওয়ার কারণে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ত্রুটিগুলোকে তিনি সঠিকভাবে চিহ্নিত করলেন তার সমাধান দিতে তিনি অপারগ হলেন। এই ভাববাদী ঝোঁকের কারণে তিনি রুশ বিপ্লবে প্রলেতারীয় শক্তিকে বাড়িয়ে দেখেছিলেন, সেজন্য রাশিয়ায় বলশেভিকদের কৃষি কর্মসূচি এবং জাতিসত্তার লাইনকে ‘বাম’ দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রমণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে জার্মানিতে জাতীয় অ্যাসেম্বলির বদলে শ্রমিক এবং সৈন্যদের কাউন্সিলের মধ্যে জনগণের শক্তির আধার খুঁজে পান এবং এভাবে নিজের পুরানো অবস্থান বদলে নেন।
Comments