সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও স্তালিনের ভ্রান্তি [পর্ব-এক]
"জাতীয় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিজয় এখন ঘটনা। আর, তার অর্থ কী? এর অর্থ এই যে মানুষের হাতে মানুষের শোষণের অবসান ঘটানো হয়েছে, তা পরিত্যক্ত হয়েছে, আর সোভিয়েত সমাজের অটল ভিত্তি হিসাবে উৎপাদনের উপকরণ ও যন্ত্রাদির সমাজতান্ত্রিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।"
- স্তালিন [২৫ নভেম্বর, ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সোভিয়েতগুলোর বিশেষ ৮ম কংগ্রেসের বক্তৃতা থেকে নেয়া]
‘‘তোমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করছো,অথচ তোমরা জানো না বুর্জোয়ারা কোথায়। তারা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেই - যারা পুঁজিবাদের পথ নিচ্ছে।’’
- মাও সে তুং [১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার একটি বিবৃতি থেকে নেয়া]
স্তালিনের বক্তৃতা দেখিয়ে দেয় সমাজতন্ত্রের প্রতি তার গভীর বিশ্বাস সত্ত্বেও তিনি ‘সমাজতন্ত্র’ কী তা বোঝার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। মাও সে তুং সেখানে সঠিক সমস্যাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশে শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্বের উপর জোর দিয়ে নয়, একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদের উৎস কোথায় তা দেখিয়ে দিয়ে তিনি মার্কসবাদ লেনিনবাদের পতাকা বহন করে নিয়ে গেছেন। পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে মাও সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের নঞর্থক দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন। একই সময়ে তিনি তাদের পার্টিতে ভুল লাইনের প্রবক্তাদের উপর, তাদের ক্ষমতাবৃদ্ধির ওপর, ষাটের দশকের মাঝামাঝি তারা যে প্রায় ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল তার উপর তীক্ষ নজর রেখেছিলেন। স্তালিনের সবচাইতে বড় ভুল ছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্ব স্বীকার না করা। প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের অনেক বছর আগে ১৮৭৫ সালে মার্কস কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে পুঁজিবাদী উপাদানগুলোর টিকে থাকার কারণগুলো বিশ্লেষণ করেন-
‘‘আমাদের এখানে কাজ করতে হবে সেই কমিউনিস্ট সমাজ নিয়ে, যা তার নিজের ভিত্তির উপর বিকশিত হয়নি, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সদ্য বেরিয়েছে; আর তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিকভাবে, নৈতিকভাবে ও বৌদ্ধিকভাবে তার গায়ে লেগে রয়েছে পুরানো যে সমাজ থেকে তার জন্ম তা থেকে লব্ধ জন্মদাগ।’’
লেনিন বলেছিলেন-
‘‘এবং শ্রেণীগুলো এখনো থেকে যাবে, থেকে যাবে সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের যুগেও। সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের অধীনে শ্রেণী সংগ্রামের অবসান ঘটে না, তা কেবল অন্য চেহারা নেয়।’’
একই লেখায় লেনিন ব্যাখ্যা করে বোঝান সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের সময় শোষক শ্রেণীগুলোর শক্তির উৎস কী, উৎখাত হওয়া শোষকদের শ্রেণী সংগ্রাম কেমন করে তিক্ততর হয়ে ওঠে তা সম্পর্কে-
‘‘পুুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ হতে একটা পুরো ঐতিহাসিক যুগ লেগে যায়। সেই যুগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শোষকরা সব সময় প্রত্যাবর্তনের আশা করে, এই আশা রূপান্তরিত হয় প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টায় দশগুণ জোরালো শক্তি, তীব্র উত্তেজনা ও শতগুণ জোরালো ঘৃণা নিয়ে।"
লেনিন মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বুর্জোয়াদের শক্তির উৎসটি থাকে সমাজের অন্ত:স্থলে; সমাজ থেকে রসদ সংগ্রহ করে বুর্জোয়ারা নিজেদের জোরদার করে তোলে-
‘‘আর এদের ক্ষমতা থাকে অভ্যাসের শক্তির মধ্যেও, ক্ষুদ্র উৎপাদনের শক্তির মধ্যে। দুঃখের কথা, ক্ষুদ্র উৎপাদন এখনো বিশ্বে ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে, আর এই ক্ষুদ্র উৎপাদনের মধ্যেই পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়ারা তৈরি হয় প্রতি দিন, প্রতি ঘন্টায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, বড় মাপে।’’
অন্যদিকে ১৯৩৯ সালে অষ্টদশ পার্টি কংগ্রেসে স্তালিনের রিপোর্টে ছিল-
‘‘সোভিয়েত সমাজকে সব পুঁজিবাদী সমাজ থেকে যেটা পৃথক করে তা এই যে এতে কোনও বৈরী শ্রেণী নেই: শোষক শ্রেণীগুলোকে উৎপাটিত করা হয়েছে, সোভিয়েত সমাজ তৈরি যে শ্রমিক, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে, তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতার মধ্যে বাস করে, কাজ করে।’’
দ্বাবিংশ কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন-
"সব জনগণের রাষ্ট্র’, ‘সব জনগণের পার্টি।"
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক) এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল-
সমাজে যদি দমন করার মতো কেউ না-ই থাকে তাহলে রাষ্ট্রকে কেন অতীতের যাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে না?
উত্তরে স্তালিন বলেছিলেন-
"এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে যে শুধু পুঁজিবাদীদের ঘিরে থাকার বিষয়টির গুরুত্বই কমিয়ে দেখা হচ্ছে তাই নয়, বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো ও তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ও গুরুত্ব, আমাদের দেশে তাদের পাঠানো চর, গুপ্তহত্যাকারী ও অন্তর্ঘাতীদের ভূমিকা, তারা যে সশস্ত্র আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে, তার গুরুত্বও কমিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
এরপর স্তালিন রাষ্ট্র সম্পর্কে এই ধারণার তাত্ত্বিক ভিত্তি দেন এঙ্গেলস এর অ্যান্টি ড্যুরিঙ এর একটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে, যেখানে এঙ্গেলস রাষ্ট্রের শুকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন এঙ্গেলসের কথা সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নয় দু'টি কারণে-
(১) আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখা যায় না;
(২) তখন সব দেশে তো নয়ই, বেশির ভাগ দেশেও সমাজতন্ত্র বিজয়ী নয়।
তিনি তার অবস্থানকে জোরদার করার জন্য লেনিনের উদ্ধৃতি দেন-
‘‘মার্কসবাদী তত্ত্বকে আমরা চূড়ান্তভাবে সমাপ্ত কিছু বা যার গায়ে একেবারে হাত দেয়া যাবে না এমন কিছু মনে করি না। জীবনের সঙ্গে তাল রাখতে হলে সমাজতন্ত্রীদের অবশ্যই একে সবদিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’
[‘আমাদের কর্মসূচি’, ১৮৯৯]
কিন্তু এঙ্গেলস রাষ্ট্রের শুকিয়ে যাওয়ার দীর্ঘকালীন ও সাধারণ দিশা সম্পর্কে বলছিলেন-
‘‘যেখানে সামাজিক সম্পর্কে রাষ্ট্রশক্তির হস্তক্ষেপ একের পর এক ক্ষেত্রে বাড়তি হয়ে পড়ে, আর তা শেষ হয়ে যায়।"
চীনে জনগণতন্ত্র গড়ার পর থেকে ১৯৫৬ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেস পর্যন্ত সময়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত। সিপিসি-র ৮ম কংগ্রেস এর উদাহরণ, যেখানে শ্রেণী সংগ্রামকে অপ্রধান অবস্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সিপিসি-র সপ্তম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় প্লেনারি অধিবেশনের রিপোর্টে মাও সে তুং বলেছিলেন-
‘‘ব্যক্তিগত পুঁজিবাদকে সীমিত রাখার নীতি বুর্জোয়াদের কাছ থেকে নানা স্তরের ও নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে বাধ্য, বিশেষ করে ব্যক্তি উদ্যোগগুলোর বড় মালিকদের কাছ থেকে, অর্থাৎ বড় পুঁজিপতিদের কাছ থেকে। সীমিত রাখা আর সীমিত রাখাকে বাধা দেয়া, এটা হবে নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণী সংগ্রামের প্রধান ধরন। বর্তমানে আমাদের পুঁজিবাদকে আটকে রাখার দরকার নেই বা ‘পুঁজির নিয়ন্ত্রণ’ এর শ্লোগান এখন বাদ দেয়া চলে, এমনটা ভাবা একেবারেই ভুল হবে; সেটা হবে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।’’
১৯৫২ সালের জুন মাসে তিনি বিবৃতি দিলেন-
"শ্রমিকশ্রেণী ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এখন চীনে প্রধান দ্বন্দ্ব।"
১৯৫৭ সালে মাও বললেন-
‘‘শ্রেণী সংগ্রাম একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। সর্বহারা ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রাম, বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রাম এবং মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সর্বহারা ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রাম এখনও দীর্ঘকাল চলবে, চলবে আঁকাবাঁকা পথে, কখনো কখনো তা খুব তীব্র হবে। সর্বহারারা চায় তাদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বিশ্বকে রূপান্তরিত করতে, বুর্জোয়ারাও তাই চায়। এতে কে জয়ী হবে, সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ, সে প্রশ্নটির সমাধান এখনো হয়নি।’’
মাও পরিষ্কার ধারণা পোষণ করতেন যে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার রূপান্তর ঘটলেই তা নিজে থেকে সমাজতন্ত্র আনতে পারে না-
‘‘আমরা মূল বিজয় অর্জন করেছি, উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার রূপান্তর ঘটিয়েছি, কিন্তু রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিজয় থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে। মতাদর্শগত ক্ষেত্রে কে বিজয়ী হবে, সর্বহারারা না বুর্জোয়ারা, সেটি এখনো নির্ধারিত হয়নি।’’
১৯৬২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম কেন্দ্রীয় কমিটির ১০ম প্লেনারি অধিবেশনে তিনি বলেন-
‘‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক কাল জুড়ে রয়েছে। সমাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক পর্বে শ্রেণী, শ্রেণী দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী সংগ্রাম থেকে যায়, সমাজতান্ত্রিক পথ আর পুঁজিবাদী পথের মধ্যে সংগ্রাম থেকে যায়, পুঁজিবাদে পুন:প্রত্যাবর্তনের বিপদ থেকে যায়। এই সংগ্রাম যে দীর্ঘ হবে, জটিল হবে, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের নজরদারি তীব্র করতে হবে, নইলে আমাদের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশ এর বিপরীতটা হয়ে দাঁড়াবে, এতে পচন ধরবে, পুঁজিবাদ পুন:প্রবর্তিত হবে। এখন থেকে আমাদের প্রতি বছর প্রতি মাসে প্রতি দিন এটা নিজেদের মনে করিয়ে দিতে হবে, যাতে করে এই সমস্যা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা রাখতে পারি, একটা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লাইন নিতে পারি।’’
১৯৬৪ সালের শেষে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকর সম্মেলন আহ্বান করেন এবং তার নির্দেশে ২৩ দফা দলিল তৈরি হলো, যার নাম ‘গ্রামাঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা আন্দোলনে উপস্থাপিত কয়েকটি সাম্প্রতিক সমস্যা’। তাতে তিনি প্রথম লক্ষ্য নির্দেশ করলেন-
‘‘বর্তমান আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হলো ক্ষমতায় থাকা পার্টির সেসব লোকজন যারা পুঁজিবাদের পথ নিচ্ছে’’।
উল্লেখ্য, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ১৬ মে, ১৯৬৬ সালের সার্কুলারটিকে সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরু বলে ধরা হয়।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি আলোচনায় মাও বলেন-
‘‘অতীতে আমরা গ্রামাঞ্চলে, কারখানায়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংগ্রাম করেছি; সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা আন্দোলন করেছি, কিন্তু সমস্যা সমাধানে এগুলো সব ব্যর্থ হয়েছে, কারণ আমরা এমন কোনো ধরন, পদ্ধতি বের করতে পারিনি যার মাধ্যমে অন্ধকার দিকগুলো খোলাখুলিভাবে, সব দিক থেকে, একেবারে নীচ থেকেই জনগণকে দেখানো যায়।’’
‘সর্বহারা একনায়কত্বের যুগের অর্থনীতি ও রাজনীতি’, ‘একটি মহান সূচনা’, ‘সর্বহারা বিপ্লব ও দলত্যাগী কাউটস্কি’, ‘বামপন্থী কমিউনিজম - একটি শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ প্রভৃতি লেখায় লেনিন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কেন সর্বহারা একনায়কত্বের কালে শ্রেণী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া কমিউনিস্টদের অবশ্য করণীয়।
মাও এর মতে পার্টিতে সংশোধনবাদীরাই বুর্জোয়াদের সদর দপ্তর। সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটাবে মূলত পার্টির মধ্যকার পুঁজিবাদী পথযাত্রীরা, যদিও বুর্জোয়া সামাজিক শক্তিগুলো বুর্জোয়াদের প্রত্যাবর্তনের উপযোগী ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে।
উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তি মালিকানার অবসান হলো সর্বহারার প্রথম কাজ। কিন্তু সেটা করাই সমাজতন্ত্র গড়া ও তার বিকাশের পক্ষে যথেষ্ট নয়। প্রথম থেকেই শ্রেণী সংগ্রাম থাকে, কারণ সমাজতন্ত্র জন্ম নেয় পুঁজিবাদের নানা চিহ্ন সাথে নিয়ে। লেনিন বলেছিলেন:
‘‘তাত্ত্বিকভাবে এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট উৎক্রান্তিকালীন সময় থাকবে, যাতে সামাজিক অর্থনীতির এই দুই রূপেরই কিছু কিছু চিহ্ন ও ধর্ম বিদ্যমান থাকবে। এই উৎক্রান্তিকালীন কালটি হবে মরণোম্মুখ পুঁজিবাদ ও সদ্যজাত সমাজতন্ত্রের মধ্যকার সংগ্রামের কাল। কিংবা অন্য কথায় বলতে গেলে, পরাজিত কিন্তু এখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত নয় এমন পুঁজিবাদ আর জন্মেছে কিন্তু এখনো খুব দুর্বল সমাজতন্ত্রের মধ্যে সংগ্রামের কাল।’’
পুঁজিবাদের আগমনের আগে পর্যন্ত পুরানো সমাজের গর্ভে নতুন উৎপাদিকা শক্তি ও সে অনুসারে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠতো। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ হয় অভূতপূর্ব মাত্রায়। কিন্তু এর মধ্যে নতুন কোনও উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেয় না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা উৎপাদনকে একটি সামাজিক রূপ দিয়ে সর্বহারার সৃষ্টি করে, যারা সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে ভবিষ্যতে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ব্যক্তি মালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় রূপান্তরিত করে উৎপাদিকা শক্তিকে শৃঙ্খলমুক্ত করবে। সদ্যজাত সমাজতান্ত্রিক সমাজে এমন ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হবে যাতে 'পূর্বনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সামাজিক উৎপাদন এখন সম্ভবপর হয়'। সর্বহারা কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর চেতনাই উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারণ করতে শুরু করে। এতদিন ভিত্তি উপরিকাঠামোকে নির্ধারণ করতো, এখন উপরিকাঠামো মূলত ভিত্তিকে নির্ধারণ করবে। যে পুঁজিবাদকে তারা পরাজিত করেছে তার চাপ থেকে যায়। মাও এর মতে-
"তাদের প্রতিরোধের শক্তি শতগুণ, হাজারগুণ বাড়ে।"
সমাজতান্ত্রিক সমাজে চলমান শ্রেণী সংগ্রামকে যদি স্বীকার করা না হয়, সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, সর্বহারা একনায়কত্ব বুর্জোয়া একনায়কত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তি মালিকানার অবসান এবং তাকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে রূপান্তর সর্বহারার প্রাথমিক ও মৌলিক কাজ। সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে শ্রমের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো এবং তার মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে আসা।
সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের আমল থেকেই এ কথা মনে করা হতো যে, শোষক শ্রেণীগুলোর যেহেতু অবসান ঘটানো হয়েছে এবং শ্রেণী সংগ্রাম আর নেই, সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব তাই উন্নত উৎপাদন সম্পর্ক ও পিছিয়ে পড়া উৎপাদিকা শক্তির মধ্যে। মনে করা হতো, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল পূর্বশর্তগুলো যেহেতু পূরণ করা হয়েছে, উৎপাদনকে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা, বাজার ও মুনাফামুক্ত করা হয়েছে; সেহেতু পরিকল্পিত অর্থনীতি এবার উৎপাদিকা শক্তির অবাধ বিকাশ ডেকে আনবে। এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার জন্য ভারি শিল্পের ওপর জোর দেয়া হলো, হাল্কা শিল্প ও কৃষি মার খেলো। স্তালিন মনে করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সমাজতন্ত্রের শক্তিশালী বস্তুগত ভিত্তি গড়া দরকার, সেই কারণে আধুনিক প্রকৌশলের ব্যবহার এবং সেগুলো ব্যবহার করতে সক্ষম কর্মীবাহিনী তৈরি করা সমাজের প্রাথমিক প্রয়োজন। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একজনের হাতে পরিচালনার ভার দেয়া, পিস ওয়ার্ক, বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরতা, বোনাস দেয়া পর্যন্ত শুরু করা হয়। উৎপাদন সম্পর্কের কথা ভুলে যাওয়া হলো। নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক, পরিচালকবৃন্দ ও শ্রমিকদের মধ্যকার সম্পর্ক, বিশেষজ্ঞ ক্যাডার ও সাধারণ ক্যাডারদের মধ্যকার সম্পর্ক পুঁজিবাদী সম্পর্কের দিকে চলতে শুরু করলো। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মধ্যে স্থানীয় প্রয়াসের স্থান থাকলো না। উৎপাদন ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ হয়ে দাঁড়ালো পার্টির ওপরের স্তরের কিছু ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার। এক একজন শ্রমিক বা কৃষক হয়ে উঠলেন ‘সমাজতন্ত্রের’ সাধারণ কাঠামোর মধ্যে একটা ছোট অংশ মাত্র। এসব হতে শুরু করলো ‘সমাজতন্ত্র’ এর সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই, যেখানে শ্রমজীবী জনতা উৎপাদনের উপকরণের মালিক। উপরিকাঠামো ও উৎপাদন সম্পর্কের ক্রমাগত বিপ্লবীকরণ করে যাওয়ার কাজটিকে স্তালিন অবহেলা করেন। তিনি যেহেতু সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি, তাই উপরিকাঠামো থেকে কোনো বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি সতর্ক ছিলেন না। এই বিপদ উৎপাদন ও উৎপাদিকা শক্তির মানব অংশটিকে বিষিয়ে তুলতে পারে। এর ফলে উৎপাদক উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। পুঁজিবাদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটাতে পারে এবং কোনো কোনো দেশে তা ঘটিয়েছে। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণ থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে পারে না তারা। সেই কারণে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রকে আলাদা করার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৪৪ সালে কার্ল মার্কস বিচ্ছিন্নতার সমস্যাটি আবিষ্কার করেন-
‘‘যখন সে (শ্রমিক) কাজ করছে না তখন সে ঘরে রয়েছে, আর যখন সে কাজ করছে তখন সে স্বচ্ছন্দ নয়। তার শ্রম তাই ঐচ্ছিক নয়, জোর করে আদায় করা, চাপিয়ে দেয়া শ্রম। এটা তাই কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করে না, বাইরের কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করার উপায় মাত্র। যখনই কোনো জোর খাটানোর বস্তুগত বা অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তখনই এই শ্রম, যাতে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, সেটি হয়ে যায় আত্মবিসর্জনের, বিরক্তিসূচক শ্রম। এর থেকেই এর বিচ্ছিন্নতার চরিত্রটি বোঝা যায়।’’
এঙ্গেলস বলেছিলেন-
সমাজতন্ত্রে "উৎপাদিক শ্রম হয়ে উঠবে বিরক্তিকর নয়, আনন্দদায়ক"।
শ্রমিক যে পণ্য উৎপাদন করছে সেই পণ্য সম্পর্কে, সেটি কেন উৎপাদন করা হচ্ছে সেই কারণ সম্পর্কে, এই উৎপাদনজাত আয় কেমনভাবে বণ্টিত হচ্ছে, আর কেন তা হচ্ছে - এগুলো সম্পর্কে অন্ধকারে থাকলে সে কখনোই এই শ্রমে আনন্দ পেতে পারে না। সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ও একঘেয়ে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার ব্যক্তিগত দক্ষতা, তার সৃজনশীলতা কোনো কাজে লাগে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকদেরও একই দশা হয়েছিল সোভিয়েত আমলের শেষের দিকে।
Comments