সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও স্তালিনের ভ্রান্তি [পর্ব-তিন]
লিউ মাও এর পক্ষে ‘সামনের দিকে বিরাট উল্লম্ফন’ এর ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি তিনি সামনের দিকে উল্লম্ফন ও জনগণের কমিউন এর কর্মসূচি ব্যর্থ করার জন্য দুটি বিপজ্জনক পন্থা অবলম্বন করেন। প্রথমটি হলো পরিকল্পিত কাজগুলোকে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে অন্তর্ঘাত করা - এটি ‘গরিব কৃষক ও কৃষি মজুর লাইন’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি নীতি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর তিনি একপেশেভাবে এটির একদিকের ওপর জোর দিতে থাকেন এবং এভাবে কর্মসূচির বারোটা বাজান। অন্য পথটি হলো দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য, শিক্ষা ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মতাদর্শগত আক্রমণ। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দর্শনের ক্ষেত্রে ইয়ান সিয়েন চেন এর আক্রমণ। তার ‘সংশ্লেষিত অর্থনৈতিক ভিত্তি’ এবং ‘দুইকে এক করা’-র কুখ্যাত তত্ত্ব ‘শ্রেণীসংগ্রাম শুকিয়ে যাওয়া’র দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করে, যা ছিল লিউয়ের সবচেয়ে পছন্দের রাজনৈতিক লাইন। এই পর্যায়ে লিউয়ের লোকদের ইচ্ছাকৃতভাবে করা বাড়াবাড়ি ছাড়াও সামনের দিকে বিরাট উল্লম্ফন ও জনগণের কমিউনের অন্য সমস্যা ছিল। মাও এর লাইনের বদনাম রটাতে সংশোধনবাদীরা এগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এগুলোর অনেকটা এসেছিল সোভিয়েতের উদাহরণ ও আগেকার কাজ থেকে। ‘নির্দেশবাদ’ ছিল, ভোগ আর বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব ছিল - কোনো কোনো এলাকায় কোনো কোনো সময়ে সঞ্চয়ের হার ছিল বেশি। ফলে শিল্পক্ষেত্রের জন্য কৃষিক্ষেত্রকে শোষণ করা হয়ে যায় (যদিও চীন শিল্পপণ্য ও কৃষিপণ্যের মূল্যের মধ্যকার ফারাক যথাসাধ্য কমানোর চেষ্টা করে)। তাড়াহুড়ো করে পানি সংরক্ষণ প্রকল্প গড়তে গিয়ে পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হয়। পরিবহনের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কয়েকটি পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। আর কিছু ‘বাম’ ভুলত্রুটি ঘটে। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির লুশান সভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেঙ তে-হুয়াই দাবি করলেন সামরিক বাহিনীকে একটি আধুনিক বাহিনী বানানো হোক, ভারী শিল্প ও সামরিক গঠনকার্যের ওপর জোর দেয়া হোক।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Peng_Dehuai
২০ দিন ধরে পেঙ ‘পাতি বুর্জোয়া অন্ধ উন্মাদনা’র ওপর সমালোচনা চালিয়ে গেলেন। মাও শান্ত থেকে বললেন-
"বড় আকারে গণ্ডগোল হয়েছে, আর আমি তার দায়িত্ব নিচ্ছি।’’
২ আগস্ট বর্ধিত পলিটব্যুরো মিটিংকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনামে রূপান্তরিত করে তার ‘বাহিনী’ থেকে সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে মাও প্রত্যাঘাত করলেন-
‘‘পেঙ তে-হুয়াই এর চিঠি দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের পার্টি বিরোধী বক্তব্য। এটি কোনোভাবেই হঠাৎ করে ঘটা বা ব্যক্তিগত ভুল নয়, এটি পরিকল্পিত, সংগঠিত, তৈরি করা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’’
মাও তার কমরেডদের বলেন সামনের দিকে বিরাট উল্লম্ফন ও কমিউনকে প্যারি কমিউন হিসাবে দেখতে-
"যেটি ছিল প্রথম সর্বহারা একনায়কত্ব, তিনি (মার্কস) মনে করতেন তা মাত্র তিন মাস টিকলেও ভালো। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেখলে, এটা তেমন কাজের ছিল না।"
কেন্দ্রীয় কমিটির অষ্টম প্লেনামের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন-
‘‘গণমুক্তি বাহিনী যদি পেঙ তে-হুয়াইয়ের পথ ধরে।’’
এটা লক্ষ্য করার মতো যে লুসান প্লেনামে লিউ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেন; সেখানে মাওকে সমর্থন করার ভঙ্গিমা ছিল, আবার পেঙ-কে ছাড় দেয়ার কথাও বলেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোয় পেঙ ও অনুচরদের কার্যনির্বাহী পদ থেকে বাদ দেয়া হলেও সেখানে তাদের সদস্যপদ থেকে গেলো। লুসান প্লেনামের পর দেশব্যাপী শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু হলো দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেখানে সামনের দিকে উল্লম্ফনের নীতি তুলে দেয়া হয়েছিল সেগুলো ফিরিয়ে আনা হলো। কিন্তু একই সময়ে তাদের চীনা সঙ্গীদের সহযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সংশোধনবাদী শাসকরা একতরফাভাবে চীনে চলতে থাকা প্রকল্প থেকে সব প্রযুক্তিবিদ ও ব্লুপ্রিন্ট তুলে নিলো। এতে চীনের অর্থনীতির দারুণ ক্ষতি হয়। এরপর পরপর তিন বছর ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলো। লিউ ও তার লোকেরা চীনের এই অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিলো। তিনি ১৯৬০ সালের নভেম্বরে পার্টি ক্যাডারদের কাছে গোপন নির্দেশ পাঠায় ‘গ্রামাঞ্চলে কাজ নিয়ে জরুরি নির্দেশ’ (১২ দফা) শিরোনামে। তাতে কমিউনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। এরপর আরেকটি দলিল পাঠানো হয় ‘গ্রামাঞ্চলে জনগণের কমিউন নিয়ে খসড়া নিয়মাবলী’ শিরোনামে। ১৯৬১ সালের মার্চ মাসে ক্যান্টনের কেন্দ্রীয় ওয়ার্ক কনফারেন্সে এটি অনুমোদন করা হয়। দেং জিয়াও পিং ও পেঙ চেন এর খসড়া করা এই নিয়মাবলী বিরাট উল্লম্ফনের নীতি উল্টে দিতে চাইলো। শিল্পক্ষেত্রে লিউ এর উদ্যোগ দেখা গেলো। শিল্পের নিয়ন্ত্রণের জন্য তার ‘৭০ দফায়’ তিনি বাজার ও মুনাফার প্রধান ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, কারখানাগুলোতে রাজনৈতিক সংগ্রামের অবসান হোক। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে ৭০০০ ক্যাডারের এক কনফারেন্সে তিনি বলেন দুই বছর ধরে নাকি লোকেরা না খেয়ে থেকেছে! তিনি ১৯৬০ সালে সান জি ই বাও (মুক্ত বাজারকে আরো প্রসারিত করা, ব্যক্তিগত জমির টুকরোকে বাড়ানো, প্রতি গৃহস্থালি ভিত্তিক উৎপাদনের কোটা স্থির করা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে হস্তক্ষেপ না করা) নিয়ে এলেন। ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে তিনি তার কুখ্যাত বই ‘আত্ম অনুশীলন’ আবার বন্টন করতে শুরু করলেন, যা পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তনের জন্য জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংশোধনবাদীদের হ্যান্ডবুক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মাও পার্টিতে দক্ষিণপন্থীদের লাগাতার আক্রমণ সম্পর্কে কমরেডদের সতর্ক করতে শুরু করেন। পার্টি নেতৃত্বকারী কমিটিগুলোতে তিনি আহ্বান জানান-
‘‘কখনো শ্রেণী সংগ্রাম ভুলো না।’’
অষ্টম কেন্দ্রীয় কমিটির ১০ম প্লেনারি অধিবেশনে (সেপ্টেম্বর, ১৯৬২) মাও সমাজতন্ত্রের পুরো পর্যায়ের জন্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মূল লাইন তুলে ধরেন। তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপ্লবী বা প্রতি বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম নেয়, বিকশিত হয়। তিনি অনেকবার স্বীকার করেছেন শিক্ষা ক্ষেত্রে পার্টির মার্কসবাদীদের চেয়ে সংশোধনবাদীদের আধিপত্য বেশি। নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় থেকে তিনি উপরিকাঠামোর এই সমস্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, ‘নয়াগণতন্ত্র প্রসঙ্গে’ ও ‘ইয়েনান ফোরামে ভাষণ’ এই দু'টি বিখ্যাত লেখায় তিনি সাংস্কৃতিক ফ্রণ্টে দু’লাইনের সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন। সমাজতন্ত্রের পর্বে বিপ্লবী মতাদর্শ, সাহিত্য ও শিল্প সম্পর্কে তার একইরকম চিন্তা দেখা যায় ‘দ্বন্দ্বের সঠিকভাবে মীমাংসা প্রসঙ্গে’, ‘প্রচারকার্য সম্পর্কে’ ইত্যাদি লেখায়। অন্যদিকে পার্টির মধ্যকার দক্ষিণপন্থীরা মতাদর্শগত ক্ষেত্রগুলোতে, যেমন- সংবাদপত্র, রেডিও, পত্রপত্রিকা, পুস্তক, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সিনেমা, থিয়েটার, গীতিকবিতা, গান, নাচ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী মতাদর্শ প্রচার করতে লাগলো। এসব শুরু হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ‘য়ু সুনের জীবন’ ও ‘লাল কামরার স্বপ্ন’ দিয়ে, আর ১৯৫৯ সালে লুসানের মিটিংয়ের সময় যখন ‘তিন পরিবারের গ্রাম’ নামক দলটি একের পর এক মার্কসবাদ বিরোধী বই বের করতে থাকে। যেমন- ‘হাই জুই সম্রাটকে তিরস্কার করল’, ‘হাই জুই পদ থেকে বহিষ্কৃত হল’, ‘ইয়েনানে সন্ধ্যায় কথাবার্তা’, ‘তিন পরিবারের গ্রামের ডায়েরি’ ইত্যাদি। ১৯৬০-৬২ সালে সংশোধনবাদীদের বিজয়ী অগ্রগতি রুখতে মাও সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা আন্দোলনের ওপর জোর দেন। ১৯৬৩ সালের মে মাসে মাও এর নির্দেশে ‘গ্রামাঞ্চলে আমাদের বর্তমান কাজকর্মের কতগুলো সমস্যা নিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির খসড়া সিদ্ধান্ত’ (দশ দফা সিদ্ধান্ত) তৈরি করা হয়, যাতে আন্দোলনের মূল নীতি স্থির করা হয়। লিউ শাও-চি দক্ষিণপন্থী ক্যাডারদের প্রতি সমালোচনার ঢেউকে আটকানোর জন্য তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে চাইলেন। সংশোধনবাদী নেতৃত্বের ওপর জনগণ ও ক্যাডারদের আক্রমণ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি তাদের আক্রমণের লক্ষ্য নীচুতলার কর্মীদের দিকে সরিয়ে দিলেন, বললেন সবাই যেন ‘চারটি প্রশ্নে পরিষ্কার আছে কি নেই’ (রাজনীতি, মতাদর্শ, সংগঠন ও অর্থনীতি) সে বিষয়ে আত্মানুসন্ধান করেন। সব আঘাত গিয়ে পড়লো নীচু তলার কর্মীদের ওপর আর নেতারা ছাড় পেয়ে গেলেন। মাও ১৯৬৪ সালের শেষে কেন্দ্রীয় কমিটির ওয়ার্কিং কনভেনশন ডাকলেন এবং ‘গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা আন্দোলনের সময় উত্থিত কয়েকটি সাম্প্রতিক সমস্যা’ (২৩ দফা দলিল) বের করলেন। মাও বললেন-
‘‘বর্তমান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো পার্টির সেইসব লোকেরা যারা পুঁজিবাদী পথ বেছে নিয়েছে।’’
এতদিন দুই লাইনের সংগ্রাম ছিল গ্রামাঞ্চলের কর্মসূচি নিয়ে, একটা লাইন যৌথকরণের ও জনস্বার্থের সর্বহারা লাইন আর একটা লাইন ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ব্যক্তিস্বার্থের বুর্জোয়া লাইন। ১৯৬৫ সালে দুই লাইনের সংগ্রাম চলে এলো পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিকিং পৌরসভার সহ মেয়র য়ুহানের নেতৃত্বে পৌরসভার সংশোধনবাদী চক্র পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘাঁটি বানিয়েছিল, যেখানে লক্ষ্য ছিল নবীন প্রজন্মকে সর্বহারা ও তাদের সংস্কৃতি থেকে সরিয়ে নেয়া। লু পিং ছিল এই চক্রের প্রধান। তার অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে সে বুর্জোয়া একাদেমিক কর্তৃত্বের প্রশংসা করতো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী মতাদর্শ প্রচার করতো। এইসব লোকেরা সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে তাচ্ছিল্য ছাড়া কিছু পোষণ করতো না, তারা এই আন্দোলনকে রোখার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে বিপ্লবী ছাত্র ও শিক্ষকরা লু পিং ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা শিক্ষা আন্দোলনে কীভাবে সংশোধনবাদী নীতি আনছে সে সম্পর্কে প্রচুর তথ্য প্রমাণ সামনে এনে আন্দোলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। ১৯৬৪ সালে যখন সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা আন্দোলন চলছিল, তখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দায়িত্ব নেয়ার জন্য একটি গোষ্ঠী তৈরি করা হয়। এই গোষ্ঠীর ৫ জন সদস্য ছিলেন। নেতৃত্বে ছিলেন পিকিং শহরের মেয়র এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য পেন চেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Peng_Zhen
ইয়াও ওয়েন-ইউয়ান ‘হাই জুই তার দপ্তর থেকে বরখাস্ত হলেন শীর্ষক ঐতিহাসিক নাটক প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি লিখেন যা সাংহাই ওয়েনহুইপাও পত্রিকায় ১০ নভেম্বর, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yao_Wenyuan
নাটকটি পিকিং শহরের উপ মেয়র (ভাইস মেয়র) উ হান রচনা করেছিলেন। মিং রাজবংশের সৎ এবং স্পষ্টবাদী বক্তা কর্মচারী হাই জুই এর একটি কাহিনী নিয়ে এটি রচিত হয়েছিল, যিনি সম্রাটের ত্রুটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস প্রদর্শন করেছিলেন। ইয়াও ওয়েন-ইউয়ান দাবি করেন এই রূপকটি, অর্থাৎ সম্রাট যে হাই জুইকে বরখাস্ত করেছিলেন তা আসলে ১৯৫৯ সালে মাও সে তুং যে পেং তে-হুয়াইকে বরখাস্ত করেছিলেন তার প্রতি ইঙ্গিত। ১৯৬৫ সালে একটি বক্তৃতায় মাও সে তুং আরও বলেছিলেন-
‘‘হাই জুই দপ্তর থেকে বরখাস্ত হলেন। নাটকের মূল বিষয়টি হলো হাই এর দপ্তর থেকে বরখাস্ত হওয়া। সম্রাট জিয়াজিং হাই জুইকে বরখাস্ত করেছিলেন; ১৯৫৯ সালে আমরা পেং তে-হুয়াইকে বরখাস্ত করেছিলাম।’’
পেন চেন এই প্রবন্ধটির প্রচার রুদ্ধ করে দেন। কিন্তু 'লিবারেশন আর্মি ডেইলি' পত্রিকা পিকিং এ প্রবন্ধটি প্রচার করে। ১৯৬৬ সালের প্রথমার্ধে পণ্ডিত মহল এবং সাহিত্যিক মহলে পূর্ণ মাত্রার সমালোচনামূলক প্রচরাভিযান শুরু হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য যে গোষ্ঠীটি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল তারা নাটকটি অধ্যয়নের জন্য সভা আহ্বান করে।
‘বর্তমান সাংস্কৃতিক আলোচনার রূপরেখার ওপর রিপোর্ট’ এ পাঁচ সদস্যের গোষ্ঠীটি পুরো আলোচনাটিকে রাজনৈতিক বিতর্কের স্তরে না নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আলোচনা পণ্ডিতি স্তরে রেখে দিতে চায়। তারা আরও বলে-
‘‘অন্যদের বোঝানোর জন্য বদ্ধমূল ধারণার বদলে যেন যুক্তির আশ্রয় নেয়া হয়; ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতো ক্ষমতা প্রদর্শন করে যেন দাবিয়ে রাখা না হয়।’’
পিকিং এর পার্টির লেখকরা এই বিতর্কের রাজনৈতিক দিকটি সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। পুরো বিতর্কটিকে পণ্ডিতি বিতর্কে সীমাবদ্ধ রাখার বিরুদ্ধে ইয়াও ওয়েন-ইউয়ান আরও প্রবন্ধ লেখেন। উ হান, তেং তো এবং লিয়াও মো-শা এই তিন জন একত্রে লেখেন ‘তিনটি পারিবারিক গ্রামের নোট থেকে’, তেং তো লেখেন ‘ইয়েন শান-এ বৈকালী আড্ডা’। ইয়াও ওয়েন-ইউয়ান এই দু'টি লেখার সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে চিয়াং চিং এবং লিন পিয়াও একটি সাহিত্য ও শিল্পের ফোরাম গঠন করেন। এই ফোরাম সেই সময়কার শিল্প ও সাহিত্য মহলের সমালোচনা করে লেখে-
"(এই চালু ঘরানা) একটি পার্টি-বিরোধী এবং সমাজতন্ত্র বিরোধী লাইন অনুসরণ করছে। এই লাইন আমাদের ওপর একনায়কত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে এবং ১৯৩০ থেকে প্রগতিশীল শিল্প ও সাহিত্য যা কিছু অর্জন করেছে এবং নয়া চীন নির্মাণের এই ১৭ বছরে যা কিছু হয়েছে তার অপযশ করছে।’’
এই সভার বিবরণীর সারাংশ মাও দ্বারা সংশোধিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটির দলিল হিসেবে সেটি সারা দেশে বিতরণ করা হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরোর এক বর্ধিত সভায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয়। সভাটি বসে ১৯৬৬ সালের মে মাসের ৪ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত। এই সভা থেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সবচেয়ে বিখ্যাত সার্কুলারটি ঘোষিত হয় যা ‘১৬ মে, ১৯৬৬ সার্কুলার’ নামে খ্যাত। এই সার্কুলারটির মাধ্যমে পূর্বে বর্ণিত ‘বর্তমান পণ্ডিতি আলোচনার রূপরেখা’ নামক রিপোর্টটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়; পাঁচ সদস্যর গোষ্ঠী ভেঙে দিয়ে তাদের দপ্তর গুটিয়ে নেয়া হয় এবং সরাসরি পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির তত্ত্বাবধানে নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবী গোষ্ঠী গঠন করা হয়। এই সার্কুলারে ঘোষণা করা হয়-
‘‘আমাদের দেশ এখন মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এক অভ্যুত্থানে প্রবেশ করেছে। সমস্ত ধরনের অবক্ষয়ী মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক অবস্থান যা বুর্জোয়া বা সামন্ততন্ত্রের অবশেষ এখনও আঁকড়ে রেখেছে তার বিরুদ্ধে এক বৃহৎ আক্রমণ শুরু করেছে।’’
পাঁচজনের গোষ্ঠী যে ‘আলোচনার রূপরেখা’ দিয়েছিল তার তীব্র সমালোচনা করে মে ১৬-র সার্কুলার বলে-
‘‘সংশোধনবাদী লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মোটেই একটি তুচ্ছ বিষয় নয়, বরং তা হলো আমাদের পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভবিতব্য বিষয়ে একটি মুখ্য ব্যাপার, আমাদের পার্টির ভবিষ্যতের বিন্যাস এবং বিশ্ব বিপ্লবের সঙ্গে তা গুরুত্বপূর্ণভাবে যুক্ত।"
মাও যেভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিষয়টি ভেবেছিলেন তার প্রচার ১৯৬৬ সালের ২৫ মে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টি কর্মী নিয়ে ইউয়ান-জে বড় অক্ষরের প্রাচীরপত্র দিয়ে শুরু করেন। এই প্রাচীর পত্রের মাধ্যমে নি-য়ে ও তার কমরেডরা উ হান এর নাটক নিয়ে গণ রাজনৈতিক বিতর্ক পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। সরাসরি লু পিং এর নাম করে এই রাজনৈতিক বিতর্ককে তিনি পণ্ডিতি বিতর্কে পর্যবসিত করতে চাইছেন বলে তার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করেন। লু পিং তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। লু পিং তখন ছিলেন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টি ইউনিটের সচিব। তিনি অনেক ছাত্রকে একজোট করে নি-য়ে এবং তার কমরেডদের আক্রমণ করে বলেন নি-য়ে ও তার কমরেডরা পার্টির কর্তৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছেন। যে সমস্ত ছাত্রবৃন্দ তাদের পার্টির নেতাদের মান্য করতো, যারা ভেবেছিলেন এই সমস্ত নেতারা চীনা পার্টি এবং মাও এর প্রতিনিধিত্ব করেন, সেসব ছাত্রদল নি-য়ে ও তার কমরেডদের এক সপ্তাহ ধরে ঘেরাও করে রাখে। ২ জুন চীনা পার্টির সরকারি মুখপত্র পিপলস্ ডেইলিতে নি-য়ে'র প্রাচীরপত্রটি প্রদর্শিত হয় এবং প্রাচীর পত্রটি পিকিং বেতার এর মাধ্যমে সারা দেশে সম্প্রচারিত হয়। বিষয়টি সারা দেশজুড়ে নি-য়ে'র আহ্বানে ছাত্র অভ্যুত্থানের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে। শ্রীমতী নি-য়ে'র আহ্বান ছিল-
‘‘সমস্ত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীবৃন্দ, এখন সময় হয়েছে যুদ্ধযাত্রার। আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাও সে তুং চিন্তাধারার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং মাও সে তুং এর চারপাশে সমবেত হই এবং সংশোধনবাদীদের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ও ফন্দিকে বিচূর্ণ করে দিই।"
লু পিং এই সমস্ত বিদ্রোহী ছাত্রদের দমন করার জন্য ‘কার্যকর টিম’ প্রেরণ করেন। ‘কার্যকর টিম’ এর সদস্যরা বিদ্রোহী ছাত্ররা যেমন শ্লোগান দিয়েছিলো প্রায় তার অনুরূপ স্লোগান চিৎকার করে বলতে থাকে। কিন্তু এগুলো ছিলো রক্ষণশীল পার্টি নেতাদের রক্ষা করার ছলমাত্র। তারা চেয়েছিল জনগণের একাংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। তখন জনগণের নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। ৫০ দিন ধরে পিকিং এবং সিনহুয়া বিশ্বাবিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত সংস্থায় এই ‘কার্যকর টিম’ আধিপত্য চালায়। ১৯৬৬ সালের ৮ আগস্ট ৮ম কেন্দ্রীয় কমিটির ১১তম অধিবেশনে ‘মহান সর্বহারার বিপ্লব বিষয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত’ গৃহীত হয়। এই অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য কর্মসূচী নির্মাণ করা, প্রতিরোধ নিশ্চিহ্ন করা এবং জনগণকে পুনরায় জাগ্রত করা। এই ‘সিদ্ধান্ত’-র তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল "জনগণ নিজেদের শিক্ষিত করে তুলুক"। বলা হয়-
"এই মহান সর্বহারার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একমাত্র পদ্ধতি হলো জনগণ নিজেদের মুক্ত করবে এবং জনগণের হয়ে কাজ করে দেয়ার কোনও পদ্ধতি কিছুতেই ব্যবহার করা চলবে না।’’
ঐ ‘সিদ্ধান্ত’-তে আরও বলা ছিল কেমনভাবে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীসমূহ, কমিটিগুলো এবং অন্যান্য সাংগঠনিক কাঠামোগুলো ‘সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মুখপাত্র হিসেবে’ উপস্থিত হবে। বিপ্লবী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং কমিটিগুলোর নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘সিদ্ধান্ত’ প্যারী কমিউনের কথা উল্লেখ করে। এই অধিবেশনে লিউ শাও-চি পার্টি নেতৃত্বের দ্বিতীয় স্থান থেকে অষ্টম স্থানে অবনমিত হন এবং লিন পিয়াও পার্টির দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেন। একাদশ অধিবেশন চলাকালে ৫ আগস্ট মাও সে তুং লেখেন-
‘‘সদর দপ্তরে কামান দাগো - এই আমার বড় অক্ষরের প্রাচীরপত্র।"
এই লেখাতে তিনি পার্টির সদর দপ্তরের বুর্জোয়াদের সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন-
"গত ৫০ দিন ধরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে নিচের তলার কিছু নেতা বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান গ্রহণ করছেন, তারা বুর্জোয়া একনায়কত্ব চাপানোর চেষ্টা করছেন এবং মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জোয়ারকে রুদ্ধ করছেন।’’
চীনের সর্বত্র বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলো 'রেড গার্ড' নাম নিয়ে তৈরি হতে থাকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Red_Guards
এই লালরক্ষীর কর্মীবাহিনীর মধ্য থেকে লাল রক্ষী আন্দোলন শুরু হয়। পার্টির একাদশ অধিবেশনের সমাপ্তির ছয় দিন পর ১৮ আগস্ট মাও সামরিক পোশাকে আবির্ভূত হয়ে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের মঞ্চে দণ্ডায়মান হন, তার হাতে ছিলো লাল রক্ষীর ফিতা এবং সারা দেশ থেকে জড়ো হওয়া ১০ লক্ষ মানুষ। লাল রক্ষীরা রাস্তায় নেমে শ্লোগান দিতে থাকে। তারা বক্তৃতা দেয়, প্রচারপত্র বিলি করে এবং পোস্টার সাঁটতে থাকে। তারা ‘যা কিছু পুরানো - শোষক শ্রেণীর পুরানো আদর্শ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, অভ্যাস’ তাদের বিরোধিতা এবং উৎপাটনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা শপথ নিয়ে বলে-
"এই সংগ্রাম হলো কর্তৃপক্ষের সেই সমস্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে, তাদের উচ্ছেদের জন্য, যারা ধনতান্ত্রিক পথের পথিক। (এই সংগ্রাম হলো) প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া পণ্ডিতদের ‘কর্তৃত্ব’-র বিরুদ্ধে, বুর্জোয়া এবং অন্যান্য শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যারা শিক্ষাকে, সংস্কৃতি ও শিল্পকে, উপরিসৌধের সমস্ত কিছুকে সমাজতন্ত্রের ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে। (এই বিরোধিতার মাধ্যমে আমরা) সমাজতন্ত্রের বৃদ্ধি এবং তাকে সংহত করার প্রয়াসী।’’
লিউ শাও-চি এবং তার অনুগামীরাও (তাদের ‘বিশ্বস্ত’ বলা হতো) লাল রক্ষী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের চেষ্টা ছিল সাধারণ কর্মীদের বিভ্রান্ত করা এবং রক্ষণশীলদের আড়াল করা। এই সমস্ত ইউনিটগুলো বিপ্লবীদের ইউনিটগুলোর কাছাকাছি ধরনের নাম গ্রহণ করে। এই দুই দল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে তুং চিন্তাধারার নামে শপথ নেয়। দক্ষিণপন্থী লাল রক্ষীরা অতিবাম ছদ্মবেশ ধরে জনগণকে প্রতারণার পদ্ধতি গ্রহণ করে। বিদ্রোহী লাল রক্ষীবৃন্দও সমস্ত স্তর থেকে ক্ষমতার অধিকারীদের হঠিয়ে দেয়ার শ্লোগান তুলে প্রায়শই অতিবাম বিচ্যুতির দিকে ঢলে পড়ে। লালরক্ষীদের অধিকাংশই এসেছিলো যুব-ছাত্র অংশ থেকে, যাদের পেটি বুর্জোয়া ঝোঁক ছিলো। যে সমস্ত যুব-ছাত্ররা সমাজতান্ত্রিক চীনে বড় হয়ে উঠেছিলেন, তাদের পুরো পার্টির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল এবং পার্টির প্রতিটি স্তরের প্রতি তাদের আস্থা ছিল। এদের অনেকে আসল বিষয়টি ঠিক মতো হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিলেন না। বিদ্রোহী গোষ্ঠীবৃন্দ দ্রুত কমিউন এবং ফ্যাক্টরিগুলোতে তাদের ইউনিট তৈরি করে ফেলে; তাদের বিরোধীরাও তাদের এই পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। তারা আরও জঙ্গী নাম গ্রহণ করে এবং ছলনা করার জন্য মাও সে তুং এর সত্যিকার অনুগামী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে। তৃণমূল স্তরের জনগণ প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় এতো গোষ্ঠীর মধ্যে কারা সত্যি সত্যি মাও এর চিন্তাধারার প্রতিনিধি। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে ‘বিশ্বস্ত’ গোষ্ঠী জনগণের মধ্যে তাদের অনুগামীর সংখ্যা বাড়াতে থাকে, এই অনুগামীরা এই গোষ্ঠীর শ্লোগানকে সত্যি ধরে নিয়ে এদের মাও এবং কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি বলে ধরে নেয়। ১৯৬৭-র শুরুতে সাংহাই এর শ্রমিকরা ‘সাংহাই শ্রমিকদের বিপ্লবী বিদ্রোহের সাধারণ সদর দপ্তর’ তৈরি করেন। এর পরই সারা শহর জুড়ে বিপ্লবী সংগঠন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিপ্লবী সংগঠনগুলোর অগ্রগতি রুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে সাংহাই শহরের মেয়র সাও তি-চিউ এবং শহরের পার্টি কমিটি আন্দোলন শুরু করে ‘মাও সে তুং চিন্তাধারা রক্ষার জন্য সাংহাই শ্রমিকদের টকটকে লাল রক্ষী বাহিনী’ নামে। তিয়েন সিন, উহান এবং পিকিং এবং ক্যান্টনে একই ধরনের বাহিনী গড়ে ওঠে। কিন্তু সাংহাই শ্রমিক আন্দোলনের মূল কেন্দ্র থেকে যায়। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরের শেষদিকে বিদ্রোহীরা বলতে থাকে তাদের নিজস্ব পত্রিকা ‘রেড গার্ড ডিসপ্যাচ’ যেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব চীন ব্যুরোর সরকারি পত্রিকা ‘লিবারেশন ডেইলি’-র সঙ্গে একযোগে বিলির ব্যবস্থা করা হয়। পার্টির বিশ্বস্ত অংশ বিদ্রোহীদের এই দাবি মানতে অস্বীকার করে। এতে বিদ্রোহীরা ‘লিবারেশন ডেইলি’র দপ্তর দখল করে প্রকাশনা সংক্রান্ত সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়। ‘শ্রমিকদের সদর দপ্তর’ সংগঠন এবং তাদের বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। প্রচারপত্র, দেওয়াল সংবাদপত্র, ঘোষণা, মাইক সহযোগে বিতর্ক, অনুগামীদের জড়ো করা সংঘর্ষের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পায়। এই অবস্থা চলে আটদিন ধরে। পতন আসন্ন বুঝতে পেরে শহরের পার্টি কমিটি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতায় আসে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু সংবাদপত্রের দপ্তর থেকে রাস্তায় স্থানান্তরিত হয়। বিদ্রোহীরা ৬ লক্ষ মানুষের জনসমাবেশ ঘটায় এবং তাদের একটি নয়া প্রকাশনার জন্য মেয়রের অনুমতি আদায় করে। এই নয়া প্রকাশনার নাম হয় ‘বিদ্রোহী শ্রমিক’। পার্টি কমিটি কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য, শ্রমিকদের সমর্থন পাওয়ার আশায় শ্রমিকদের প্রচুর পরিমাণে অর্থনৈতিক টোপ দিতে থাকে। বিদ্রোহীরা কর্তৃত্বের এই কৌশলকে বাতিল করে একটার পর একটা উৎপাদন ক্ষেত্রের দখল নিতে থাকে। তারা এরপর শহরের দখল নেয়ার উদ্যোগ নেয়। ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৭ সালে চ্যাং চুং-চিয়াও এর নেতৃত্বে ১০ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটে সাংহাইতে; যেখানে জনসমক্ষে সাংহাই শহরের মেয়র সাও এবং পূর্ব চীনের ব্যুরো প্রধান চেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zhang_Chunqiao
পুরানো পার্টি কমিটি ভেঙে দেয়া হয় এবং চীনের বৃহত্তম শহর ও শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকরা ক্ষমতা দখল করে। ৯ জানুয়ারি ৩২টি সংগঠন যৌথভাবে ‘গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি’ জারি করলো। নতুন সরকার গড়ার লক্ষ্যে এটি কয়েকটি নিয়মনীতি ঘোষণা করলো যা সমস্ত চীনা সংবাদপত্রে ছাপা হলো। মাও একে একটি আদর্শ হিসাবে অভিনন্দন জানালেন। ২২ জানুয়ারি জেন মিন জিপাও লিখলো-
‘‘নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নিতে যতগুলো পদ্ধতি আছে শেষ বিচারে তার একমাত্র পদ্ধতি ক্ষমতা দখল! যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তাদের সব কিছুই আছে। যাদের ক্ষমতা নেই তাদের কিছুই নেই। আমরা শ্রমিক, কৃষক এবং সৈন্যবাহিনী হচ্ছি এই বিশ্বের প্রভু!’’
সারা শহর জুড়ে শ্লোগান উঠলো-
"কম্যুনের হাতে সব ক্ষমতা চাই!’’
দশ লক্ষ মানুষের এক মিটিং এ ৫ ফেব্রুয়ারি কমিউন ঘোষিত হলো। শ্রমিকরা ঘোষণা করলেন-
"ক্ষমতার নতুন আধার সৃষ্টি হয়েছে চেয়ারম্যান মাও এর মতবাদ অনুসারে এবং শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের নীতি অনুসারে।’’
সাংহাই এর শ্রমিকদের দ্বারা ক্ষমতা দখল থেকে লিউ এর অনুগামীরা বুঝতে পারলো সংগ্রামকে আর বিতর্ক এবং স্বরূপ উন্মোচনের সীমায় বেঁধে রাখা যাবে না। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অর্গল খুলে গেছে। বিদ্রোহীদের এই প্রচেষ্টা রুখে দেয়ার জন্য তারা তিনটি উপায় অবলম্বন করে। বিপ্লবকে বিপথগামী করার জন্য অর্থনীতিবাদকে অবাধে প্রশ্রয় দেয়া, সত্যিকারের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা আটকে দেয়ার জন্য ভুয়া ক্ষমতা দখল এবং সশস্ত্র শক্তির ব্যবহার। এসময় ‘তিন সমর্থন এবং দুই নিয়ন্ত্রণ’ প্রয়োগে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে গণমুক্তিবাহিনী নিয়োগ করার জন্য মাও এবং লিন পিয়াও এর সিদ্ধান্ত হলো। তিন সমর্থন হলো শিল্প, কৃষি ও বামপন্থীদের সমর্থন; দুই নিয়ন্ত্রণ হলো সংঘাত জর্জর প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং ছাত্রদের রাজনৈতিক-সামরিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ। সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল, দোকান, কারখানা, খনি এবং গ্রামগুলোতে ২৮ লক্ষ সেনা অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের পাঠানো হলো। মাও সে তুং এর সপক্ষে গণমুক্তিবাহিনীর প্রচার টিম অবতীর্ণ হলো। তাদের কাজ হলো প্রকৃত বাম কমিটিগুলোকে চিহ্নিত করা এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ একশনের জন্য চালিত করা। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো জন্মের মাত্র কুড়ি দিনের মাথায় সাংহাই বিপ্লবী কমিটি দিয়ে সাংহাই কমিউনকে প্রতিস্থাপিত করা। অন্যান্য শহরের কমিউনগুলোতেও একই কাজ করা হলো। ‘বিপ্লবী কমিটি’র মূল বৈশিষ্ট্য কী? মাও বলেন-
"বিপ্লবী কমিটির মূল অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই রকম - তারা ত্রিস্তরীয়: তারা বিপ্লবী কর্মীদের প্রতিনিধি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং বিপ্লবী জনতার প্রতিনিধি। এটা বিপ্লবী ‘একের-মধ্যে-তিন’ সমন্বয় সাধন করে। বিপ্লবী কমিটিকে ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব দিতে হবে, অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাঠামো বাতিল করতে হবে। ‘সহজ প্রশাসন এবং অধিক উন্নত সৈন্যবাহিনী’ এই নীতি অনুসরণ করতে হবে এবং জনগণের সাথে সংযোগ রাখে এমন বিপ্লবী অগ্রণী গ্রুপ সংগঠিত করতে হবে।’’
চৌ এন লাই এর সভাপতিত্বে ১৯৬৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির পলিটব্যুরো মিটিং এ পলিটব্যুরোর বিরাট সংখ্যক সদস্য এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করে ফেটে পড়লো-
সাংস্কৃতিক বিপ্লব কি কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বারা পরিচালিত হবে না অন্য কিছু দিয়ে? সমস্ত বয়স্ক কমরেডদের ছুঁড়ে ফেলা কি সঠিক কাজ? সেনাবাহিনীতে সুস্থিতি রক্ষা করা কি প্রয়োজনীয় নয়?
উপপ্রধানমন্ত্রী তান ঝেনলিন সাংহাইতে প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করার জন্য চ্যাং চুন চিয়াওকে অভিযুক্ত করলেন এবং যে ভয়ংকর সব ভুল একের পর এক করে যাওয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে তিক্ত সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। তাতে যদি তার পার্টি থেকে বহিষ্কার, জেল বা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যায় তা-ও তিনি এটা করবেন! ১৮ ফেব্রুয়ারির এক মিটিং এ মাও পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যে প্রচেষ্টা করছেন তার তীব্রভাবে নিন্দা করলেন। এতে মাও এর অনুসরণকারীরা প্রতিবিপ্লবী স্রোতকে প্রতিহত করার জন্য দেশব্যাপী প্রচারাভিযানে নামে। এই সংকট মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে ব্যতিক্রমী ক্ষমতা দেয়া হয়। ‘কমিউন এর হাতে সব ক্ষমতা চাই’ শ্লোগানটি উবে যায়।
Comments