ভারত বিদ্বেষিতার রাজনৈতিক কারণ

 

ভারতীয় বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল। ২১শে জানুয়ারী, ১৯৭২ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাংবাদিক মার্টিন ঊলাকট Indians 'loot whole factory' শিরোনামে লিখেছেন-

“Systematic Indian army looting of mills, factories and offices in Khulna area has angered and enraged Bangladesh civil officials here. The looting took place in the first few days after the Indian troops arrived in the city on December 17.”

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Martin_Woollacott

https://theguardian.newspapers.com/article/the-guardian/138813272/?locale=en-US

ঐসময় খুলনার ডিসি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট সচিব ডক্টর কামাল সিদ্দিকী। তিনি তখন ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখে বলেছিলেন কেবল খুলনা থেকেই প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টাকার পরিমাণ সম্পত্তি লুটপাট করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। কামাল সিদ্দিকী পরবর্তীতে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে করা তার পিএইচডি থিসিসে বাংলাদেশের দরিদ্রতার কারণ হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার থিসিসটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে বই আকারে বের হয়। ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র এবং ৮৭টি ট্যাংক নিয়ে যায়, যার মুল্য ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। 'অনিক' নামে ভারতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকার বরাতে কামাল সিদ্দিকি আরো লিখেন ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের মধ্যে অস্ত্র ছাড়াও ছিল মজুদকৃত খাস্য শস্য, কাঁচা পাট, সুতা, গাড়ি, জাহাজ, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিন ও যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য। কামাল সিদ্দিকীর মতে সব মিলিয়ে কম করে ধরলেও কেবল খুলনা জেলা থেকেই এই লুটপাটের পরিমাণ ছিল তৎকালীন হিসেবে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!

[The political economy of rural poverty in Bangladesh]

https://eprints.soas.ac.uk/28560/1/10672719.pdf

ভারতীয়দের এসমস্ত কর্মকান্ডের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখতে হয় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ, যেখানে ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ - যার মূল্য ঐসময় ছিলো ২৭ হাজার কোটি টাকা, তার সবই ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৫টি বিশাল জাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে লুট করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের শত শত মিল কারখানার যন্ত্রপাতি, ব্যাংক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ঘর-বাড়ির গৃহস্থালী জিনিসপত্র পর্যন্ত বাদ যায়নি ভারতীয় লুটেরাদের হাত থেকে। এসব সম্পদ ও দ্রব্যাদির তখনকার মূল্য ছিলো ৯০ হাজার কোটি টাকা। শৌচাগারের বদনাগুলোও বাদ দেয়নি ভারতীয় লুটেরার দল। এছাড়া যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রদত্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য লুট করে নিয়ে যায় ভারত। বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুন্ঠনের ব্যাপারে আজিজুল করিম ‘হোয়াই সাচ এন্টি ইন্ডিয়ান ফিলিংস এমং বাংলাদেশী?’ শিরোনামের নিবন্ধে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ভারতীয় মাসিক ‘অনিক’ এর রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন-

“ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য ছিল প্রায় ১শ’ কোটি মার্কিন ডলার।”

বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুণ্ঠনের ব্যাপারে ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ পুস্তকে সালাহউদ্দিন আহমদ লিখেছেন-

“যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ভারতীয় সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিক সময় অবস্থান করতে থাকায় ভারত সমালোচিত হতে থাকে। অভিযোগ করা হয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্রাক বহরে করে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ভারত বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশালী রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় এমন একটি আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও সংশয় সৃষ্টি হয়।”

https://books.google.com.bd/books?id=Szfqq7ruqWgC&printsec=frontcover&redir_esc=y#v=onepage&q&f=false

মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক জয়নাল আবেদীনের ‘র এন্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে লেখা একটি বইয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুন্ঠনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

https://pdfcoffee.com/raw-and-bangladesh-pdf-free.html

বইটিতে তিনি লিখেছেন-

“পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক লুটতরাজ দেখতে পেয়ে ভারতের প্রকৃত চেহারা আমার কাছে নগ্নভাবে ফুটে উঠে। ভারতীয় সৈন্যরা যা কিছু দেখতে পেতো তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো এবং সেগুলো ভারতে বহন করে নিয়ে যেতো। লুটতরাজ সহজতর করার জন্য তারা আমাদের শহর, শিল্প স্থাপনা, বন্দর, সেনানিবাস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এমনকি আবাসিক এলাকায় কারফিউ জারি করে। তারা সিলিং ফ্যান থেকে শুরু করে সামরিক সাজসরঞ্জাম, তৈজষপত্র ও পানির ট্যাপ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যায়। লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পরিবহনের জন্য হাজার হাজার সামরিক যান ব্যবহার করা হয়।”

বইটির আরেকটি অংশে তিনি লিখেছেন-

“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটি তার নিজের স্বার্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়, আমাদের স্বার্থে নয়।”

তথাকথিত সাহায্যের কারণ-

১. পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল করার লক্ষ্যে দুই টুকরো করতে পারলে ভারতের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা, ভারত ভালোভাবেই জানতো পূর্ব পাকিস্তানের আয় (পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, চামড়া, নিউজপ্রিন্ট ও আরো অন্যান্য পন্য রপ্তানী বাবত বিপুল বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন) দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনীতির চাকা সচল রাখা হতো।

২. পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে সামরিক দিক দিয়েও লাভবান হবে ভারত, ভারতকে আর তার পূর্রাঞ্চলে (ইস্টার্ন সেক্টরে) সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখতে হবে না, পুরো সামরিক শক্তি তখন ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে (ওয়েস্টার্ন সেক্টরে) পাকিস্তানের বিপরীতে প্রস্তুত রাখা যাবে।

৩. ভারত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে এমনভাবে ভারত নির্ভরশীল করে তুলবে এবং বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনীতি ও অর্থনীতির মূল শক্তিগুলোকে এমনভাবে ধ্বংশ করে দিবে যাতে বাংলাদেশ অনেকাংশে ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পাট ও চা শিল্প আরো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে এখন এই বাজার একচেটিয়া ভারতের দখলে চলে গেছে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এবং জনশক্তি রপ্তানী খাত ভারতের তীব্র প্রতিযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিনত হয়েছে।

৪۔ উজানে বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদীকে মরুভূমি বানিয়ে বাংলাদেশের কৃষি, জলবায়ূ ও প্রকৃতিকে ইতিমধ্যেই ধ্বংশের শেষ সীমায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভারতের জন্য কোন হুমকী হবে না, বরং ভারতের লাভ হবে এবং কার্যত ভারতই বাংলাদেশের জন্য হুমকী হয়ে থাকতে পারবে। এসব হিসাব-নিকাশ সঠিকভাবে করেই ভারত ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে পৃথক তথা স্বাধীন বাংলাদেশ হতে সাহায্য করেছিল।

কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা ব্যারেজের প্রধান স্থপতি ছিলেন। নেহেরু সরকার এই পরিকল্পনা হাতে নেয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গের আমজনতাকে বুঝিয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ তৈরী করে নাকি কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো হবে অতিরিক্ত পানি ভাগীরথী খাত দিয়ে প্রবাহিত করার মাধ্যমে! এই স্থপতি একটি পুস্তিকার মাধ্যমে আসল পরিস্থিতি তুলে ধরলে ভারত সরকার তাকে বিনা বিচারে জেলে আটক করে রাখে এবং দেয়ালে দেয়ালে প্রচারপত্র সেঁটে বিরুদ্ধতাকারীদের হুমকি দেয়।

কেন ভারত আমাদের ২৬ শে মার্চ এর পর পরই সাহায্য করলো না, যদি সত্যই তারা আমাদের সাহায্য করতে চাইতো?

রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ছিলেন না কেন? তাকে কি আসতে বাঁধা দেয়া হয়েছিল?

কেন মুক্তিযোদ্ধারা ৯০ ভাগ অঞ্চল মুক্ত করার পর ভারত ডিসেম্বরের ৩ তারিখ আক্রমণ করলো?

জর্জ হ্যারিসনের 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' ও এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ সহ বিশাল পরিমাণ ফান্ডের টাকা কোথায় গেলো? ভারত কি হিসেব দিয়েছিল?

কেন রাশিয়ার দেয়া অস্ত্র ভারত নিজেদের দেয়া বলে চালিয়ে নিয়েছিল?

'ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড এফেয়ার্স' এর এক সেমিনারে 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব স্ট্রেটেজিক স্টাডিজ' এর পরিচালক সুব্রামানিয়াম বলেছিলেন-

"ভারতের উপলব্ধি করা উচিত যে পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়াতে ভারতের স্বার্থ নিহিত রয়েছে। এ ধরনের একটা সুযোগ আবার কখনো না-ও আসতে পারে।"

তিনি এই সুযোগকে 'চান্স অব দ্য সেঞ্চুরি' বলে আখ্যায়িত করেন। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড শেখ মুজিবকে জানান যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে মার্কিনিরা পশ্চিম পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন হারাবে।

এক শ্রেণীর মুক্তমনা দাবিদারদের একটা কমন প্রচারণা হচ্ছে বাংলাদেশীরা ভারতীয়দের ঘৃণা করলেও তাদের দেশেই চিকিৎসার জন্য যায়। উল্লেখ্য, ভারত সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আয় করে এই বাংলাদেশ থেকেই। অমর্ত্য সেন এর 'ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা' বইটা থেকে কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক যা থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশী ছাড়াও আশেপাশের দেশগুলোর অধিবাসীদের সেদেশের চিকিৎসা খাতে খরচ করা অর্থ কিভাবে কর্পোরেট জোঁকেদের পকেট ভর্তি করছে আর দরিদ্র ভারতীয়রা কতটা অসহায় অবস্থায় আছে। ভারতে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক খরচ মাত্র ৩৯ ডলার। সরকার সামরিক ক্ষেত্রে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করলেও জিডিপির মাত্র ১۔২% খরচ করে এই খাতে। দেশটির স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় মাত্র ২৯% আর বাকিটা যায় জোঁকেদের পকেটেই। এজন্যই দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পৃথিবীর সর্বাধিক বাণিজ্যায়িত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলোর অন্যতম। দেশটির ব্যবসায়ী বান্ধব বুর্জোয়া সরকারগুলোর দরিদ্র ভারতীয়দের বীমা কোম্পানি আর কর্পোরেট মালিকদের ক্লিনিকগুলোতে বলির পাঠা বানিয়ে তাদের পকেট ভর্তির প্রকল্পের ব্যাপারটা তো আছেই।

আদানি গ্রূপ মূলত গুজরাটভিত্তিক ব্যবসায়ী গ্রূপ। মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় এদের ডোনেশনের পরিমাণ ছিল বিশাল। মোদি তাদের এই অবদানের কথা স্মরণে রেখেই বাংলাদেশে আসার পর তাদের কাজ পাইয়ে দেন। আদানি গ্রূপ ভারতের নিম্ন মানের কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এদেশে রফতানি করবে এবং রিলায়েন্স গ্রূপ তৈরী করবে এলএনজি প্লান্ট। অথচ অবকাঠামো ও বিদ্যুতের লাইন টেনে নেয়ার দায়িত্ব হবে বাংলাদেশ সরকারের! তথ্যের স্বচ্ছতার ব্যাপারে গালভরা বুলি আউড়ে গেলেও সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম কিংবা চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। মোদি এদেশে আসার পর যে ২০০ কোটি ডলার ঋণ বাংলাদেশকে দেয়ার কথা বলেছিলেন ঐ ধরণের ঋণকে বলা হয় সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট। এই সিস্টেমে ৫০,০০০ ভারতীয় ঋণ গ্রহণের পর নির্দিষ্ট খাতগুলোতে চাকরি পাবে (টাইমস অব ইন্ডিয়া)! কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। একসময় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো অন্য দেশকে যে সিস্টেমে ঋণ দিতো সেটাকে বলা হতো বার্টার ট্রেড, যেখানে ঋণ গ্রহণকারী দেশ থেকে বিনিময়ে পণ্য নেয়া হতো। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদুভেন্দ্র মাথুরের টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ভারত এই সিস্টেমে নেপাল, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপকে ঋণের জালে ফাঁসিয়েছে। বাংলাদেশের পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির কাজও বাগিয়ে নিয়েছে এই আদানি গ্রূপ।

আন্তর্জাতিক নিয়মে কোনো দেশের বানিজ্যিক বিমান অন্য দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করলে অন্তত ৫০০ ডলার ফী দিতে হয় ঐ দেশকে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করলে ৯৫℅ বানিজ্যিক বিমানকে বাংলাদেশকে কোনো ডলার দিতে হয় না। উল্টো বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করে চার্জ পায় ভারত। ভারতের রাডার থেকে সিগনাল রেজিস্ট্রার করা হয় বলে এসব বিমান থেকে বাংলাদেশের আকাশ সীমা ব্যবহারের সকল অর্থ পায় ভারত। জিয়াউর রহমানের আমলে (১৯৮০) শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের একমাত্র বেসামরিক রাডারটি বসানো হয় ও কমিশন করা হয়। এই একটি মাত্র রাডার দিয়ে বাংলাদেশের আকাশ পাহারা দেয়া হচ্ছে এখনো! ৪৪ বছরের পুরাতন রাডারটি অনেক বছর আগেই এক্সপায়ার হয়ে গেছে, এখনও বারবার মেরামত করে প্রথম প্রজন্মের এই রাডার ব্যবহার করতে হয়। এতো পুরাতন রাডার দক্ষিণ এশিয়ায় শুধুমাত্র বাংলাদেশই ব্যবহার করে, যার কার্যক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানদন্ডে প্রশ্নের মুখে বহুদিন থেকে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের জন্য নতুন একটি ৪র্থ প্রজন্মের  রাডার কেনা হয়। রাডারটি ২০১৭ সালে স্থাপন করা হলেও এখন পর্যন্ত চালু করে কমিশন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের কারণেই এই রাডার সচল করা হচ্ছে না। রাডারটি বসানোর সময়ও ভারত আপত্তি জানায়। অথচ ভারত তাদের রাডার ব্যবহার করে বাংলাদেশের আকাশ সীমায় ভাড়া গুনছে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো থেকে, যার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলারর উপরে। উল্লেখ্য, ভারতের নাগরিকদের প্রতিদিন গড়ে একশোর উপর বিমানে বাংলাদেশের আকাশ সীমা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রদেশে যাতায়াত করতে হয়।

মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান ভিয়েতনামে নিয়োজিত মার্কিনিদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন ভিয়েতকং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। ইনিই আবার মুজিববাহিনীকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবীদের খুন করতে। আর ঐ ট্রেনিং এর ব্যয়ভার সম্পূর্ণ বহন করেছিল মার্কিনিরা। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়কালব্যাপী অসংখ্য বিপ্লবী হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চট্টগ্রামের নাপোড়া পাহাড়ের ঘটনাটি। মুজিববাহিনী ঘুমন্ত অবস্থায় কৃষক নেতা প্রাণকুমার ভট্টাচার্য, আবু সাদেক, কমান্ডার জাহেদ, ডাক্তার তুহীন, এম۔ এ۔ মোস্তফা চৌধুরী, মামুন, হাবিলদার রুস্তম, আসাদুল্লাহ, বজল আহমদ, নূরুল ইসলাম, আবুল হাশেম, কালু মিয়া, শের আলী, আমানত খান চৌধুরী, আলী আহমদ ও জামাল আহমদ চৌধুরীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অন্তত চারটি ডিভিশনের অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, গোলাবারুদ, যানবাহন ও অন্যান্য সরঞ্জাম ভারতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিবাদ করলে টোকেন হিসেবে অল্প কিছু পুরানো অস্ত্র ফেরত দেয়া হয়।

এতো কিছু নিয়ে যাবার পরও ব্রিগেডিয়ার র‍্যাঙ্কের অফিসার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ট্রাকে ভর্তি করে ভারতে পাচার করে। একজনকে ভারতীয় বাহিনী এই লুটের অপরাধে কোর্ট মার্শালও করে, তার নাম ব্রিগেডিয়ার মিশ্র।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/B._D._Mishra

উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার 'পূর্ব পশ্চিম' উপন্যাসে লিখেছেন-

“ঢাকায় এতসব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়, এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার - এইসব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে।”

পাকিস্তানি বাহিনীর পরিত্যক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক যান, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ অনেক মুল্যবান জিনিস এমনকি প্রাইভেট কার পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাথরুমের আয়না এবং ফিটিংসও সেই লুন্ঠন থেকে রেহাই পায়নি। নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল তখন খুলনায়, তিনি প্রাইভেট কার যা পেলেন তা রিকুইসিজন করে সার্কিট হাউজে মুক্তিযোদ্ধাদের তত্বাবধানে রেখে কিছু সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করেন। ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধে এই সেক্টর কমান্ডার জনগনকে সাথে নিয়ে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। ৩১শে ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হন। যশোর সেনা ছাউনির অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে তাকে আটক রাখা হয়। বাড়িটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন সেল। বাড়িটি অন্ধকার, রুমে মানুষের রক্তের দাগ, এলোমেলো ছেড়া চুল, কিছু নরকংকাল সাথে শকুন আর শেয়ালের উপস্থিতির মধ্যে একটা খাটে ডিসেম্বরের শীতের রাতে আধা ছেড়া কম্বল গায়ে দিয়ে দেশের প্রথম রাজবন্দী বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল শুনতে পেলেন পাশেই ভারতীয় সেনাদের বর্ষবরনের উল্লাস, নাচের ঘুঙুরের শব্দ আর সেইসাথে নারী-পুরুষের হল্লা। জলিলের সঙ্গে সেদিন ভারতীয় বাহিনী আরো গ্রেপ্তার করে একই সেক্টরের আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত নৌবাহিনীর প্রাক্তন লিডিং সী ম্যান সুলতানউদ্দিন আহমেদ ও মো: খুরশিদ। বাকী দুইজন খালাস পেলেও জলিলের কোর্ট মার্শাল হয়। সেই সামরিক আদালতের বিচারক ছিলেন আরেক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের। বিচারে জলিল নির্দোষ প্রমাণিত হন। মেজর জলিল নিজে থেকেই এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

এ পি জে কালাম সাহেব নিজের বইগুলোতে দারুন দারুন কথা লিখে গেলেও বাস্তব জীবনে এই নৈতিকতার ছিটেফোঁটাও ছিল না, অন্তত বাংলাদেশের প্রতি। তাঁর কাছে 'নৈতিকতা' শব্দটা কেবল প্রযোজ্য ছিল নিজের দেশের জন্যই। ঠিক যেমন নাৎসীরা নিজেদের কর্মকান্ডকে 'দেশপ্রেম' এর অংশ হিসেবে মনে করতো। ঠিক যেমন ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী সেভেন সিস্টার্স, কাশ্মীর, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি জায়গায় নানা বর্বরতা চালালেও তাদের 'হিরো' হিসেবে ভাবতে আমজনতার মগজ ধোলাই করা হয়। ২০০২ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আন্ত:নদী সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করতে বিভিন্ন কার্যক্রমের সূচনা করেন। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০৩ সালে টিপাইমুখ বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা রাজ্যসভায় পাশ হয়। 

আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-

'প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে।'

একই নীতিমালার ১৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-

'প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে।'

১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নাম্বার নীতিতে বলা হয়েছে-

'পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে।'

১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত 'পানি প্রবাহ কনভেনশন' নীতিমালার ৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা'র কথা বলা হয়েছে।

পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নাম্বার অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নাম্বার অনুচ্ছেদ ইত্যাদি জায়গায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার সেসব নির্দেশকে কাঁচকলা দেখিয়েছে বছরের পর বছর তিস্তার ক্ষেত্রে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের রুদ্র কমিশন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমার রায় বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদানের সুপারিশ করলেও 'জোর যার মুল্লুক তার' নীতিই অনুসৃত হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]