সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও স্তালিনের ভ্রান্তি [পর্ব-পাঁচ]

 

মাও স্পষ্টভাবে বলেছেন-

"সর্বহারার একনায়কত্বকে সংহত করা, পুঁজিবাদী পুন:প্রতিষ্ঠা রোধ করা এবং সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য বর্তমান মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী।"

মার্কস জে ওয়েডেমেয়ারকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন-

‘‘আমার কথা যদি বলেন, আধুনিক সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব অথবা তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে আবিষ্কার করা আমার কোনো কৃতিত্ব নয়। আমার অনেক আগে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা শ্রেণীসংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা করেছেন অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাসের বর্ণনা। আমি নতুন যা করেছি তা হলো প্রমাণ করা যে (১) শ্রেণীর অস্তিত্ব একমাত্র সেই বিশেষ ঐতিহাসিক পর্বের উৎপাদন এর বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত, (২) শ্রেণীসংগ্রাম অবধারিতভাবে সর্বহারার একনায়কত্বের জন্ম দেয় (৩) সেই একনায়কত্ব নিজেই আসলে একটি রূপান্তর পর্ব - সমস্ত ধরনের শ্রেণীর অবসান থেকে একটি শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থায়।’’

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Joseph_Weydemeyer

https://www.marxists.org/archive/marx/works/1852/letters/52_03_05-ab.htm

‘গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা’য় মার্কস বলেন-

‘‘পুঁজিবাদী এবং কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থার মাঝখানে থাকে একের থেকে অন্যে রূপান্তরীকরণের পর্যায়। সেই অনুযায়ী এটি একটি রাজনৈতিক রূপান্তর পর্ব যেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না।’’

লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ এ বলেছেন-

‘‘যারা শুধুমাত্র শ্রেণীসংগ্রামকে স্বীকার করে তারা এখনও মার্কসবাদী নয়; তাদের এখনও দেখা যাবে বুর্জোয়া ভাবনা আর রাজনীতির গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে একমাত্র সে-ই মার্কসবাদী যে শ্রেণীসংগ্রাম থেকে সর্বহারার একনায়কত্ব - এক স্বীকৃতি দেয়। এটাই একজন মার্কসবাদীর সঙ্গে একজন সাধারণ পাতি (ও বড়) বুর্জোয়ার তফাৎ গড়ে দেয়।’’

মার্কসের কাছে, প্যারী কমিউন হলো সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ রচনায় তিনি বলেন-

‘‘মূলগতভাবে এটি ছিল একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রব্যবস্থা, ভোগকারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে উৎপাদনকারী শ্রেণীর সংগ্রামের ফসল, অবশেষে আবিষ্কৃত রাজনৈতিক কাঠামো যার অধীনে ঘটাতে হবে শ্রমের মুক্তি: শেষের শর্তটি ব্যতিরেকে কমিউনের সংবিধান হতো অবাস্তব এবং একটি প্রতারণা মাত্র। উৎপাদনকারীর রাজনৈতিক শাসন আর তার অপরিবর্তিত সামাজিক দাসত্ব কখনই একসঙ্গে চলতে পারে না।’’

সর্বহারার একনায়কত্বের মূর্তরূপ প্যারী কমিউন ছিল উৎপাদনকারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। মার্কস এখানে জোর দিয়েছেন উৎপাদনকারীর রাজনৈতিক শাসনের ওপর, তার মতে এটাই হলো অবশেষে আবিষ্কৃত সেই রাজনৈতিক কাঠামো যার অধীনে থেকে অনুসন্ধান করতে হবে শ্রমের অর্থনৈতিক মুক্তির। ঐ পুস্তকে মার্কস ব্যাখ্যা করেছেন-

‘‘শ্রমের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মানুষই হবে একজন কর্মী এবং উৎপাদনমুখী শ্রমের কোনো বিশেষ শ্রেণীকর্ম আর থাকবে না।’’

মার্কসের মতে শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার পথে উৎপাদনকারীর রাজনৈতিক শাসন (ক্ষমতা দখল) হলো অপরিহার্য যুগ পরিবর্তন পর্ব। মার্কসের উপলব্ধি অনুযায়ী উৎপাদনকারী শ্রেণী যত দৃঢ়ভাবে শ্রেণী একনায়কত্ব কায়েম করতে পারবে অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবে সেটাই হবে সমাজতন্ত্রের সাফল্যের মাপকাঠি। ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ বইতে মার্কস বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন কেমন করে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বহারার একনায়কত্বের অধীনে কাজ করতে পারে, প্যারী কমিউনের মধ্য দিয়ে যা প্রকাশ পেয়েছিল।

‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ থেকে বইতে বলা হয়েছে-

‘‘অতএব, কমিউনের প্রথম ঘোষণা ছিল চালু সেনাবাহিনীর বিলোপ এবং সশস্ত্র জনগণের দ্বারা সেই স্থান পূরণ।’’

‘‘সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত দায়িত্বশীল এবং প্রত্যাহারযোগ্য মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলরদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল কমিউন যেখানে পদগুলো ছিল স্বল্প মেয়াদী। কমিউনের বেশীরভাগ সদস্য ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিক অথবা শ্রমিক শ্রেণীর অনুমোদিত প্রতিনিধিবর্গ।’’

‘‘পার্লামেন্টের বদলে কমিউন ছিল এমন একটি ক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান যা একইসঙ্গে কার্যনির্বাহী এবং আইন প্রবর্তক।’’

‘‘অবিলম্বে পুলিশের রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের কমিউনের দায়িত্বশীল এবং প্রয়োজনে প্রত্যাহারযোগ্য প্রতিনিধিতে পরিণত করা হলো। একই ব্যবস্থা নেয়া হলো প্রশাসনের সমস্ত শাখার কর্মকর্তাদের।’’

‘‘কমিউন সদস্য থেকে শুরু করে নীচের তলায় জন পরিষেবায় নিযুক্ত সকলেই কাজ করবেন শ্রমিকদের পারিশ্রমিক অনুযায়ী। উচ্চ পদাসীন ব্যক্তিদের বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে কায়েমী স্বার্থ এবং রাষ্ট্রের উচ্চ পদাধিকারীদের প্রতিনিধিত্বমূলক ভাতাও বিলুপ্ত হলো।’’

‘‘শুধু মিউনিসিপ্যাল প্রশাসন না, এতদিন ধরে যে সমস্ত উদ্যোগ রাষ্ট্র নিয়ে এসেছে সেসব কমিউনের হাতে ন্যস্ত হলো।’’

"যাজকদের ক্ষমতার দমনপীড়নের আধ্যাত্মিক দুর্গগুলো ভাঙবার জন্য উদ্বিগ্ন কমিউন এর মূল সম্পত্তির অধিকারী সংস্থা চার্চগুলোকে ভেঙে দিয়ে তাদের বৃত্তি বন্ধ করে দিলো।’’

‘‘সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনা খরচে শিক্ষার জন্য জনগণের সামনে খুলে দেয়া হলো এবং গির্জা ও রাষ্ট্রের যাবতীয় খবরদারি বন্ধ করা হলো।’’

‘‘অন্যান্য সমস্ত জনপ্রতিনিধিদের (পরিষেবা কর্মচারীদের) মতই ম্যাজিস্ট্রেট এবং জজরাও হবেন নির্বাচিত, দায়িত্বশীল এবং প্রত্যাহারযোগ্য।’’

এই সর্বহারার একনায়কত্বের সংক্ষিপ্ত রূপ ছিল ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ এ রাজনৈতিক ধারণা রূপে, যা বাস্তবে পরিণত হলো প্যারী কমিউন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কমিউনিস্ট ইস্তেহারে যেভাবে দেখা হয়েছিল, প্যারী কমিউন হলো সেই ‘সর্বহারার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল’ এর মূর্ত অভিজ্ঞতা; শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের প্রথম ধাপ’ যার অভিমুখ, মার্কস এবং এঙ্গেলসের মতে ‘‘সর্বহারাকে শাসক শ্রেণীর পর্যায়ে তোলা, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে জয়যুক্ত হওয়া"। প্যারি কমিউন থেকে শিক্ষা নিয়ে লেনিন এই চর্চা অব্যাহত রাখলেন এবং সর্বহারার একনায়কত্বের তত্ত্বের আরও বিকাশ ঘটালেন। ‘সর্বহারার বিপ্লব এবং দলত্যাগী কাউটস্কি’ বইটিতে তিনি বলেছিলেন-

‘‘রাশিয়াতে সোভিয়েতগুলো হলো সর্বহারা একনায়কত্বের একটি রাশিয়ান রূপ। যদি কোনো মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সর্বহারার একনায়কত্ব বিষয়ে প্রকৃত গবেষণা করে একটি লেখা তৈরি করতেন, তাহলে প্রথমে তিনি একনায়কত্বের একটি সাধারণ সংজ্ঞা নিরূপণ এবং তার বিশেষ জাতীয় কাঠামো এই সোভিয়েতগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করে তাদের সর্বহারার একনায়কত্বের একটি ধরণ বলে নিশ্চয়ই মতামত দিতেন।’’

এই বইতে তিনি আরও বলেন-

‘‘এই সোভিয়েতগুলো হলো শ্রমজীবী এবং বঞ্চিত মানুষদের একেবারে নিজেদের সংগঠন যেগুলো তাদের সংগঠিত হতে এবং নিজেদের রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য সমস্ত দিক দিয়ে পরিচালনা করতে সাহায্য করেছে।’’

সোভিয়েতের কর্তব্য সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা করেন-

‘‘কিন্তু এটা (সোভিয়েত ক্ষমতা) সমাজতন্ত্রের জন্য রাস্তা করে দেয়। এতকালের বঞ্চিত মানুষদের সুযোগ করে
দেয় মেরুদণ্ড এতটাই সোজা করে দাঁড়াবার যে তারা দেশের পুরো সরকার, পুরো অর্থনৈতিক পরিচালনা, উৎপাদনের পুরো ব্যবস্থাপনা তাদের নিজেদের হাতে নিতে পারে।’’

লেনিনের মতে-

‘‘সোভিয়েত ক্ষমতা যে সমাজতন্ত্রের অভিমুখী সেটা আবিষ্কার করেছিলেন শ্রমজীবী মানুষেরাই এবং সেই কারণেই এটাই প্রকৃত রাস্তা, সেই কারণেই এটি অজেয়।’’

রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক) এর অষ্টম পার্টি কংগ্রেসের খসড়া কর্মসূচী তৈরির সময় লেনিন সর্বহারার একনায়কত্ব গঠনের কর্তব্যটি সামনে রাখলেন-

‘‘সোভিয়েত ক্ষমতা (জনগণের) ঐ সংগঠনটিকে সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি রূপে দাঁড় করিয়েছে, স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয়, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। একমাত্র এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের (শ্রমজীবী মানুষ) পক্ষে গণতন্ত্র অর্জন করা সম্ভব, তা হলো রাজ্য পরিচালনায় বাস্তব অংশগ্রহণ।’’

‘‘অগ্রণী শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামীণ সর্বহারা ও আধা সর্বহারাদের সর্বাপেক্ষা পশ্চাদপদ ও অসঙ্ঘবদ্ধ জনসাধারণকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ করছে।"

‘‘প্রকৃত গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন, তা হলো সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের সমানাধিকার এবং সমাজের সদস্য তালিকা থেকে সেসব শোষকদের বের করে দেয়া যারা সমস্ত ধরনের অধিকার ভোগ করতো।’’

‘‘রাষ্ট্র কাঠামো এবং প্রশাসনে শ্রমজীবী জনগণের আরও প্রত্যক্ষ প্রভাব নির্বাচন প্রক্রিয়ার দ্বারা, আরও ঘন ঘন নির্বাচন সংঘটনের সম্ভাবনার দ্বারা এবং পুনর্নির্বাচন ও প্রতিনিধি প্রত্যাহারের দ্বারা।"

‘‘রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে অগ্রণী সর্বহারা জনগণের ঘনিষ্ঠতর সংযোগ।"

‘‘শ্রমিক এবং কৃষকদের সশস্ত্র বাহিনী গঠন, যেটি আগের থেকে শ্রমজীবী ও শোষিত মানুষদের অনেক কাছাকাছি।’’

‘‘একই সময়ে সোভিয়েত ক্ষমতা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করলো বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সেসব নেতিবাচক দিকগুলোকে যেগুলো প্যারী কমিউন বিলোপ করা শুরু করেছিল - তা হলো, পার্লামেন্টবাদ অথবা আইন ও কার্যনির্বাহী ক্ষমতাগুলোকে আলাদা করা।"

‘‘সোভিয়েত রাষ্ট্র সংগঠন একাই সর্বহারা বিপ্লবকে এক আঘাতে বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে ফেলা এবং তার শক্ত ভিতকে ধ্বংস করার শক্তি যুগিয়েছিল আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা তাই অত্যন্ত জরুরী।"

‘‘প্রথমত সোভিয়েতের প্রতিটি সদস্য বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো না কোনো কাজে অংশগ্রহণ করবে; দ্বিতীয়ত এই কাজগুলো সর্বদাই পরিবর্তিত হতে থাকবে যাতে তারা সবদিক দিয়ে সরকারকে তার সব শাখায় আপন করে নিতে পারে এবং তৃতীয়ত ধাপে ধাপে উদ্যোগ নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সমস্ত শ্রমজীবী জনগণকে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে স্বাধীন অংশগ্রহণে টেনে নিয়ে আসতে হবে।"

‘‘সর্বহারা তথা সোভিয়েত গণতন্ত্র বিপরীতক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রবিন্দুকে পরিবর্তিত করে সেখানে আর কেউ নয়, একমাত্র পুঁজি দ্বারা শোষিত, বঞ্চিত শ্রমজীবী জনগণের বাস্তব অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করেছে।"

‘বামপন্থী কমিউনিজম - শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ বইটিতে  লেনিন বলছেন-

‘‘সোভিয়েতসমূহে সংগঠিত সর্বহারারা একনায়কত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন; এই সর্বহারারা বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত হতেন।"

কমিউনিস্ট পার্টি হলো উচ্চতম সচেতনতার সংগঠন, যা সর্বহারার অগ্রণী অংশ যৌথভাবে বহন করে এবং সর্বহারার সমস্ত ধরনের বাস্তব কার্যকলাপে তার মতাদর্শগত নেতৃত্ব অপরিহার্য। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে আর সি পি (বি)-র ৮ম কংগ্রেসে প্রদত্ত পার্টি কর্মসূচীর ওপর রিপোর্টে তিনি বলেন-

‘‘সোভিয়েতগুলো তাদের কর্মসূচীর নিরিখে শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা চালিত সরকারের অঙ্গ, কিন্তু বাস্তবে সেগুলো সামগ্রিকভাবে শ্রমজীবী মানুষ নয়, সর্বহারার অগ্রণী অংশ দ্বারা পরিচালিত শ্রমজীবী মানুষের জন্য গঠিত সরকারের অঙ্গ।"

একই রিপোর্টে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন-

‘‘আমরা তখনই আমলাতন্ত্রের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বের লড়াই করে জয় ছিনিয়ে আনতে পারি যখন সমগ্র জনসাধারণ সরকার পরিচালনার কাজে অংশগ্রহণ করে।’’

তিনি এই অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতির জন্য শ্রমিকদের ‘নিম্নমানের সংস্কৃতি'কে দায়ী করেন, এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি ‘লাগাতার শিক্ষা’র পরামর্শ দেন। লেনিন সমস্যাটির চরিত্র এবং তার সমাধানকে চিহ্নিত করেন-

‘‘সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন করা হয়নি এবং সেই কারণেই আমলারা তাদের আগের অবস্থানগুলো দখল করে আছে। যদি সর্বহারারা এবং কৃষকরা আরও ব্যাপকভাবে সংগঠিত হতে পারে তাহলে ঐ আমলাদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করা যায় এবং সরকারে শ্রমিকদের নেয়ার জন্য তালিকা প্রস্তুতের প্রকৃত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।"

সংস্কৃতি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মানোন্নয়ন লেনিনের মতে একটি ‘প্রসারমান গণতন্ত্রের’ পূর্বশর্ত, যেটি কমিউনিজমের দিকে সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় উপাদান। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি (ব)-র দশম কংগ্রেসে লেনিন বলেছেন-

‘‘সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আড়াই বছর পর আমরা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে এসে দাঁড়াই এবং সারা দুনিয়াকে জানাই যে কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে না হলে সর্বহারার একনায়কত্ব সম্ভবই হতো না।’’

কিন্তু দশম কংগ্রেসের সমগ্র রিপোর্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়লে উপলব্ধি করা যায় এটিকে সাধারণ নিয়মনির্দেশ বলে প্রমাণ করা কখনই লেনিনের উদ্দেশ্য ছিল না, বিপরীতপক্ষে এটা একটা ঐতিহাসিক বাধ্যতার ফলশ্রুতি। এই বিশেষ পরিস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নে কায়েম ছিল সোভিয়েতগুলোর সম্পূর্ণ বিলোপের দিন পর্যন্ত এবং তা সর্বহারার একনায়কত্বের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মার্কস এবং লেনিন যে প্রাথমিক সূত্রায়ন করেছিলেন তার সঠিকতাকে প্রমাণ করেছিল।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম জাতীয় কংগ্রেসে চীনকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল-

‘‘শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন এমনই একটি পার্টি যা দেশের রাষ্ট্র শক্তিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, অতএব জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব অন্তর্বস্তুতে হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বহারার একনায়কত্বের একটি রূপ।’’

ঐ দলিলে আরও বলা হয়-

‘‘এমন একটি রাষ্ট্রক্ষমতা সারের বিচারে সর্বহারার একনায়কত্ব ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। একমাত্র যখন সর্বহারারা তাদের অগ্রণী বাহিনী কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে এই অস্ত্র প্রয়োগ করেছে তখনই তারা এই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কর্তব্যটি সম্পাদন করার শক্তি অর্জন করেছে।’’

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এই আত্মপ্রসাদ আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ৮ম পার্টি কংগ্রেসের আগে লেখা ‘সর্বহারার একনায়কত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বিষয়ে’ ও পরে লেখা ‘সর্বহারার একনায়কত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বিষয়ে আরো কিছু কথা’তে পার্টির বিভিন্ন সমস্যা (সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেস, স্তালিনের মূল্যায়ন, ব্যক্তিপূজার সমালোচনা ইত্যাদি) নিয়ে চর্চা থাকলেও একটি মাত্র লাইনও লেখা হয়নি সর্বহারার নিজস্ব শ্রেণী সংগঠন এবং তার নেতৃত্ব গঠন করার সমস্যা নিয়ে। কখনও কখনও গোটা পার্টিটাই অসচেতন রয়ে গেছে এই সমগ্র পর্যায় জুড়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সবথেকে জরুরী সমস্যাটির বিষয়ে। 

ঐসময়ে এসব কিছু ঘটার পিছনে লিউ শাও-চি দায়ী ছিল। মাও পর্যন্ত যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না তা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৯৫৫ সালে লেখা মাও এর প্রবন্ধ ‘কৃষির সমবায়ে রূপান্তরীকরণ সম্বন্ধে’ থেকে। দেশের সমাজতন্ত্রে রূপান্তরের ঠিক আগে বিষয়টি নিয়ে লেখা হয়েছিল যেখানে চীনের বিশাল গ্রামাঞ্চলে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ ছিল। তার পরিবর্তে শ্রমিকশ্রেণীকে ভুলে গিয়ে তিনি জোর দিলেন পার্টি এবং জনগণের ওপর। পার্টি সর্বব্যাপী, পাটিই একমাত্র লক্ষ্য বা পরিণতি। উপরোক্ত প্রবন্ধে মাও বলেন-

‘‘পার্টি দেশের সমস্ত জনগণকে সমাজতন্ত্রের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।’’

‘‘আমাদের জনগণের ওপর আস্থা রাখা উচিত এবং আমরা অবশ্যই পার্টির ওপর আস্থা রাখবো। এই দু'টি হলো মৌলিক নীতি।"

‘‘পার্টি এবং যুবলীগের উপর আস্থা রাখতে হবে।’’

এখানে কোনো উল্লেখ নেই শ্রমিকশ্রেণীর যাদের ‘শ্রেণী’গত নেতৃত্ব চীনা সমাজকে কমিউনিজমের দিকে নিয়ে যাওয়ার চালিকাশক্তি। ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মূল একক’ এই যে গণ কমিউন কাঠামো, যেভাবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ১৯৫৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রস্তাবে এতে সংজ্ঞা নিরূপণ করেছিলেন, তাতে চীনা ধরণে সর্বহারার একনায়কত্ব হিসাবে গড়ে ওঠার সমস্ত উপাদানগুলো এর মধ্যে ছিল। প্যারী কমিউন ও সোভিয়েতের মত চীনা কমিউনগুলো জনগণ দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছিল। পার্টির হস্তক্ষেপের আগে হোনান এর স্পুটনিক কমিউন তার নিজস্ব সংবিধান রচনা করে যাতে বলা হয় গণ কমিউন হলো ‘সমাজের মূল একক’, ‘সকল শিল্প ও কৃষিজ উৎপাদন, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক কাজকর্ম এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলো তার নিজস্ব সীমার মধ্যে পরিচালনা করা তার কাজ।’ প্রায় ৩৩% কৃষক জনগণ কমিউন ভুক্ত হওয়ার পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম প্রস্তাব গৃহীত হয় ২৯শে আগস্ট, ১৯৫৮ সালে যেখানে বলা হয় ‘নতুন এই কাঠামোটিই সমাজতান্ত্রিক গঠন কাজকে ত্বরানিত করার জন্য এবং ক্রমশ কমিউনিজমে রূপান্তর ঘটানোর জন্য উপযুক্ত গঠন'। ১৯৫৮ সালের ১০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে কমিউনের কাজ সম্পর্কে বর্ণনা ছিল-

‘‘এই ছিল আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে বড় মাপের গণকমিউন যেখানে শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা এবং সামরিক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে এবং যাতে সরকারী প্রশাসন এবং কমিউনের ব্যবস্থাপনার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।’’

এই সমস্ত ঘোষণাগুলো প্রায়শই সর্বহারার একনায়কত্বের কাঙিক্ষত লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলতো। এতদসত্ত্বেও কমিউনের কার্যকলাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দেখিয়ে দেয় চীনের গণ কমিউন কোনো সময়ই তার সূচনার সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি, উৎপাদনকারী ইউনিট হিসাবে কৃষক সমবায় তার পরবর্তী ধাপে বিকশিত হতে পারেনি। ১৯৫৭-৫৮ সালের শীতে সরকার দেশব্যাপী জল সংরক্ষণ এবং সেচ কর্মসূচী গ্রহণ করে। ছোট ছোট সমবায় যেগুলো বড় বড় বাঁধ ও খালের সুবিধা যথাযথভাবে ব্যবহারে সমর্থ ছিল না তাদের ভেঙে ফেলা দরকার পড়লো। চীনের গ্রামাঞ্চল জুড়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সমবায়গুলোর সংযুক্তিকরণ শুরু হয়ে গেলো। ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে হোনান প্রদেশে ২৭টি সমবায় একীকৃত হলো এবং কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ও দলগত আলোচনার পর সংযুক্তিকরণ চূড়ান্ত করা হয়; নতুন সংবিধান গৃহীত হলো ৭ আগস্ট, ১৯৫৮ সালে। নাম হলো 'ওয়েশিং (স্পুটনিক) বর্ধিত সমবায়'। পরবর্তীকালে কৃষকরা নিজেরাই নামকরণ করেন গণ কমিউন এবং মাও তা অনুমোদন করেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বিধিবদ্ধ প্রস্তাব এটিকে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য এবং ক্রমাগত কমিউনিজমে রূপান্তরীকরণের উপযুক্ত কাঠামো বলে অভিহিত করেছিল, কিন্তু এমন কোনো তাত্ত্বিক লেখা কখনই পাওয়া যায়নি যাতে গণ কমিউন ও সর্বহারার একনায়কত্বের মধ্যকার সম্পর্কটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। চু লি এবং থিয়েন চিয়ে-ইউন এর লেখা ‘গণ কমিউনের অভ্যন্তরে’ বইটিতে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে, যাতে দেখানো হয়েছে কিভাবে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ কমিউনে প্রযুক্ত হয়েছিল। তাতে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে একজন পলায়মান জমিদার রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালাবার সময় মিলিশিয়াদের হাতে ধরা পড়ে এবং তাকে তার নিজের গ্রামের দরিদ্র ও মধ্য কৃষকদের হাতে তুলে দেয়া হয়। কমিউনের ওপর চীনা বিশেষজ্ঞদের ভুরি ভুরি লেখা পাওয়া যায়, কিন্তু কেউই প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি অথবা তার চেষ্টাও করেননি যে কমিউনগুলো সর্বহারার একনায়কত্বের মূর্তরূপ ছিল। এই কমিউনগুলো যা করতে পেরেছিল তা হলো উৎপাদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎপাদনকারীদের আংশিক অংশগ্রহণ। কমিউনের কার্যকলাপে পার্টির হস্তক্ষেপের প্রকাশ শুরু হয়েছিল একেবারে গোড়া থেকে। ১৯৫৯ সালে আনা লুই স্ট্রং তার বইতে মন্তব্য করেছিলেন যে-

‘‘কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শহর থেকে জাতির কেন্দ্র পর্যন্ত অধিষ্ঠান করে। স্থানীয় কমিউনিস্টরা স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করেন তাদের আরও ভালোভাবে জীবনযাপনের চাহিদা পূরণের জন্য। যখন তারা খারাপ নেতৃত্ব দেয়, যেমনটি হয়েছিল ১৯৫৭ সালে চাংশিতে ঔদাসীন্যের কারণে এবং হোনান প্রদেশে একটি ভুল রাস্তা নেয়ার জন্য, সেখানে প্রকৃত ব্যর্থতার কারণে সব হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়, যা প্রকট হয় কম ফসল উৎপাদনে এবং দরিদ্রতর জীবনযাত্রায়।"

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Anna_Louise_Strong

কমিউন বিষয়ে পার্টির কর্তৃত্বসুলভ হস্তক্ষেপ যে গণকমিউনের ওপর অভিশাপ হিসাবে নেমে এসেছিল, তীব্র ভাষায় সেটি কমরেড মাও এবং ডং পিং হান তার গবেষণামূলক বই ‘অপরিচিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ এ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন-

‘‘যেসব পার্টি কর্মকর্তা সাধারণ গ্রামবাসীদের জন্য দায়িত্ববদ্ধ ছিলেন না, তাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার অত্যন্ত দুঃখজনক পরিণতি ঘটেছিল ১৯৫৮-৫৯ এর ‘সম্মুখে বৃহৎ উল্লম্ফন’ আন্দোলন এর সময়ে। দ্রুত ফল লাভ করে ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্ট করার চাপে গ্রাম এবং কমিউনের কর্মকর্তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাস চালকে পরিণত হয়েছিলেন। প্রায় সময়ই গ্রামের মানুষের পক্ষে কর্মকর্তাদের দ্রুত ফললাভের ক্রমবর্দ্ধমান চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়ে উঠছিল না। গ্রামবাসীদের প্রচলিত জ্ঞান এবং ‘সম্মুখে বৃহৎ উল্লম্ফন’ এর সময় উৎপাদন মাত্রাকে বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতাকে উপেক্ষা করে কমিউন এবং দেশনেতাদের অযৌক্তিক  পরিকল্পনা কার্যকরী যোগসূত্রকে ভেঙে দিয়েছিল। জিমোতে অনেক কমিউন এবং গ্রামীণ নেতা কমিউন ও গ্রামে খাদ্য ঘাটতিকে উপেক্ষা করে ঊর্ধ্বতনদের খুশী করার জন্য রাষ্ট্রের কাছে বেশী বেশী শস্য বিক্রি করে দেন। পরিণামে কয়েকটি অঞ্চলে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়।’’

চীনের সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল ইউনিট এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার মূল ইউনিট হওয়ার প্রাথমিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কমিউনগুলো পার্টির কর্তৃত্ববাদের শিকার হয়েছিল। পার্টির মধ্যকার পুঁজিবাদী পথের পথিকদের পরাস্ত করে এবং গণ উদ্যোগের বিশাল ব্যাপ্তি ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব দেশকে সমাজতান্ত্রিক পথে চালনা করার মহান প্রতিশ্রুতি সামনে রেখেছিল। ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে’ নতুন ধরনের সংগঠন বিষয়ে আলোচনার সময়ে প্যারী কমিউনের দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছিল। আবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম কেন্দ্রীয় কমিটির একাদশ প্লেনারি বৈঠকে জনগণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশ্নটির উপর জোর দেয়া হয়েছিল-

‘‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সাফল্যের চাবিকাঠি হলো জনগণের উপর আস্থা রাখা, তাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা, তাদের জাগিয়ে তোলা এবং তাদের উদ্যোগকে শ্রদ্ধা করাজনগণের শিক্ষক হওয়ার আগে তাদের ছাত্র হও।"

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান ছিল ‘‘সাহস করে বিপ্লবে যোগ দাও এবং যত্নের সঙ্গে বিপ্লব সম্পন্ন করো। প্রতিকূলতার আশঙ্কায় ভীত হয়ো না।’’

৮ আগস্টের সিদ্ধান্তে একদিকে বলা হয়-

‘‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একমাত্র পদ্ধতি হলো জনগণ নিজেরাই নিজেদের মুক্ত করবে এবং তাদের হয়ে কিছু করে দেয়ার কোন পদ্ধতি এখানে নেয়া উচিত নয়।’’

আবার অন্যদিকে বলা হয়-

"পার্টির নেতৃত্বে জনগণ নিজেদের শিক্ষিত করে তুলছেন।"

একদিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঘোষিত লক্ষ্য সর্বহারার একনায়কত্বকে সংহত করা (বর্ধিত দ্বাদশ প্লেনারি বৈঠকের ঘোষণা), অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মনোযোগের গুরুত্বের স্থানগুলো হলো ‘সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিভাগ এবং পার্টি ও সরকারের অগ্রণী সংগঠনগুলো’, (৮ আগস্ট এর সিদ্ধান্ত) যেখানে সর্বহারা শব্দটির কোনো উল্লেখমাত্র নেই। পার্টির সর্বব্যাপী কর্তৃত্ব এবং জনগণের উদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা, এই দুইয়ের দ্বন্দের শেষ হলো সাংহাই কমিউনের পতনের মধ্য দিয়ে।  সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতি অনুগত সাংহাই এর কারখানা কমিটিগুলো পুরোপুরি কারখানা শ্রমিকদের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এবং সেগুলোই ছিল সর্বহারার একনায়কত্বের ভ্রূণ বিশেষ। সাংহাই মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল সমর্থিত, মূলত পার্টি সদস্যদের নিয়ে গঠিত উৎপাদন গোষ্ঠীর পাশাপাশি ছিল ‘হেড কোয়ার্টার’ বলে পরিচিত এই কারখানা কমিটিগুলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘হেড কোয়ার্টারগুলোর’ ক্ষমতা এতটাই বাড়লো যে তারা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের কর্তৃত্বকে পর্যন্ত অস্বীকার করলো এবং ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে দশ লক্ষাধিক বিপ্লবী শ্রমিকের উপস্থিতিতে লাগাতার কয়েকটি সভার পর সেটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়লো। ৯ জানুয়ারি ৩২টি সংগঠন যৌথভাবে ঘোষণা প্রকাশ করলো যাতে নতুন বিপ্লবী সরকার বলে দাবি করা নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য নিয়মাবলী নির্দিষ্ট করা ছিল। মাও নিজে এই ঘটনার প্রশংসা করলেন এবং ভবিষ্যতের মডেল বলে উল্লেখ করলেন। এই প্রয়োগের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৎসঙ্গে একটি গণআন্দোলন কি প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠবে তা বেরিয়ে এল; রক্ষণশীল সদস্যরা ভেসে গেলো এবং বিপ্লবী নেতৃত্ব (চ্যাং চুন-চিয়াও যার অন্যতম) কোনো রকম কর্তৃত্ববাদ ছাড়াই কাজ করতে লাগলেন। চীনা ধরণের সর্বহারার একনায়কত্বের আদর্শ নজীর হওয়ার সমস্ত উপাদান ছিল সাংহাই কমিউনের মধ্যে। গোড়া থেকেই এই ধরনের আন্দোলনের প্রতি পার্টি অসন্তুষ্ট ছিল। কেন্দ্রীয় এবং অন্যান্য শহরের প্রচার মাধ্যম এই কমিউন গঠনের ব্যাপারে নীরব ছিল। ঘোষণার ২০ দিন পর সাংহাই কমিউন ভেঙে দিয়ে পরিবর্তে পার্টি সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী এবং বিপ্লবী জনগণকে নিয়ে বিপ্লবী কমিটি গড়া হলো। অন্যান্য কমিউগুলোরও একই পরিণতি হলো। রাষ্ট্রক্ষমতার কার্যকলাপে সর্বহারার প্রাধান্যকে ধ্বংস করা হলো। কমিউন ভেঙে দেয়ার কারণ হিসাবে আবারও পার্টির প্রশ্নটি সামনে উঠে এলো এবং সেই প্রশ্নটি তুললেন স্বয়ং মাও সে তুং, যিনি পাঁচ মাস আগে তার কমরেডদের ‘সদর দপ্তরে কামান দাগা’র আহ্বান জানিয়েছিলেন। সাংহাই কমিউন সম্পর্কে মাও এর প্রতিক্রিয়া প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ করেন চ্যাং চুন চিয়াও, তার ১৯৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির বক্তৃতায়। তার টেপরেকর্ড করা রিপোর্টটি পরে দলিলে লিখিত হয়। মাও বলেছিলেন-

‘‘যদি সবকিছুই কমিউনে পরিবর্তিত হয় তাহলে পার্টির কি হবে? আমরা পার্টিকে কোথায় রাখবো? কমিউন কমিটি সদস্যদের মধ্যে পার্টি এবং পার্টি বহির্ভূত সদস্যরাও আছেন। পার্টি কমিটিকে তাহলে কোথায় স্থান দেবো? যেকোনভাবেই হোক একটি পার্টি তো থাকতেই হবে! যে নামেই ডাকি না কেন একটি নিউক্লিয়াস তো থাকতেই হবে। কমিউনিস্ট পার্টিই বলি অথবা সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অথবা কুয়োমিন্টাং কি আই-কুয়ান-তাও, একটি পার্টি থাকা চাই। কমিউনের একটি পার্টি থাকতে হবে, কিন্তু কমিউন কি পার্টির বিকল্প হতে পারে?’’

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yiguandao

মাও আরো বলেন-

‘‘নামে কোনো পরিবর্তনের অর্থ তার রূপের পরিবর্তন, কিন্তু অন্তর্বস্তুর সমস্যার সমাধান তা দিয়ে হয় না। যখন আমরা একটি সাময়িক ক্ষমতার কাঠামো প্রতিষ্ঠা করি, তখনও কি তাদের বিপ্লবী কমিটি বলি না?’’

মাও বিপ্লবী কমিটির উপাদান নিয়ে ভাবিত ছিলেন, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন। সর্বহারার স্বাধীন উদ্যোগকে আটকে দেয়া হলো এবং শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব প্রচেষ্টায় সর্বহারার একনায়কত্বের সংহতকরণ বিধ্বস্ত হলো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম কংগ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী-

‘‘১৯৪৯ এ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোর উৎপাদনের মূল্য সমগ্র শিল্পোৎপাদনের মূল্যের মাত্র ২৬৩ শতাংশ ছিল; ১৯৫২ সালে তা ৪১৫ শতাংশে পৌঁছেছিল এবং ১৯৫৫-য় এটি পৌঁছায় ৫১৩ শতাংশে।’’

এরকম একটি পশ্চাদপদ সমাজে রাষ্ট্রের মালিকানা যদি ১০০ শতাংশেও পৌঁছায়, ভিত্তিস্তরে উৎপাদন সম্পর্ক একই থেকে যায় এবং আরও দৃঢ়ভাবে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ককে রক্ষা করে চলে; উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি না লাগাতার এবং জোরদার বিপ্লবীকরণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রের প্রথাগত মালিকানা থাকলেই তা সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের জন্ম দেয় না। যদি কোনো দেশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে কমিউনিজমে রূপান্তরের রাস্তা নেয় তার পক্ষে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ককে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তন করা পৃথক, স্বাধীন এবং দৃঢ় উদ্দেশ্যমূলক কাজ। সাংস্কৃতিক বিপ্লব তার সমস্ত বিপ্লবী সম্ভাবনা এবং বিপ্লবী আকাঙক্ষা নিয়েও বিষয়টিতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে ব্যর্থ হয়। তার সমস্ত সক্রিয়তা কেন্দ্রীভূত ছিল সমাজের উপরিকাঠামোর মধ্যে অনুপ্রবেশকারী পুঁজিবাদী উপাদানগুলোকে ঘিরে, যা পার্টির মধ্যকার পুঁজিবাদের পথের পথিক সংশোধনবাদীদের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেতো। কীভাবে পুঁজিবাদ তার জন্ম ও বিকাশের জন্য সম্পর্কের ভিত্তিমূলে উর্বর ভূমি খুঁজে পেল এবং লাগাতার মূলগতভাবে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কের জন্ম দিয়ে গেলো, এই বিষয়টিকে অবহেলা করা হয়। এটি ছিল স্তালিনীয় মডেলের সমাজতন্ত্র, যার ধারণায় ছিল উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান স্বত:স্ফূর্তভাবে ‘সমাজতান্ত্রিক মালিকানা’র জন্ম দেবে যদি সেখানে ‘সমাজতান্ত্রিক উপরি কাঠামো’ থাকে। মাও এর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে ঐ উপরিকাঠামোয় পুঁজিবাদী পথের পথিকদের অনুপ্রবেশ ঘটে। মাও এবং তার সমর্থকদের লক্ষ্য ছিল ঐসব ব্যক্তিদের পার্টি থেকে উচ্ছেদ করা। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য জনগণ বিশেষ করে ছাত্র, যুবক এবং গণমুক্তি ফৌজ রাজনৈতিকভাবে যাদের সহজেই প্রভাবিত করা যায় তাদের উৎসাহিত করে তোলা হয়েছিল ‘আনুগত্যবাদী’দের খুঁজে বার করে হেনস্থা করতে। ‘সদরদপ্তরে কামান দাগো’ শ্লোগানটি তাদের আরও বেশি করে আক্রমণাত্মক হতে প্ররোচিত করে। যখন মাও একটি সমান্তরাল পার্টি গঠন করতে মনস্থ করতে পারলেন না তখন সেই শ্লোগান, তার যতই বিপ্লবী উপাদান থাকুক না কেন একেবারেই অন্যায্য ছিল। সাংহাই কমিউনের উত্থানের পর মাও যে পার্টি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন তা ছিল সেসব পার্টি সদস্যদের ভূমিকার প্রতিক্রিয়াবশত, যারা উন্মত্তের মত ‘দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারী সকলকেই’ উৎখাত করছিল। ইতিমধ্যে সাংহাই কমিউন উপর থেকে কোনো নির্দেশ ছাড়াই শ্রমিকশ্রেণীর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দেয়ার অভিমুখে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ গ্রহণে প্রবৃত্ত হলো। সাংহাই কমিউনের বিলুপ্তির পর শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকারের প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো, যার পরিণতিতে চীনা সমাজে উৎপাদনের উপকরণ থেকে প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীর বিচ্ছিন্নতা কায়েম রইলো, অর্থাৎ বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ক আরও ব্যাপকভাবে বজায় রইলো। প্রথমদিকে মাও এই ‘বিচ্ছিন্নতা’ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং এটিকে সোভিয়েত ব্যর্থতার কারণ হিসাবে বিবেচনা করেন। ১৯৬৭ সালের গোড়ায় যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল তা বড় অংশের পার্টি কমরেডদের, বিশেষ করে মাও সহ পুরোনো কমরেডদের বিরক্ত করে তোলে। আশঙ্কা ছিল আরও বড় বিশৃঙ্খলা বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং পার্টি বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। এই কারণেই মাও চ্যাং চুন চিয়াও এবং ইয়াও ওয়েন-ইউয়ান এর সঙ্গে আলোচনায় বসার সময় শুধুমাত্র পার্টির গুরুত্বকে তুলে ধরেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম কয়েক মাসের উৎসাহ মহৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে অতিরিক্ত ক্ষতির কারণ প্রমাণ করে রক্ষণশীলতাকে পথ করে দেয়।

পার্টির সর্বগ্রাসী ক্ষমতা বৃদ্ধির সহগামী হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রম দাসমান স্বাধীন আত্মঘোষণা। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পার্টির কর্তৃত্বকামী হস্তক্ষেপ অনিবার্যভাবে শ্রেণীর নিজস্ব সংগঠন, উদ্যোগ এবং বহু বর্ণময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন নতুন সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে তার সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দেয়। যদি সর্বহারার অগ্রণী বাহিনীর অর্থাৎ পার্টির (যেটি ছাড়া মানব সমাজের শ্রেণীহীন সমাজের দিকে কঠিন ও জটিল যাত্রা কল্পনা করা যায় না) উন্নততর চেতনা কেবলমাত্র মতাদর্শগত পথপ্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সর্বহারা তার শক্তিশালী শ্রেণী সংগঠনের দ্বারা এমনভাবে উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লবীকরণ করতে থাকবে যে উৎপাদন, বন্টন এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে উৎপাদকদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে আর এভাবেই গণতন্ত্র ক্রমসম্প্রসারণশীল হতে থাকবে। কেবলমাত্র এটিই হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব বিকাশের একমাত্র গ্যারান্টি। এই প্রক্রিয়াই পারে শ্রেণী থেকে পার্টির বিচ্ছিন্নতাকে রোধ করতে। শ্রমিকশ্রেণীর (সমাজের সব চেয়ে সংগঠিত শ্রেণী) বস্তুগত অস্তিত্বই কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত ভিত্তি রচনা করে। শ্রেণী সংগঠনের শক্তিশালী উপস্থিতি পার্টি এবং শ্রেণীর মধ্যে জীবন্ত সম্পর্কের গ্যারান্টি। একনায়কত্ব অনুশীলনকারী শ্রেণী সংগঠনের দ্বারা (পার্টির পরামর্শে) সমৃদ্ধ ও পুষ্ট হয়ে পার্টি ক্রমান্বয়ে উজ্জীবিত হতে থাকে। শ্রেণী ও পার্টির মধ্যে এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, তাদের মধ্যে এই উভয়মুখী চলাচল শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বকে সংহত হতে সাহায্য করে এবং যে শ্রেণীর সে অগ্রবাহিনী সেই শ্রেণী থেকে তার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে রাখে। পার্টি যদি শ্রমিকশ্রেণীর হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা অনুশীলনের দায়িত্ব নেয়, তবে শ্রমিকশ্রেণী গণআন্দোলন পরিচালনার, সংগ্রামের নতুন নতুন রূপ উদ্ভাবনের এবং শ্রেণী হিসাবে প্রাণবন্ত অস্তিত্ব উপভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। যে শ্রেণী গতির মধ্যে নেই, সেটি রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুরীভূত হয়ে যায়, হয়ে পড়ে প্রায় একটি মৃত সত্তা। পার্টি যদি পুঁজিবাদী বিচ্যুতি দেখাতেও থাকে তবে তাকে চ্যালেঞ্জ করা বা সমালোচনা করা এই ধরনের সত্তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি পার্টিকে তার শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে (যে দৃষ্টিভঙ্গী সমাজে তার বস্তুগত উপস্থিতি ক্রমাগতভাবে সৃষ্টি করে চলবে) সমৃদ্ধ করতে পারবে না। পার্টি পরিণত হবে পুঁজিবাদী ধ্যানধারণা এবং উপাদানের সূতিকা গৃহে; সর্বহারা শ্রেণী শাসন করার ক্ষমতা হারাবে, অর্থাৎ একনায়কত্ব অনুশীলন করতে ব্যর্থ হবে। মাও এর নেতৃত্বাধীনে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও শ্রমিকশ্রেণীর বিনিময়ে পার্টির হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত করার সোভিয়েত ঐতিহ্য থেকে খুব বেশি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

যেহেতু পার্টির মধ্যকার পুঁজিবাদী পথের পথিকদের সমালোচনা করার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মৌলিক কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল তাই পেটি বুর্জোয়াদের, বিশেষ করে ছাত্র ও যুবাদের ভূমিকা মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব পেয়ে গেলো। কারণ যদি পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদের পথিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেবলমাত্র ভাষা দিয়ে আক্রমণের (যেটা আবার প্রায়শই প্রবীণ পার্টি কর্মীদের নিপীড়নে পর্যবসিত হতো) মধ্যে সীমায়িত থাকে, তবে এরা দৃশ্যপটে আগে ফুটে উঠবে; কারণ তারাই হচ্ছে রাজনৈতিক বিতর্ক, অন্যকে বুঝিয়ে দলে টেনে আনা এবং প্রয়োজন মতো মৌখিক ও শারীরিক আক্রমণে সবচেয়ে বেশি পটু। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মৌলিক নেতৃত্বদায়ী ইউনিট হিসেবে যখন ক্যাডার, গণমুক্তি বাহিনীর সদস্য এবং জনসাধারণকে নিয়ে গঠিত ‘বিপ্লবী কমিটি’কে ঘোষণা করা হলো, তখন পেটিবুর্জোয়া উপাদানকে নেতৃত্বকারী ভূমিকায় স্বীকার করে নেয়ার আনুষ্ঠানিক অনুমতি মিলে গেলো। সাংস্কৃতিক বিপ্লব সূচনার পরের মাসগুলোতে মাও এর আলোচনা, বক্তৃতা, চিঠিপত্র এবং কথোপকথনগুলোতে দেখা যায় সেগুলো সবই হচ্ছে ছাত্র-যুবাদের কেন্দ্র করে; শ্রমিকশ্রেণীর কোনো উল্লেখ কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় জুড়ে মাও বা অন্য কারো একটিও লেখা পাওয়া যায় না যা পার্টির কর্তৃত্ববাদ থেকে মুক্ত, কিন্তু একই সঙ্গে তার মতাদর্শগত পরামর্শ নিতে প্রস্তুত; শ্রমিকশ্রেণীর হাতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা ন্যস্ত করার গভীর সমস্যাটিকে নিয়ে পর্যালোচনা করছে ‘ক্ষমতা দখল’ বলতে মাও যা বুঝেছিলেন তা তিনি স্পষ্ট করেছেন ১৯৬৭ সালের মে মাসে আলবেনিয়ায় সামরিক প্রতিনিধিদের কাছে দেয়া ভাষণে-

‘‘তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে ক্ষমতা দখল ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ৪র্থ পর্যায়টি ছিল মতাদর্শগতভাবে সংশোধনবাদী ও পুঁজিবাদীদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার। ফলত এটা ছিল দু'টি শ্রেণীর মধ্যে, দু'টি পথের মধ্যে, দু'টি লাইনের মধ্যে নির্ধারক লড়াই এর সঙ্কটময় কাল। এটিই হলো সমগ্র আন্দোলনের প্রধান এবং সঠিক অন্তর্বস্তু।’’

এটা দেশ শাসনের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর আরও বেশি করে ভূমিকা পালনের প্রশ্ন ছিল না, ছিল পার্টির একটি অংশের কাছ থেকে অন্য অংশের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার প্রশ্ন এবং তা কেবলমাত্র মতাদর্শগতভাবে। এখানে বক্তব্য ছিল যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা পার্টির বিপ্লবী অংশের হাতে থাকে সেটা নিজেই তার সমস্ত তাৎপর্য সহ শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সমান হয়ে দাঁড়াবে। চেতনার ভূমিকার এই একপেশে প্রয়োগ পার্টিকে সংশোধনবাদের গভীর খাদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারলো না, তাছাড়া এটা এমন কিছু বিচ্যুতির জন্ম দিল যা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে লক্ষ্যচ্যুত করলো এবং চীনের সমাজতন্ত্রের পতনকে ত্বরানিত করলো।

যখন তৃণমূল স্তরে শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত ক্ষমতার লড়াই পার্টির মধ্যে পুঁজিবাদের পথিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো, তখন সমগ্র মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতার লড়াই এ। পার্টি কাঠামোয় সাংগঠনিক শক্তির বিচারে লিউ শাও-চি তার প্রতিপক্ষের থেকে বেশি এগিয়ে ছিল। অপরপক্ষে সমগ্র জাতির কাছে ‘মহান কাণ্ডারী’ হিসেবে মাও এর ছিল প্রশ্নাতীত সম্মান। মাও এর এমন ভাবমূর্তি ছিল যে এমনকি যে পার্টি কর্মীরা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিরোধিতা করতে চাইতো তারাও তাদের সহগামীদের সমাবেশিত করতো মাও এর নাম করে। মাও এর প্রকৃত অনুসরণকারীরা আবার তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য আরও উন্মত্তের মতো মাওকে মহিমার আসনে বসাতো। একদিকে এই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা আর অন্যদিকে মাওপন্থীদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মৌলিক লাইনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় মাওকে দেবত্বের আসনে বসানোর প্রচেষ্টা ব্যক্তি পূজাকে প্রশ্রয় দিলো, আর তা ঘটলো এমন সময়ে যখন পার্টির ঘোষিত নীতি ছিল ‘রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিন'। পরিস্থিতির এমনই বাধ্যবাধকতা ছিল যে মাও এটিকে বন্ধ করতে নিরস্ত ছিলেন। যে সমাজে সামন্ত ঐহিত্যের শক্তিশালী শিকড় প্রোথিত ছিল পরতে পরতে, ব্যক্তিপূজার মতো সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সেখানে সহজেই অনুকূল ক্ষেত্র পেয়ে গেলো। রাজনীতির প্রকৃত বিষয়গুলো ভুলে যাওয়া হলো এবং সমস্ত লড়াই নেমে এলো মাও এর প্রকৃত অনুসরণকারী এবং ভুয়া অনুসরণকারীদের তীব্র সংঘর্ষে। শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন এবং তার শৃঙ্খলাপরায়ণ আন্দোলন পারতো নেতৃত্বকে ঠিকঠাক চলতে বাধ্য করতে। কিন্তু সেটি ছিল অনুপস্থিত। ঘটনার পুরোভাগে ছিল ছাত্র ও যুবা। তারা ছিল অতিরিক্ত স্পর্শকাতর, হঠকারী এবং একটা পরিমাণে উৎশৃঙ্খল। রাজনৈতিক প্রচারাভিযান (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিপূজার রূপ নিতো) ঝুঁকে পড়লো হাতাহাতি, গালমন্দ এবং রাস্তার লড়াই এ। উ হানে এই দ্বন্দ্ব এক ধরনের যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিচারে না রেখে পার্টির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের অত্যাচার এবং অপমান করা হতো। মাও এবং তার লাইনকে বিপদে ফেলার জন্য মাও বিরোধীরা মাও এর নাম করেই নানা ধরনের বাড়াবাড়ি শুরু করলো। ‘পুরাতন চার’-কে, বুদ্ধিজীবী, বৈজ্ঞানিক এবং শিক্ষাবিদদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার নামে তাদের নির্বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল তকমা দেয়া হলো, ভয় দেখানো হলো, অত্যাচার করা হলো। মাও নিজেই ‘পৃথিবী জুড়ে বিরাট বিশৃঙ্খলা’-র কথা স্বীকার করেছেন। এই বিশৃঙ্খলা শ্রমিকদের নিজস্ব ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক দূর করার লক্ষ্যে শ্রমিকদের পরিচালিত বিপ্লবী আন্দোলনের কারণে নয়। একেবারে শুরুতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। পার্টির শিলীভূত সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই ভাঙতে শুরু করেছিল এবং কেবল সমাজের নয়, পার্টিরও গণতন্ত্রীকরণ ঘটার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব (পার্টির সর্বময় কর্তৃত্বে অভ্যস্ত) ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো, বিশেষত সাংহাই কমিউনের পর। পার্টির ভূমিকা অনেকটাই শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে চলেছে দেখে তারা ভয় পেয়েছিলেন। এমন একটা পরিস্থিতি কল্পনা করতে পার্টি ভয় পেলো যেখানে শ্রমিকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান আন্দোলন পার্টির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার বদলে বরং তাকে আরও বেশি করে উজ্জীবিত করবে। এটা সে করবে পার্টিকে শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে নিষিক্ত করে। এভাবে প্রাণের স্পন্দনে জাগরিত পার্টি আবার শ্রমিকশ্রেণীর এবং তাদের আন্দোলনের মতাদর্শগত পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। এটা ভাবতে না পারার ফলে কমিউনগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হলো। ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা কমতে থাকলো এবং পেটি বুর্জোয়া ছাত্র ও যুবারা কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো। এই সময় পর্ব থেকে নৈরাজ্য শুরু হলো। যখন শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থবাহী ব্যক্তিবর্গ ও পুঁজিবাদীদের স্বার্থবাহী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কারা ক্ষমতায় থাকবে এ প্রশ্নটিতেই সংগ্রাম একমাত্রিকভাবে চলতে থাকলো, তখন এটা অনিবার্য ছিল। যখন এই বিশৃঙ্খলার মাত্রা বাড়তে লাগলো তখন মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লবে গণমুক্তি ফৌজের ভূমিকা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ‘একের মধ্যে তিন’ সূত্র প্রথম জনসমক্ষে প্রচার হয় ২৩শে মার্চ, ১৯৬৭ সালের ‘লিবারেশন আর্মি ডেইলী’র সম্পাদকীয়তে অর্থাৎ কমিউন ভেঙে দেয়ার ঠিক পরপর। নিবন্ধে গণমুক্তি ফৌজকে ‘একের মধ্যে তিন’ এর শক্তিশালী স্তম্ভ বলে ঘোষণা করা হয়। গণমুক্তি ফৌজই নির্ণয় করবে বিপ্লবের শত্রুমিত্র, আর বলা হলো ‘‘আমাদের সেনাবাহিনী হচ্ছে সর্বহারার একনায়কত্বের প্রধান অবলম্বন’’। লিন পিয়াওকে অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেয়া হলো যা তিনি আমৃত্যু উপভোগ করলেন এবং গণমুক্তি ফৌজ সমস্ত আন্দোলনের রাশ তাদের হাতে রাখলো। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসে লিন পিয়াও মাও এর উত্তরাধিকারী রূপে নির্বাচিত হলেন এবং দেখা গেলো ২৫ জন পলিটব্যুরো সদস্যের মধ্যে ১৪ জন গণমুক্তি ফৌজের জেনারেল। নবম কংগ্রেসের সমাপ্তির পর ক্ষমতার কেন্দ্রে দৃঢ়ভাবে রয়ে গেলো গণমুক্তি ফৌজ এবং সেটি গোপনে ক্রিয়াকলাপ বাড়াতে শুরু করলো, ১৯৭১ সালে যখন লিন পিয়াও অসফলভাবে ক্যু দেতা ঘটালেন এবং ১৯৭৬ সালের সেনা অভ্যুত্থান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অবশিষ্ট চিহ্নটুকুকেও শেষ করে দিয়ে লিউ শাও-চিকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথকে সুগম করে দিলো।

১২ আগস্ট, ১৯৬৬ সালে ৮ম কেন্দ্রীয় কমিটির একাদশ প্লেনারি বৈঠকের ঘোষণাপত্রে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল ভাবধারা প্রতিফলিত হয় যার মধ্যে সর্বহারার একনায়কত্বকে সংহত করার লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত গণবিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার সমস্ত উপাদান অঙ্গীভূত ছিল। তাকে খুন করা হলো ১৯৬৭ সালের প্রথম কয়েক মাসে। সেই ঘোষণাপত্রের কয়েকটি ছত্র:

‘জনগণের শিক্ষক হওয়ার আগে তাদের ছাত্র হও।’

‘বিপ্লব ঘটাতে সাহসী হও এবং বিপ্লবের প্রতি যত্নশীল হও।'

‘বিশৃঙ্খলাকে ভয় পেও না।’

কিন্তু জনগণ যখন সত্যই সাহসের সঙ্গে বিপ্লব ঘটানোর পথ গ্রহণ করলো, পার্টি দ্রুত পিছু হটতে আরম্ভ করলো। কিন্তু বর্ধিত অধিবেশনে সূত্রায়িত নীতিগুলো তাড়াহুড়োর ফসল ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে গিয়ে স্তালিন যে বহুবিধ ভুল করেছিলেন সে সম্পর্কে মাও সতর্ক ছিলেন। তার গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলোতে যেমন- ‘দশটি প্রধান সম্পর্ক’, ‘৬০টি নির্দেশিকা’ কিংবা ‘সোভিয়েত অর্থনীতির সমালোচনা’য় মাও স্তালিনের ভুলগুলোকেই শুধু তুলে ধরলেন না, সেই সঙ্গে তার নিজের দেশে পুনর্বার সেই ভুল আটকাতে কি কি ব্যবস্থা নেয়া উচিত তার নির্দেশ রাখেন। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা এক অর্থে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মাও এর ধারণার বাস্তবায়ন। একাদশ প্লেনারি বৈঠকের নির্দেশগুলো দীর্ঘ সময়কাল ধরে চর্চিত মতাদর্শগত-রাজনৈতিক মন্থন থেকে উঠে আসা। সোভিয়েত পার্টির অনেক বিচ্যুতির মোকাবিলা করলেও মাও পার্টির প্রশ্নে সোভিয়েতের উত্তরাধিকারী রয়ে গেলেন। পার্টি সম্পর্কে সেই বিশেষ ধারণাটি তাকে অতীত থেকে প্রয়োজনমত সরে এসে সঠিক দিশা নির্ধারণে বাধা দিলো। স্তালিনের বিপরীতে মাও সঠিকভাবে এই ধারণাটিকে তুলে ধরেছিলেন যে উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিকানা ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রের হাতে পরিবর্তিত হলেই স্বত:স্ফূর্তভাবে তা সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। মাও তার ‘সোভিয়েত অর্থনীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে’ নিবন্ধে বলেছেন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘পুরানো উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় নতুনকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে’ তা সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমেই সম্ভব। এতদসত্ত্বেও যখন শ্রমিকরা তাদের কমিউনে উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লবীকরণ শুরু করলেন, মাও পার্টির প্রশ্ন তুলে তাদের উদ্যোগের রাশ টেনে ধরলেন। পার্টির একচেটিয়া ক্ষমতার সোভিয়েত ধারণা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে দুইভাবে প্রভাবিত করেছে; প্রথমত সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে ঘিরে সমস্ত কাজকর্ম পার্টি সংগঠনের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে মূলত পার্টির মধ্যকার পুঁজিবাদের পথিকদের নিশানা করা, আক্রমণ করা এবং পার্টি থেকে উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে; দ্বিতীয়ত উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লবীকরণ করে ভিত্তিমূল থেকে ধাপে ধাপে সর্বহারার একনায়কত্ব গড়ে তোলার দিকে পার্টি নজর দিলো না। ভাবা হয়েছিল পার্টির মধ্য থেকে পুঁজিবাদের পথিকদের বিতাড়িত করতে পারলেই পার্টির মধ্যে বুর্জোয়াদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা আটকে যাবে এবং সর্বহারার একনায়কত্ব সুদৃঢ় হবে। এই বিশ্বাস জেগেছিল যে পার্টি থেকে সংশোধনবাদীদের বিতাড়িত করতে পারলেই পার্টি প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চরিত্র ধরে রাখতে পারবে এবং সেই পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হওয়ার সুবাদে অন্যান্য প্রতিটি সমাজ প্রগতির প্রতি যত্নশীল হতে পারবে। একথা ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে সর্বহারার নেতৃত্বে চলমান গণ আন্দোলন এবং পার্টির মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক হতে পারে পার্টির মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চরিত্রকে ধরে রাখার একমাত্র ভিত্তি। ধরে নেয়া হয়েছিল যেহেতু পার্টি একটি স্বাধীন সত্তা ও সর্বোচ্চ চেতনতার মূর্ত রূপ, তাই সেটি সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব কায়েম করার অধিকারী। এরূপ একটি পার্টিতে যদি সংশোধনবাদীরা অত্যধিক সংখ্যায় সমাবেশিত হয়, তখন ‘সদর দপ্তরে কামান দাগা’ ভিন্ন অন্য উপায় থাকে না। যখন ক্রমবর্ধমান সর্বহারা আন্দোলনের যুগে পার্টির কর্তৃত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তখন তার ‘নিউক্লিয়াস’ বা কেন্দ্রস্থিত অংশটিকে রক্ষা করা জরুরী কর্তব্য হয়ে পড়ে। দুই বিপরীত দিক থেকে আগত দুই বিপদের উৎস ছিল সেই একই বোঝাপড়া - পার্টির ভূমিকা হবে সর্বত্রগামী যা জীবন ও সমাজের প্রতিটি দিককে নিয়ন্ত্রণ করবে। পার্টির হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে তা পার্টির মধ্যে জন্ম দেবে কর্তৃত্ববাদ, অতিকেন্দ্রিকতা এবং দুর্ভেদ্য স্তরভিত্তিক বিভাজনের। মাও তার সমস্ত বিপ্লবী ধ্যানধারণা নিয়েও 'পার্টি সব কথার শেষ কথা, চূড়ান্ত ও অনপেক্ষ এক সত্তা' ধারণার উত্তরাধিকারকে বহন করে গেলেন। পরিণামে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রারম্ভিক বিপুল সম্ভাবনা নিয়েও ব্যর্থ হলো-

*সমাজের ভিত্তিমূলে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কের বৈপ্লবীকরণ ঘটাতে।

*শ্রমিক আন্দোলনের থেকে আহরিত পুষ্টি দিয়ে পার্টিকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর করতে।

*ক্রমসম্প্রসারণশীল সর্বহারার গণতন্ত্রের সামনে পার্টিকে উন্মুক্ত করে তার অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটাতে।

*জনসাধারণকে রাজনৈতিক বিতর্কে যুক্ত করতে।

*এই সমস্ত কারণের সম্মিলিত প্রভাব দ্বারা সর্বহারার একনায়কত্বের পক্ষে সমাজের মেরুকরণ ঘটাতে।

এপ্রিল থিসিস থেকেই লেনিন প্যারী কমিউন ধরনের রাষ্ট্রের পক্ষে মত রাখতে শুরু করেন-

‘‘একটি রাষ্ট্র যেখানে কোনো স্থায়ী সৈন্যবাহিনী থাকবে না, জনবিরোধী পুলিশ থাকবে না, জনগণের মাথার ওপর কোনো আমলাতন্ত্র থাকবে না।"

তার কাছে নিজের দেশের পক্ষে সোভিয়েত ছিল কমিউনের আদর্শ বিকল্প এবং তিনি ঐ মডেলকে সামনে রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করেন কাজটি সহজ নয়। তার প্রথম পশ্চাদপসরণ দেখা যায় রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম কংগ্রেসে, যখন তিনি সোভিয়েতের সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বীকার করেন সোভিয়েতগুলো হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘সকল  শ্রমজীবী জনগণের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বদলে শ্রমজীবী জনগণের অগ্রণী অংশের দ্বারা পরিচালিত শ্রমজীবী জনগণের জন্য সরকারের একটি সংগঠন’। লেনিন মনে করতেন, সরকারী কাজে ক্রমে ক্রমে সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের অংশগ্রহণ হলো সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতির চাবিকাঠি। একই কংগ্রেসে তিনি এই সাফল্যের পথে বাধা হিসাবে শ্রমজীবী জনগণের ‘নিম্ন সাংস্কৃতিক মান’কে চিহ্নিত করেন। তিনি উপলব্ধি করেন শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিটি সদস্যকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যকলাপের অংশীদার করে তুলতে হলে তার সাংস্কৃতিক মানকে অবশ্যই উন্নত করতে হবে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি শ্রমিক শ্রেণীর ‘লাগাতার শিক্ষা’র পরামর্শ দেন। ৮ম কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যতদিন না সাংস্কৃতিক মান উন্নত হচ্ছে, ততদিন আমলারা তাদের পুরানো অবস্থান আঁকড়ে বসে থাকবে এবং শ্রমজীবী জনগণের দ্বারা রাষ্ট্র গড়ে তোলা স্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে। সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আড়াই বছর পরও লেনিন এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাননি। ২৩শে জুলাই, ১৯২০ সালে কমিনটার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে স্প্যানিশ ন্যাশনাল কনফেডারেশন অফ লেবার এর অ্যাঞ্জেল পাস্তানা এবং ব্রিটেনের জ্যাক ট্যানার এর সঙ্গে বিতর্ক চলাকালীন লেনিন বলেন কিভাবে

‘‘পুঁজিবাদের  যুগে যখন শ্রমিক জনগণ অবিরাম শোষণের শিকার, (তারা) তাদের মানবিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে পারে না।"

তিনি আরও বলেন-

‘‘আমরা সেই কারণেই স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে একমাত্র সেই শ্রেণী সচেতন সংখ্যালঘুরাই শ্রমিক জনগণকে পরিচালনা করতে ও নেতৃত্ব দিতে পারে।’’

লেনিন এখানে স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন সর্বহারার একনায়কত্বের বিকাশের প্রশ্নে তৎকালীন ঘটনাবলী ছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা সংঘটিত বাধ্যতা এবং সেই কারণে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি। তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে কমিন্টার্নের বক্তৃতাটির দৃষ্টান্ত দেন-

‘‘আমাদের সকলের কঠোর পরিশ্রমের অভিজ্ঞতাই বলে দেয় যে ঐসব পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভীষণ কঠিন ছিল। সোভিয়েত ক্ষমতার আড়াই বছর পর আমরা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে এসে গোটা দুনিয়াকে জানালাম যে কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যম ছাড়া সর্বহারার একনায়কত্ব ক্রিয়াশীল থাকতে পারে না।’’

তার বাকী জীবন ধরে লেনিন একদিকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সর্বদা শ্রমজীবী জনগণের প্রতিটি সদস্যের অংশীদারিত্বের কথা তুলে ধরেছেন, তেমনই পুঁজিবাদী যুগের জবরদস্তি চাপানো প্রভাবগুলো সমাজে যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলেছে তাদের মুছে ফেলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেছেন। কিন্তু বিষয়টি সমাধান করা কঠিন ছিল বলে তিনি কখনও কৌশলে তা এড়িয়ে যাননি।

রূপান্তর পর্বের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্যাটির দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি স্তালিন। সমাজতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার গোটা পর্যায় জুড়ে যে বিষয়টি লেনিনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল স্তালিন সে বিষয়ে ভাবিত ছিলেন না। এই অবহেলার অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ ছিল যখন থেকে সর্বহারাদের সংগঠনগুলো (সোভিয়েত কিংবা ট্রেড ইউনিয়নগুলো) উবে গেলো বা দুর্বল হতে লাগলো, একই সঙ্গে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পার্টির ভূমিকা ক্রমশ প্রাধান্য বিস্তার করতে লাগলো এবং শ্রমিকশ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পার্টি নিজের মধ্যে অতিকেন্দ্রিকতা এবং কর্তৃত্ববাদের সমস্ত অসুস্থ লক্ষণগুলো ফুটিয়ে তুলতে লাগল। স্তালিনের পর মাও সমাজতন্ত্রের সমস্যাবলি বিষয়ে উন্নততর উপলব্ধির পরিচয় রেখেছিলেন। কিন্তু তার এই উন্নততর উপলব্ধি ভেসে গিয়েছিল পার্টির সর্বময়ত্বর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর সর্বহারার অগ্রণী ও পশ্চাদপদ অংশের মধ্যকার দূরত্ব আরও তীব্রতার সঙ্গে সমাধান দাবি করলো। পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে মানবতার যাত্রা পর্বে চেতনা পালন করবে নির্ণায়কের ভূমিকা। পুরানো সমাজের ভয়ংকর শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উৎপাদন সম্পর্ক সহ সবকিছু নতুন করে বিকশিত করে প্রায় শূন্য থেকে সম্পূর্ণ নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই কারণে চেতনার শক্তিশালী ভূমিকাকে বাদ দেয়া যায় না; কিন্তু কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী অংশই তার অগ্রণী মানের সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজ চালিয়ে যেতে পারে। একটি সফল বিপ্লবের পর বুর্জোয়াদের পরাজিত করে সমগ্র শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। সেই জন্যই সর্বহারার একনায়কত্ব কেবল অগ্রণী অংশের নয়। যেহেতু সমাজের বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং মানব ইতিহাসে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে উন্নততর চেতনার বিশেষ সক্রিয়তার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে অগ্রণী চেতনার ধারক-বাহকদের ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে হয়। সর্বহারার এই অংশের (অগ্রণী) মনে হয়, পশ্চাদপদ অংশের জনগণ সমাজতন্ত্রের বহুবিধ জটিলতার মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়, তেমনই তাদের কৃষক সুলভ বা পেটি বুর্জোয়াসুলভ পশ্চাদপদ মানসিকতার জন্য তারা সামগ্রিকতায় বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে অক্ষম। সেই কারণে পার্টি অর্থাৎ অগ্রণী অংশ সমগ্র শ্রেণীর মুক্তির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। পার্টি একবার এই প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করলে দু'টি বিষয় দেখা যায়। প্রথমত পার্টি নিজেকে সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠন বলে ভাবতে শুরু করে এবং সেই কারণে তার ইচ্ছা পশ্চাদপদ অংশের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার তার আছে বলে মনে করে; দ্বিতীয়ত পশ্চাদপদ অংশ অনুভব করতে থাকে যে পার্টি তাদের সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণ করছে যদিও তাদের সমগ্র শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব তার করার কথা। ঐ শ্রেণী (যার অধিকাংশ পার্টির সীমানার বাইরে রয়ে গেছে) পার্টি দ্বারা অবহেলিত হচ্ছে বলে মনে করতে থাকে এবং বিরাট ফাঁক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।
 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]