বুলগেরিয়ায় কমিউনিস্ট নিধন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বুলগেরিয়ান সমাজের বড় অংশ ছিল কৃষক ও শ্রমিক। কৃষকদের নিজস্ব জমি ছিল না। জমিদাররা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার খুব ছোট অংশ হলেও দেশের মোট জমির বেশিরভাগ তাদের দখলে ছিল। জমিদাররা সেখানে ভূমিহীন কৃষকদের বেগার খাটাতো এবং পারিশ্রমিক হিসেবে ফসলের কিছু অংশ প্রদান করতো। উৎপাদিত বাড়তি কৃষি পণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগিয়ে শহরের কারখানাগুলোতে শিল্পপণ্য উৎপাদন করা হতো। শিল্পকারখানাগুলো ছিল শহুরে পুঁজিপতিদের দখলে। বুলগেরিয়ার কৃষক ও শ্রমিকদের শোষণ উদ্ধার করতে উনিশ শতকের শেষদিকে গড়ে ওঠে বুলগেরিয়ান অ্যাগ্রারিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bulgarian_Agrarian_National_Union
তারা তাদের রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে নির্বাচিত হওয়ার পর বিশদ কৃষি ও শিল্প সংস্কার এবং দেশের ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থায় সংশোধন আনার প্রস্তাব দেয়। তারা বলেছিল নির্বাচিত হলে জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করবে এবং জমিগুলো ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্টন করবে। ১৯১৯ সালের নির্বাচনে তারা ৩১ শতাংশ ভোট পায় এবং অন্য একটি রাজনৈতিক দলের সাথে জোট বেধে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। বুলগেরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী চার বছর পর পর নির্বাচনের কথা বলা ছিল। ১৯১৯ সালের নির্বাচনে ‘বুলগেরিয়ান অ্যাগ্রারিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন’ বিজয়ী হওয়ার পর আলেক্সান্দার স্ট্যামবোলিস্কি দেশের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Aleksandar_Stamboliyski
সরকার জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে তাদের জমিগুলো ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্টন করে এবং প্রাচীনপন্থী বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। বুলগেরিয়ার বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন স্ট্যামবোলিস্কি। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে দলটি ৫১ শতাংশ জনসমর্থন লাভ করে এবং দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। দেশটির অভিজাত শ্রেণীর বেশিরভাগ ছিল হয় শিল্পপতি নাহয় জমিদার। স্ট্যামবোলিস্কি সরকারের প্রবর্তন করা বিভিন্ন সংস্কারের জন্য এই শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শত শত বছর ধরে বুলগেরিয়ান সমাজে তাদের যে প্রতিপত্তি ছিল তা শূন্যের কোটায় নেমে আসে। এছাড়া বিশ্বযুদ্ধের পর চুক্তি অনুযায়ী বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনীতে সদস্য সংখ্যা বিশ হাজারে নামিয়ে আনতে বাধ্য করা হয়। যেসব সেনা কর্মকর্তাকে সামরিক বাহিনী থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ছাটাই করা হয়, তারা সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। ১৯১৯ সালের দিকে বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরত আসা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে বুলগেরিয়ান অ্যাগ্রারিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়নের বিজয়ের পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় কিছু দিনের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হবে।
https://www.jstor.org/stable/j.ctvd58sh4
১৯২৩ সালের জুন মাসে সেনা কর্মকর্তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অভিজাত শ্রেণী প্রতিপত্তি ফিরে পাওয়ার আশায় সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের পেছনে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করে। জুন মাসে সেনাবাহিনী আলেক্সান্দার স্ট্যামবোলিস্কি সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। সেনাবাহিনী দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। এরপর কোনো শক্তিশালী প্রতিরোধ ছাড়া বুলগেরিয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয়। বুলগেরিয়ান অ্যাগ্রারিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন যেন জাতীয় রাজনীতিতে আর কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই লক্ষ্যে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যার জন্য অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে আলেক্সান্দার স্ট্যামবোলিস্কি সহ অন্য অনেক নেতা মৃত্যুবরণ করেন। সামরিক অভ্যুত্থানের সময় দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের কাছে এই ঘটনা ছিল ‘শহুরে বুর্জোয়া’ বনাম ‘গ্রামীণ বুর্জোয়া’র দ্বন্দ্ব। পরবর্তীতে ‘কমিন্টার্ন’ বুলগেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের বিপ্লব সংঘটনের জন্য বলে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Communist_International
সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিন্টার্ন ও বুলগেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসলে সোভিয়েতরা দ্রুত বিপ্লবের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য বলে। বুলগেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা দেশে ফিরে ভূমি সংস্কারপন্থী তথা বুলগেরিয়ান অ্যাগ্রারিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়নের কৃষক ও শ্রমিকদের সাথে নিয়ে বিপ্লবের ছক কষতে শুরু করেন। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ বুলগেরিয়ার গ্রামীণ অঞ্চলে সামরিক শাসন উৎখাতের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়। ভূমি সংস্কারপন্থীদের উৎখাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সামরিক সরকার কমিন্টার্ন ও বুলগেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির আলোচনা সম্পর্কে আগেই খবর পায়। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বেশ কিছু গ্রাম দখল করে নেয় এবং তাদের লক্ষ্য ছিল শহরের দিকে অগ্রসর হওয়া। দক্ষিণ বুলগেরিয়ায় সামরিক জান্তা উৎখাতের উদ্দেশ্যে পরিচালিত আন্দোলনের খবর আসার পর সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় দ্রুত এই আন্দোলন দমন করতে হবে ,অন্যথায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট এনে দক্ষিণ বুলগেরিয়ার কমিউনিস্টদের ঘিরে ফেলা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল কমিউনিস্টদের তুলনায় অনেক বেশি এবং সামরিক কৌশল তূলনামূলক উন্নত ছিল। এজন্য সেনাবাহিনীর জোরালো প্রতিরোধের সামনে কমিউনিস্টরা টিকতে পারেনি। বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনী কমিউনিস্টদের গণহারে গ্রেফতার করতে শুরু করে। চার দিনে প্রায় পনের হাজার কমিউনিস্টকে গ্রেফতার করা হয়। সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণে প্রায় পাঁচ হাজার কমিউনিস্ট নেতাকর্মী হত্যাকান্ডের শিকার হয়। জর্জি দিমিত্রোভ ও ভাসিল কোলারোভ আরও দুই হাজার কমিউনিস্ট নেতাসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যান।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Georgi_Dimitrov
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Vasil_Kolarov
কমিউনিস্ট পার্টির এই ব্যর্থ বিপ্লবের পর বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনী ‘স্টেট প্রটেকশন অ্যাক্ট’ নামে আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের মাধ্যমে বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
https://www.jstor.org/stable/40393741
Comments