তাইওয়ানে বামপন্থী নিধন

 


১৯৪৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তাইপেই শহরের এক চায়ের দোকানের সামনে একজন মাঝবয়সী বিধবা নারী অননুমোদিত সিগারেট বিক্রি করছিলেন। কিছুক্ষণ পর তামাক কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি এসে মহিলার কাছ থেকে জোরপূর্বক সিগারেট ও অর্থ ছিনিয়ে নেয়। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের আচরণের প্রতিবাদ করে সিগারেট ও অর্থ ফেরত চান। এতে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের মধ্যে একজন রিভলবারের বাট দিয়ে মহিলার মাথায় আঘাত করে। তখন জড়ো হওয়া মানুষরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা প্রতিনিধিদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে এবং বলপ্রয়োগের জন্য কৈফিয়ত চায়। অবস্থা বেগতিক দেখে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা হাতে থাকা রিভলবার দিয়ে জড়ো হওয়া মানুষের দিকে গুলি ছোড়ে। গুলির আঘাতে একজন পথচারী মারা যায় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এই ঘটনায় স্থানীয়রা ক্ষিপ্ত হয়। তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা ছিল চীনের মূল ভূখন্ডের বাসিন্দা। সেদিনের মতো তারা ফিরে যায় এবং পরদিনের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ধ্বংসসাধন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির জন্য তাইওয়ানের সাধারণ মানুষ তৎকালীন কুয়োমিনতাং সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। সেই নারী ও তামাক প্রতিনিধিদের ঘটনা আগুনে ঘি ঢালে। পরদিন তাইপেই শহরের অসংখ্য বাসিন্দা তামাক কোম্পানির অফিস অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। তাদের দাবি ছিল যে প্রতিনিধি আঘাত করেছিল তাকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এবল কোম্পানির পরিচালককে পদত্যাগ করতে হবে। যাত্রাপথে তারা দু'জন তামাক কোম্পানির এজেন্টকে ধরে ফেলে। 

https://www.fpri.org/article/2017/02/taiwans-white-terror-remembering-228-incident/

ক্ষিপ্ত জনতার হাতে অতিরিক্ত প্রহারে তাদের মৃত্যু ঘটে। এরপর যখন আন্দোলনকারী জনতা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তাইওয়ানের গভর্নর জেনারেলের বাসভবন ঘেরাও করে, তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সশস্ত্র সৈন্যরা গুলি চালালে কয়েকজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। মার্চ মাসের ১ তারিখ তাইওয়ানের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। সাত দিন তদন্তের পর কমিটি সরকারের কাছে ৩২ দফা দাবি পেশ করে। এসব দাবির মধ্যে ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে জোর দেয়া, মতামতের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি। গভর্নর জেনারেলে চেন ই'র পক্ষ থেকে এসব দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Chen_Yi_(Kuomintang)

উল্টো রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদ প্রয়োগের জন্য আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। তাইওয়ানের নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে দাবি দেয়া হয় ১৯৪৭ সালের ৭ মার্চ এর পরদিন চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে অসংখ্য সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। তদন্ত চলার সময় তাইওয়ান সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত সেনাবাহিনীর গাড়ি টহল দিচ্ছিল এবং দেখামাত্র নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হতাহত করছিল। মূল ভূখণ্ড থেকে আরও বেশি সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আসার পর সারা দেশে সেনাবাহিনী টহল দিতে শুরু করে। তাইওয়ানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল চেয়েছিলেন অস্ত্রের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা কিংবা গণহারে গ্রেফতারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারলে দানা বেধে ওঠা আন্দোলন দমন করা সহজ হবে-এটাই ভেবেছিল তাইওয়ানের সরকার। তাইওয়ানের সমাজ থেকে অসংখ্য মানুষ রাতারাতি হারিয়ে যেতে শুরু করে, যাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি। ১৯৪৯ সালে কুয়োমিনতাং সরকার সামরিক আইন জারি করে। এর মাধ্যমে সরকারের যাবতীয় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আইনগতভাবে বৈধ করার চেষ্টা করা হয়। ‘টুটুয়েন্টিএইট ম্যাসাকার’ এর মাধ্যমে কুয়োমিনতাং সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যে সূত্রপাত ঘটে, তা স্থায়ী হয় প্রায় চার দশক। বামপন্থী চিন্তাধারার বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র ও শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের টার্গেট করা হতো।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/February_28_incident

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাতের বেলা তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতো। যাদের গ্রেফতার করা হতো, তাদের বেশিরভাগ মানুষকে আর কখনও ফিরে পাওয়া যায়নি। সামরিক আইন জারির ফলে সমস্ত জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়। এমনও হয়েছে যে, কোনো ক্লিনিকে হয়তো কয়েকজন ডাক্তার একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন, এমন সময় কুয়োমিনতাং সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে হানা দিয়েছে এবং ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ করার দায়ে তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হতো। খুব সামান্য কারণে গ্রেফতার হলেও দশ-পনের বছরের শাস্তি ছিল নিয়মিত ঘটনা। সামরিক আইন জারির পর থেকে তাইওয়ানের অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন, যেগুলো তাদের চেপে যেতে হয়। অনেক জেলখানার বন্দীকে চোখ বেঁধে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর তাদের নদীর পাশে দাঁড় করিয়ে সোজা নদীতে ধাক্কা মারা হতো। এতে তাদের বুলেট বেঁচে যেতো। এছাড়া অসংখ্য মানুষের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হতো, যাতে অন্যরা সেগুলো দেখে ভয় পায়।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]