হুগো শ্যাভেজ প্রসঙ্গ : বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে চারটি বিষয়

 


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি তাদের মুখপত্র ‘রেভোলিউশনে’ ৬ মার্চ, ২০১৩ সালে 'হুগো শ্যাভেজ প্রসঙ্গ : বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে চারটি বিষয়' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে-

হুগো শ্যাভেজ, যিনি গত ১৪ বছর ধরে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, গত ০৫ মার্চ মঙ্গলবার ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘রেভোলিউশন’ পত্রিকা হুগো শ্যাভেজ, তার কর্মকাণ্ড, দৃষ্টিভঙ্গি এবং শাসন ব্যবস্থার ওপর একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করবে। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে শ্যাভেজের আমলে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং তার বিষয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান সংক্রান্ত চারটি বিষয় আমরা উপস্থাপন করছি।

১. মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীন ভেনেজুয়েলা 

পুরো বিশ শতক জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা দেশটির বৃহৎ ভূমি, শিল্প ও বাণিজ্য স্বার্থের রক্ষক শাসক শ্রেণীকে সামরিক ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে তেল সম্পদ সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের মধ্যে তেল উত্তোলনকারী দেশ হিসেবে ভেনেজুয়েলার উত্থান ঘটে এবং মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থ সেখানকার তেলক্ষেত্রের সাথে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ভেনেজুয়েলার ওপর এক ভয়াবহ নির্মম পরিকল্পনা চাপিয়ে দেয়। (পেট্রোলের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে দেয়া হয়। ফলে পেট্রোলের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে চলে যায়।) জনগণ রাস্তায় নেমে এসে জঙ্গি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তৎকালীন সরকার ৩,০০০ মানুষ হত্যা করে এই প্রতিরোধের রক্তাক্ত জবাব প্রদান করে।

২. হুগো শ্যাভেজ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পথের কাঁটা  

হুগো শ্যাভেজ ১৯৯৮ সালে ভেনেজুয়েলার দুর্নীতি, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারির বিরুদ্ধে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি স্পষ্টতই ঘোষণা দেন ভেনেজুয়েলার প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা সে দেশের জনগণের এবং তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় সামাজিক কল্যাণমূলক খাতেই ব্যয়িত হবে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলার উপযুক্ত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। এসব কারণে হুগো শ্যাভেজ তার দেশে বিপুল জনসমর্থন লাভ করতে সমর্থ হন। অন্যদিকে একই কারণে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাকে নিজেদের পথের কাঁটা হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। ২০০২ সালের এপ্রিলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর চক্রান্তে ভেনেজুয়েলাতে এক সামরিক ক্যু ঘটে। শ্যাভেজের সমগ্র শাসনকালেই মার্কিন সরকারের বিভিন্ন সাহায্যদাতা সংস্থা, সামরিক উপদল, ব্যক্তি মালিকানাধীন দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং প্রচার মাধ্যম ভেনেজুয়েলায় শ্যাভেজ বিরোধী শক্তি গড়ে তোলার পেছনে কাজ করে যায়।

৩. হুগো শ্যাভেজ প্রকৃত বিপ্লব অথবা সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী ছিলেন না 

তৃতীয় বিশ্বের একটি শোষণমূলক ব্যবস্থার অধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভেনেজুয়েলাতে দুইস্তর বিশিষ্ট পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক বিযুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল মৌলিক পরিবর্তনের। এছাড়া প্রয়োজন ছিল একটি মৌলিক সামাজিক বিপ্লব, প্রথাগত সম্পর্ক ও ধ্যানধারণার সাথে সম্পর্ক বিযুক্ততার ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন। কিন্তু তা শ্যাভেজের কর্মসূচি অথবা দৃষ্টিভঙ্গি কোনোটির মধ্যেই ছিল না। ভেনেজুয়েলা তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয়ের ওপরই নির্ভরশীল থেকে যায়, আর আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্য তো সাম্রাজ্যবাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন। এছাড়া ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি তার খাদ্যের যোগানের জন্য বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভর করে, যা কিনা আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী কৃষি বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত। একথা ঠিক যে শ্যাভেজের অধীনে ভেনেজুয়েলার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু শ্রেণী ও সমাজ কাঠামোয় কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়নি। সংখ্যায় ক্ষুদ্র কিন্তু একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী অত্যন্ত ধনী ভূমি মালিকদের হাতে কৃষি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে। শহরের দরিদ্র নাগরিকেরা ঝুপড়ি অথবা কুঁড়েঘরে বসবাস করতে বাধ্য হন। নারীকে এখনো পুরুষের অধীন করে রাখা হয়, অবমূল্যায়ন করা হয়। সেখানে গর্ভপাত এখনো আইনত নিষিদ্ধ।

৪. ভেনেজুয়েলার ব্যাপারে নাক গলানোর কোনো অধিকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেই 

ভেনেজুয়েলার সরকারকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো প্রচেষ্টা অথবা চক্রান্তের আমরা বিরোধিতা করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে এই বোঝাপড়ার ওপরই আমাদের কর্তব্য পালন করতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]