মার্ক্সবাদে নারী

 

সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা প্রচার করে বাংলাদেশে নারী অধিকার ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছে! নারীরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে! নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে! পার্লামেন্টে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো হয়েছে! স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে! ভবিষ্যতে সকল ক্ষেত্রে নারীরা আরও বেশি ক্ষমতা ভোগ করবে ইত্যাদি ইত্যাদি! বলা হচ্ছে আগামীতে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে! আর তাহলেই নাকি বাংলাদেশের নারী জাতির আরও ক্ষমতায়ন হবে! এদেশে নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যেসকল বক্তব্য শাসক-শোষক শ্রেণী দিয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী, সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ নারী, একাধিক মন্ত্রী নারী; বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও নারী যিনি তিন মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও এর বাইরে বাংলাদেশের নারী সমাজে হাসিনা বা খালেদাদের কোনো অভাব নেই। এরা নারী হলেও কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনি। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এই নারীরা কেমন আছে বা কীভাবে তাদের জীবন অতিবাহিত করছে তার খবর কী শাসক-শোষক শ্রেণীর কেউ রাখে? প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা এসব পরিবারের নারীদের জীবনে কি সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পেরেছে তার হিসাব অবশ্য শাসক-শোষক শ্রেণী দিতে পারে না। এসব অসহায় পরিবারের নারীদের ক্ষমতায়নে রাষ্ট্র কি ভূমিকা রেখেছে, শাসক-শোষক শ্রেণী তার কোনো হিসাব দেয় না। আসলে শাসক-শোষক শ্রেণী নারী বলতে তাদের শ্রেণীর বা তাদের সমাজের নারীদের বুঝে থাকে। তাই এদের শ্রেণীর বাইরে কাউকে হিসাব করে না বা তাদের জীবন নিয়ে ভাবে না। তাই নারী বলতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রমুখের কথা বলে থাকে। আবার শাসক-শোষক শ্রেণী তাদের সমাজের ক’জনকে বা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি বানাতে পারে! তাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীদেরও অবমাননাকর ঘরোয়া দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা হয়। সমাজের আর দশটা পণ্যের মতো শাসক-শোষক শ্রেণীর দৃষ্টিতে নারীরাও পণ্য মাত্র এবং যাদের ভোগ করার একচ্ছত্র অধিকার অর্পিত রয়েছে পুরুষের ওপর। কথিত নারীর ক্ষমতায়ন এদেশের এলিট শ্রেণীর নারীদেরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। এদেশে শ্রমজীবী নারীদের অবস্থা ভয়াবহ। শ্রমজীবী নারীরা একদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের শিকার, অপরদিকে পুঁজির শোষণের শিকার। এই দ্বিবিধ পীড়নে পীড়িত হয়ে সমাজের সবথেকে দুর্বলতর শ্রেণী থেকে আগত শ্রমজীবী নারীরা দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার মধ্যে জীবন কাটিয়ে থাকে। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ শ্রম সেক্টর হলো তৈরি পোশাক শিল্প। এই তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে, যাদের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ নারী শ্রমিক। বাংলাদেশে যেসব সেক্টরে নারী শ্রমিকরা কাজ করে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হোটেল শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, চা ও রাবার শ্রমিক, বারকি শ্রমিক, অন্যের বাসা বাড়িতে গৃহকর্ম করা শ্রমিক ইত্যাদি। এই সমস্ত সেক্টরে কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমান মজুরি পায় না। কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের মালিক নারী শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। যেসব নারী সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালতে পুরুষের পাশাপাশি সমান দক্ষতার সাথে কাজ করে কর্মস্থলে তাদের সম অধিকার ও সম মর্যাদা দেয়া হয় না। দেশের শাসক-শোষক শ্রেণীর এসব ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো কালচারে পরিণত করেছে। অগ্রসর পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতেও নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো বুর্জোয়া সমাজের অন্যতম কালচার। আমাদের দেশে পশ্চাৎপদ সামন্ত সংস্কৃতি চালু থাকার কারণে এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা নারী নিপীড়নের যুৎসই হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানগুলোতে মোল্লা আর সাধুরা সুযোগ পেলেই নারীদের উপর একহাত নিয়ে ছাড়ে এবং নারীদের কীভাবে অবমাননা করতে হয় সমাজের কোমলমতি শিশুদের সেই শিক্ষা দিয়ে চলে। নারীরা সমাজে পুরুষের দাস, পুরুষের অধীন, পুরুষের সেবক ইত্যাদি নানা কুরুচিপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে এরা অবুঝ শিশুদের শিক্ষিত করে তুলছে! এই সমস্ত মোল্লা, পুরুতরা সমাজে নারীদের কীভাবে অমর্যাদা করা যায় সেই কথা বলার সুযোগ পেলেই তার জন্য সব প্রচেষ্টা করে। এরা নারীদের পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে ধর্মের নামে নারীর ওপর দমন পীড়ন চালানোর সকল শিক্ষায় সমাজকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করে! বাংলাদেশে নানা এনজিও তৎপরতা চালু রয়েছে। এরা নারী মুক্তির নামে নারীবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এরা পুরুষকে নারীর প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে নারীদের পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষায় তালিম দেয়ার চেষ্টা করে। এরা নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অবৈরী দ্বন্দ্বকে প্রাধান্যে আনার চেষ্টা করে নারীর ওপর চেপে বসা শোষণ নিপীড়নের জন্য দায়ী যে প্রচলিত শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা ও এই ব্যবস্থার অবসান ছাড়া নারী জাতির মুক্তি নেই - এই সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষের উপর মানুষের শোষণের উদ্ভব ঘটে। যেই দিন থেকে সমাজে শোষণের উদ্ভব ঘটেছে, মানব জাতির একাংশ অপরাংশের ওপর শোষণের বোঝা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সেই দিন থেকেই নারী জাতির ওপর শোষণের সূচনা হয়েছে। শাসক-শোষক শ্রেণী এই সত্যকে অস্বীকার করতে চায়। তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নারীর ওপর পুরুষের শোষণ হচ্ছে শাশ্বত বা ঈশ্বরের বিধান; মানব জাতির সৃষ্টির পর থেকে এই শোষণ চলে আসছে! শ্রেণী বিভক্ত সমাজে যুগে যুগে শোষিত নারী জাতিকে এই মতবাদে আস্থাশীল করে নারী জাতির ওপর তাদের শোষণ নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সৃষ্টি করেছে এই মতবাদের উপযোগী দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি। শাসক-শোষক শ্রেণী যেমন প্রচার করে শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা ও সমাজে শ্রেণী পার্থক্য ঈশ্বরের সৃষ্টি বা শাশ্বত বিধান, তেমনি নারী জাতির ওপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণ নিপীড়ন অব্যাহত রাখাও ঈশ্বরের বিধান বা শাশ্বত নিয়ম! প্রচলিত শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা যেমন শাশ্বত বা ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়; তেমনি নারী জাতির ওপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণ নিপীড়নও শাশ্বত নয়। সমাজ বিবর্তনের ধারাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং পুরুষ কর্তৃক নারী শোষণ ও নিপীড়ন। মানব জাতি অনেক বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। আদিম সাম্য সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ততন্ত্র [ভূমিদাস প্রথা, জমিদারি প্রথা], পুঁজিবাদ, সমাজতান্ত্রিক সমাজ- বিবর্তনের ধারায় মানব জাতির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছে। আদিম সাম্য সমাজে শ্রেণী ছিল না, তাই শ্রেণী পার্থক্য ও শ্রেণী বিরোধ ছিল না। এই সমাজে নারীর ওপর শোষণ ছিল না। এটাই হলো দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের শিক্ষা। সমাজ বিবর্তনের ধারাতেই যে শ্রেণীর উদ্ভব ও শ্রেণী শোষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেন -

“বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী শেষ বিচারে ইতিহাসে নির্ধারক করণিকা হচ্ছে প্রত্যক্ষ জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন। কিন্তু ব্যাপারটির দ্বিবিধ প্রকৃতি। একদিকে জীবনযাত্রার উপকরণ- খাদ্য, পরিধেয়, আশ্রয় এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির উৎপাদন; অপরদিকে মানবজাতির জৈবিক উৎপাদন, বংশবৃদ্ধি। একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগে একটি বিশেষ দেশে মানুষ যে সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাস করে, সেগুলি এই দ্বিবিধ উৎপাদনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। একদিকে শ্রমের বিকাশের; অপরদিকে পরিবারের বিকাশের স্তর দিয়ে। শ্রমের বিকাশ যত কম হয় ও উৎপন্নের পরিমাণ এবং সেই হেতু সমাজের সম্পদ যত সীমাবদ্ধ হয়, তত বেশি সমাজ ব্যবস্থা কৌলিক সম্পর্ক দিয়ে পরিচালিত মনে হয়। কিন্তু কৌলিক বন্ধনের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজ কাঠামোর মধ্যে শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি বাড়তে থাকে; সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ পায় ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিনিময়, ধনের অসাম্য; অপরদিকে শ্রমশক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং তার ফলে শ্রেণী বিরোধের ভিত্তি।"

[পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব]

শ্রেণীহীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজে সন্তানসন্ততি মায়ের নামে পরিচিত হতো, কিন্তু শ্রেণী বিভক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে সম্পত্তির ওপর পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়; সন্তানসন্ততি পিতৃপরিচয়ে পরিচিত হতে শুরু করে। সেই অনুসারে গড়ে ওঠে উত্তরাধিকার আইন। সম্পত্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী জাতি সম্পত্তির ওপর উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো; পুরুষের ওপর সম্পত্তির একচেটিয়া মালিক হওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। এঙ্গেলস এ সম্পর্কে বলেন -

“যেমন সম্পদ বাড়তে থাকলো তাতে একদিকে পরিবারের মধ্যে স্ত্রীলোকের চেয়ে পুরুষের প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকলো এবং অপরদিকে তার নিজের শক্তিশালী সামাজিক অবস্থার জোরে নিজের সন্তানসন্ততির স্বপক্ষে প্রচলিত উত্তরাধিকার প্রথা রূপান্তরের প্রেরণা দিলো। কিন্তু মাতৃ অধিকার অনুযায়ী বংশধারা থাকাতে এটি অসম্ভব ছিল। সেজন্য এই প্রথা ভাঙ্গার প্রয়োজন ছিল ও তা ভাঙ্গা হলো এবং এই কাজটি আজ যেমন তেমন কিছু শক্ত ছিল না। কারণ এই বিপ্লব যদিও মানব সমাজের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে একটি সবচেয়ে নির্ধারক বিপ্লব, তবু এতে গোত্রের কোনো জীবিত সদস্যের কোনো অবস্থান্তর ঘটাবার কোনো প্রয়োজন হয়নি। আগেকার মতোই সকলে যেখানে ছিল, সেখানেই রইলো। এই সহজ সিদ্ধান্তটুকু যথেষ্ট যে পুরুষের সন্তানসন্ততিরা তার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু নারীর সন্তানসন্ততিরা গোত্র থেকে বাদ পড়বে এবং তারা তাদের বাপেদের গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে। এইভাবে মায়েদের দিক থেকে বংশপরস্পরার হিসাব এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের উচ্ছেদ হলো এবং তার জায়গায় বাপের দিক থেকে বংশপরস্পরা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।” 

[পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব]

শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উদ্ভব ও সম্পত্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহারা হওয়ায় নারী জাতির ওপর চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণ। এ সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেন - 

“মাতৃ অধিকারের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষ গৃহস্থালীর কর্তৃত্বও দখল করলো; স্ত্রীলোক হলো পদানত, শৃঙ্খলিত, পুরুষের লালসার দাসী, সন্তানসৃষ্টির যন্ত্র মাত্র। স্ত্রীলোকের এই অবনত অবস্থা যা বিশেষভাবে বীরযুগের এবং ততোধিক চিরায়ত যুগের গ্রিকদের মধ্যে পরিস্পুট হয়েছিল, তাকেই আস্তে আস্তে পালিশ করে এবং কিছুটা রূপান্তর মোলায়েম করা হয়েছে, কিন্তু মোটেও লুপ্ত হয়নি। পুরুষদের এই যে একচ্ছত্র শাসন এখন প্রতিষ্ঠিত হলো তার প্রধান ফল হলো পিতৃপ্রধান পরিবারের তখন উদীয়মান একটি মধ্যবর্তী রূপ। এই ধরনের পরিবারের মূল বৈশিষ্ট্য বহুপত্নী প্রথা নয়, পরন্তু স্বাধীন ও পরাধীন কিছু সংখ্যক ব্যক্তিদের পরিবার কর্তার পিতৃক্ষমতাধীনস্থ এক পরিবারে সংগঠন।"

[পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব]

শ্রেণী বিভক্ত সমাজই যে সকল রকমের শোষণ-নিপীড়ন ও দাসত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে- এটাই হলো প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ সম্পর্কে মার্ক্স বলেন -

“আধুনিক পরিবারের মধ্যে ভ্রুণ অবস্থায় শুধু দাসত্ব নয়, পরন্তু ভূমিদাসত্বও আছে, কারণ গোড়া থেকেই এটির সঙ্গে কৃষি বেগারের সম্পর্ক ছিল। পরবর্তী যুগে সমাজ ও তার রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপকভাবে যত রকমের বিরোধ দেখা দিয়েছে তার সবই ছোট আকারে এর মধ্যে আছে।”

বাংলাদেশ একটি নয়া ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদের দালাল দেশের শাসক-শোষক শ্রেণী ও তাদের সেবাদাস কথিত বুদ্ধিজীবীরা দেশের শোষিত নারীদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রচার করে থাকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে নারীর অধিকার ও নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্ক্স ঊনবিংশ শতাব্দীতেই পুঁজিবাদী সমাজে নারীর দুর্দশা তুলে ধরেছেন। মার্ক্স ও এঙ্গেলস 'কমিউনিস্ট ইস্তেহারে' বর্ণনা করেছেন -

“বুর্জোয়ারা তাদের স্ত্রীদের শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবেই দেখে। তাই তারা যখন শোনে যে, উৎপাদনের যন্ত্রগুলি সব সামাজিক সম্পদে পরিণত হবে, তখন তারা এছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না যে নারীরাও সর্বসাধারণের ভোগ্য হিসাবে ব্যবহৃত হবে। তারা ভাবতেই পারে না যে আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য নারীদের শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে থাকার হীন অবস্থার অবসান ঘটানো। তাছাড়া বুর্জোয়ারা যে খুব একটা নৈতিকতার ভড়ং দেখিয়ে ক্রোধে ফেঁটে পড়ে বলে যে, কমিউনিস্টরাই খোলাখুলিভাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নারীদের সাধারণের ভোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত করবে তার থেকে হাস্যকর আর কিছু নেই, নারীদের সাধারণের ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করার জন্য কমিউনিস্টদের প্রয়োজন নেই - স্মরণাতীত কাল থেকেই সমাজে তা চলে আসছে। আমাদের বুর্জোয়ারা সাধারণ পতিতালয়ে যায়, তাছাড়া অধীনস্থ সর্বহারাদের স্ত্রী কন্যাদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ ভোগ করে। তাতেও তাদের হয় না। তারা আবার পরস্পরের স্ত্রীদেরও ফুঁসলে এনেই চরম সুখ উপভোগ করে। বুর্জোয়া বিবাহ প্রকৃতপক্ষে নারীদের সাধারণ পত্নী হিসাবে রেখে সবাই মিলে ভোগ করার ব্যবস্থা। সুতরাং কমিউনিস্টদের ওপর দোষারোপ করে যে বলা হয়েছে তারা নাকি নারীদের সাধারণের ভোগ্যে পরিণত করতে চায়, সে কথা যদি ধরেও নেয়া যায় তাহলেও তো বলতে হবে যে, বুর্জোয়াদের ভন্ডামির গোপন ব্যবস্থাটাকেই তো তারা বড়জোর প্রকাশ্য আইনসঙ্গতভাবে তুলে ধরবে মাত্র। এসব কথা বাদে এটাতো স্বতঃসিদ্ধ যে বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সেই উৎপাদন ব্যবস্থা থেকেই উদ্ভুত নারীদের সাধারণের ভোগ্য হিসাবে প্রথারও বিলোপ হবে - প্রকাশ্য ও গোপন বেশ্যাবৃত্তির অবসান হবে।” 

কমিউনিস্ট ইস্তেহারে আরও বলা হয়েছে - 

“বর্তমান পরিবার, বুর্জোয়া পরিবার কিসের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে? পুঁজির ভিত্তির ওপর। ব্যক্তিগত মুনাফার ভিত্তির ওপর।”

নারী জাতি যেদিন থেকে সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণের অধিকার হারিয়েছে, সেদিন থেকে তার ওপর নানাবিধ শোষণ নিপীড়নের বোঝা চেপে বসেছে। এই প্রসঙ্গে লেনিন বলেন -

“নারীরা যতক্ষণ ঘরকন্নার কাজ করে আটকে থাকে ততক্ষণ তারা বাঁধাবাঁধির মধ্যেই থেকে যায়। নারীদের সম্পূর্ণ মুক্তি ও সমান অধিকারের জন্য চাই সামাজিক-অর্থনীতি ও সাধারণ উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ করা। তখনই নারীরা সমাজে পুরুষের সমান স্থান পাবে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, উৎপাদনী শক্তি, পরিশ্রমের মাত্রা, পরিমাণ, সময়, খাটুনির অবস্থা প্রভৃতি হুবহু পুরুষের মতোই হতে হবে। কিন্তু এই কথা ঠিক যে পুরুষের তুলনায় নারীরা কখনই অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছনে থাকবে না। আপনারা জানেন যে, ঘরকন্নার কাজের বোঝা মেয়েদের ওপর চাপানো হয় বলে সম্পূর্ণ সমান অধিকার পেয়েও তাদের অধীন হয়েই থাকতে হয়। এইসব ঘরকন্নার কাজের মধ্যে বেশিরভাগই তাদের কোনো কাজেই লাগে না, অত্যন্ত অসভ্য রকমের ও কষ্টকর। আর নারীদেরই এগুলি করতে হয়। এই খাটুনি অত্যন্ত নিকৃষ্ট আর এর মধ্যে এমন কিছু নেই যা নারীদের উন্নতির পথে একটুও সাহায্য করে।” 

[সোভিয়েত রিপাবলিকে শ্রমজীবী নারীদের কাজ]

ধনতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সবচেয়ে অগ্রসর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বুর্জোয়া সমাজে নারী দ্বিবিধ পীড়নে পীড়িত - শ্রমজীবী নারীদের ওপর পুঁজির শোষণ তো আছেই, তার ওপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘরোয়া দাসত্বের শৃঙ্খল নারী জাতিকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেনিন বলেন - 

“সেখানে শ্রমজীবী ও কৃষক নারীদের ওপর মূলধনের অত্যাচার তো আছেই। তার ওপর এমনকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া রিপাবলিকেও প্রথমত তাদের ছোট করে রাখা হয়, কারণ আইনগতভাবে তাদের পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয় না এবং দ্বিতীয়ত সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এই যে, তাদের পারিবারিক দাসত্বে বেধে রাখা হয়। সেখানে তারা পারিবারিক দাসী। সেখানে সাধারণত আলাদা আলাদা পারিবারিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সবচেয়ে তুচ্ছ হেয় কঠিন ও বুদ্ধিনাশা রান্নাঘরের কাজ তাদের পেষণ করে।” 

[আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস ১৯২১ উপলক্ষে পাঠানো বার্তা]

আদিম সমাজে নারী নিপীড়নের ইতিহাস দেখা যায় না। বরং তখন ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী বৈষম্য ছিল না। পুরুষের শিকার এবং নারীদের খাদ্য সংগ্রহ, সন্তান পালন ছিল জীবন ধারণের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ও যৌন জীবনে নারী-পুরুষ সমানাধিকার ভোগ করতো।  যখন থেকে সমাজে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন থেকে শ্রেণির উদ্ভব; শুরু হয় শ্রেণি শোষণ, দেখা দেয় লিঙ্গ বৈষম্য। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গড়ে উঠে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। এঙ্গেলস বলেন- 

“মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তি নারী জাতির জন্য সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষরা গৃহস্থালির দখলও ছিনিয়ে নেয়। মেয়েদের মর্যাদার হানি হয়, তারা পুরুষের কামনার দাস ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয়।” 

[পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি]

কৃষি উৎপাদন নারীর আবিষ্কার বলে ইতিহাসে স্বীকৃত। নারীর গর্ভ ধারণ, শিশু পালন, শিশুকে দুগ্ধদান ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে নারীর পক্ষে পশু শিকারে যাওয়া ছিল অসুবিধাজনক। একারণে নারী-পুরুষের মাঝে শ্রম বিভাজনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলমূলের বীজ বপন করে নারী আবিষ্কার করে কৃষিকাজের। পর্যায়ক্রমে কৃষি কাজের প্রসার এবং কৃষি কাজের মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহের পরিবেশ সৃষ্টি হলে পুরুষরাও পশু শিকার বাদ দিয়ে কৃষি কাজে নিয়োজিত হয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজের এক পর্যায়ে মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে ভূখণ্ডগত স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিজয়ীরা সম্পদের মালিকে এবং পরাজিতরা বন্দী হয়ে দাসে পরিণত হয়। এই দাসদের মালিক হয় ভূ-সম্পদের মালিকরা। সম্পদের মালিক সমাজপতিরা নারীদের কৃষি উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরে গৃহস্থালি কাজে নিয়োগ করে, পুরুষের ভোগের সামগ্রী এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করে। কালক্রমে শ্রেণি শোষণ তথা নারী শোষণকে ‘বৈধ’ করার জন্য সম্পদের মালিক সমাজপতিরা বিভিন্ন আইন, নিয়ম প্রণয়ন করে, গড়ে তোলে স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিচার ব্যবস্থা। তাদের প্রণীত আইন মানতে বাধ্য করার ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলে সশস্ত্র বাহিনী। সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র। সীমানা নির্ধারণ হয় রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের। যুগে যুগে পুরুষদের দ্বারা বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব। সব ধর্মই নারী ও শ্রেণি শোষণমূলক ব্যবস্থাকে নীতিসম্মত করে তোলে এবং জনমনে গেঁথে দেয় ঈশ্বরের আদেশ বলে। এভাবে পুরুষতন্ত্র আধিপত্য বিস্তার করে সমাজের সর্বস্তরে। পুরুষরা নারীদের তাদের অধীনস্ত করে এবং ধীরে ধীরে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে। নারীদের তারা নিজেদের প্রয়োজন ও স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার করার সুযোগ পায় এভাবেই। শ্রেণি দ্বন্দ্বের ফলে দাস সমাজ থেকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে পুঁজিবাদে, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ সাম্রাজ্যবাদে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো সমাজেই কৃষক নারীর জীবনে পুরুষতন্ত্র ও শ্রেণি শোষণ বিলুপ্ত হয়নি। উচ্চ-মধ্যবিত্ত নারীদের কিছু বৈষয়িক উন্নয়ন হলেও কৃষক নারীর অবস্থা মধ্যযুগীয় পর্যায়ে রয়ে গেছে। পুঁজিবাদী সমাজে পুরুষতন্ত্র ও শ্রেণি শোষণ হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে সমানতালে। সাম্রাজ্যবাদ আজ ঢোল পিটাচ্ছে নারীদের উৎপাদনে অংশগ্রহণের ও নারীর উন্নয়নের জন্য। কিন্তু দরিদ্র কৃষক নারীরা সংসারের আর্থিক অনটন ঘুচাতে বহুকাল আগে থেকেই বাড়ির বাইরে গিয়ে ধনী-জোতদারদের বাড়িতে কৃষিকাজ করে উপার্জন করে আসছে। ৬০ এর দশক থেকে দরিদ্র নারীরা সরাসরি কৃষি উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে। বীজতলা থেকে বীছন তোলা, আগাছা পরিস্কার করা, ধানকাটা, বহন, মাড়াই করা, পানি সেচের যন্ত্র চালু করা, ক্ষেত থেকে শাকসবজি তুলে আনা ইত্যাদি। এগুলো তারা করে শ্রমিক হিসেবে ধনী-জোতদারদের ক্ষেত-খামারে মজুরির বিনিময়ে। ঘরে গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুপাখি পালন করে তারা। পশুপাখির খাদ্য দরিদ্র কৃষক নারীরাই সংগ্রহ করে, এমনকি মাঠে গরু-ছাগলও চড়ায়। কিন্তু কৃষক মজুর নারীরা কৃষি কাজের মজুরি পায় পুরুষ মজুরদের চেয়ে অনেক কম। কৃষি উৎপাদনে দরিদ্র নারীদের মঝে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাঙালী নারীরাও জীবনের প্রয়েজনে পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ অনেকটা ভেঙে ফেলেছে। ক্ষেতের কাজ ছাড়াও দরিদ্র নারীরা বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনমূলক কাজে অংশ নিচ্ছে। যেমন- কুটির শিল্পের কাজ, বিড়ি কারখানার কাজ, ধানকলের কাজ, মাটি কাটা, ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে সংসারে অর্থের যোগান দেয়। এতসব কাজ করা সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর কাজকে উৎপাদনশীল কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। স্বামীরাই তাদের ভরণপোষণ করছে এমন মূল্যবোধ সমাজে এখনো প্রতিষ্ঠিত। নারীর উৎপাদনমূলক কাজকে অমর্যাদাকর কাজ হিসেবেই সমাজ বিবেচনা করে। একারণেই ধনী কৃষক পরিবারের মেয়েদের ক্ষেতের কাজ করতে দেয়া হয় না। যদিও এই নারীরাও উদয়াস্ত গৃহস্থালি কাজ করে। ধনীরা সস্তা শ্রম শোষণের পাশাপাশি নারীদের নারী হিসেবেও শোষণ করে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে। সামন্ত সমাজে নারী সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠেছিল যে নারীরা প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল ও নিম্নমানের এবং মাতৃত্ব ও গৃহস্থালি কাজই তাদের উপযুক্ত ও স্বাভাবিক স্থান। দরিদ্র নারীদের উপার্জিত অর্থ পরিবারের অভাব মিটাতেই ব্যয় হয়ে যায়। ধনী-গরীব নির্বিশেষে নারীরা স্বামীর সংসারে সম্পদের মালিক হতে পারে না, যদি না স্বামীরা স্বেচ্ছায় স্ত্রীদের সম্পত্তি প্রদান করে। স্বামীর মৃত্যুর পর মুসলিম নারীরা স্বামীর সমস্ত সম্পদের মাত্র এক-অষ্টমাংশের মালিকানা পায়। মুসলিম নারীরা বাবার সম্পত্তি পায় ভাইয়ের অর্ধেক। হিন্দু নারীরা তা-ও পায় না। বাবার সম্পত্তি মেয়েরা সাধারণত নিজের করে নেয় না বেড়াতে যাওয়ার বা বিপদে আশ্রয় পাওয়ার একমাত্র জায়গা বাবার বাড়িতে ভাইদের আপ্যায়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে। আবার অনেক স্বামী স্ত্রীকে বাবার সম্পদ আনতে বাধ্য করে। কৃষক নারীরা এই সম্পদও নিজের প্রয়োজনে ও ইচ্ছায় ব্যয় করতে পারে না, বরং স্বামীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। এখনো কৃষক নারীরা সম্পদের মালিক হতে না পেরে শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয়। দরিদ্র কৃষক নারীরা বৃদ্ধকালেও ছেলের উপর নির্ভর করতে পারে না। পুঁজিবাদের কঠোর শ্রম শোষণে বিবাহিত ছেলে স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনে হিমশিম খায়। বৃদ্ধ মা-বাবার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিতে পারে না। একারণে বৃদ্ধ বয়সেও মা-বাবাকে কোনো না কোনো শ্রমে নিযুক্ত থেকে খেতে হয়। শ্রমে অক্ষম হলে বা উপযুক্ত শ্রমের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন-যাপন করে তারা। সরকার যে বয়স্ক ভাতা প্রদানের প্রচার করে তা নামমাত্র এবং তা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র বৃদ্ধার জন্য সাগরে বিন্দুমাত্র। শাসক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্র তা-ও যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে অক্ষম। জমি-সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত করে এখনো সামন্ততান্ত্রিক নিয়মে কৃষক নারীকে বিয়ের মাধ্যমে স্বামীর পরিবারে পুনর্বাসন করা হয়। দেনমোহরানা নামে স্ত্রী কেনার সামন্ততান্ত্রিক নীতি এখনো সসম্মানে বিদ্যমান রেখেছে মুসলিম সমাজ। সকল সম্প্রদায়ের সমাজে প্রচলিত যৌতুক প্রথা তো আছেই। শাসক শ্রেণি ঘুষ ছাড়া জনগণকে কোনো চাকুরী দেয় না। তেমনি যৌতুক নামের ঘুষ ছাড়া পুরুষের ঘরে নারী গৃহদাসীদের কর্মসংস্থান হয়না। পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্র দরিদ্র কৃষক পিতাকে অবশিষ্ট একখণ্ড জমি, গরু-ছাগল বিক্রি করে সন্তানের বিয়ের যৌতুক যোগাতে বাধ্য করে। এগুলো না থাকলে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বা ধনী আত্মীয়-স্বজনের দ্বারস্থ হয়ে যৌতুকের টাকা যোগাড় করে মেয়ে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে দরিদ্র পিতা। তারপরও স্বামী এবং তার পরিবারের সবার আদেশ-নির্দেশ পালনই কৃষক নারীর কর্তব্য বলে সমাজে স্বীকৃত। স্বামীর নির্দেশ ছাড়া বাবার বাড়ি যাওয়ার ক্ষমতাও তাদের থাকে না। স্বামীর সংসারে সব কাজ করে সবাইকে খুশি রাখাই নারীর দায়িত্ব - এ ধারণা সমাজে এখনো বদ্ধমূল। ১৯২৫ সালে অর্জিত নারীর ভোটাধিকার কৃষক নারী আজও স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম নয়। স্বামীর নির্ধারিত ব্যক্তিকেই ভোট দিতে হয় তাদের। বিয়ের ক্ষেত্রেও কৃষক নারীদের পছন্দ করার অধিকার নেই। কৃষক নারীদের অভিভাবকদের পছন্দ মতই বিয়ে করতে হয়। যৌন প্রশ্নেও কৃষক নারীর স্বাধীনতা নেই। স্বামীর প্রয়োজনে স্ত্রী দেহদানে বাধ্য - এমন ধারণাই সমাজে প্রচলিত। নারীর যৌন ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না এক্ষেত্রে। যৌন অধিকার প্রশ্নেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। সন্তান ধারণ বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে পুরুষরাই সিদ্ধান্ত নেয় সমাজে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বহু কৃষক পরিবারে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা বদ্ধমূল। তাদের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পাপের কাজ, আল্লাহ মুখ দেবেন তো আহারও দেবেন ইত্যাদি। এখনো অনেক কৃষক নারীকে বছর বছর সন্তান জন্ম দিতে হচ্ছে। যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের মাঝে স্ত্রীদেরই খাবার বড়ি খেতে হয়, ইনজেকশন বা লাইগেশন ব্যবস্থা নিতে হয়। সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে অর্থাৎ বংশ পরম্পরায় মালিকানা হস্তান্তরের জন্য নারীকে এক স্বামীতে সন্তুষ্ট রাখার এবং পুরুষের জন্য যৌন স্বাধীনতার পুরুষতান্ত্রিক বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠিত। পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি নারীকে ধৈর্য-সহনশীল ও ত্যাগের শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক মতে পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখার মধ্যযুগীয় বিধান সমাজে প্রচলিত। অনেক কৃষক স্বামী একত্রে একধিক স্ত্রী রাখে। স্বামীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে গেলে বা যৌন বিষয়ে অবাধ্য হলে বা স্বামীর কাজে প্রতিবাদ করলে কৃষক নারীকে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় এবং গালাগাল শুনতে হয়। বিবাহ বিচ্ছেদ প্রশ্নেও তালাক দেয়াটা পুরুষের জন্য সহজ (ইসলাম কেবল পুরুষদের এই অধিকার দিয়েছে)। নারী স্বামীকে তালাক দিলে তা হয় সমাজের চোখে অবমাননাকর। দ্বিতীয় বিয়ে করা নারীর জন্য দুঃসাধ্য। স্বামীর সংসার ছাড়া সমাজে নারীর অবস্থান আরো অমর্যাদাকর ও নিপীড়নমূলক। এজন্য বিয়ে করা নারীর জন্য অপরিহার্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বর ভালো হবে কিনা তার অনিশ্চয়তা, সন্তানদের মঙ্গলার্থে কৃষক নারী স্বামীর শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর সংসারে অভিশপ্ত জীবনকে মেনে নেয়। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নারী উন্নয়নের নামে ডজন ডজন এনজিও এর মাধ্যমে দরিদ্র কৃষক নারীদের ঋণের জালে আবদ্ধ করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে। এরা নারীদের সংগঠিত করে দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর আত্মনির্ভরশীলতা তথা নারীমুক্তির স্বপ্ন দেখায়। এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নয়ন করে মূলত তাদের শোষণমূলক ব্যবস্থাকে সহনীয় করে তুলতে এবং বিপ্লবের বাধা হিসেবে সংস্কারমূলক কাজকে সামনে নিয়ে আসতে।  প্রতিবছর চৈত্র ও কার্তিক মাসে দরিদ্র নারীরা স্বামী-সন্তান নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটায়। দরিদ্র কৃষক পরিবারের তরুণী নারীরা কাজের সন্ধানে বড় বড় শহরগুলোতে ভিড় জমায় এবং সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কলকারখানায় ও বাসা-বাড়িতে কাজ, ইটভাঙা, রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করে বা জিনিসপত্র ফেরি করে জীবন ধারণ করে। সাম্রাজ্যবাদী ঋণ ব্যবস্থায় ২-৪ জনের অবস্থার যে পরিবর্তন হচ্ছে না তা নয় - কিন্তু এটা সাধারন চিত্র নয়। এনজিও'দের ঋণ ব্যবস্থা হচ্ছে শোষণমূলক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় ব্যাপক জনগণের সম্পদ গড়ে উঠতে পারে না। বরং শোষণের জালে দরিদ্র জনগণকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে শোষণমূলক ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করার দূরভিসন্ধি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ এনজিওগুলো পরিচালিত করছে। ব্র্যাক, প্রশিকা, গ্রামীণ ব্যাংক, কারিতাস, আশা ইত্যাদি এনজিওগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা পরিচালিত। এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে উৎপাদনে নামিয়ে নারীদের সস্তা শ্রম লুট করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ছে; অন্যদিকে নারীমুক্তির শত্রু সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দালাল আমলা-পুঁজিপতিকে আড়াল করছে। এরা সামন্তবাদ তথা পুরুষতন্ত্র ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে রক্ষা করছে শ্রেণীগত স্বার্থে। এনজিও নারী সংগঠনগুলো পুরুষতন্ত্রের কিছু কিছু বিরোধিতা করলেও সামগ্রিকভাবে নারীর শত্রদের চিহ্নিত ও বিরোধিতা করে না। এসব নারী সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছে নারীমুক্তির শত্রু-শ্রেণির নারীরা। যারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দরিদ্র জনগণকে শোষণ করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]