সুভাষ বোস প্রসঙ্গে - সরোজ দত্ত

 


সুভাষ বোস 'নেতাজী' হলো তার জীবনের একেবারে শেষ অধ্যায়ে, কেমন করে হলো পরে বলছি। কংগ্রেসের
মধ্যে সে নাকি 'বামপন্থী' ছিল। কিন্তু দেখা যায় প্রতিটি সঙ্কট মুহূর্তে গান্ধীর কর্তৃত্বকে সে মাথা পেতে নিয়েছে; গরম গরম বুলি আউড়ে শেষ পর্যন্ত কিন্ত গান্ধীর পায়ের উপর একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যে কংগ্রেস দালাল-বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশে সেই কংগ্রেস দখল করার জন্য একদা এক কদর্য উপদলীয় কলহে সে মেতে উঠেছিল যাকে তখনকার দিনে লোকে বলত সুভাষ সেনগুপ্তের ঝগড়া। সে দলবাজীতে কোন নীতির বালাই ছিল না এবং সে দলবাজীতে প্রায়ই রক্তারক্তি হতো। গরম গরম বুলি সে অনেক বলত, কিন্তু গান্ধীর বেঁধে দেওয়া চৌহদ্দির বাইরে সে কোনদিন পা বাড়ায়নি। সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী পেতিবুর্জোয়া গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল, কিন্ত সেই যোগাযোগকে সে কাছে লাগাত কংগ্রেসের মধ্য নেতৃত্ব দখলের লড়াইয়ে। কংগ্রেসের মত দালাল বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে আজকের মত সেদিনও ঝগড়া ছিল অবধারিত এবং ঝগড়ার জন্যই গান্ধীগোষ্ঠী তার প্রতি বিরুপ ছিল গান্ধী তাকে দেখতে পারত না। কিন্তু সুভাষ বোস যতই গরম বুলি বলুক গান্ধী তার দৌড় জানত, গান্ধী ভালোভাবেই জানত সে কোনদিনই কমিউনিস্টদের সঙ্গে হাত মেলাবে না, জঙ্গী শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে সামিল হবে না, চীনের জাতীয় বুর্জোয়াদের নেতা সান ইয়াৎ সেনের মত সশস্ত্র ফৌজ তৈরী করে দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণ করবে না। মোল্লা যতই দৌড়ক সে যে মসজিদ পেরিয়ে কিছুতেই যাবে না, গান্ধীর থেকে কেউ তা বেশী জানত না। তবু গরম গরম বুলিতে জনতাকে ও পেতিবুর্জোয়া যুব সম্প্রদায়কে তাতিয়ে চাপ সৃষ্টি করে কংগ্রেসের নেতৃত্ব সে দখল করে নিতে পারে এমন একটা ভয় গান্ধীর বরাবর ছিল। এবং ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে, ধূর্ত গান্ধীর সে ভয় অমূলক ছিল না। তাছাড়া গান্ধীর সুভাষ বিদ্বেষের আরও একটা কারণ ছিল। বহুদিন ধরেই সুভাষের যোগাযোগ ছিল জার্মান, জাপান ও ইতালীর ফ্যাসিস্তদের সঙ্গে। জার্মান, জাপানী ও ইতালীয় সাম্রাজ্যবাদীরা যুদ্ধ করে বৃটিশ, ফরাসী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে উপনিবেশগুলি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিল এবং ভারতবর্ষে এই ষড়যন্ত্র হাসিল করতে হলে ভারতবর্ষে কিছু বিভীষণ তৈরির দরকার হয়ে পড়েছিল, যারা গরম গরম বৃটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের বুলি আউড়ে এবং ঐ সঙ্গে কৌশলে হিটলার-তোজো-মুসোলিনির স্বপক্ষে প্রচার চালিয়ে ভারতীয় জনতার মনকে  নয়া সাম্রাজ্যবাদীদের অনুকূলে টেনে আনবে এবং ভারতবর্ষকে ইংরাজের পরিবর্তে ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলির উপনিবেশে পরিণত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখবে। গান্ধী ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল বুর্জোয়াগোষ্ঠীর নেতা ও প্রতিনিধি, আর সুভাষ ছিল জার্মান-জাপানী-ইতালীয় সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর উদীয়মান দালাল দলের দলপতি। ভারতীয় দালাল বুর্জোয়াদের ছোট তরফ, যারা ভবিষ্যতে প্রভুবদল হলে বড় তরফ হবার স্বপ্ন দেখত, তাদের মদত ছিল এদের পেছনে। ইংরাজ এদের দেখতে না পারলেও সহ্য করত, কারণ কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থান ও প্রসারের বিরুদ্ধে এরা ছিল তাদের বড় রকমের সহায়ক শক্তি। তাছাড়া যুদ্ধ ছিল তখনও দূরের বস্তু, এবং ভারতবর্ষ হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা তখনও তার কাছে বাস্তব ছিল না, তাই কিছুটা ইংরাজের প্রশ্রয়েই এরা বেড়ে উঠেছিল, তবু ভুললে চলবে না, গান্ধীগোষ্ঠী ও সুভাষগোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ ছিল আন্তর্জাতিক দুনিয়ার দুই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর বিরোধেরই প্রতিফলন। দুই গোষ্ঠীই ছিল ভারতবর্ষের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের দুই তরফের রাজনৈতিক প্রতিনিধি মাও-সে-তুঙ দেখিয়েছেন, চীনেও এমনই বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে চীনের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াশ্রেণীবিভিন্ন গ্রূপ যুক্ত ছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নিজেদের বিরোধ এই মুৎসুদ্দি গ্রূপগুলির বিরোধরুপে আত্মপ্রকাশ করত। যদিও চীনের মত ভারতবর্ষে একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরোক্ষ শাসন ছিল না, ছিল একটিমাত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ একচ্ছত্র আধিপত্য, তথাপি ভারতের ক্ষেত্রে ঐ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি এবং তারই প্রকাশ গান্ধী সুভাষের বিরোধ। গান্ধীগোষ্ঠীর হিসাব ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ কখনও পরাজিত হবে না এবং ভারতবর্ষ কখনও তাদের হাতছাড়া হবে না; অতএব জনতাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য যতখনি না দেখালে নয় তার বেশী বৃটিশ বিরোধিতা দেখানো হবে না এবং যুদ্ধে ইংরাজ জড়িয়ে পড়লে এ বিরোধিতাটুকুও শিকেয় তুলে রাখতে হবে। আর সুভাষগোষ্ঠী হিসেব ছিল, যদিও ভারতবর্ষে ইংরাজ একচ্ছত্রধিপতি, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মান-জাপানী-ইতালী জোট ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠবে এবং একদিন যুদ্ধ বাধিয়ে ইংরাজের হাত থেকে ভারতবর্ষ কেড়ে নেবে; অতএব সেইমত প্রস্তুত হতে হবে, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নতুন প্রভুদের নেকনজরে থাকতে হলে আগে থাকতেই তাদের কাছে বৃটিশ বিরোধিতার পরিচয় দিতে হবে; তাদের আগমনের পথ সুগম করার জন্য যে অনেক কিছুই করা হয়েছে তার প্রমাণ রাখতে হবে। সুভাষের গান্ধী-বিরোধিতা ও গান্ধী-বিদ্বেষীতার মূল রয়েছে এখানেই। ক্রমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী বিরোধ তীব্র হয়ে যুদ্ধ বেধে যাওয়ায়, কংগ্রেসে গান্ধীসুভাষের বিরোধও তীব্র হয়ে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত সুভাষ পরাজিত হয়, তাকে দেশ ছেড়ে জার্মানীতে পালিয়ে যেতে হয়গান্ধীগোষ্ঠী ও সুভাষগোষ্ঠীর এই বিরোধের পাশাপাশি মিলও ছিল এবং সে মিল অত্যন্ত মৌলিকউভয়েই ছিল সোভিয়েত বিরোধী, কমিউনিজম বিরোধী, শ্রমিক-কৃষক-জনতা বিরোধী। সুভাষ বোস সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে, এআইটিইউসি'র সভাপতিও হয়েছে, এমনকি সহজানন্দের সঙ্গে মিলে কমিউনিস্টদের বিরদ্ধে একটা কাগুজে কৃষকসভাও বসিয়েছে, কিন্তু ঐ সবই ছিল ঠ্যালায় পড়ে এবং লোক দেখানো। আসলে সে ছিল অস্থি-মজ্জায় ফ্যাসিস্ত। হিটলার-তোজো-মুসোলিনি ছিল তার আদর্শ। সে শ্রমিক-কৃষক-জনতাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করত। তার 'স্বাধীন' ভারতবর্ষে শ্রমিক-কৃষকের আত্মপ্রতিষ্ঠার কোন স্থান ছিল না। শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলনকে সে কখনও সহ্য করতে পারত না। গান্ধীগোষ্ঠীর সঙ্গে লড়তে গিয়ে বামপন্থী শক্তিকে হাতে রাখার স্বার্থে যদিও তাকে মাঝে মাঝে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সমর্থকরূপে নিজেকে জাহির করতে হয়েছে, কিন্তু আদতে সে শ্রমিক-কৃষকের দাবী ও অধিকারের প্রশ্নটাকেই স্পর্ধা মনে করত। এই জন্যই তার কাছে নাৎসী মতাদর্শের এতখানি আকর্ষণ ছিল। সেইজন্যই বিশ্বভারতী ও রামকৃষ্ণ মিশনকে কেন্দ্র করে বিনয় সরকার, কালিদাস নাগ, সুনীতি চ্যাটার্জী, প্রমথ রায়, তুৰ্চী প্রমুখ 'অধ্যাপকেরা' হিটলার, মুসোলিনি ও তোজোর টাকায় যে ফ্যাসিবাদের প্রচার চক্র গড়ে তুলেছিল সুভাষ বোস ছিল অর অত্যুৎসাহী পৃষ্ঠপোষক। এই শতকের বিশের কোঠায় সে যখন কোলকাতা কর্পোরেশনের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ছিল তখন যেভাবে পুলিশ ও 'ব্ল্যাক লেগ' দিয়ে ধর্মঘট ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল তা হয়ত প্রবীনদের এখনও মনে আছে। ১৯২৮ সালে কোলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে যখন কয়েক হাজার ধর্মঘটি রেল শ্রমিকের এক মিছিল আসে কংগ্রেস নেতাদের কাছে তাদের সংগ্রামের সমর্থনে দাঁড়ানোর আবেদন নিয়ে, তখন ভলান্টিয়ার বাহিনীর অধিনায়করুপে সুভাষ বোস কিভাবে তাদের উপর লাঠি চার্জ করার নির্দেশ দিয়েছিল সিপিএমের নেতা মুজফফর আহম্মদ পর্যন্ত তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে। কিভাবে সদ্যগঠিত ফরোয়ার্ড ব্লকের তহবিলে 'চাঁদা'র বিনিময়ে সুভাষ বোস মোহিনী মিলসের শ্রমিক ধর্মঘটের বিরুদ্ধে মালিক পক্ষের সমর্থনে কাগজে বিবৃতি দিয়েছিল তাও নিশ্চয়ই অনেকেরই স্মরণ আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতার প্রোগ্রাম হিসাবে কমিউনিস্টরা যখন জঙ্গী কৃষক আন্দোলন শুরু করে তখন তাকে বানচাল করার জন্য সুভাষ বোস রাতারাতি 'হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙ্গা'র আন্দোলন শুরু করে দিল। এই কৃষক সংগ্রামের সমর্থনে একটি বিবৃতি দিতে পর্যন্ত সে অস্বীকার করে; বলে, সে বিবৃতি দেবে না, তবে দরকার হলে কিছু কম্বল দিতে পারে। দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে লাভ নেই। সত্যই সুভাষ ছিল মনে প্রাণে ফ্যাসিস্ত, মনে প্রাণে শ্রমিক-কৃষক বিরোধী।যুদ্ধের প্রথম দিকের গতি দেখে, বিশেষ করে জার্মানী কর্তৃক সোভিয়েত আক্রান্ত হওয়ার পরবর্তী কয়েক মাসের ঘটনাবলী দেখে ভারতবর্ষের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের দৃঢ় ধারণা হলো ইংরাজ হেরে যাচ্ছে এবং ভারতবর্ষ জার্মান-জাপানী উপনিবেশে পরিণত হচ্ছে। রাতারাতি গান্ধীগোষ্ঠী ভীষণ বৃটিশ বিরোধী হয়ে উঠল। যুদ্ধ আরম্ত হলে যে গান্ধী বলেছিল, ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদের উপর বোমা পড়লে সে সহ্য করতে পারবে না; সেই গান্ধীই হঠাৎ ইংরাজকে 'কুইট-ইন্ডিয়া' অর্থাৎ 'ভাগো হিঁয়াসে' বলে চরমপত্র দিল, 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গেবলে হুঙ্কার দিয়ে উঠল এবং '৪২-এর আন্দোলনের অর্থাৎ বৃটিশ বিতাড়নের জন্য সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থানের প্ল্যান করল। যে সুভাষকে তারা খেদিয়ে দেশছাড়া করেছিল সেই সুভাষই রাতারাতি তাদের ভীষণ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। তখন জার্মান ও জাপানী সাম্রাজ্যবাদের 'গুডবুকে' থাকার জন্য গান্ধী ও সুভাষের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। যে গান্ধী-সুভাষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল রাতারাতি তারা পরস্পরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। বার্লিন বেতার থেকে সুভাষ বোস গান্ধীর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে বক্তৃতা দিতে লাগল; গান্ধীও সুভাষ বলতে মুহুর্মুহু মুর্চ্ছা যেতে লাগল। মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিদের এক অংশ অন্য হিসাব করেছিল। এই অংশের প্রতিনিধি ছিল নেহরু, আজাদ ও রাজাজী। তাদের হিসাব ছিল, শেষ পর্যন্ত ইংরাজ জিতে যাবে এবং জার্মানী, জাপান, ইতালি হারবে কারণ যুদ্ধের গতিপথে ইংরাজের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে আমেরিকা, চীন এবং সর্বোপরি রাশিয়া। অতএব শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষ ইংরাজের হাতেই থাকবে; তাই ইংরাজের পক্ষ ত্যাগ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু এদের কথায় তখন গান্ধীগোষ্ঠী কান দেয়নি। গান্ধীর 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের পূর্বাহ্নে এলাহাবাদে এআইসিসি'র গোপন বৈঠকের যে হুবহু বিবরণ (মিনিটস) ভারত সরকার গুপ্তচর মারফৎ সংগ্রহ করে প্রকাশ্যে ছেপে দিয়েছিল (কংগ্রেসের তরফ থেকে তার কোন প্রতিবাদ হয়নি) তাতেই এ কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। লক্ষ্য করুন, 'যে জিতবে তার সঙ্গে থাকতে হবে' এতে সকলেই একমত, মতভেদ শুধু কে জিতবে নিয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নামে স্বার্থান্বেষী সুবিধাবাদের এ এক কদর্য নিদর্শন। সত্যনিষ্ঠ গান্ধী ইংরাজ পক্ষ ত্যাগ করতে চাইছে ইংরাজ অন্যায় যুদ্ধ করছে বলে নয়, ইংরাজ হেরে যাচ্ছে বলে; আর ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধের অন্যতম বিশ্বনায়ক বলে পরিচিত নেহরু ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলির বিরুদ্ধে ইংরাজের সঙ্গে থাকতে চাইছে ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলিকে যে কোন মূল্যে হারানোর মহান আদর্শে প্রণোদিত হয়ে নয়, ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলির পরাজয় সুনিশ্চিত বলে। জার্মানী কর্তৃক রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন কিন্ত যুদ্ধের চেহারা ও চরিত্র পালটে গেছে। সমগ্র দুনিয়ার এবং ঐ সঙ্গে ভারতেরও প্রগতিশীল জনতা তখন দুনিয়ার একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়ার সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ চলছে। স্তালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ানরা অমিত বিক্রমে লড়ছেন। রাশিয়ানরা যদি স্তালিনগ্রাদ রক্ষা করতে পারেন তা হলেই দুনিয়া বাঁচবে, নতুবা সব শেষ। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধংস হয়ে গভীরতম অন্ধকারে দুনিয়া আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। ঠিক সেই সময়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী বাহিনীর পরাজিত ও বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে হিটলার 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' নামে একটা সেনাবাহিনী তৈরী করে এবং সুভাষ বোসকে তার নায়ক করে দেয়। সুভাষ বোসকে মাথায় বসিয়ে 'স্বাধীন ভারত সরকার' নাম দিয়ে একটা পুতুল সরকারও সে তৈরী করে। তার প্ল্যান ছিল স্তালিনগ্রাদের পতন হলে সে সুভাষ বোস ও তার 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' ও 'আজাদ হিন্দ সরকার'কে নিয়ে ককেসাস পর্বতমালা পেরিয়ে ভারতে ঢুকবে এবং সেখানে সুভাষ বোসকে দিয়ে ঐ বিভীষণ সরকারের প্রতিষ্ঠা করাবে; যার বাইরের খোলসটা হবে 'স্বাধীন ও জাতীয়তাবাদী' কিন্তু আসলে সে হবে জার্মান সাম্রাজ্যবাদের একটি ঔপনিবেশিক পুতুল সরকার। সুভাষ বোসও তখন রোজ বার্লিন বেতার থেকে ভারতবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলত স্তালিনগ্রাদের পতন হলো বলে এবং হলেই হিটলার বাহিনীর সঙ্গে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' নিয়ে সে ভারতে যাবে এবং ভারতবর্ষে তার 'স্বাধীন সরকার'কে প্রতিষ্ঠা করবে। এদিকে বাবুর ভাগ্য বিপর্যয়ে রক্ষিতার মত গান্ধীগোষ্ঠীও তখন নতুন বাবুর রক্ষিতা হবার আশায় দিন গুণছে এবং যে সুভাষকে দুবছর আগে তারা তাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে তখন দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছেসুভাষ-গান্ধীতে তখন ভেদাভেদ ঘুচে গেছে। সুভাষ বোসের সমর্থনে অনেকে বলে থাকেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তো ভারতীয় বিপ্লবীরা জার্মানীর সাহায্যে ভারতের মুক্তিবিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল। এরা যে কথাটি ভুলে যান বা চেপে যান তা হচ্ছে এই যে, তখন অক্টোবর বিপ্লব হয়নি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল না এবং ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনও ছিল না। তখন হয়তো তাদের পক্ষে এসব ধরনের কাজ ও চিন্তা স্বাভাবিক ও সঙ্গত ছিল। কিন্তু দুনিয়ার এক-ষষ্ঠাংশ জুড়ে ঔপনিবেশিক জনতার এতবড় অকৃত্রিক বন্ধু ও সাহায্যকারী এক বৃহৎ ও এত শক্তিশালী এক রাষ্ট্রশক্তি বিদ্যমান থাকতেও এবং ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলন এতখানি জোরদার ও অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নামে তাকে শুধু বাদ দেওয়া নয়, তার বিরোধী ও ধ্বংসকামী শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো অমার্জনীয় অপরাধ ও সীমাহীন ভন্ডামী। ঐতিহাসিক নজির টানারও একটা মাত্রা থাকা উচিত। থাক সে কথা। কিন্ত স্তালিনগ্রাদের পতন হলো না, যুদ্ধের চাকা ঘুরে গেল। পতন শুরু হলো হিটলারের। গান্ধী-সুভাষের সমস্ত হিসাব বানচাল হয়ে গেল। স্তালিনগ্রাদের বিজয়োৎসবে সারা দুনিয়ার প্রগতিশীল জনতা যখন উল্লাসে ফেটে পড়ছে তখন সুভাষ বোস মাথায় হাত দিয়ে বসেছে। সে তখন বুঝেছে, স্তালিনের লালফৌজের অমিত বিক্রম আক্রমণে হিটলার বাহিনীর পতন ও ধ্বংস অনিবার্য। তখন তার একমাত্র ভরসা জাপান। তখন সে জাপানে চলে আসে। তখন চীনে জাপান বিরোধী যুদ্ধ চলছে এবং জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছে। জার্মানীর মত জাপানও সুভাষ বোসকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী বাহিনীর পরাজিত ও বন্দী ভারতীয় সৈনাদের দিয়ে একটা ফৌজ বানিয়ে দিল; একটা পুতুল সরকারও তৈরী করে দিল এবং সঙ্গে করে ভারতে নিয়ে চললো ঠিক জার্মানী যা করেছিল তাই করার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হলো না। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েৎনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয় ও বর্মার বীর জনগণ সশস্ত্র সংগ্রামে ফ্যাসিস্ত জাপানী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দিয়ে সুভাষ বোসের জাপান অধিকৃত ভারতে পুতুলরাজা সাজার সাধ চিরতরে মিটিয়ে দিল। তাই যেমন ইউরোপ-আমেরিকার বিপ্লবী জনগণের চোখে, ঠিক তেমনই এশিয়া-আফ্রিকার বিপ্লবী জনগণের চোখে সুভাষ বোস ফ্যাসিস্ত দুশমনদের ঘৃণিত সহযোগী মাত্র। অতএব তাদের পূজো করার অর্থ নিজেদের দুনিয়ার বিপ্লবী জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া। যুদ্ধে জিতে ইংরাজ আবার কংগ্রেসকেই ক্ষমতায় বসায় এবং যারা একদিন সুভাষ বোসকে দেশছাড়া করেছিল তারাই সেদিনের সুভাষ বোসকে 'নেতাজী' বানিয়ে তার মূর্তি গড়ে পূজা করতে আরম্ভ করে। কারণ ভারতীয় জনতা তখন জেগে উঠে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে অগ্রসর হতে চাইছে; তাই কমিউনিস্টদের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে হলে কমিউনিস্ট বিদ্বেষের ও ফ্যাসিস্ত ভাবাদর্শের প্রতীক সুভাষ বোসের ভাবমূর্তির তার বড় প্রয়োজন। যুদ্ধের পর অবস্থা তখন এমন হয়েছে যে অহিংস সংগ্রামের কথা শুনলে লোক মারতে আসছে, আবার সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বললে সংগ্রাম কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়। এই উভয় সংকট এড়ানোর জন্য হাতের কাছে যুতসই অস্ত্র পাওয়া গেল সুভাষ বোস - সশস্ত্র সংগ্রাম ও কমিউনিস্ট বিদ্বেষের সংযোগের প্রতিমূর্তি। সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে এই যে, সুভাষ বোসকে সামনে নিয়ে দালাল বুর্জোয়াদের এই সুকৌশলী কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযানের সম্মুখে সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারল না, তারা জনতার কাছে সুভাষকে 'নেতাজী' বানানোর রহস্য ফাঁস করার চেষ্টা করল না, ফ্যাসিস্ত কাগুজে বাঘের করাল দংষ্ট্রা রূপ দেখে ভয়ে তাদের হাঁটু কাঁপতে লাগল; ওদিকে তাদের মাথায় ঘুরতে লাগল ভোট; সত্যকে বিসর্জন দিয়ে যেনতেন প্রকারে জনতার মনোরঞ্জনই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠল। একদা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের চাপে সুভাষ বোসকে তারা যে ফ্যাসিস্ত বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়েছিল, ভোট খোয়ানোর আতঙ্কে নাকে খত দিয়ে তারা তা প্রত্যাহার করে নিল। ভারতবর্ষে সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের এই নীতিহীনতা, সুবিধাবাদিতা ও কাপুরুষতার সুযোগ নিয়ে ভারতবর্ষের বুকে গেড়ে বসল 'নেতাজী'। ১৮৫৭-৫৮ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকেই বলা চলে বৃটিশ শাসন উচ্ছেদের জন্য ভারতীয় জনতার মধ্যে বারবার নিজস্ব ফৌজ গঠন করে সশস্ত্র গণসংগ্রামের আকাঙ্খা জেগে ওঠে এবং প্রতিবারই সে আকাঙ্খা কংগ্রেসী কূটচক্রে অপূর্ণ থেকে যায়। শ্রমিক-কৃষক জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন পেতিবুর্জোয়া বিপ্লববাদের প্রাধান্য এবং সর্বহারা মতাদর্শের অভাবের ফলেই অবশ্য এই কূটচক্র বিফল হতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ও পরে ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জার্মান ও জাপানী ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণ প্রতিরোধ সংগ্রামের দৃষ্টান্তে এবং চীনের জাপান বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতির প্রভাবে ভারতীয় জনতার মধ্যে আবার নিজস্ব ফৌজ মারফত সশস্ত্র সংগ্রামের পথে বৃটিশ শাসন উচ্ছেদের আকাঙ্খা প্রবল হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, জনতার এই আকাঙ্খাকে দমন বা বিভ্রান্ত করা কংগ্রেসী নেতৃত্বের পক্ষে আর সম্ভব হয় না; ভারতীয় জনতা এই আকাঙ্খা নিয়ে অনিবার্যভাবেই কমিউনিস্ট পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব কিন্তু 'চীনের পথ থেকে ভারতের পথ ভিন্ন' এই আওয়াজ তুলে প্রথমে বামপন্থী হঠকারিতা ও পরে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের আশ্রয় নিয়ে এই বিপ্লবমুখী জনতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। একদিকে কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের এই বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে ভারতীয় জনতার নিজস্ব ফৌজের সাহায্যে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা - এর সুযোগ পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' ও 'নেতাজীর' ভাবমূর্তি তৈরী করা হয়। বিপ্লবী জনতার মধ্যে সুভাষ বোস বলতে এখনও যে একটা শ্রদ্ধার ভাব দেখা যায় তা হচ্ছে আসলে জনতার এই বিপ্লবী আকাঙ্খারই প্রতিফলন। পাল্টা কমিউনিস্ট প্রচারের অভাবের সুযোগ নিয়ে বুর্জোয়া প্রচার তাদের মধ্যে এই মিথ্যার ধারণা এখনও জীইয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে যে, বিপ্লবী জনতা যা চায় সুভাষ বোস ঠিক তাই করতে চেয়েছিল। বুর্জোয়া প্রচারের উদ্দেশ্য হল সুভাষ পূজার মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে জনমনে ফ্যাসিস্ত ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। একটা কথা মনে রাখা দরকার। 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' গণফৌজ নয়। 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' শ্রেণীসংগ্রাম থেকে উদ্ভুত বা সংগৃহীত ফৌজ নয়, কিংবা সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী সৈন্যদের নিয়ে গঠিত ফৌজ নয়, যা ছিল 'সিপাহী বিদ্রোহে'র বিদ্রোহীদের ফৌজ। এই সেনাবাহিনী ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরাজিত ও বন্দী ভাড়াটিয়া সৈন্যদের নিয়ে অপর একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক গঠিত পুতুল ফৌজ, যার গালভরা নাম দেওয়া হয় 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' বা 'ভারতীয় মুক্তি ফৌজ'। হিটলার যখন পূর্ব-ইউরোপের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশক্তি ও তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ফৌজকে পরাজিত করে ঐ দেশগুলি দখল করে নেয় তখন ঐ সব পরাজিত ও বন্দী ভাড়াটিয়া ফৌজ থেকেই সে নতুন নতুন পুতুল ফৌজ তৈরী করেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণে তাদের নিয়োগ করেছিল; সব ফৌজকেও সে সব দেশের 'গণমুক্তি ফৌজ' নাম দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে প্রতিটি অধিকৃত দেশের জন্য এক একটি মুক্তি সরকার তৈরী করেছিল ও তাদের প্রত্যেকের জন্য এক একজন নায়কও তৈরী করে দিয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিটি অধিকৃত দেশেই সে একজন করে 'নেতাজী' ও তার একটি করে 'আজাদ ফৌজ' ও 'আজাদ সরকার' তৈরী করে দিয়েছিল। স্তালিনের লালফৌজের বিজয় অভিযানের মুখে ঐ সব দেশের জনতা সশস্ত্র অভ্যুত্থানে সব 'নেতাজী', 'আজাদ সরকার' ও তার 'আজাদ ফৌজ'কে চূর্ণ করে ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে নিক্ষেপ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়ার মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতার চোখে ফ্যাসিজম জয়ী স্তালিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে আরূঢ়। খোশলা কমিশন উপলক্ষ্যে আজও যেমন রটানো হচ্ছে, পঁচিশ বছর আগে সে দিনও তেমনি স্বার্থান্বেষীদের পক্ষ থেকে গুজব রটানো হয়েছিল যে, সুভাষ বোস স্তালিনের আশ্রয়ে রয়েছে এবং সেখানে বসে ভারতের মুক্তিযুদ্ধের প্ল্যান আঁটছে। এইভাবে মহান স্তালিনের নাম নিয়ে ঘৃণিত এক ফ্যাসিস্ট দালালকে তারা মহান মুক্তিযোদ্ধার আসনে বসানোর চেষ্টা করেছিল ঠিক যেমনটি আজও করছে। সেদিন এই রটনার মুখের মত জবাব এসেছিল স্তালিনের রাশিয়া থেকে। আজ থেকে ২৫ বছর আগে, ১৯৪৬ সালের ৯ই জানুয়ারী, রয়টার্স পরিবেশিত যে ছোট্ট সংবাদটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তা ঐ তরিখের 'হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকা থেকে আমরা এখানে তুলে দিচ্ছি:-

লন্ডন, ৭ই জানুয়ারী, মস্কো বেতারে বলা হয়েছে: সুভাষচন্দ্র বোস, যে যুদ্ধের মধ্যে স্বাধীন ভারত সরকারের প্রধান ছিল সে এখন সোভিয়েত ইউনিয়নে রয়েছে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেই সংবাদকে আজ সোভিয়েত সাংবাদিক ডেভিভ জাল্লাভস্কি প্রাভদায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে 'আজগুবী রূপকথা' বলে ঘৃণাভরে অস্বীকার করেছেন। জাল্লাভস্কি লিখেছেন, এইসব রূপকথার মূল হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষের কুখ্যাত ভবিষৎ বিভীষণ সুভাষচন্দ্র বোস, যে আগে বার্লিনে হিটলারের টাকা খেত ও পরে টোকিওতে জাপানী সাম্রাজ্যবাদীদের টাকা খেয়েছে, সে নাকি রাশিয়ায় পালিয়ে গেছে। এই ফ্যাসিস্ত হারামজাদা নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে এবং সেখানে তার তিন লাখের এক সেনাবাহিনী পরিদর্শন করেছে। একজন বেনামী সৈন্য নাকি জানতে পেরেছে যে সোভিয়েত সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা সুভাষ বোসের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং ভারতীয় ফ্যাসিস্ত ভাগ্যাদ্বেষীটিকে কি সব কাল্পনিক নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। এই হচ্ছে আজগুবী রুপকথা।

প্রাভদার পুরো প্রবন্ধের এইটুকু মাত্র তখন রয়টার্স ভারতবর্ষে পরিবেশন করেছিল এবং অন্তত বাংলাদেশের সমস্ত সংবাদপত্রেই তা প্রকাশিত হয়েছিল। হয়নি শুধু তখনকার দিনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক 'স্বাধীনতা'য়, পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি.সি. যোশী ছাপাতে নিষেধ করে দিয়েছিল। ভারতের মুক্তিযুদ্ধের নাম দিয়ে যে ফ্যাসিস্ত হারামজাদা একদিকে স্তালিনের রাশিয়া ও অন্যদিকে মাও সে তুঙ এর চীনকে ধংস করার দুনিয়াজোড়া চক্রান্তের অংশীদার হয়েছিল, স্বয়ং স্তালিন এইভাবে যখন দুনিয়ার দরবারে তার মূর্তি ভেঙে দিচ্ছিলেন, তখন ভারতবর্ষের সংশোধনবাদী বজ্জাতরা ভারতবর্ষে সেই মূর্তি এইভাবে রক্ষা করেছিল। আজ ২৫ বছর পরে 'নকশালবাড়ী'র আলোকে জাগ্রত ভারতবর্ষের বিপ্লবী যুব ছাত্ররা সুভাষ বোসের মৃর্তিকে ভেঙ্গে স্তালিনের আরদ্ধ কাজকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আর জ্যোতি-প্রমোদ-হরেকেষ্ট প্রমুখ ভোট ভিখারী সংশোধনবাদী কুত্তার দল বিশ্ব সর্বহারার দুশমনের ঐ মূর্তিকে বুক দিয়ে রক্ষা করছে। এরাই যখন আবার স্তালিনের নাম করে স্তালিনের জন্মোৎসব পালন করে, বুর্জোয়া পার্লামেন্টের শুয়োরের খোঁয়াড়ে ঢোকার অজুহাত হিসাবে ঘন ঘন স্তালিনের উদ্ধৃতি দেয় এবং দন্ত বিকশিত করে সভা সমিতিতে স্তালিনের জয়ধ্বনি করে তখন ইচ্ছা করে লাথি মেরে শালাদের দাঁতের পাটি খসিয়ে দিই।

দেশব্রতী, ২০শে মার্চ, '৭১

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]