পুঁজিবাদী চীনে শ্রমিক আন্দোলন


মাও জমানায় শ্রমিকরা ছিল কারখানারা প্রভু। শ্রমিকরা বিবিধ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতো সেসময়। শ্রমিকদের বসিয়ে দেয়ার অধিকার কারখানাগুলোর ছিল না। যদি রাষ্ট্র কোনো কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতো, তাহলে তা শ্রমিকদের নতুন চাকরিতে পুনর্বাসন করতো। জাতীয় মজুরীর মানদণ্ড অনুযায়ী মজুরী বণ্টন করা হতো এবং আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা পরিষেবা শ্রমিক এবং তাদের পরিবারকে সস্তায় বা বিনামূল্যে সরবরাহ করা হতো। শ্রমিকরা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতো এবং ম্যানেজাররা অংশগ্রহণ করতো কায়িক শ্রমে।শ্রমিকদের চার মহান অধিকার ছিল (স্বাধীনভাবে কথা বলবার অধিকার, যে কারোর নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার, বিশাল ‘ক্যারেক্টার পোস্টার’ লেখার অধিকার এবং মহাবিতর্ক পরিচালনা করার অধিকার) যার সাহায্যে তারা প্রকাশ্যে ক্যাডারদের সমালোচনা করতে পারতো। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় (১৯৫২-১৯৫৬) চীন উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনার সোভিয়েত মডেল থেকে শিক্ষা নিয়েছিল, যেখানে ম্যানেজার ব্যবস্থাপনার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতো আর শ্রমিকরা ম্যানেজারের নির্দেশকে মেনে চলতে বাধ্য ছিল। উপরন্তু, সোভিয়েত মডেল বস্তুগত উৎসাহ প্রদান চালু করেছিল উৎপাদনে শ্রমিকদের উৎসাহকে বজায় রাখতে। সোভিয়েত মডেল শ্রমিকদের উৎপাদনের সাবজেক্ট হিসাবে না দেখে যন্ত্র হিসাবে বিচার করতো। এটি ম্যানেজারকে 'ডিভাইড অ্যান্ড কঙ্কার' নীতি অনুসরণ করতে অনুমোদন দিতো, যেহেতু সকল শ্রমিকের বস্তুগত উৎসাহ প্রদানের দ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, বস্তুগত উৎসাহ প্রদান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৮ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কালের কয়েক বছর পর মাও সেতুং বস্তুগত উৎসাহ প্রদানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপণের জন্য রাজনৈতিক অর্থনীতির সোভিয়েত পাঠ্যপুস্তকের সমালোচনা করেন-

"(পাঠ্যপুস্তকটি) একথা বলে না যে, যদি সমস্ত মানুষের আগ্রহকে অর্জন করা যায়, তাহলে ব্যক্তির আগ্রহকেও অর্জন করা যায়; পাঠ্যপুস্তকের বস্তুগত উৎসাহ প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপণ প্রকৃতপক্ষে একটি অত্যন্ত অদূরদর্শী ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ। সক্ষমতার অনুসার হতে, কর্মক্ষমতার অনুসার অবধি বাক্যের প্রথম অংশের অর্থ হলো, উৎপাদনের ক্ষেত্রে জনগণ তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা প্রদান করবে। লোকেরা কেন এই বাক্যটিকে প্রথম অংশ ছাড়া বোঝে এবং সবসময় বস্তুগত উৎসাহ প্রদানে জোর দেয়?"

[Mao’s Notes and Talks on Reading Socialist Political Economy, National History Academy, Beijing, 1998]

১৯৬০ সালে আনগাং ইস্পাত কারখানায় আনগাং সংবিধানের প্রস্তাব করা হয়। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Angang_Constitution#:~:text=The%20Angang%20Constitution%20was%20an,under%20management%20at%20a%20capitalist

সোভিয়েত মডেলের বিকল্প ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতির উপর আনগাং সংবিধান জোর দিয়ে বলে, উৎপাদনে শ্রমিকের উৎসাহের ভিত্তি হবে শ্রমিকদের চেতনার মানের উপর - শ্রমিকদের এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, তারাই কারখানার প্রভু এবং এই উৎপাদন সামগ্রিকভাবে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থকেই পুষ্ট করবে।

[China's Industrial Revolution: Politics, Planning, and Management, 1949 to the Present]

শ্রমিকদের কারখানার মালিক হিসাবে গড়ে তুলতে তিনটি শর্তকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে। সবার প্রথমে উৎপাদন এবং ম্যানেজমেন্ট শ্রমিক এবং ম্যানেজারের মধ্যকার বিভাজনকে দুর্বল করবে; এতে শ্রমিকেরা ম্যানেজমেন্ট এ অংশগ্রহণ করবে এবং ম্যানেজাররা অংশগ্রহণ করবে কায়িক শ্রমে। এর সাথে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ম্যানেজারদের সমালোচনা করার রাজনৈতিক অধিকার শ্রমিকদের থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের চাকরির সম্পূর্ণ নিরাপত্তা এবং সুস্থিত আয় থাকতে হবে; অন্যথায় তাদের জীবন ধারণের জন্য উদ্বেগে থাকতে হবে এবং এতে উৎপাদনের বিকাশে তারা তাদের পূর্ণ সক্ষমতা দিতে পারবে না।

তৃতীয়ত, বস্তুগত উৎসাহ প্রদানকে বাতিল করতে হবে যেহেতু তা ম্যানেজারদের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বল্পকালীন ব্যক্তিগত স্বার্থ শ্রমিক শ্রেণির সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এটি বিশেষত চীনের মতন একটি দেশে হতে পারে যেটিকে একইসাথে দু'টি ঐতিহাসিক কাজ সামলাতে হয়েছে: একটি হলো শিল্পায়নের কাজ এবং অপরটি হলো শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নতি। যদি উৎপাদনে শ্রমিকদের উৎসাহের ভিত্তি বস্তুগত উৎসাহ প্রদান হয়, তাহলে শ্রমিকদের আরও বেশি মজুরী এবং কম সঞ্চয়ের প্রয়োজন হবে এবং শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থকে কেউ পাত্তা দেবে না।

মাও জামানায় শ্রমিকদের ভোগ করা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো এবং সেই অধিকার ভোগের মাধ্যমে গড়ে ওঠা তাদের চেতনা সেই যুগের উৎপাদনের মডেলের ভিত্তি নির্মাণ করেছিল। যেহেতু বস্তুগত উৎসাহ প্রদান উৎপাদনের মডেলের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল, তাই এককভাবে একটি কারখানার শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির অধিকার ছিল না এবং শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা ও শ্রমিকের জীবনধারণের মানকে বিবেচনার মধ্য দিয়ে একমাত্র রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিতে পারতো কখন ও কিভাবে মজুরী বাড়ানো হবে।

নিচের চার্টটি মাও জমানায় প্রকৃত মজুরীর স্তরের ছবি তুলে ধরছে যা থেকে বোঝা যায় প্রকৃত মজুরী প্রায় একই ছিল। এটি ঘটেছিল ন্যূনতম মজুরীর স্তরের স্থবিরতার কারণে। ১৯৫৮ সালে টংগাং প্রতিষ্ঠার পর মজুরী বৃদ্ধি ঘটেছিল ১৯৫৯, ১৯৬৩, ১৯৭১ এবং ১৯৭৭ সালে। এই মজুরী বৃদ্ধি থেকে সমস্ত শ্রমিক উপকৃত হয়নি; ১৯৬৩ এবং ১৯৭৭ সালে যথাক্রমে ১৪% এবং ৩০% শ্রমিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত মজুরী পেয়েছিল।

[Tonghua Steel Company, Tonggang History 1958-1985]

মজুরীর স্থবিরতা মানে এটা নয় যে, প্রকৃত মজুরীর স্তর শ্রমিকদের জন্য কম ছিল। আজকের দিনের ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল আবাসন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা পরিসেবার সাথে তুলনায় ['শ্রমিকের পিঠের তিনটে বিরাট পাহাড়'] শ্রমিকদের আবাসন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা পরিসেবার জন্য খুবই সামান্য ব্যয় করতে হতো সেসময়। মাও জমানায় টংগাং এ ন্যূনতম মজুরীর স্তর ছিল বাৎসরিক ৬০০ ইউয়ান।

শ্রমিকরা তাদের মজুরীকে মূলত আবশ্যিক ভোগ্যপণ্যে; যথা- খাবার, জামাকাপড়ে খরচ করতো। গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড আন্দোলনের সময় শহরের জনসংখ্যার অস্থিতিশীল সম্প্রসারণের পর সরকার শহরের জনগণের কাছে আবশ্যিক ভোগ্যপণ্যকে রেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করা শুরু করে। খাদ্য সরবরাহের মানদণ্ড অনুযায়ী ভারি কায়িক শ্রম দিচ্ছে এমন শ্রমিক প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৪.৫ কিলোগ্রাম এবং একজন ম্যানেজার ১৩.৫ থেকে ১৬ কিলোগ্রাম দানা শস্য কিনতে পারতো। আবশ্যিক ভোগ্যপণ্যের দামের ওঠাপড়া একদম ছিল না। ১৯৮০ সালে দানা শস্যের জাতীয় গড় মূল্য ছিল কিলোগ্রাম প্রতি ০.৩ ইউয়ান।

[National Bureau of Statistics, China Statistical Yearbook 1981]

আবাসন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা পরিষেবা - সমস্ত কিছু টংগাং ও টংগাং এর সাথে যুক্ত স্কুল এবং হাসপাতালগুলো সরবরাহ করতো। যদি পরিবারের মাথা পিছু মাসিক আয় ৮ ইউয়ানের কম হতো, তাহলে স্কুলের ফি মওকুফ হয়ে যেতো। যদি মাথা পিছু মাসিক আয় ১০ ইউয়ানের কম হতো, তাহলে পরিবার ইউনিয়ন থেকে ভর্তুকি পেতো।

[Wages, Benefits and Social Insurances in the Contemporary China, Social Science Press, 1987]।

প্রতি মাসে ১০ ইউয়ান আয়কে দারিদ্র সীমা বলে ধরে নেয়া হলেও একজন শ্রমিকের এই মজুরী পাঁচ জনের একটি পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারতো, এজন্যই শ্রমিকরা মাও জমানায় কোনও অর্থনৈতিক চাপ অনুভব করতো না। চাকরির নিশ্চয়তার কারণে মাও জমানায় শ্রমিকরা এটা প্রত্যাশা করতে পারতো যে, উৎপাদনের বিকাশের সাথে সাথে তাদের জীবন মানের উন্নতি হবে। মাও জমানায় ম্যানেজার এবং শ্রমিকের মধ্যকার অর্থনৈতিক অসাম্য ছিল সামান্য, নিচু স্তরের ম্যানেজাররা শ্রমিকদের গড় মজুরীর চেয়ে কম মজুরী পেতো। শ্রমিকদের রাজনৈতিক অধিকারের কারণে ম্যানেজার এবং শ্রমিকদের মধ্যে বাধ্যতামূলক বৈষম্য ছিল। মাও জমানা চীনা শ্রমিক শ্রেণিকে ব্যাপকভাবে সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা প্রদান করেছিল। শ্রমিকদের কাছে সমাজতন্ত্র কোনও পাঠ্যপুস্তকের ধারণা মাত্র ছিল না। সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা শ্রমিকদের কাছে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে, পুঁজিবাদ বা বেসরকারিকরণ একমাত্র বিকল্প নয় এবং পুঁজিবাদ ছাড়াই উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো যায়। ১৯৫৮ সালে যখন টংগাং স্থাপিত হলে চীনের বিভিন্ন অংশ থেকে ১৩ হাজারের অধিক শ্রমিক টংগাং এর দ্বারা নথিবদ্ধ হয়েছিল। 

মাও পরবর্তী সংস্কার শ্রমিকদের দ্বারা সৃষ্ট মূল্যকে পুঁজির অংশীদার এবং কারখানার প্রভুদের মুনাফামুখি সংস্থার মজুরী দাসে পরিণত করেছিল। ১৯৭৮-১৯৯৫ পর্যন্ত টংগাং মাও জমানার মডেলকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য বস্তুগত উৎসাহ প্রদান চালু করে। মাও জমানার পর রাজনৈতিক অধিকারগুলো বাতিল করা হয় এবং ম্যানেজমেন্টে ম্যানেজারদের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা হয়। মাও জমানার উৎপাদনের ভিত্তিকে হারাতে শ্রমিকদের উৎসাহকে বজায় রাখতে বস্তুগত উৎসাহ প্রদানকে চালু করতেই হতো এবং সংস্কারের পক্ষে সমর্থনের জন্য শ্রমিকদের ঘুষ দিতেই হতো। টংগাং এ মোট মজুরীর উপর বোনাসের ভাগ ১৯৭৮ সালের ২% থেকে বেড়ে ১৯৮০ সালে ১০% এর বেশি বৃদ্ধি পায়।
মজুরীর বৃদ্ধিকে মুনাফার বৃদ্ধি, কর এবং শ্রমের উৎপাদনশীলতার সাথে যুক্ত করে টংগাং এ মজুরী বৃদ্ধিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে দেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ম্যানেজমেন্ট মডেল নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি, কারণ তখনও শক্তিশালী শ্রমিক শ্রেণি মুনাফাকে বের করে নিতো। সংস্কার যুগের প্রথম পর্যায়ের পর টংগাং রাষ্ট্রীয় নীতির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, যে নীতির লক্ষ্য ছিল মধ্য ৯০-এর দশকের গুরুতর মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। মুনাফার পতন প্রথম পর্যায়ে ম্যানেজমেন্ট মডেলের সমাপ্তিকে চিহ্নিত করেছিল।

১৯৯৬-২০০৫ পর্যন্ত টংগাং শ্রমিকদের অধিকারকে বাতিল করতে বিভিন্ন প্রকারের একাধিক কার্যক্রম গ্রহণ করে। লাগাতার মজুরী বৃদ্ধিকে রদ করা হয়। ১৯৯৬ সালে চিফ ম্যানেজার ঘোষণা করলেন-

"মজুরী এবং সুযোগ সুবিধা বিষয়ে আইন এবং সরকারের নথি যা স্থির করেছে তা একমাত্র তখনই পাওয়া যেতে পারে যখন টংগাং তা দেয়ার মতো সক্ষম হবে। তাই অনেক উদ্যোগই তাদের শ্রমিকদের কোনও মজুরী আজকাল দিতে পারে না। টংগাং বরাবরের জন্য মজুরী বৃদ্ধিকে চালিয়ে যেতে পারে না।"

প্রথাগত শ্রমিকদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের পরিযায়ী শ্রমিকদের মজুরী ছিল গড়ে অর্ধেক। টংগাং পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে ছাঁটাই করতে পারতো। ১৯৯৬ সালে পরিযায়ী শ্রমিকদের ১ কোটি ৩০ লক্ষ ইউয়ান দেয়া হয়েছিল যা কোম্পানির বেতন খাতে খরচের ৯ শতাংশ সাশ্রয় করে। টংগাং শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সংস্কারের যুগের শুরুতে টংগাং এর শ্রমিক ছাঁটাই এর অধিকার ছিল না। ১৯৮৫ সালে টংগাং সমস্ত নতুন নথিবদ্ধ শ্রমিকদের লেবার কন্ট্রাক্টে সাক্ষর করতে বললো যা শ্রমিক এবং কারখানার মধ্যকার মজুরী ও কাজের সম্পর্কের আইনি ভিত্তি স্থাপনের পৃষ্ঠভূমি রচনা করে। ১৯৯৫ সালে এই শ্রম চুক্তি ব্যবস্থা সমস্ত শ্রমিককে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বেঁধে ফেললো। দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি শ্রমিকদের জন্য চাকরির নিশ্চয়তা নিয়ে আসেনি। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ৮ হাজার শ্রমিক অর্থাৎ টংগাং এর মোট নিযুক্ত শ্রমিকের ২২ শতাংশকে লে অফ করা হয়।

এই শ্রম চুক্তি পরিণত হলো ম্যানেজমেন্টের শ্রম শোষণের সুবিধা সৃষ্টিকারী যন্ত্রে। ২০০০ সালে ম্যানেজমেন্ট দাবি করলো ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া চুক্তি ব্যবস্থা “কার্যকরী হওয়ার জন্য খুবই পুরানো”। যদি ১৯৯৫ সালের চুক্তি টিকে থাকে, তাহলে শ্রমিক ছাঁটাই বেআইনি হয়ে থাকবে। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন ছিল দশ বছরের কম সময় কাজের অভিজ্ঞতা যুক্ত শ্রমিকের, যাতে তিন বছরের দীর্ঘ মেয়াদি চ্যুক্তিকে বদলে ফেলা যায়। লে অফ হওয়া শ্রমিকের স্বার্থকে বলি দিয়ে টংগাং এর মোট মুনাফা ২০০২ সালের ১ কোটি ৫ লক্ষ ইউয়ান থেকে বেড়ে ২০০৪ সালে ৮ কোটি ৫২ লক্ষ ইউয়ান হয়।

প্রাদেশিক সরকার (সেসময় টংগাং এর একক অংশীদার) এবং ম্যানেজমেন্ট মনে করেছিল এটাই বেসরকারিকরণের সঠিক সময়। ২০০৫ সালে টংগাং নিজেদের পুনর্গঠিত করে, সমস্ত অলাভজনক ব্যবসা থেকে মুক্তি পেতে (নথিবদ্ধ খনি, কারখানা, স্কুল প্রভৃতি) সেগুলিকে কর্মচারীদের কাছে বিক্রি করে বা স্থানীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। টংগাং ঐসব ব্যবসাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের থেকেও মুক্তি পেয়েছিল। টংগাং এবং তথাকথিত 'স্ট্র্যাটেজিক অংশীদার' [ব্যক্তি মালিকানাধীন স্টিল উদ্যোগ] টংগাং'কে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে। অবশিষ্ট শ্রমিকরা নতুন কোম্পানির সাথে নতুন শ্রম চুক্তি সই করে। বেসরকারিকরণের পর টংগাং প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত অংশীদারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যারা চালু করে নিষ্ঠুর ম্যানেজমেন্ট, মজুরীর স্থবিরতা, শ্রমিকের সুযোগ সুবিধা বাতিল (যেমন- শ্রমিকের ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা) এবং বেকারির ছড়ি ঘুরিয়ে শ্রমিকদের ভয় দেখানো।

দুই নং চার্টটি দেখাচ্ছে সংস্কারের যুগে প্রকৃত মজুরীর বিভিন্ন পরিমাপ: প্রথম পরিমাপটিতে কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স ব্যবহার করেছে প্রকৃত মজুরীকে হিসেব করতে, দ্বিতীয় পরিমাপটিতে হাউজিং প্রাইস ইন্ডেক্স ব্যবহার করেছে সিপিআই, যা বর্তমান যুগের বিস্ফোরক আবাসন মূল্যকে বিবেচনা করে না। সংস্কারের প্রথম যুগে প্রকৃত মজুরী দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু বর্তমান যুগে এই বৃদ্ধি অনেক মন্থর।

তিন নং চার্টটি দেখাচ্ছে সংস্কারের যুগে শ্রম বিভাগ বা মোট মূল্য যুক্ত মজুরীর ভাগ। শ্রমের ভাগকে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিকের ক্ষমতা বিস্তারের পরিমাপ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৯৯০ এর প্রথম ভাগ থেকে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে।

১৯৯০ এর প্রথম ভাগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর সংস্কার, গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরে পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপক প্রবেশ এবং শ্রমিকের সুযোগ সুবিধার ক্ষয় - সব মিলিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতাকে খর্ব করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর সংস্কার মূলত সংঘটিত হয় ১৯৯৭ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চদশ সম্মেলনের পর, যাতে ৩ কোটির বেশি শ্রমিককে লে অফ করা হয়। শহুরে লে অফ হওয়া শ্রমিক এবং গ্রামের আংশিকভাবে নিযুক্ত শ্রমিক বাহিনী বিরাটভাবে মজুত শ্রম বাহিনীকে বাড়িয়ে তোলে যা উল্লেখযোগ্যভাবে মজুরী বৃদ্ধিকে আটকে দেয়। আবাসন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা পরিষেবার বাজারি সংস্কার শ্রমিকদের আবশ্যিক চাহিদা পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।

চীনের অন্যান্য জায়গার মতো টংগাং এ শ্রমিকের ক্ষমতাকে খর্ব করার মধ্য দিয়ে বন্টন ব্যবস্থা ক্রমশ ম্যানেজারদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়ে উঠলো; ফলত, বন্টনের অসাম্য মারাত্মকভাবে বেড়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে অসাম্য ছিল ২০০৯ সালের ২৪শে জুলাই এর ঘটনার প্রত্যক্ষ কারণ।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tonghua_Iron_and_Steel_Group_riot

১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত মজুরীর মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমিক এবং ম্যানেজারদের মধ্যকার পার্থক্য মাও জমানার কাছাকাছি ছিল। ১৯৯৯ সালে টংগাং মজুরী এবং বেতনের উপর সংস্কার চালায় যাতে জোর দেয়া হয় 'কাজ অনুযায়ী বন্টন'কে অঙ্গীভূত করতে হবে, সাথে 'উৎপাদনের ফ্যাক্টরগুলো অনুযায়ী বন্টন' (যথা পুঁজিকে অন্তর্ভুক্ত করা); দ্বিতীয়ত, বণ্টনকে অবশ্যই ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে প্রতিফলিত করতে হবে; তৃতীয়ত, মজুরী তখনই প্রদান করা হবে যখন মুনাফা অর্জন করা যাবে। এই নীতিগুলো ম্যানেজমেন্টকে দেয়া বিপুল বোনাস এবং ব্যক্তিগত অংশীদারদের মুনাফা দেয়ার আইনি জমি প্রস্তুত করে। ২০০০ সালে সরকারি নথিতে স্থিরীকৃত হয় যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতা এবং মুনাফা বছরে ৮% হারে বৃদ্ধি পায়, তবে মজুরী ৬%-৮% বৃদ্ধি করা যাবে। ২০০৪ সালে একজন নিম্ন পদস্থ ম্যানেজার বছরে ১৫ হাজার ইউয়ান বোনাস পেতে পারতেন যা ২০০৩ সালের সমস্ত কর্মচারীর গড় মজুরীর ১.৬ গুণ! ২০০৫ সালে টংগাং মধ্য পদস্থ ম্যানেজারদের জন্য বাৎসরিক ভিত্তিক বেতন চালু করে যাতে একজন মধ্য পদস্থ ম্যানেজারের প্রাপ্য হতো সমস্ত কর্মচারীর গড় মজুরীর ৬ গুণ! ২০০৫ সালে বেসরকারিকরণকে তুলে ধরার প্রচেষ্টার পুরস্কার হিসাবে সর্বোচ্চ ম্যানেজমেন্ট ১০ কোটি ইউয়ান সমমূল্যের কোম্পানির জয়েন্ট স্টক পেয়েছিল। বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সর্বোচ্চ ম্যানেজাররা উদ্যোগের মালিকে পরিণত হয়। বণ্টনের এই অসাম্যের তথ্যগুলো পাওয়া যাবে টংগাং দ্বারা প্রকাশিত ইয়ারবুকগুলোতে।

ম্যানেজাররা তাদের পুঁজিকে আহরণ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদের বেসরকারিকরণের মাধ্যমে, যা প্রথাগত পুঁজিবাদীদের থেকে আলাদা, যারা পুঁজি আহরণ করে তাদের নিজেদের পুঁজি থেকে। ১৯৮০-র দশকে অধিকাংশ শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা যৌথ মালিকানাধীন উদ্যোগে কাজ করতো, যা মাও জমানার কিছু ধারাকে বজায় রেখেছিল। ২০১৩ সালে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৬ কোটি ৯০ লক্ষ, যা শহরের কর্মসংস্থানের শতকরা ৭০ ভাগ। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ৬২% নিজের শহরের বাইরে গিয়ে কাজ করে এবং ২৯% নিজের প্রদেশের বাইরে গিয়ে কাজ করে; এদের ৪৭% ১৯৮০ সালের পর জন্মেছে।

[National Statistical Bureau, Investigation Report on Migrant Workers, 2013]

টংগাং এর শ্রমিকরা সেখানকার শ্রমিক কমিউনিটির বাসিন্দা, যেটি ১৯৫৮ সালে বানানো হয়। শ্রমিক কমিউনিটির মানুষেরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোভাবে জানে; তাই তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করা এবং সংগঠিত হওয়া সহজ। অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকরা ভীষণভাবে চলমান, যেহেতু তাদের কাজ অস্থায়ী; শহরের উচ্চ জীবন ধারণের মানকে পোষাতে না পারলে তাদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি ফিরে ফেতে হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের পক্ষে টংগাং এর মতো শ্রমিক কমিউনিটি বানানো কঠিন। টংগাং এর অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা মাও জমানা এবং সংস্কারের জমানা - উভয় ব্যাপারে অভিজ্ঞ। মাঝ বয়সী শ্রমিকরা যারা ১৯৮০ সাল থেকে কাজ করা শুরু করেছে, তারাও মাও জমানার ধারাকে এবং সামাজিক পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষ করেছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো টংগাং এ শ্রমিক সংগ্রামকে সংগঠিত করেছিল। বিপরীতক্রমে, পরিযায়ী শ্রমিকদের মাও জমানার কারখানা জীবন সম্পর্কে প্রায় কোনও অভিজ্ঞতা নেই; এজন্য মাও জমানা এবং সংস্কারের জমানার মধ্যকার বিরোধ পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে অনেক ভোঁতা। তাই পরিযায়ী শ্রমিকদের লড়াইয়ের লক্ষ্য পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের ভিতকে চ্যালেঞ্জ করার বদলে ব্যক্তি পুঁজিবাদীদের শ্রম আইন মানতে জোর করা। সেজন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের নেতৃত্বে সংগ্রাম এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগ্রাম একে অন্যের থেকে পৃথক। প্রথম প্রকারের আন্দোলনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণ (বেসরকারিকরণ, দুর্নীতি, সরকারের কিছু নির্দিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধতা প্রভৃতি) ব্যতিত অন্য কারণ থাকে; অপরদিকে পরবর্তী প্রকারের আন্দোলনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক কারণ (মজুরী বৃদ্ধি, ওভারটাইমের ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি)। চীনে ২০০৭ সাল থেকে আরও প্রতিযোগী হয়ে উঠবার জন্য পুঁজি সস্তা পরিযায়ী শ্রমিক ও পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাজনক শর্তের লক্ষ্যে (উদাহরণস্বরূপ জমি) উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে চীনের মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলের দিকে বইতে শুরু করেছে। 




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]