ইজরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকার গোপন সম্পর্ক
গোপন দক্ষিণ আফ্রিকার নথিগুলো প্রকাশ করেছে যে ইজরায়েল বর্ণবাদী শাসকের কাছে পারমাণবিক ওয়ারহেড বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা রাষ্ট্রটির কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার প্রথম সরকারী প্রামাণ্য প্রমাণ প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের 'টপ সিক্রেট' মিনিটগুলো দেখায় যে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পি۔ডব্লিউ বোথা ওয়ারহেড চেয়েছিলেন এবং তৎকালীন ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শিমন পেরেস তাদের প্রস্তাব দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন "তিন ধরনের আকারে"। এই দু'জন দু'টি দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী একটি বিস্তৃত পরিসরের চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছিলেন যার মধ্যে একটি ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল যে 'এই চুক্তির অস্তিত্ব' গোপন থাকবে। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর একটি বইয়ের গবেষণায় আমেরিকান শিক্ষাবিদ সাশা পোলাকো সুরানস্কি দ্বারা উন্মোচিত নথিগুলো প্রমাণ দেয় যে ইজরায়েলের তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিত বা অস্বীকার করার ক্ষেত্রে 'অস্পষ্টতা' নীতি থাকা সত্ত্বেও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ পরবর্তী সরকারকে পোলাকো সুরানস্কির অনুরোধে নথিগুলোকে প্রকাশ করা বন্ধ করার জন্য চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। ইজরায়েলের এই পরামর্শের প্রচেষ্টাও ছিল যে, যদি এটির কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকে তবে এটি একটি 'দায়িত্বশীল' শক্তি হবে যা সেগুলোর অপব্যবহার করবে না, যেখানে ইরানের মতো দেশগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না। পেরেসের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন যে প্রতিবেদনটি ভিত্তিহীন এবং দুই দেশের মধ্যে 'কোনও আলোচনা' হয়নি। যদিও ভদ্রমহিলা নথির সত্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার নথিগুলো দেখায় যে বর্ণবৈষম্য যুগের সামরিক বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে প্রতিরোধক হিসাবে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য হামলার জন্য চেয়েছিল। নথিগুলো দেখায় যে উভয় পক্ষই ৩১ মার্চ, ১৯৭৫ সালে মিলিত হয়েছিল। পোলাকো সুরানস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত তার বইটি লিখেছেন 'দি আনস্পোকেন অ্যালায়েন্স: ইজরায়েল সিক্রেট রিলেশনশিপ উইথ এপার্থেইড সাউথ আফ্রিকা' শিরোনামে।
https://www.sahistory.org.za/archive/unspoken-alliance-israels-secret-relationship-apartheid-south-africa-sasha-polakow-suransky
আলোচনায় ইজরায়েলি কর্মকর্তারা "আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের অস্ত্রাগারে থাকা কিছু পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়"।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jericho_(missile)
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক বাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আর. এফ আর্মস্ট্রং।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Raymond_Armstrong
তিনি অবিলম্বে একটি মেমো তৈরী করেন যাতে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র প্রাপ্তির সুবিধাগুলো তুলে ধরেন, কিন্তু শুধুমাত্র যদি সেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রে লাগানো হয়। মেমোটি 'টপ সিক্রেট' হিসাবে চিহ্নিত এবং ইজরায়েলিদের সাথে বৈঠকের একই দিনে তারিখটি দেয়া হয়েছিল, তবে এর প্রেক্ষাপট পুরোপুরি বোঝা যায়নি কারণ এটি একই দিনে ইজরায়েলি প্রস্তাবের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল বলে জানা যায়নি। এটি ইজরায়েলের কাছে সরাসরি অনুরোধের ভিত্তি ছিল। এতে আর্মস্ট্রং লিখেছেন-
“উপস্থাপন করা একটি অস্ত্র ব্যবস্থার যোগ্যতা বিবেচনা করে, কিছু অনুমান করা হয়েছে: ক) যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আরএসএ এর মধ্যে (দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র) উৎপাদিত বা অন্যত্র থেকে প্রাপ্ত পারমাণবিক ওয়ারহেড দিয়ে সজ্জিত হবে।"
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হতে অনেক বছর বাকি ছিল। দুই মাসের কিছু বেশি পরে, ৪ জুন, পেরেস এবং বোথা জুরিখে দেখা করেন। ততদিনে জেরিকো প্রকল্পের সাংকেতিক নাম হয়ে গিয়েছিল 'শ্যালেট'। মিটিং এর অতি গোপনীয় মিনিটগুলো রেকর্ড করে যে-
"সঠিক পেলোড ব্যবহারযোগ্য থাকা সাপেক্ষে মন্ত্রী বোথা শ্যালেটের সীমিত সংখ্যক ইউনিটে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।"
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Payload
নথিটি তখন রেকর্ড করে-
“মন্ত্রী পেরেস বলেছিলেন যে সঠিক পেলোড তিনটি আকারে ব্যবহারযোগ্য ছিল। মন্ত্রী বোথা তার প্রশংসা করেন এবং বলেছিলেন যে তিনি পরামর্শ চাইবেন।"
'তিনটি আকার' বলতে প্রচলিত, রাসায়নিক এবং পারমাণবিক অস্ত্রকে বোঝায় বলে মনে করা হয়। 'সঠিক পেলোড' শব্দের ব্যবহার পারমাণবিক ইস্যুতে ইজরায়েলি সংবেদনশীলতাকে প্রতিফলিত করে এবং এটি প্রচলিত অস্ত্রের কথা উল্লেখ করলে ব্যবহার করা হতো না। এটি শুধুমাত্র পারমাণবিক ওয়ারহেড বোঝাতে পারে, কারণ আর্মস্ট্রংয়ের স্মারকলিপি স্পষ্ট করে যে দক্ষিণ আফ্রিকা শুধুমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহের উপায় হিসাবে জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্রে আগ্রহী ছিল। উপরন্তু, ইজরায়েল থেকে পাওয়ার জন্য জন্য দক্ষিণ আফ্রিকানদের একমাত্র পেলোড ছিল পারমাণবিক। দক্ষিণ আফ্রিকানরা অন্যান্য ওয়ারহেড একত্রিত করতে সক্ষম ছিল। খরচের কারণে বোথা আংশিক চুক্তিতে এগিয়ে যাননি। উপরন্তু, যেকোনো চুক্তির জন্য ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদন থাকতে হবে এবং এটি যে আসন্ন হবে তা অনিশ্চিত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা অবশেষে তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বোমা তৈরি করে, যদিও সম্ভবত ইজরায়েলের সহায়তায়। কিন্তু সামরিক প্রযুক্তিতে সহযোগিতা শুধুমাত্র পরবর্তী বছরগুলোতে বৃদ্ধি পায়। ইজরায়েলের তাদের অস্ত্র উন্নয়নের জন্য যে ইয়েলোকেক ইউরেনিয়াম প্রয়োজন ছিল তার বেশিরভাগই দক্ষিণ আফ্রিকা সরবরাহ করেছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yellowcake
নথিগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন নৌ কমান্ডার ডিটার গেরহার্ডের অ্যাকাউন্টগুলো নিশ্চিত করেছে - যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য ১৯৮৩ সালে কারাগারে বন্দী হন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Dieter_Gerhardt
বর্ণবাদের পতনের সাথে সাথে তার মুক্তির পর গেরহার্ড বলেছিলেন যে ইজরায়েল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে শ্যালেট নামক একটি চুক্তি ছিল যাতে 'বিশেষ ওয়ারহেড' সহ আটটি জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত করার জন্য ইহুদি রাষ্ট্রটির একটি প্রস্তাব জড়িত ছিল। গেরহার্ড বলেন, এগুলো পারমাণবিক বোমা। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রস্তাবটির কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পেরেস বোথাকে পারমাণবিক ওয়ারহেডের প্রস্তাব দেয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে দুই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী 'সেকমেন্ট' নামে পরিচিত সামরিক জোটকে পরিচালনা করার জন্য একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এটি এতটাই গোপন ছিল যে এতে তার নিজের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল-
"এটি স্পষ্টভাবে সম্মত যে এই চুক্তির অস্তিত্ব গোপন থাকবে এবং উভয় পক্ষের দ্বারা প্রকাশ করা হবে না।"
চুক্তিতে আরও বলা হয় যে কোনো পক্ষই একতরফাভাবে তা ত্যাগ করতে পারবে না।
ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির অস্তিত্ব ১৯৮৬ সালে সানডে টাইমসের কাছে মোর্দেচাই ভানুনু দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mordechai_Vanunu
তিনি ডিমোনা পারমাণবিক সাইটের ভিতরে তোলা ফটোগ্রাফ সরবরাহ করেছিলেন এবং পারমাণবিক উপাদানের অংশ তৈরিতে জড়িত প্রক্রিয়াগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু কোনও লিখিত নথি প্রদান করেননি।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Shimon_Peres_Negev_Nuclear_Research_Center
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর তেহরানের মার্কিন দূতাবাস থেকে ইরানি ছাত্রদের জব্দ করা নথি থেকে জানা যায় যে শাহ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ইজরায়েলকে সাহায্যের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার নথিগুলো নিশ্চিত করে যে ইজরায়েল পারমাণবিক ওয়ারহেড দিয়ে জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত করার অবস্থানে ছিল। ইজরায়েল বর্ণবাদী সরকার পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে চাপ দেয় পোলাকো সুরানস্কির প্রাপ্ত নথিগুলোকে প্রকাশ না করার জন্য।
https://www.theguardian.com/world/2010/may/23/israel-south-africa-nuclear-documents
তিনি বলেছিলেন-
"ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেকমেন্ট চুক্তিতে আমার প্রবেশকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, কারণ এতে সংবেদনশীল উপাদান ছিল, বিশেষ করে স্বাক্ষর এবং তারিখ। দক্ষিণ আফ্রিকানরা পাত্তা দেয়নি বলে মনে হয়; তারা কয়েকটি লাইন কালো করে আমার হাতে তুলে দিলো। এএনসি সরকার বর্ণবাদী শাসনের পুরানো মিত্রদের নোংরা ধোপাখানা রক্ষার জন্য এতটা চিন্তিত নয়।"
Comments