বাম রঙ্গ [পর্ব-দুই]
খ্রিষ্টান ডানদের প্রধান কাজ হলো চার্চ খাড়া করা, ধর্মান্তরকরণ করানো আর ধর্মীয় অফিশিয়ালদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা। খ্রিষ্টান বাম ও ডানের মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাত হলো চ্যারিটির প্রশ্নে। দু’পক্ষই চ্যারিটি’র ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু দারিদ্র্য প্রসঙ্গে খ্রিষ্টান বামেদের সমালোচনাটা হলো প্রাচুর্যে ভরপুর একটা জায়গায় যখন দান করতে হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে সেখানে আসলে যেটা দরকার সেটা হলো ক্ষমতার কাঠামোগত পরিবর্তন। সামাজিক বিশ্বাসের প্রশ্নে তারা বর্ণবিদ্বেষ ও সমকামি বিদ্বেষের বিরোধিতা করে। আর ধর্মীয় বহুত্ববাদ তথা নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষদের সাথে জোট বাঁধার ওপর গুরুত্ব দেয় এরা। এরা গর্ভপাতের অধিকারকে সমর্থন করে। বিজ্ঞানের ব্যাপারে ‘নবীন পৃথিবী সৃষ্টিতত্ত্ব'কে এরা মানে না এবং এরা বলে ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করলেও পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলো এবং বাস্তবকেই কেবল সৃষ্টি করেছে, বিশ্বকে নয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Young_Earth_creationism
সমস্ত স্কুলে বিবর্তনবাদ ও জলবায়ুর পরিবর্তন পড়ানোর পক্ষে রিচার্ড ডকিন্সের অভিমতকে এরা সমর্থন করে এবং বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার যেকোনো ধরনের প্রবণতাকে প্রত্যাখান করে। তবে ক্রিস হেজেসের মতো রাজনীতির প্রশ্নে স্যাম হ্যারিস ও ক্রিস্টোফার হিচেন্সের মত নব্য নাস্তিকদের থেকে নিজেদের এরা বিচ্ছিন্ন করে এই বলে যে, ওরা আসলে খ্রিষ্টান ডানেদের মতই; এসব লেখকের ভাষায় যারা “বর্বর” তাদের ভেতরে যুক্তি প্রতিষ্ঠার নামে অন্য দেশে অনুপ্রবেশ করার কারণে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Chris_Hedges
ধর্মীয় দর্শনের প্রশ্নে তারা তাদের মত খাড়া করে মূলত সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, ফিওদর দস্তয়েভস্কি ও লিও টলস্টয়ের মতো চিন্তাবিদদের ওপর ভিত্তি করে। নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করা কিংবা ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নিয়ে মাথা না ঘামানো বাম খ্রিষ্টানদের ভেতরে বিরল নয়। এরকম উদাহরণ হলেন চমস্কিপন্থী নৈরাজ্যবাদী রবার্ট জেনসেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Robert_Jensen
এই দর্শন যেখানে বিতর্কের মুখে পড়ে সেটা হলো ঈশ্বর বিশ্বাসী না হওয়া সত্ত্বেও একজন খ্রিষ্টান হয় কী করে? একই সাথে মার্ক্সবাদী আবার খ্রিষ্টান, এটা কিভাবে সম্ভব? তাদের যুক্তি হচ্ছে খৃষ্টধর্ম তাদের কাছে একটা ব্যক্তিগত দর্শন, কোনও গোঁড়ামি নয়!
তারা আরও বলে-
তুমি বাইবেল থেকে যেমন খুশি উদ্ধৃতি দাও আর প্রয়োজনে বাইবেলকে সমালোচনা করো। কেউ কেউ তো ভগবানের মুন্ডপাত করেন আর বলেন, ভগবান হচ্ছে গণহত্যাকারী উন্মাদ; কিন্তু যিশুর শিক্ষা তারা মানেন। আর যিশু যদি সত্যিই কোনও পবিত্র ব্যক্তি হন, যিনি বাকিদের ভালো-মন্দের পরোয়া করেন; তবে বাকিরা তাকে বিশ্বাস করলো কি না তাতে তার কিছু এসে যাওয়ার কথা নয়, তার চিন্তার বিষয় হলো গরিবরা বিশ্বের উত্তরাধিকার পাবে কি না। আর যদি ভগবান এমন হন যে তাকে যারা মানে না, তিনি তাদের শাস্তি দেন, তবে সেই ভগবান সত্যিকারের ভগবান নন এবং তিনি নিন্দার পাত্র।
যে বিষয়টা খ্রিষ্টান বাম ও খ্রিষ্টান নৈরাজ্যবাদীদের অন্যান্য র্যাডিক্যালদের থেকে আলাদা করে সেটা হলো বলপ্রয়োগের ব্যাপারে তাদের অবস্থান। অনেক বাম খ্রিষ্টান নিজেদের যদিও শান্তিবাদী বলবে না, কিন্তু বলপ্রয়োগ হবে তাদের সর্বশেষ অস্ত্র। শত্রুকে ভালবাসা, অন্য গাল ফিরিয়ে দেয়া, রাগ না করা ইত্যাদি বিষয়গুলোর ওপর তারা অনেক গুরুত্ব দেয়। এ ধরনের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে তাদের ওপর কাজ করে মূলত টলস্টয়, গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং এর প্রভাব। শান্তির পন্থার বিষয়ে তারা একটা প্রয়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি নেয় এই বলে যে, উত্তর আমেরিকাতে শাসকরা প্রতিবাদীদের হিংসার পথে ঠেলে দিতে চায়, মারপিট বাধানোর জন্য সিআইএ’র লোককে পয়সা দেয়ার ইতিহাসও আছে যাতে প্রতিবাদীদের তাড়ানোর একটা অজুহাত পুলিশ পায়। লুথার কিং আর গান্ধীর সাফল্যের প্রতি তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং হিংসাত্মক বিপ্লবের ব্যর্থতা, যেগুলো কর্তৃত্ববাদী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেগুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখায়। তাদের মতে যেহেতু হিংসা মানেই ক্ষমতা, আর ক্ষমতাই হলো দুর্নীতির উৎস। অবশ্য সমস্ত খ্রিষ্টান বামপন্থীদের যে শান্তিবাদ প্রসঙ্গে একই দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান তা সঠিক নয়। তার উদাহরণ ফিলিস্তিন, লেবানন ও দক্ষিণ আমেরিকার খ্রিষ্টান বামেরা। আমেরিকার মধ্যে তাদের সবচেয়ে বড় লড়াই হলো খ্রিষ্টান ডানেদের বিরুদ্ধে। যাদের এরা ফ্যাসিবাদী বলে নিন্দা করে আর বলে এরা নাকি খ্রিষ্টধর্মকে ধ্বংস করছে। ন্যাকড়া পরা একটা মানুষের শিক্ষা থেকে মজুরদের দুর্দশার বিনিময়ে ভ্যাটিকানের বিশাল বিশাল ক্যাথিড্রাল তৈরি হয় কী করে? কীভাবে শান্তির বাণী হয়ে যায় যুদ্ধ আর গণহত্যার সপক্ষে যুক্তি? কীভাবে সকলের সাথে মিলনের এক ধর্ম তৈরি করে ফ্যাসিবাদ, নাৎসীবাদ ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যা দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন করা হয়? খ্রিষ্টান বামেদের যুক্তি এগুলোই। তবে কীভাবে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, তা নিয়ে এদের মধ্যে বিরোধ আছে। যদিও মোটের ওপর এরা সবাই মানে যে, শান্তির পথই প্রধান পথ হওয়া উচিত। কোনও কোনও খ্রিষ্টান বাম আবার মনে করে মার্কস, লেনিন, বাকুনিন ইত্যাদি ধর্মবিরোধী নাস্তিকদের যখন চার্চের চাইতে বেশি মিল যিশুর সাথে তখন সত্যিকারের খ্রিষ্টান আদর্শ তখনই তৈরি হবে যখন চার্চগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হবে, যাজকদের ক্ষমতাহীন করে দেয়া হবে আর টিভিতে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার বন্ধ হবে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Televangelism#:~:text=Televangelism%20(tele%2D%20%22distance%22,and%20television%2C%20to%20communicate%20Christianity.
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mikhail_Bakunin
খ্রিষ্টান বামেদের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য হলো ভোগবাদের ধ্বংস, বিশেষ করে ক্রিসমাসের। আমেরিকায় ক্রিসমাস শুরুতে ছিল যিশুর জন্মদিন উদযাপন করার জন্য ছুটির দিন। এখন এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন একটা ছুটির দিন যেখানে লোকে সুখের লালসা চরিতার্থ করার বাসনায় খরচ করে, বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের ওপর যা নির্ভরশীল। ভ্যালেন্টাইন্স ডে ছিল প্রেম উৎযাপনের ছুটির দিন। প্রেমের অর্থ এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মনিবেদনের বদলে চকলেট আর অন্যান্য জিনিসের ওপর টাকা খরচ করা। আমেরিকাতে রিপাবলিকান পার্টি আয়ান র্যান্ডের লিবারটারিয়ান দর্শন, কর্পোরেটবাদ আর খ্রিষ্টীয়তাকে একসাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Libertarianism
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ayn_Rand#:~:text=Rand%20denounced%20libertarianism%2C%20which%20she,lead%20to%20collectivism%20in%20practice.
...........................................................................
সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের মৃত্যুর পর মনগড়া সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্য চালাতে গিয়ে শ্রমিকশ্রেণির যে পরাজয় ঘটে, তার ফলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মুখোশের আড়ালে একচেটিয়া আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছিল। গর্বাচেভ সেই প্রক্রিয়ার সন্তান। ক্রুশ্চেভের সময় থেকে যে বুর্জোয়া সংস্কারের গতি ঝোড়ো হাওয়ায় পরিণত হয়েছিল, তারই পরিণতি হলো গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা। পেরেস্ত্রৈকা ছিল একগুচ্ছ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংস্কার, যা সোভিয়েত অর্থনীতিকে মুনাফা ধারণার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করতে চেয়েছিল। ক্রুশ্চেভের সময় থেকে এই দিশায় সোভিয়েত অর্থনীতি বদলাতে বদলাতে গেছে। স্তালিনের সময়ে অনেক পরিবর্তন সত্ত্বেও অর্থনীতির মুনাফা কেন্দ্রিকতার ব্যাপারে প্রথাগত মার্কসবাদী তত্ত্বে হাত দেয়া হয়নি। কিন্তু ক্রুশ্চেভের সময় থেকে সে সম্পর্কে মার্কসবাদী ধারণাকে বিসর্জন দিয়ে একেবারে বুর্জোয়া ধারণা গ্রহণ করা হয়, যার চরম রূপ গর্বাচেভ আনীত পেরেস্ত্রৈকার ধারণাগুলোর মধ্যে দেখা যায়। স্তালিন 'সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সমস্যাবলী'-তে লিখেছেন-
"যদি একথা সত্য হয় তাহলে এটা বোঝা অসম্ভব হবে কেন আমাদের হালকা শিল্পগুলো যা সর্বাপেক্ষা লাভজনক তার চরম বিকাশ হলো না, এবং কেন অগ্রাধিকার দেয়া হয় ভারী শিল্পতে, যেগুলো অধিকাংশ সময়ে কম লাভজনক এবং কখনও কখনও সম্পূর্ণভাবে অলাভজনক। যদি এটা সত্য হয় তাহলে এটা বোঝাও অসম্ভব হয়ে যাবে যে, কেন আমাদের একগুচ্ছ ভারী শিল্প কারখানা যা এখনও অলাভজনক এবং যেখানে শ্রমিকের শ্রম ‘ঠিকঠাক মুনাফা’ আনতে পারে না, সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়নি এবং কেন নতুন নতুন হালকা শিল্প কারখানা যেগুলো নিশ্চিতভাবে লাভজনক এবং যেখানে শ্রমিকের শ্রম ‘বড় আকারে মুনাফা’ নিয়ে আসতে পারে, সেগুলো খোলা হয়নি। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে এটা বোঝা অসম্ভব হবে যে, কেন কারখানাগুলো কম লাভজনক কিন্তু আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্যে খুবই জরুরী সেগুলো থেকে শ্রমিকদের উচ্চ মুনাফাযুক্ত কারখানাগুলো থেকে সরিয়ে দেয়া হয়নি…"
https://www.marxists.org/reference/archive/stalin/works/1951/economic-problems/index.htm
সোভিয়েত অর্থনীতির একটা অংশ পরিকল্পনামাফিক লোকসানে চালানো হচ্ছিল জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক স্বার্থকে মাথায় রেখে। জারের কুশাসনে বেহাল অর্থনীতি যে সঙ্কটে পড়েছিল তা বিপ্লবী ঝঞ্ঝায় পরিবর্তিত হওয়ার পর দীর্ঘ চার বছরের গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী কাটিয়ে আবার অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন জনতাকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ দিতে হলে অন্য উপায় ছিল না। তার উপর ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা। বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থনীতি কোনো অবস্থাতেই এভাবে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নেয় না। তার পদক্ষেপের ভিত্তিই হলো মুনাফার সম্ভাবনা সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা, অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিটকে লাভজনক করতে হবে এবং প্রতি মুহূর্তে লাভজনক থাকতে হবে। তাতে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সম্পূর্ণ বোঝা শ্রমিকশ্রেণি, মেহনতি মানুষ এবং সাধারণ জনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। ১৯৬২ সালে ক্রুশ্চেভের জমানায় ঠিক এই বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী যুক্তিই দেয়া হয় সোভিয়েত তাত্ত্বিকদের পক্ষ থেকে। তৎকালীন নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এল গতোভস্কি 'কমুনিস্ত' পত্রিকায় লেখেন-
"প্রথমত, স্তালিন উচ্চ লাভজনকতার তত্ত্বকে লাভের ধারণা থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। সুতরাং, 'উচ্চ লাভজনকতা' কথাটা তার অন্তর্বস্তুর সঙ্গেই মিললো না। লাভজনকতা সংক্রান্ত পরিষ্কার সুসংজ্ঞায়িত ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করা হলো সম্পূর্ণভাবে ধোঁয়াশাপূর্ণ, সংজ্ঞায়িত করা যায় না এমন এবং শূন্যগর্ভ ধারণা, যার সঙ্গে লাভ বা মুনাফার কোনো সম্পর্কই নেই, এমন ধারণার দ্বারা।
দ্বিতীয়ত, এখানে একটি সংস্থা এবং মুনাফার যে সম্পর্ক বিবৃত হচ্ছে তা ভ্রান্ত। একইভাবে, লাভজনকতা সুস্থির এবং লাগাতার একই রকম হতে পারে না, হওয়া উচিতও নয়। তা সব সময়েই অস্থির এবং পরিবর্তনশীল হবে।
তৃতীয়ত, যে ভারসাম্য স্তালিন নির্ণয় করেছিলেন তার ‘উচ্চ লাভজনকতা’-র সাথে তা একটি নির্দিষ্ট সংস্থার নিজস্ব লাভজনকতার সাথে সংঘাতে চলে যাচ্ছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
লাভজনকতার সাথে পরিকল্পনার এই বিচ্ছিন্নতা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার মৌলিক কর্তব্যের বিরোধী। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম মৌলিক কর্তব্যই হলো এক একটি সংস্থার লাভের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক সঞ্চয়ন গড়ে তোলা।"
মুনাফা কেন্দ্রিকতা সম্পর্কে সামগ্রিক ধ্যানধারণা ক্রুশ্চেভের সময় থেকে পালটে গিয়ে পুরোপুরি বুর্জোয়া পথে চলে যায়। তারপর গর্বাচেভের সময় শুরু হয় প্রত্যেকটি শিল্প ইউনিটে মুনাফা বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হলো ‘বলশেভিকা মায়াক’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এর মূল কথা হলো প্রত্যেকটি ইউনিটে ম্যানেজমেন্টকে সেই সংস্থার লাভের ভিত্তিতে বোনাস দেয়া হবে। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছিল লাভের একটি অংশ রাষ্ট্রীয় তহবিলে না দিয়ে সংস্থার হাতে রেখে দেয়ার মতো ব্যাপার। ঐ অংশ সম্পূর্ণ ম্যানেজমেন্টের মালিকানায় থাকতো এবং তাদের জন্য খরচ করা হতো। ১৯৬০ সালে এই ভাগাভাগি ছিল ৬৪% রাষ্ট্রীয় তহবিলের জন্য, ৩৬% ম্যানেজমেন্টের জন্য। ১৯৬৯ সালে ৬১% বরাদ্দ হলো রাষ্ট্রীয় তহবিলে আর ৩৯% থাকলো ম্যানেজমেন্টের হাতে। বলশেভিকা-মায়াক পদ্ধতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। নির্বিচারে প্রত্যেকটি সংস্থায় লাভের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে ক্রুশ্চেভের অপসারণ এবং ব্রেজনেভের আগমনে এই প্রক্রিয়া দ্রুততর হলো। সোভিয়েত অর্থনীতি বিষয়ক ১৯৬৫ সালের একটি পত্রিকা অনুযায়ী বলশেভিকা-মায়াক পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে ঐ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে পুঁজির পরিমাণ একই থাকলেও মুনাফা দ্বিগুণ হয়ে যায় (Finansy SSSR, 1965)। অন্য একটি পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী লেনিনগ্রাদের একটি সংস্থা ১৯৬৪ সালের ২০০ রুবল লাভ করলেও ১৯৬৫ সালে লাভ করেছিল ৭২,৯০০ রুবল (Vestnik Statistiki, 1965)। এই প্রক্রিয়া তিন দশক ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্রমশ শক্তিশালী হয়। একেকটি সংস্থায় নিজস্ব মুনাফা এবং তার এক বড় অংশ দিয়ে ম্যানেজমেন্ট ও আমলাতন্ত্রের ফুলে ফেঁপে ওঠার এই খেলা ১৯২০-র দশকের দ্বিতীয়ার্ধে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর এবং শ্রম দিন কমানোর যে মরিয়া প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি তার একেবারে বিপরীত ছিল। উইলিয়াম জে ফস্টার তার ১৯৩২ সালে প্রকাশিত এক গ্রন্থে লিখেন-
“সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে শ্রমিকদের মজুরি দেয়া হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতি যতটা অনুমোদন করতে পারে ততটা উঁচুতে, আর পুঁজিবাদী দুনিয়া দিচ্ছে শ্রমিকরা যতটা নিচু মেনে নিতে পারে ততটাই নিচুতে।”
https://www.marxists.org/archive/foster/1932/toward/index.htm
১৯১৭ সালে শ্রমিকরা যা মজুরি পেতেন তা ১৯২০-র দশকের শেষে দ্বিগুণ হয়ে যায়। গড় শ্রম ঘন্টা ছিল দৈনিক ৭.২ ঘন্টা এবং সপ্তাহ পাঁচ দিনের। সেইসময় আমেরিকাতে গড় শ্রম ঘন্টা ছিল দৈনিক ৮ ঘন্টা এবং সপ্তাহ ছয় দিনের। সোভিয়েত অর্থনীতিতে যতদিন উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে মজুরি বাড়ানোর এবং শ্রম দিন বা শ্রম ঘন্টা কমানোর প্রক্রিয়া জারি ছিল, ততদিন উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধির ফলে বর্ধিত মূল্য শ্রমজীবী মানুষের হাতে গেছে। ফলে চাহিদা বেড়েছে এবং তার টানে আবার উৎপাদন শক্তি বেড়েছে। বর্ধিত উৎপাদন শক্তি আবার চাহিদা বাড়িয়েছে এবং বর্ধিত চাহিদা আবার উৎপাদন শক্তি বাড়িয়েছে। শ্রম সময় কমার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। এসবের প্রত্যক্ষ টানে আবার শিল্প উৎপাদন বেড়েছে। অর্থনীতি সর্বদা আভ্যন্তরীণ শক্তিতে গতিময় থেকেছে। কিন্তু লেনিন আর স্তালিনের মতো মহান দুই নেতার মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির নির্ধারক পরাজয় এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মুখোশে একচেটিয়া আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর প্রতিবিপ্লব বিজয়ী হওয়ার মধ্যে দিয়ে যখন মুনাফা এবং মুনাফার সম্ভাবনার ধারণার পরিবর্তন ঘটানো হলো তখন শিল্প সংস্থাগুলোর লাভ যত বাড়তে লাগলো, তত বাড়তে থাকলো শোষণের মাত্রা। উৎপাদিত মূল্যের মধ্যে মজুরি ও উদ্বৃত্ত মূল্যের অনুপাত ক্রমে উদ্বৃত্ত মূল্যের অনুকূলে ঢলে পড়তে লাগলো, ফলে সমাজে অসাম্য বাড়তে থাকলো। উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা পিছিয়ে পড়তে লাগলো। একসময় তৈরি হলো সংকট। সংকট কাটাতে গিয়ে পুঁজির সপক্ষে আরও বড় সংস্কার হতে লাগলো, তা ডেকে আনলো আরও বড় অসাম্য এবং আরও বড় সংকট। আগে অর্থনীতির যে ইতিবাচক টান ছিল তা এই দুষ্টচক্রে পড়ে নেতিবাচক টানে পর্যবসিত হলো এবং একসময় হলো বিস্ফোরণ। গর্বাচেভ পূর্ব ইউরোপের উপর থেকে সোভিয়েতের সামরিক নিয়ন্ত্রণ অনেকখানি শিথিল করেছিল। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছিল। গর্বাচেভের আগে অন্য কেউ এমনটা করেনি। সোভিয়েত রাশিয়ায় পুঁজিবাদের পুন:প্রতিষ্ঠার অবধারিত ফলাফল ছিল সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মতই সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল তার সামরিক শক্তি। কিন্তু অর্থনীতি যখন বিপুল পরিমাণ সামরিক বাজেট বহন করতে পারে না তখন কোথাও না কোথাও সেই বিন্দু আসবে, তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক ক্ষমতা কমানো ছাড়া অন্য পথ থাকে না।
..................................................................................
'দি ইন্ট্রোডাকশন টু এ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ হেগেলস ফিলোসফি অফ রাইট' শীর্ষক লেখায় ধর্ম নিয়ে আলোচনার শুরুতে মার্কস বলেছেন ধর্ম নিয়ে প্রয়োজনীয় সমালোচনার কাজ কার্যত সম্পূর্ণ হয়েছে।
https://www.marxists.org/archive/marx/works/1859/critique-pol-economy/
মার্কসের আগে প্রকৃতি বিজ্ঞানের অগ্রগতি, ফয়েরবাখ ও অন্য নব্য হেগেলীয়দের ধর্ম নিয়ে সমালোচনা ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করেছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Young_Hegelians
মানুষ বিজ্ঞানকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে কোনো রোগই তার কাছে দুরারোগ্য নয়, অথচ সামান্য রোগে সে তার সন্তানকে চিকিৎসাহীন অবস্থায় মারা যেতে দেখে; কৃষক এতো বেশি উৎপাদন করে যে ফসল বিক্রি করতে না পেরে সে নিজেই অপুষ্টির শিকার হয়; তারই শ্রমে উৎপন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে ক্রয়ক্ষমতাহীন শ্রমিকের বধূ অভিমানী হয়ে ওঠে। ধর্ম হলো এই সামঞ্জস্যহীন জগতের জনপ্রিয় ব্যাখ্যা। সেই কারণে মার্কস বললেন, ধর্ম হলো মানুষের উল্টানো জগৎ চেতনা।
“ধর্ম হলো নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, এক হৃদয়হীন জগতের হৃদয়। ধর্ম জনগণের জন্য আফিম।”
কিন্তু ধর্মীয় যন্ত্রণা একই সাথে মানুষের বাস্তবিক জীবন যন্ত্রণার বহি:প্রকাশ এবং সেই যন্ত্রণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইতিহাসে অসংখ্য পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে ধর্মীয় আঙ্গিকে (ঔপনিবেশিক লিবিয়া, রাজতান্ত্রিক ইরান প্রভৃতি)। ধর্মের কাল্পনিক সুখবিলাস থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হলে বিকল্প বাস্তবিক সুখের সন্ধান তাদের দিতে হবে। সেজন্য এই শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে। যে কারণে ধর্ম টিকে থাকে, সেই কারণকে অপসারণ না করে কেবল নাস্তিকতার প্রচার করে জনগণের চেতনা পরিবর্তন করার চেষ্টা কোনো মার্কসবাদী কর্মসূচি হতে পারে না। ব্ল্যাঙ্কুইস্টদের প্রস্তাব ছিল, তাদের কাঙ্ক্ষিত পারি কমিউনে কোনো পাদ্রীর প্রয়োজন নেই এবং সেখানে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মীয় প্রদর্শন নিষিদ্ধ হবে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Blanquism
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Paris_Commune
১৮৭৪ সালে এঙ্গেলস এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন-
“অনভিপ্রেত বিশ্বাসকে প্রোমোট করার শ্রেষ্ঠ পন্থা হলো বিশ্বাসীর উপর নির্যাতন।”
শ্রমিকশ্রেণির দ্বারা সংঘটিত বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লবের পরে মার্কসবাদীরা ব্যক্তি নাগরিকের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিল। লেনিন ১৯০৫ সালে ‘সোশ্যালিজম অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ নিবন্ধে লিখেছেন-
“ধর্ম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয় হবে না এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরকারি আধিকারিকদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আইনানুসারে প্রত্যেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন থাকবে যে কোনো ধর্ম যা সে বিশ্বাস করে তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে অথবা কোনো ধর্মেই যদি তার বিশ্বাস না থাকে সেক্ষেত্রেও। কোনোভাবেই নাগরিকদের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কোনো প্রভেদ করা যাবে না। এমনকি সরকারি নথিতে কোনো নাগরিকের ধর্মের কোনো উল্লেখ প্রশ্নাতীতভাবে নিষিদ্ধ হবে।”
https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1905/dec/03.htm
মার্কসবাদ হলো জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। স্বভাবতই একজন মার্কসবাদী ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণে একজন নাস্তিক। শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট জনগণকে অশিক্ষা, ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোকময় আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উত্তরণ করানোর কর্মসূচি একজন মার্কসবাদী এড়িয়ে যেতে পারে না। ইউরোপের নবজাগরণ প্রথম রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসাবে সেক্যুলারিজমের যে মডেল হাজির করে তার অর্থ হলো একজন নাগরিক নাস্তিক, ডীইস্ট (যারা ঈশ্বরকে স্রষ্টা বলে মানে, কর্তা বলে মানে না) বা ধর্ম বিশ্বাসী যা খুশি হতে পারে, রাষ্ট্রের সে বিষয়ে কিছু বলার নেই। ইউরোপের উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল সেক্যুলারিজমের পতাকা বাহক। তখন চার্চ ছিল সামন্ততন্ত্রের অন্নভোগী এবং জনমানসে সামন্ততন্ত্রের বৌদ্ধিক রক্ষক। সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল করতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর চার্চের প্রভাব খর্ব করা আশু প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সামন্তশ্রেণিকে নির্মূল করার পর বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে চার্চের বৈরিতা ক্রমশ ক্ষীণ হয়। চার্চ তার পুরানো অবস্থান থেকে সরে আসে। ক্যাপিটালের প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধে চার্চের এই ভূমিকা নিয়ে মার্কস লিখেছেন-
“প্রতিষ্ঠিত চার্চগুলো তাদের উনত্রিশটি বিধানের মধ্যে আঠাশটি বিধানের অবমাননা সহ্য করবে, কিন্তু উনত্রিশ ভাগের এক ভাগ আয় কমে যাওয়াটা ক্ষমা করবে না।”
একদিকে চার্চের এই অবস্থান পরিবর্তন, অন্যদিকে সামন্ততন্ত্রের চ্যালেঞ্জ না থাকা - এই দুই কারণে বুর্জোয়া শ্রেণি চার্চের প্রতি তার পুরানো বৈরিতা থেকে সরে আসে। ইউরোপ ও আমেরিকা সেক্যুলারিজমের দৃঢ় অবস্থান থেকে সরে এসে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক আপসকামী ধর্মনিরপেক্ষতার আশ্রয় নিতে শুরু করে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অবিভক্ত ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার যে নীতি গ্রহণ করেছিল তা মোটেই সেক্যুলারিজম ছিল না। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র কর্তৃক সব ধর্মের স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা। ভারতের নতুন শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি সামন্ততন্ত্র ও তার সামাজিক, বৌদ্ধিক ভিত্তিকে ধ্বংস না করে তাদের সাথে আপস ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে চেয়েছিল। গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী কয়েক দশকে মানুষ এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছিল। তখন পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশে উড়ছে সমাজতন্ত্রের পতাকা, যেখানে ধর্ম নিছক কিছু নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের জোয়ার, সারা পৃথিবী আলোড়িত প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে। বিশ্ব পুঁজিবাদ তখন গাঁটছড়া বাঁধে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর সাথে, যাদের আশ্রয় ছিল ধর্ম। শতাব্দীর শেষ পর্বে এসে পূর্ব ইউরোপসহ সোভিয়েতের ভাঙ্গন ঘটলো, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনুন্নত বিশ্বে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কাছে প্রগতিশীল আন্দোলনের পরাজয় ঘটলো। প্রযুক্তি তাড়িত বিশ্বায়নের যুগে ধর্ম এখন কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, রাজনীতির অন্যতম প্রধান উপাদান। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেছিলেন 'এন্ড অফ হিস্ট্রি', অর্থাৎ বিশ্বায়িত নিঃস্বায়নের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সামনে শোষণহীন সমাজের স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটেছে!
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Francis_Fukuyama
১৯৯৩ সালে আমেরিকান দক্ষিণপন্থী লেখক স্যামুয়েল হান্টিংটন তার 'দ্য ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনস' বইতে লেখেন-
“নতুন এই বিশ্বে আগামী সংঘাতগুলো আদর্শ বা অর্থনীতির কারণে হবে না, হবে সাংস্কৃতিক কারণে। মানুষে মানুষে পার্থক্য ও সংঘাতের কারণ হবে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। বিভিন্ন সভ্যতার পারস্পরিক পার্থক্যের রেখাগুলোই হবে আগামীর যুদ্ধরেখা।”
http://www.amarboi.com/2017/03/the-clash-of-civilizations-samuel-p.-huntington.html?m=1
শ্রেণি সংগ্রামের বিকল্প হিসাবে ধর্ম-সংস্কৃতির সংঘাত দক্ষিণপন্থীদের নিরাপদ ও পছন্দের প্রকল্প। বিপরীতক্রমে, জনগণের ঐক্য বিনষ্টকারী এই কৃত্রিম সংঘাতের আবর্ত থেকে শোষিত মানুষকে মুক্ত করে শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্র করা মার্কসবাদীদের লক্ষ্য। ইসলামিক দেশগুলোতে ধর্ম রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ। প্রাক ঔপনিবেশিক ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দাঁড়িয়েছিল দুটো স্তম্ভের উপর - উলেমাতন্ত্র ও বাদশা। বুর্জোয়া বিপ্লব পূর্ববর্তী ইউরোপে অনুরূপ ভূমিকায় ছিল যাজকতন্ত্র ও রাজা। বুর্জোয়া শ্রেণির হাত ধরে ইউরোপে যাজক, সামন্তদের প্রভুত্বের অবসান ঘটে। কিন্তু ইউরোপিয় বুর্জোয়া শ্রেণির মানদণ্ড একদিন ইসলামিক দুনিয়ার রাজদণ্ডে পরিণত হলো। যেমনটা লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে করেছিল, মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা তেমনটা করলো না। ঔপনিবেশিক শোষণের জন্য এখানে তারা স্থানীয় ধর্মের উপর নির্ভর করলো। ফলে উলেমাতন্ত্র টিকে গেলো এবং সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে থাকলো, যেমনটা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা হয়েছে। ইসলামিক দেশগুলোর শাসকশ্রেণির মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য (যেমন- শিয়া ও সুন্নি) সত্ত্বেও তারা সকলে জনগণের নিদারুণ দুঃখ-দারিদ্র্যের কারণ হিসাবে ইসলামের আদি আদর্শ থেকে বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করে (ঠিক যেমনটা রাজনৈতিক জ্ঞান বিবর্জিত তথাকথিত মুক্তমনারা মনে করে ধর্ম গায়েব হলেই পৃথিবী বেহেশতে পরিণত হবে)। তারা প্রত্যেকে দেশগুলোতে বিদ্যমান নিপীড়নমূলক সামন্ততান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে রক্ষা করতে চায় এবং এগুলোকে আরও বেশি ইসলাম সম্মত তকমা দেয়। ঐসব দেশের দরিদ্র জনসাধারণের বড় অংশ এটা ভাবতে বাধ্য হয় যে কোরান ও সুন্নার বিধানে ফিরে যাওয়া আধ্যাত্মিক পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। একাংশের নারীর কাছে হিজাব এই পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারার ধর্মীয় বিধান, যা মান্য করাটা তাদের আধ্যাত্মিক পরিত্রাণের একটা উপায়। যে সামাজিক কাঠামোতে এই পরিত্রাণপন্থা তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে সেই কাঠামোকে না ভেঙে নারীমুক্তির একমাত্র পন্থা হিসাবে হিজাবের বিরোধিতা করলে তা খুব একটা কার্যকরী হয় না। তার অর্থ এই নয় যে হিজাবকে আইনত বাধ্যতামূলক করে তুলে ইসলামিক দেশগুলোতে যখন অনিচ্ছুক নারীদের উপর জোর করে সেই পোষাক বিধি চাপিয়ে দেয়া হয় এবং ঐ সমাজের ভিতর থেকে যখন সেই নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়, মার্কসবাদীরা সেই আন্দোলন থেকে দূরে থাকবে। বছর পাঁচেক আগে ইরানের সাংবাদিক মাসিহ আলিনেজাদ ইরানের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর হিজাবহীন ছবি স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে অন্য মহিলাদের উৎসাহিত করেন এমন গোপন স্বাধীন মুহূর্তের ছবি পোস্ট করতে। #mystealthyfreedom হ্যাশট্যাগে অসংখ্য হিজাবহীন সেলফি পোস্ট হয়। আলিনেজাদকে দেশ ছাড়তে হয়, এখনো প্রতিদিন তাকে খুনের হুমকি শুনতে হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তেহরানের রাজপথে বাধ্যতামূলক হিজাবের আইন অমান্য করে ২৯ জন মহিলা গ্রেফতার হন। ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯ সালে উত্তর ফ্রান্সের এক স্কুলে তিনজন মুসলিম ছাত্রী হিজাব পরে স্কুলে আসায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সাসপেন্ড করে। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে ফরাসি পার্লামেন্টে ভোটাভুটি করে আইন পাশ করা হয়, কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মীয় পরিচয়বাহী পোশাক পরে আসতে পারবে না। মার্কসবাদীদের জানতে হবে যে, অনভিপ্রেত বিশ্বাস প্রচার করার শ্রেষ্ঠ পন্থা হলো বিশ্বাসীর উপর নির্যাতন। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে ঠিক সেই ঘটনাই ঘটেছে। হিজাব নিষিদ্ধ হওয়ার পর ফ্রান্সে নতুন করে অনেক ইসলামিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, অনেক ছাত্রী স্কুল ছেড়ে বাড়ি থেকে পড়াশোনা করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কোনো কোনো ছাত্রী চুল ঢাকার নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে মস্তক মুণ্ডিত করে স্কুলে যাচ্ছে। যাদের পক্ষে সম্ভব, তারা ফ্রান্স ছেড়ে চলে গেছে। দেশভাগের পর ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়ারা যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বলেছিল তার গোড়াতে গলদ ছিল। দেশটিতে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা। সারা পৃথিবীতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মডেল হলো সংখ্যালঘুর শক্তিবৃদ্ধি ও সামর্থ সম্পর্কে সংখ্যাগুরুর মনে মিথ্যা আতঙ্ক সৃষ্টি। ইসলামোফোবিয়ার ভারতীয় ভাষ্য হলো “হিন্দু খতরে মে হ্যায়”। একদিকে কর্পোরেট পুঁজি দেশটির পানি, জমি, আকাশ সব লুঠ করবে; অন্যদিকে জনগণের তীব্র দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, বেকারত্ব - সবকিছুর জন্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করা হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সংখ্যাগুরুর মনে বিদ্বেষ, সন্দেহ, ঘৃণা সৃষ্টি করে তাকে আক্রমণাত্মক করে তোলা হবে। দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে, নানান বিদ্বেষমূলক আইন প্রণয়ন করে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার নামিয়ে আনা হবে। আর এসব কাজে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হবে। অপরদিকে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মসীহা হিসাবে অবতীর্ণ হয়ে সেই সমাজের সমস্ত প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে সংখ্যালঘুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। বিজেপির শাসনে গত আট বছর ধরে একের পর এক এই কাজগুলোই করা হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে হিজাব নিষিদ্ধ করা সেইরকম হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। যারা শিক্ষাঙ্গন থেকে সংসদ সর্বত্র ধর্মীয় রীতিনীতি প্রবর্তন করতে চায়, তাদের এই হিজাববিরোধী আন্দোলনে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান খুজে পাচ্ছে তারা নাস্তিক্যবাদী, যুক্তিবাদী, নারীবাদী যা খুশি হতে পারে। কিন্তু মার্কসবাদী না।
নাস্তিকতার ধাপসমূহ-
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Outline_of_atheism
কমিউনিজম বুঝতে হলে যত পড়াশোনা করতে হয় এর ক্ষুদ্র একটা আউটলাইন-
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Outline_of_Marxism
..................................................................................
১৯৪৪ সালের কাছাকাছি মার্কিন বাম নেতা আর্ল ব্রাউডার 'সৃজনশীল মার্ক্সবাদ' এর নামে সর্বত্র পার্টিকে অবলুপ্ত করে এর পরিবর্তে আলোচনা চক্র গড়ার প্রস্তাব করেছিলেন!
............................................................................
ইউরো কমিউনিজমের অনুসারী নির্বাচনপন্থী যেসব বামেরা গণযুদ্ধকে 'নৃশংসতা' বিবেচনা করে 'শান্তিপূর্ণ' উপায়ে জোঁকেদের সাথে সিট ভাগাভাগি করেন এবং জোঁকেদের মারলে যাদের কষ্টে বুক ভেসে যায় তাদের জন্য টমাস পেইনের এই উক্তিটি উপযুক্ত। ফরাসী বিপ্লবের সঙ্গে জড়িতদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে এডমন্ড বার্ক কর্তৃক সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন-
"আপনি পাখির পালকের জন্য দরদ দেখাচ্ছেন, মরণোন্মুখ পাখির জন্য নয়।"
............................................................................
বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের কুফল খোদ পশ্চিমা পন্ডিতদের মুখে শোনা যাক-
লেকি বলেন-
"গণতন্ত্র শ্রেষ্ঠতর প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করে, কিন্তু অধিকতর স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করে না।"
এমিল ফ্যাগুয়ে বলেন-
"গণতন্ত্র অক্ষমতার শাসন প্রণালি।"
লেকি আরও বলেন-
"গণতন্ত্র হচ্ছে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, অজ্ঞ ও অকর্মণ্য ব্যক্তির সরকার, কারণ এ শ্রেণির লোকই সর্বাধিক।"
কার্লাইল এই ধরনের সরকার ব্যবস্থাকে 'নির্বোধের রাজত্ব' বলেছিলেন।
স্যার হেনরি মেইন বলেন-
"গণতন্ত্র সাহিত্যবিজ্ঞান বা সুকুমার কলার তেমন কদর করে না। অজ্ঞ ও সাধারণ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত এই শাসনব্যবস্থা চারুকলা ও অন্যান্য বিষয় তেমন একটা বোঝে না।"
......................................................................
ভারতের যেসব নির্বাচনপন্থী বামেরা বলেন স্তালিন নাকি জ্যোতি বসুকে বলে গেছেন ভারতের প্রেক্ষাপট ভিন্ন দেখে নির্বাচনে গিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে তাদের জন্য কিছু তথ্য দেয়া যাক। ১৯০৮ সালে স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ম্যাডাম কামা স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন এবং ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের পূর্ণ মুক্তির সরব সমর্থকে পরিণত হন লেনিন সেসময়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bhikaiji_Cama
অথচ পশ্চিমা সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা ভারতের মতো উপনিবেশের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে অস্বীকার করেছিল। লেনিন বালগঙ্গাধর তিলকের গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bal_Gangadhar_Tilak
১৯২০ সালে লেনিন তার 'বামপন্থী কমিউনিজম, বালসুলভ ব্যাধি' লেখায় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করেন এবং ভারতকে মুক্ত করার জন্য 'ভারতের বলশেভিক'দের অবশ্যম্ভাবী উত্থানকে স্বাগত জানান। স্তালিন ১৯২৪ সালে 'লেনিনবাদের ভিত্তি' প্রসঙ্গে তার ভাষণে বলেছিলেন-
"শিগগিরই ভারতে বিপ্লব সংঘটিত হবে এবং রাশিয়ার পর বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের পরবর্তী বৃহৎ যোগসূত্র ছিন্ন করবে।"
.................................................................
১৮৫১ সালে মার্ক্স বলেছেন-
"আমরা শ্রমিকদের বলি কেবল বিদ্যমান অবস্থা পরিবর্তনের জন্যই নয়, সেই সঙ্গে নিজেদেরও বদল করার জন্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে নিজেদের যোগ্য করার জন্য আপনাদের ১৫, ২০, ৫০ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।"
নির্বাচনপন্থী বামেরা কি এরপরও স্বয়ং মার্ক্স কর্তৃক গণযুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা বলার পরও নিজেদের ভাঙা রেকর্ড বাজাতেই থাকবেন?
........................................................................
লেনিন বলেছিলেন-
"অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই পিছু হটা বন্ধ করতে পারবো। যত শিগগির এটা বন্ধ করতে পারবো ততই আমাদের পরবর্তী সাফল্যের অগ্রগতি দ্রুত, ব্যাপক ও স্থির হবে। রাশিয়া রূপান্তরিত হবে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায়।"
Comments