আমলাতন্ত্রের ২০ ধরণের প্রকাশ বৈশিষ্ট্য - মাও সে তুং [ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০]
১. প্রশাসন বা সংগঠনের উচ্চতর/উচ্চস্তরের নেতৃবৃন্দ ধারণা রাখেন না বা তারা কম জানেন। তারা জনগণের মতামত বুঝতে চেষ্টা করেন না বা বোঝেন না। তারা অধ্যয়ন অনুসন্ধান করেন না। তারা সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করেন না। তারা রাজনৈতিক মতাদর্শগত আলোচনার কাজ করেন না। তারা বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত থাকেন, জনগণ থেকে দূরে থাকেন এবং পার্টি নেতৃত্ব থেকেও দূরে সরে থাকেন। তারা সর্বদা নির্দেশনামা জারি করেন এবং তা নিষ্ফল-ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। নিশ্চিতভাবে তারা দেশ ও জনগণকে ভুলপথে নিয়ে যান এবং সবশেষে তারা পার্টির ধারাবাহিক অবিচল নীতি পন্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। তারা জনগণের নাগাল পেতে ব্যর্থ হন বা জনগণের মন জয় করতে পারেন না।
২. তারা নিজেদের নিয়ে উচ্চধারণা পোষণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। তারা রাজনীতি নিয়ে লক্ষ্যভেদবিহীন ভাবে আলোচনা করে থাকেন। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করেন না। তারা কায়া ফেলে ছায়ার পেছনে ঘোরেন এবং তারা একচক্ষু বিশিষ্ট। তারা কাউকে তোয়াক্কা করেন না। তারা জনগণকে বুঝতে চেষ্টা করেন না। তারা ভাবে রণোন্মত্ত এবং যুক্তিবিবেচনাহীন। তারা বাস্তবতার ধার ধারেন না এবং গোঁয়ারের মতো নিয়ন্ত্রণ করে আরোপ করেন। এটাই হলো কর্তৃত্বমূলক আমলাতান্ত্রিকতার ধরণ।
৩. তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ততার ভাব নিয়ে থাকেন। তারা সারা বছর কাজের মধ্যে থাকার ভান করেন। তারা জনগণের চাহিদা-চিন্তা নিয়ে নিরীক্ষা করেন না। তারা বাস্তব বিষয়াদি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন না বা ভাবেন না। তারা জনগণের উপর আস্থা বা বিশ্বাস রাখেন না। তারা কী নিয়ে আলোচনা করবেন বা বক্তব্য রাখবেন তা নিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি নেন না। কী কাজ করবেন তা নিয়েও পরিকল্পনা করেন না। এটাই বোধজ্ঞানশুন্য দিকভ্রষ্ট আমলাতন্ত্রের স্বরূপ। অন্যভাবে বললে একে রুটিনইজম বা নিয়মবাদ বলা যেতে পারে।
৪. তাদের ভাবভঙ্গিতে আমলাতান্ত্রিকতার নানামাত্রিক প্রকাশ ফুটে ওঠে। তারা পথ ঠাহর করতে পারেন না। তারা আত্মরতিতে মগ্ন থাকেন। তারা বিজ্ঞতার ভান করে সবকিছু তুরি মেরে উড়িয়ে দেন। তারা জনগণকে চোখ রাঙিয়ে তাদের বশীভূত করতে চায়। ক্রমাগতভাবে তারা জনগনের প্রতি বিষোদ্গার করে থাকেন। তাদের কাজের ধরণই হলো রূঢ়। তাদের জনগণকে তাদের সমমর্যাদা দিতে চান না। এটি জমিদারী আমলাতান্ত্রিকতার মতো।
৫. তারা অজ্ঞ বা জ্ঞানশুন্য কিন্তু তারা নিজেদের অজ্ঞতাকে স্বীকার করেন না এবং কোনো বিষয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করতে লজ্জ্বাবোধ করেন। তারা মিথ্যা কথা বলেন এবং সবকিছুতে অতিরঞ্জন করে থাকেন। তারা নিজেরা ভুলে ভরা কিন্তু তার বা সে ভুলের দায় চাপান জনগণের উপর। কিন্তু তারা সফলতার ভাগ বসাতে আগ বাড়িয়ে থাকেন। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে প্রতারণা করেন। তারা তাদের উচ্চস্তরের নেতৃত্বকে ভুল তথ্য দেয় বা প্রতারণা করে এবং তাদের অধস্তনদের বোকা বানিয়ে রাখে। তারা তাদের ভুলভ্রান্তিকে প্রকাশ করে না এবং ভুল পাশ কাটিয়ে যায়। এটাই শঠতামূলক আমলাতান্ত্রিকতা।
৬. তারা রাজনীতি বোঝেন না। তারা তাদের কাজও করেন না। তারা কাজের ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেন। তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন না। তারা ওজর দেখিয়ে দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থাকে। তারা বোধশুন্যহীন। তারা নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। এটাই অদায়িত্বশীল আমলাতান্ত্রিকতার লক্ষণ।
৭. তারা তাদের দায়িত্ব পালনে অমনোযোগী। তারা জীবন নির্বাহসর্বস্ব হয়ে যায়। তারা সবসময় ভুলই করে থাকে। তারা চারদিক রক্ষা করে চলে এবং তারা এতো পিচ্ছিল যে তাদের ধরা যায় না। তারা উর্দ্ধতনের কাছে নিজেকে সম্মানীয় পরিগণিত করতে চেষ্টায় থাকে এবং নিচুস্তরের কাছে নিষ্কর্মাতে পরিগণিত হতে থাকে। এটা যারা চাকুরিজীবির মতো কাজ করে এবং জীবিকার খাতিরে কাজ করে সেই ধরণের আমলাতান্ত্রিকতা।
৮. তারা রাজনীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ শিখে না। তারা কাজের কাজি। তাই তাদের আলোচনার ধরণও হয়ে থাকে বিস্বাদ বা স্বাদহীন। তারা নেতৃত্বদানের সময় দিশাহীন। তারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করে থাকে অথচ প্রাপ্য পেতে চায়। তারা লোক দেখানো কাজেই সিদ্ধহস্ত। তারা জমিদারের মতো ঠাটবাট বজায় রাখে এবং যে সকল কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে কিন্তু উর্দ্ধতনের মনমতো কাজ করতে পারে না তখন তারা উচ্চস্তরের গালমন্দ শুনতে পায়। এই ধরণের আমলাতান্ত্রিকতা হলো ফাঁকিবাজির ও মেধাশুন্য আমলাতান্ত্রিকতা।
৯. তারা নির্বোধ বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন এবং দ্বিধাগ্রস্ত। তাদের নিজস্ব চিন্তা বলে কিছু নেই। তাদের মননে পচন ধরেছে।দিনশেষে তাদের বাগাড়ম্বরই সার। তারা পরিশ্রমী তো নয়ই এবং তারা একইসাথে অস্থিরচিত্তসম্পন্ন ও অজ্ঞ। এটা হলো নির্বোধ-জড়বুদ্ধিসম্পন্ন, অকর্মা আমলাতন্ত্রের ধরণ।
১০. তারা অন্যদের বলে দলিল পড়তে এবং তারা তা পড়ে থাকে। কিন্তু যে পড়তে বলে সে-ই নিজে তা না পড়ে ঘুমায়। তারা বিষয় সম্পর্কে না জেনে সমালোচনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ভুলের সমালোচনা করে এবং জনগণকে শাপান্ত করতে থাকে। ভুল থেকে উত্তরণের পথটি তারা খুঁজে পায় না। তারা সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেনা, বরং সমস্যাকে একপাশে রেখে দিয়ে বগল বাজায়। তারা তাদের উচ্চস্তরের নেতৃবৃন্দের মন যোগাতে ব্যস্ত থাকে। তারা তাদের অধস্তনদের কাছে নিজেকে বুঝদার জাহির করতে চায়, যখন তারা সামলাতে বা পেরে উঠতে সক্ষম না হয় তখন তাদের হিক্কা উঠতে থাকে অথবা ভাব দেখাতে থাকে। যারা তাদের সমপর্যায়ের তাদের সাথে তারা সবসময় তর্ক চালাতে থাকে সবসময় তারা অন্য আরেকটি তত্ত্ব এনে হাজির করে থাকে এবং এটা হলো অলস আমলাতন্ত্রের ধরণ।
১১. সরকারের লটবহর বাড়তে থাকে এবং বেড়ে চলে। কিন্তু সমস্যার শেষ থাকে না। কাজের চেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সংখ্যা বেশি এবং তারা অলস সময় কাটাতে থাকে, তারা ঝগড়া ফ্যাসাদ বাধাতে থাকে, অনর্থক বিষয় নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকে। জনগণ আরো অধিক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকে, কিন্তু তারা (প্রশাসনিক ব্যক্তি) নিজেদের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করে না। এটা সরকারী দপ্তরের আমলাতন্ত্র।
১২. দলিলাদির সংখ্যা অসংখ্য এবং এসকল জরুরী গোপনীয় লাল ফিতায় মোড়ানো নির্দেশনামা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু যে সকল প্রতিবেদন এসেছে তা অপঠিত অমূল্যায়িত থাকতে থাকে। অনেক ছক কষা হতে থাকে,কাজের তালিকা বাড়তে থাকে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। অনেক আলোচনার পরে বা বৈঠকের পরে কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় না। একে অপরে সুহৃদ সদ্ভাব বজায় রাখে, কিন্তু শিক্ষালাভ করা হয়ে ওঠেনা। এটাই লাল ফিতার ও আনুষ্ঠানিকতার আমলাতন্ত্র।
১৩. তারা সুখ খোঁজে, আমোদ খোঁজে; কিন্তু কষ্ট করতে ভয় পায়। তারা সবসময় পেছন দরজা দিয়ে বোঝাপড়া সেরে নেয়। নিজে দায়িত্ব পাওয়ার পরে পরিবারের সবাই সুযোগ পেতে থাকে। একজন নিরবান লাভ করলো তো পরিবারের সবাই স্বর্গবাসী হয়ে গেলো। অনুষ্ঠান হলেই তারা ‘গিফট’ পেতে থাকে। এটা ’চাঙবাড়া’ বা ‘অতিঅতিক্রমী’ আমলাতন্ত্রের লক্ষণ।
১৪. যত উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বসম্পন্ন তিনি হন তত তিনি সহিষ্ণুতা হারাতে থাকেন। তিনি তাকে নির্ভুল প্রমাণিত করতে ততই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার ঘরদোর ও আসবাবপত্রের বাহার বাড়তে থাকে এবং তার জিনিসপত্রের মান ভাল হতে থাকে। উচ্চস্তর অধিক ভাগ পেতে থাকেন কিন্তু নিচের স্তরকে তার মূল্য দিতে হয়। বিলাসিতা বাড়তে থাকে, আবর্জনা বাড়তে থাকে। উচ্চ-নীচ-ডানে-বামে ‘ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না’ হয়ে থাকে। এটা হলো দায়িত্বকে আকাশে ভিত্তি ছাড়া তুলে রাখার মতো আমলাতন্ত্র।
১৫. তারা অহংকারী হয়ে ওঠে। তারা সাধারণ জনতার মতো তাদের আকাংখার পূরণ ঘটায়। কারচুপি, সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। যত পায় তত তারা চায় এবং চাহিদা তাদের বাড়তে থাকে। এটা হলো অহংকারী আমলাতন্ত্রের লক্ষণ।
১৬. তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থের ভাগ নিয়ে বিবাদে লেগে থাকে, তারা খ্যাতি চায়, সুবিধা চায়। তারা ক্ষমতা চায় এবং তারা যদি তা না পায় তবে তারা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। তাদের মেদ বাড়তে থাকে, তারা রোগা হতে থাকে। তারা বেতন ভাতাদির ব্যাপারে বেশ সোচ্চার থাকে। তারা তাদের সহযোদ্ধাদের সাথে উঞ্চ সম্পর্ক ধরে রাখে, কিন্তু জনগণকে তারা তোয়াক্কা করে না। এটা হলো ক্ষমতা ও অর্থের ভাগ নিয়ে বিবাদে লেগে থাকার আমলাতন্ত্রের ধরণ।
১৭. সংখ্যাভারাক্রান্ত নেতৃত্বমন্ডলী সুসসমন্বিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে জানে না। তারা সবাই যে যার মতো করে পথ দেখাতে থাকে এবং তাদের কাজে হযবরল হতে থাকে। নিজের চিন্তা চাপিয়ে দিতে গিয়ে তারা অন্যের চিন্তার থোরাই কেয়ার করে। উচ্চস্তর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নিম্নস্তর থেকে এবং বিকেন্দ্রীকরণের কোনো নিশানাই থাকে না, গণতন্ত্র সেখান থেকে সরে চলে যায়। এটাই একতাবিহীন আমলাতন্ত্রের লক্ষণ।
১৮. তখন আর কোনো সংগঠন বা সাংগঠনিক কাঠামো থাকে না, তারা নিজেদের বন্ধু-স্বজনদের মনোনীত করতে থাকে। এতে উপদলীয়বাদ সৃষ্টি হয়। তারা সামন্তীয় ধারার সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। তারা ক্ষুদ্র দল সৃষ্টি করে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য এবং তারা একে অপরকে রক্ষা করে চলে। এতে সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তিবাদিতা জাহির হতে থাকে। এই ব্যক্তিবাদি সাংগঠনিক কাঠামো জনগণের ক্ষতি করে থাকে। এটাই হলো গোষ্ঠীবাদী আমলাতন্ত্রের ধরণ।
১৯. তাদের বিপ্লবী আকাংখা ক্ষয়ে যেতে থাকে। তাদের এই রাজনৈতিক চরিত্র তাকে পরিবর্তিত করতে থাকে। তারা দেখায় যে তারা অনেক অনেক অভিজ্ঞ। তারা দায়িত্ব পালনকে লাটে ওঠাতে থাকে। তারা যা ভাবে তা প্রকাশ করে না এবং যা করে তা ভাবে না। তারা সহজেই কঠিন বিষয়কে এড়িয়ে যায়। তারা অসুস্থ না হলেও ডাক্তার ডাকে। তারা পাহাড়ে, সাগর সৈকতে সময় কাটাতে যায়। তারা ভাসাভাসা ভাবে সবকিছু করে থাকে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে সবসময় ভাবতে থাকে। কিন্তু তারা জাতীয় স্বার্থ নিয়ে যারপরনাই চিন্তাই করে না। এটা হলো অধ:পতিত আমলাতন্ত্রের ধরণ।
২০. তারা খারাপ প্রবণতা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাকে উস্কে দেয়। তারা মন্দ লোকদের সাথে সংযোগ রাখে এবং খারাপ অবস্থাকে লাই দিতে থাকে। তারা আইন ভাঙতে থাকে। তারা সন্দেহজনক হতে থাকে। তারা পার্টি ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক। তারা গণতন্ত্রকে পিষতে থাকে। তারা লড়াই চালায় এবং প্রতিশোধ নিতে থাকে। তারা খারাপ বা মন্দকে রক্ষা করতে আইন ও বিধি ভাঙতে থাকে। তারা শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করে না। এটাই ভ্রান্ত প্রবণতা ও প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতন্ত্রের ধরণ।
Comments