উদারতাবাদের বিরোধিতা করুন - মাও সে তুং [৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭]

 

আমরা সক্রিয় মতাদর্শগত সংগ্রামের পক্ষে, কারণ এটা হচ্ছে আমাদের সংগ্রামের স্বার্থে পার্টির ভিতরে ও বিপ্লবী সংগঠনগুলোর ভেতরে ঐক্যকে নিশ্চিত করার হাতিয়ার। প্রত্যেক সাম্যবাদী ও বিপ্লবীর উচিত এই হাতিয়ার হাতে তুলে নেয়া। কিন্তু উদারতাবাদ মতাদর্শগত সংগ্রামকে বাতিল করে দেয় এবং নীতিহীন শান্তির পক্ষ নেয়, এইভাবে তা ক্ষয়িষ্ণু ও অসভ্য মনোভাবের জন্ম দেয় আর পার্টি ও বিপ্লবী সংগঠনগুলোর কোনো কোনো একক ও ব্যক্তির রাজনৈতিক অধ:পতন ঘটায়। উদারতাবাদ বিভিন্নভাবে নিজেকে প্রকাশ করে।

যখন সুস্পষ্টই দেখা যায় যে, কোনো লোক ভুল পথে যাচ্ছেন, অথচ সে লোক একজন পুরনো পরিচিত লোক, একই জায়গার অধিবাসী, সহপাঠী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রিয়জন, পুরনো সহকর্মী বা পুরনো অধস্তন লোক বলে তার সাথে নীতির ভিত্তিতে যুক্তিতর্ক না করা, শান্তি ও সখ্যতা বজায় রাখার জন্য হাল্কাভাবে কিছু বলা, কিন্তু চূড়ান্তভাবে মীমাংসার চেষ্টা না করা। এর ফলে সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষ উভয়েরই ক্ষতি হয়। এটা হচ্ছে প্রথম প্রকারের উদারতাবাদ।

নিজের প্রস্তাব সংগঠনের সামনে সক্রিয়ভাবে উত্থাপন না করে আড়ালে দায়িত্বজ্ঞানহীন সমালোচনা করা। সামনাসামনি কিছু না বলে পেছনে গুজব রটনা করা অথবা সভায় কিছু না বলা কিন্তু পরে আজেবাজে কথা বলা। যৌথ জীবনের নীতির প্রতি আদৌ কোনো প্রকার শ্রদ্ধা না দেখিয়ে নিজের ঝোঁকে চলা। এটা দ্বিতীয় প্রকারের।

যে ব্যাপার নিজেকে স্পর্শ করে না তাকে চলতে দেয়া; কোনো বিষয়কে স্পষ্টতই ভুল জেনেও সে বিষয় সম্পর্কে যথাসম্ভব কম বলা; সাংসারিক বিষয়ে অভিজ্ঞ সাজা, গা বাঁচিয়ে চলা ও কেবলমাত্র দোষ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা। এটা তৃতীয় প্রকারের।

আদেশ অমান্য করা ও নিজের মতামতকে প্রথম স্থান দেয়া। সংগঠনের কাছ থেকে শুধু বিশেষ সুবিধা দাবি করা, কিন্তু সংগঠনের শৃংখলা অস্বীকার করা। এটা চতুর্থ প্রকারের।

ঐক্য বা অগ্রগতি অথবা সুষ্ঠুভাবে কর্ম সম্পাদনের জন্য ভুল মতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুক্তিতর্ক না করে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালানো, ঝগড়া বাধানো, ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশ করা বা প্রতিহিংসা নেয়ার চেষ্টা করা। এটা পঞ্চম প্রকারের।

ভুল মতামত শুনেও তা খণ্ডন না করা, এমনকি প্রতিবিপ্লবী মন্তব্য শুনেও সে সম্বন্ধে কোনো রিপোর্ট না করা, বরং সেগুলো নির্বিকারভাবে গ্রহণ করা যেন কিছুই ঘটেনি। এটা ষষ্ঠ প্রকারের।

জনসাধারণের মধ্যে থেকেও তাদের মধ্যে প্রচার না চালানো এবং তাদেরকে উত্তেজিত না করা, সভায় বক্তৃতা না দেয়া, তাদের মধ্যে তদন্ত ও অনুসন্ধান না চালানো, তাদের সুখ-দুঃখের প্রতি কোনো রকম যত্ন না নেয়া, বরং তাদের সম্বন্ধে উদাসীন থাকা এবং নিজে যে একজন সাম্যবাদী সে কথা ভুলে একজন অ-সাম্যবাদীর মতো আচরণ করা। এটা সপ্তম প্রকারের।

কেউ জনসাধারনের স্বার্থের ক্ষতি করছে দেখেও ক্রোধ অনুভব না করা বা তাকে উপদেশ দিয়ে বিরত না করা, না থামানো, যুক্তি দিয়ে তাকে না বুঝানো, বরং জেনে শুনেও তাকে সে কাজ করে যেতে দেয়া। এটা অষ্টম প্রকারের।

কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা লক্ষ্য ছাড়া উৎসাহহীনভাবে কাজ করা, যেনতেনভাবে কাজ করা এবং জগাখিচুড়ী পাকিয়ে চলা যেন “যতদিন মঠের সন্যাস্যী থাকবো ততদিন ঘন্টা বাজিয়েই যাবো”। এটা নবম প্রকারের।

বিপ্লবের জন্য নিজে বিরাট অবদান রেখেছেন বলে মনে করা, প্রবীন অভিজ্ঞ বলে নিজেকে জাহির করা, বড় কাজ করতে অসমর্থ হওয়া সত্ত্বেও ছোট কাজ করতে ঘৃণা করা, কাজে অমনোযোগী হওয়া আর পড়াশুনায় ঢিল দেয়া। এটা দশম প্রকারের।

নিজের ভুল জানতে পেরেও তা সংশোধনের চেষ্টা না করা, নিজের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করা। এটা একাদশ প্রকারের।

আমরা আরো কয়েকটি ধরণের কথা উল্লেখ করতে পারি। কিন্তু এই এগারটিই প্রধান। এগুলোই উদারতাবাদের অভিব্যক্তি। বিপ্লবী যৌথ সংগঠনের ভেতর উদারতাবাদ অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা হচ্ছে একটা ক্ষয়কারক বস্তু যা ঐক্য নষ্ট করে, সংহতি ধ্বংস করে, কাজে নিষ্ক্রিয়তা আনে আর মতভেদ সৃষ্টি করে। এটা বিপ্লবী বাহিনীকে দৃঢ়বদ্ধ সংগঠন ও কঠোর শৃংখলা থেকে বঞ্চিত করে, নীতিগুলোকে পুরোপুরি কার্যকরী করা অসম্ভব করে তোলে আর পার্টি যাদের পরিচালনা করে সেই জনসাধারণ থেকে পার্টি সংগঠনকে পর করে দেয়। এটা অত্যন্ত খারাপ ঝোঁক। পাতি বুর্জোয়া স্বার্থপরতা হতে উদারতাবাদের জন্ম, এটা ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রথম স্থান দেয় এবং বিপ্লবের স্বার্থকে দেয় দ্বিতীয় স্থান। ফলে মতাদর্শগত, রাজনীতিগত ও সংগঠনগত উদারতাবাদের উদ্ভব ঘটে। উদারতাবাদীরা মার্কসবাদের নীতিগুলোকে বিমূর্ত ধর্মকথার মত মনে করেন। মার্কসবাদকে তারা অনুমোদন করেন, কিন্তু তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে বা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে তারা প্রস্তুত নন, নিজেদের উদারতাবাদের পরিবর্তে মার্কসবাদকে গ্রহণ করতে তারা তৈরি নন। এইসব লোকের আছে তাদের মার্কসবাদ, আবার তাদের উদারতাবাদও আছে। মুখে তারা মার্কসবাদের কথা বলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা প্রয়োগ করেন উদারতাবাদ। অন্যদের প্রতি তারা প্রয়োগ করেন মার্কসবাদ, কিন্তু নিজেদের প্রতি প্রয়োগ করেন উদারতাবাদ। দুই ধরণের জিনিসই তারা মজুদ রাখেন, আর একেকটি একেক কাজে ব্যবহার করেন। কোনো কোনো লোকের চিন্তা এইভাবে কাজ করে থাকে। উদারতাবাদ সুবিধাবাদের এক প্রকারের প্রকাশ, আর মার্কসবাদের সঙ্গে এর মৌলিক সংঘর্ষ রয়েছে। এটা নেতিবাচক এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এটা শত্রুকে সাহায্য করার ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই শত্রুরা আমাদের মধ্যে এর সংরক্ষণকে স্বাগত জানায়। উদারতাবাদের প্রকৃতি যখন এইরূপ, তখন বিপ্লবীদের মধ্যে তার কোনো স্থান থাকতে পারেনা। নেতিবাচক উদারতাবাদ দূর করার জন্য আমাদের মার্কসবাদের ইতিবাচক ভাবমানস গ্রহণ করতে হবে। একজন সাম্যবাদীকে বিশাল মনের অধিকারী, একনিষ্ঠ ও সক্রিয় হতে হবে। বিপ্লবের স্বার্থকে নিজের প্রাণের মতো করে দেখতে হবে আর ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীনে রাখতে হবে। তাকে সর্বদা ও সর্বক্ষেত্রেই নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে আর সমস্ত ভুল চিন্তাধারা ও আচরণের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করতে হবে যাতে করে পার্টির যৌথ জীবনকে সুসংবদ্ধ আর পার্টি ও জনসাধারণের মধ্যকার সংযোগকে জোরদার করা যায়; ব্যক্তিবিশেষের চাইতে পার্টি ও জনসাধারণের সম্বন্ধে আর নিজের চেয়ে অপরের সম্বন্ধে তাকে বেশি যত্নশীল হতে হবে। শুধু তাহলেই তাকে একজন সাম্যবাদী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। সকল বিশ্বস্ত, সৎ, সক্রিয় ও ন্যায়পরায়ণ সাম্যবাদীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে যে উদারতাবাদের যে ঝোঁক রয়েছে তার বিরোধিতা করে তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের মতাদর্শগত ফ্রন্টের অন্যতম কর্তব্য।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]