বিপ্লবের ডাক্তার
১৮৯০ সালে ডা. নরমান বেথুন কানাডায় জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে আর্থিক অশ্চলতার কারণে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে কানাডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি আমেরিকা থেকে এম.ডি. এবং
ইংল্যান্ড থেকে এফ.আর.সি.এস. ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন কবি এবং চিত্রশিল্পী হিসেবেও তিনি খ্যাতি লাভ করেন। ডা. বেথুন সিদ্ধান্তে আসেন যে, দরিদ্র জনগণ পুষ্টিকর খাদ্য এবং ওষুধ পেলে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে সক্ষম। তার মতে, অধিকাংশ রোগের মূল কারণ হলো দারিদ্রপ্রসূত অপুষ্টি। এজন্য তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার সামাজিকীকরণের দাবি তোলেন। তার অভিমত জনগণের সমর্থন লাভ করলেও সরকার ও ধনীরা তাকে পাগল, সমাজদ্রোহী আখ্যা দেয়। ১৯২৯-৩০ সাল ছিল সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশসমূহের জন্য ভয়াবহ সংকটের সময়। মুনাফার লোভে তারা অতিরিক্ত উৎপাদন ঘটালেও লোকের ক্রয় ক্ষমতার অভাবে উৎপাদিত দ্রব্যাদি অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এসব জোঁকেরা মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উৎপাদিত দ্রব্যের আংশিক ধ্বংস করে ফেলে, কলকারখানা বন্ধ করে দেয়, শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে। এতে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে গিয়ে তারা অনাহারের সম্মুখীন হতে থাকে। নরমান বেথুন দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং তাদের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। একদিন তিনি এক বন্ধুকে নিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। পথে দেখলেন বিরাট পতাকাবাহী বেকার মানুষদের দীর্ঘ মিছিল সরকারি অফিস ভবনের দিকে যাচ্ছে। মিছিল থেকে আওয়াজ আসছে –“খাদ্য দাও, শিশুর জন্য দুধ দাও, বেকার ভাতা দাও, বাঁচার সুযোগ দাও।” পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ডা. বেথুন বন্ধুকে বললেন নিরস্ত্র, নিরপরাধ, ক্ষুধার্ত, মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ শোষক ধনীদের সরকারের সুপরিকল্পিত দরিদ্র হত্যার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি আহতদের নিজের চেম্বারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। মিছিলের নেতারা চেম্বারে এসে ‘কমরেড বেথ’ সম্বোধন করে তাকে কৃতজ্ঞতা জানান। কিছুকাল পর তাকে দেয়া এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেন “আপনাদের প্রদত্ত সম্মান মাথা পেতে নিলাম। কিন্তু সেদিন যে কিছু বেকার, ক্ষুধার্ত মানুষ আমাকে ‘কমরেড বেথ’ ডেকে করমর্দন করেছিলেন তাকে আমি সবচেয়ে বড় সম্মান মনে করি।” ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। জার্মানী ও হাঙ্গেরীতে বিপ্লব ব্যর্থ হলেও দুনিয়াব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এবং পরাধীন দেশসমূহের স্বাধীনতা আন্দোলন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের দমন করে ইতালিতে মুসোলিনী ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে এবং ১৯৩৫ সালে আবিসিনিয়া আক্রমণ করে। জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে চীনকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। ১৯৩৩-৩৪ সালে জার্মান পুঁজিপতিরা মার্কিন ও ব্রিটিশদের সাহায্যে কমিউনিজম ধ্বংসের আওয়াজ তুলে হিটলারকে ক্ষমতায় বসায়। বিভিন্ন দেশের এসব ঘটনার গতিপ্রকৃতি ডা. নরমান বেথুনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। ১৯৩৫ সালে লেনিনগ্রাদে বিশ্ব ফিজিওলজিক্যাল কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ডা. বেথুন আরও ৩ জন কানাডিয়ান চিকিৎসকসহ এই সম্মেলনে যোগ দেন। প্রায় দু’মাস সোভিয়েতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি অনুসন্ধান চালান। তিনি দেখতে পান সোভিয়েতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা উন্নত পর্যায়ের এবং প্রত্যেক সোভিয়েতবাসী বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পায়। সমাজতন্ত্রই যে মেহনতিদের মুক্তির একমাত্র রাস্তা এ বিষয়ে তার উপলব্ধি আরও গভীর ও স্বচ্ছ হয়। দেশে ফিরে তিনি কানাডার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। স্পেনে স্বেচ্ছাচারী প্রাইমোরিভেরার রাজত্বের অবসানে সার্বজনীন ভোটে যে নির্বাচন হয় তাতে প্রতিক্রিয়াশীলরা পরাজিত হয়, প্রগতিভাবাপন্ন বুর্জোয়ারাসহ সাধারণতন্ত্রপন্থী সব দল মিলে একটি সম্মিলিত সরকার গঠন করে। হিটলার ও মুসোলিনির প্রত্যক্ষ উষ্কানিতে স্পেনের জেনারেল ফ্রাংকো মূল স্পেনের সৈন্যদের পক্ষে আনতে না পেরে এর উপনিবেশ মরক্কো থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে স্পেন আক্রমণ করে। হিটলার ও মুসোলিনী তাকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রদান করে। গণতন্ত্রের ঢোল পেটানো ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমরিকা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে। তারা নিজেদের নিরপেক্ষ ঘোষণা করলেও স্পেনের জন্য সাহায্য পাঠাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। স্তালিনের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষদের, মেহনতি মানুষদের কাছে অস্ত্র সংগ্রহ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের জন্য আবেদন জানায়। পৃথিবীর অনেক দেশে ‘স্পেন সাহায্য কমিটি’ গঠিত হয়। কানাডায় নরমান বেথুনকে সভাপতি করে সব দলের প্রগতিশীলদের নিয়ে অনুরূপ সাহায্য কমিটি গঠিত হয়। সমগ্র কানাডা ও আমেরিকা ঘুরে তিনি ডলার, ওষুধ ইত্যাদি স্পেনে পাঠাতে থাকেন। বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধাদের নিয়ে স্পেনে গঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড। ইংল্যান্ডের দুই বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ব্যালফ্যাকস ও কডওয়েল এই যুদ্ধে শহীদ হন, যারা ছিলেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। রিপাবলিকান সরকারকে সাহায্যের জন্য স্তালিন বিমান বাহিনী, ট্যাংক ও অন্যান্য আধুনিক সামরিক সাহায্য পাঠালেন। তাছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের জন্য জেনারেল রকোভস্কির নেতৃত্বে তিনি একদল সামরিক প্রশিক্ষকও পাঠান। ডা. বেথুন কানাডার স্পেন সাহায্য কমিটির বর্ধিত সভায় ঘোষণা করলেন তিনি স্পেনের ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধে যোগদান করবেন। সেখানে পৌঁছে তিনি ব্লাড ব্যাংক ও রক্ত ট্রান্সফিউশন ব্যবস্থা ট্রেঞ্চের কাছে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। কানাডায় থাকাকালে তিনি চীনের বিপ্লবী সংগ্রামের বিস্তারিত খবর রাখতে শুরু করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন উত্তর চীনে গিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে তাদের বিপ্লবী সংগ্রামকে সাহায্য করবেন। ১৯৩৭ সালে তিনি চীন রওয়ানা হন। কমিউনিস্ট পার্টি ও জনগণের সাহায্যে পরিচালিত সংগ্রামের মহান নেতা মাও সে তুং ডা. বেথুনকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। স্পেনে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের যে ধরনের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন চীনেও তার প্রবর্তন করেন। তিনি রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে ঘাঁটি স্থাপন করে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি গেরিলাদের একাংশকে ফাস্ট এইড ও অন্যান্য ধরনের চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন। তার প্রতি শ্রদ্ধায় বিপ্লবীরা গান রচনা করে “আমাদের যথেষ্ট খাবার নেই, আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু আমাদের সাথে আছে বেথুন।” চীনারা ভালেবেসে তাকে ‘পাই চু এন (আমাদের ঘরের লোক)’ বলে ডাকতো। মাও সে তুং নির্দেশ দিলেন এই বিপ্লবী ডাক্তারকে মাসিক ১০০ ডলার বেতন দিতে। বেথুন বলেছিলেন তিনি মাসিক মাত্র ১ ডলার করে বেতন নিবেন। কারণ সাধারণ সৈন্যদের মাসিক বেতন ছিল ১ ডলার। তিনি একটি কেন্দ্রীয় মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি চীনের স্থানীয় কিছু গাছ-গাছড়া থেকেও ওষুধ তৈরি করেন। কামারশালা থেকে যন্ত্রপাতি তৈরি করতে বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। কঠোর পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে পড়ে। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও বিশ্রামের জন্য গেরিলা সেনাধ্যক্ষের অনুরোধ তিনি রাখেননি। তার সিদ্ধান্ত ছিল অন্য গেরিলারা যা খায় তার বেশি তিনি খাবেন না। এসময় ভারত থেকেও একটি মেডিকেল মিশন চীনে গিয়েছিল। জনৈক গেরিলার অস্ত্রোপচারের সময় ডা. বেথুনের হাতে ছুরির আঘাত লাগে। রক্তের বিষক্রিয়ার কোনো প্রতিষেধক ওষুধ ছিল না। ১৯৩৯ সালের ১৩ই নভেম্বর এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যু হয়। চীনে ডা. নরমান বেথুন আন্তর্জাতিক হাসপাতাল, বেথুন যাদুঘর ও স্মৃতিসৌধ রয়েছে।
Comments