বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে রুশ বিশ্লেষক



'পিপলস ফ্রেন্ডশীপ ইউনিভার্সিটি অফ রাশিয়া'র ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এন্ড প্রেডিকশন্স বিভাগের সদস্য এ্যান্ড্রু করিবকো এর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণের অনুবাদ-

গত বুধবার ‘দি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ (এপি) এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে ‘প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণ হরণকারী সহিংস সংঘর্ষের পর বাংলাদেশ হামাগুড়ি দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।’ সংক্ষেপে বললে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি ক্রমাগত তিক্ত বা বিরূপ হয়ে উঠছে এবং দিল্লির স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিকে শাস্তি দিতে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারাটা তাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক। কেননা বাংলাদেশ ভারতের নিকটবর্তী সেই নাজুক, স্পর্শকাতর বিন্দু। এছাড়া, বাংলাদেশ মস্কোকে পরিত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় ওয়াশিংটনও ঢাকার প্রতি ক্ষুব্ধ। এই বিষয়গুলোই ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশে ২০২৪ এর জানুয়ারির আগে একটি ‘কালার রেভল্যুশন’ আয়োজনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল, যদিও মার্কিনীদের এই পরিকল্পনা তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থার ক্ষেত্রে চিড় ধরেছে এবং সেজন্যই বাংলাদেশের নেত্রী সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, আমেরিকা তাঁর দেশকে একটি বশংবদ বা প্রতিনিধি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। এমতাবস্থায় বাইরে থেকে যে কোনো পর্যবেক্ষকের এমন মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম অস্থিতিশীলতা একটি বিলম্বিত ‘কালার রেভল্যুশন’ থেকেও খানিকটা বেশি। তবে বাস্তবতা আরো অনেক বেশি জটিল। সেদেশের বিরোধী দল নিশ্চিতভাবে এই উত্তেজক এবং সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ইন্ধন যোগানোর কাজ করেছে। পাশাপাশি এই ভয়ানক সংঘর্ষপরায়ণ পরিস্থিতি চিরস্থায়ী করতেই যেন পুরো উত্তপ্ত অবস্থা ছাত্রদের নেতৃত্বেই রইলো এবং সমাজের অন্য নানা অংশের সদস্যদেরও তারা যুক্ত করতে চাইলো। কারণ ছাত্ররাসহ বাংলাদেশের সমাজের বহু মানুষের কাছে সরকারি চাকরি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যদিও এতে করে ছাত্রদের গৃহীত আন্দোলনের সহিংস পন্থাকে উপেক্ষা করা যায় না, তবে এটা থেকে বোঝা সম্ভব, কেন এই ছাত্রদের আন্দোলনের ইস্যুটি এত জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের অর্থনীতির চেয়েও আয়তনে আরো বৃহদাকার হয়ে উঠেছে। ব্যপারটি সত্যিই আগ্রহ জাগানীয়া, যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের একটি অংশ। তবু বাংলাদেশের সমাজের কিছু অংশ দেশটিতে সম্পদের বন্টন এবং শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন। দেশটিতে বাড়তে থাকা ভিন্ন মতের সাথে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার মিলে ইতোমধ্যেই বিরোধী দলের রাজনীতির প্রতি অনুরাগী তরুণদের একটি বিপুল অংশকে সরকারি চাকরির কোটা নীতি বিষয়ে সংগঠিত হবার পেছনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে। যদিও এই খাতে প্রাপ্ত নতুন চাকরিগুলো দেশের সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় প্রতি বছরই যেন আরো বেশি অপ্রতুল বলে মনে হয়, তবু যারা সরকারি কাজ পায়, তারা যেন সারা জীবনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ জন্যই দেশজুড়ে এই দাবি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, মেধার ভিত্তিতেই চাকরিগুলো প্রাপ্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই অনুভূতিকেই কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা এবং কিছু বিক্ষোভকারীকে সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে প্ররোচিত করেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু না-জানা কোনো অপ্রশিক্ষিত নিরীক্ষক বা পর্যবেক্ষকের কাছে বর্তমানের সহিংস পরিস্থিতিকে ‘কালার রেভল্যুশন’ বলে মনে হলেও বাস্তবে বহু যুগের পুরনো নীতির প্রতি দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা অসন্তোষের ফলাফল হলো এই গৃহযুদ্ধতুল্য পরিস্থিতি। আর বাংলাদেশের বাইরের শক্তিগুলোর পক্ষে এই সার্বিক পরিস্থিতি তাদের নিজেদের কাজে লাগনোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। গত জানুয়ারির নির্বাচনের সময়েই বিরোধী দলগুলোর প্রতি আনুগত্যপূর্ণ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কর্তৃক সুবিধাপ্রাপ্ত এনজিওগুলো কোটাবিরোধী ছাত্রদের একটি বিপুল অংশকে সংগঠিত করে তুলেছিল যা পরবর্তী সময়ে এই দ্বিতীয় দফা সহিংসতার মঞ্চ প্রস্তত করেছে।ক্ষমতাসীন দলকে তাই এই মুহূর্তে বিশেষ সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে যেহেতু সেদেশের প্রাপ্তবয়স্ক তরুণেরা সাম্প্রতিক নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে নতুন মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই নিরাপত্তা বাহিনীসমূহ কর্তৃক বলপ্রয়োগের অসম ব্যবহারে বিক্ষুব্ধ এবং তরুণ প্রজন্মের ভেতরে চিন্তার এই প্রবণতা সহজে আর বিপরীতমুখী করা যাবে না। এটা বোঝা খুব কঠিন নয় যে, কীভাবে এই আন্দোলন খুব দ্রুত একটি শাসন বা সরকার পরিবর্তনের প্রকাশ্য আহ্বানে পরিণত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে আরো বেশি বেশি প্রতিবাদ সমাবেশ হতে পারে এবং এই অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় আরো ফাটল ধরলে সরকার বিরোধী উগ্রতম শক্তিগুলো কর্তৃক একটি বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী অভিযান চালানো যায়। ভবিষ্যতে তাই বাংলাদেশ নিজেকে আরো চাপের ভেতরে আবিষ্কার করতে পারে। যদিও এটি অস্বচ্ছ যে, এই অস্থিতিশীলতার পরবর্তী পালা কখন শুরু হবে, ঠিক কতটা স্তর পর্যন্ত দেশের বাইরের বা বহিঃশক্তিগুলো নিজেদের এসবে জড়াবেন এবং একবার চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে গেলে সবকিছু কি ভয়ানক রূপ নেবে! যাহোক, অনিবার্য যা সামনে আসবে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রস্তত হতে হবে এবং সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর সাথে শান্তিপূর্ণভাবে পাল্টা লড়াই লড়তে হলে সরকারের অনুকূল নাগরিক সমাজের শক্তিসমূহের বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ‘গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা’র শিক্ষা অনুযায়ীই সেটা বাংলাদেশ সরকার করতে পারলে ভালো। ভারত মহাসাগরের উত্তরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগবিন্দুতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ এর সময় পরাশক্তিগুলোর ভারসাম্যের প্রশ্নে দেশটির ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। এর অর্থ হলো দেশটিকে সারা জীবনই বিদেশী শক্তিগুলোর চক্রান্তের বিষয়বস্তু হয়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটির একইসাথে চীন, ভারত, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রীজোট বাঁধা আপাতদৃষ্টে বাস্তববাদী বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর মনে হলেও বস্তুত এ কারণেই ওয়াশিংটন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। যেহেতু দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কনিষ্ঠ অংশীদার’ হতে রাজি হয়নি। 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]