আলেক্সান্দ্রা কল্লোনতাই




আলেক্সান্দ্রা কল্লোনতাই ১৮৭২ সালে ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৪ সালে কল্লোনতাই প্রথম রাজনৈতিক কাজ শুরু করেন, যখন তিনি সদ্যজাত সন্তানের মা। এসময় তিনি সান্ধ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে ‘রাজনৈতিক রেডক্রস’ নামে একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে প্রকাশ্য ও গোপন উভয় কাজই করেন। সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল রাজবন্দীদের সহযোগিতা করার জন্য। পরে তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা অগাষ্ট বেবেলের রচিত ‘নারী ও সমাজতন্ত্র’ বইটি অধ্যয়ন করেন। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/August_Bebel

বইটি অধ্যয়ন তার রাজনৈতিক জীবনে নারীমুক্তির দর্শন অনুশীলনে ব্যাপক প্রভাব রাখে।

https://www.marxists.org/archive/bebel/1879/woman-socialism/index.htm

১৮৯৬ সালে তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক কারখানায় শোষণ ও নিপীড়ন সরেজমিনে দেখেন। পরের বছর সেইন্ট পিটার্সবুর্গের বস্ত্র কারখানার শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং অর্থ সংগ্রহ করেন। এরপর থেকে সেইন্ট পিটার্সবুর্গের নারী শ্রমিকদের সাথে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের বাকি সময়ে যোগাযোগ রেখেছেন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। ১৮৯৬ সালের সেইন্ট পিটার্সবুর্গের শ্রমিক ধর্মঘটের পর থেকেই তিনি অনুধাবন করতে থাকেন শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব ও শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রের কথা। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব ছাড়া যে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সম্ভব নয় এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের প্রতি তিনি সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ হয়ে পড়েন। মার্কসীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে কল্লোনতাই তার শিশু সন্তান ও স্বামীকে রেখে মার্কসবাদী অর্থনীতি পড়তে জুরিখ চলে যান। এরপর রাশিয়ায় ফিরে সংশোধনবাদী বার্নস্টাইনের বিরুদ্ধে রচনা লেখেন। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eduard_Bernstein

১৮৯৯ সালে তিনি রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টিতে (রুশ কমিউনিস্ট পার্টি) যোগদান করেন এবং গোপন কাজ শুরু করেন। ১৯০০ সালে তিনি প্রথম ফিনল্যান্ডের সমস্যার উপর নিবন্ধ লিখে রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তী ২০ বছর ফিনিশ সমস্যার উপর অগ্রণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন তিনি। তিনি জারের দুমায় রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের পরামর্শদাতা হিসেবে ও ফিনল্যান্ডের বিপ্লবীদের সংযোগকারী রূপে কাজ করেন। ফিনল্যান্ডের জার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরামর্শ দেয়ার ‘অপরাধে’ গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হলে তিনি গ্রেফতার এড়াতে নির্বাসনে চলে যান। কল্লোনতাই ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সাল- এই তিন বছর বুর্জোয়া নারীবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালান, নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দেন, সমাজতন্ত্রী সংগঠনগুলোর মধ্যে পুরুষদের আধিপত্য এবং রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ - এই তিন বছর নারীদের মধ্যে তিনি যে কাজগুলো করেন তাতে তিনি নারীমুক্তির নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৭ এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে তিনি কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। এসময় তিনি অন্যান্য বিষয়েও লেখালেখি করেন। তিনি জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেন। আসন্ন বিশ্ব যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর কারণে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯১৫ সালে মুক্ত হয়ে তিনি লেনিনের সাথে যোগযোগ স্থাপন করেন এবং বিশ্বযুদ্ধে অগ্রণী সৈনিকদের প্রতি পুস্তক রচনা করেন ‘কে যুদ্ধ চায়?’ নামে। বইটি কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। একই বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে চার মাস বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান যুদ্ধের বিরুদ্ধে সমর্থন গড়ে তোলার জন্য। তিনি ১২৩টি সভায় ৪টি ভাষায় বক্তৃতা দেন। ১৯১১ সালের প্রথমদিকে ইতালিতে প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্সিম গোর্কীর সমাজতান্ত্রিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯১৭ সালের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে-বিপক্ষে যখন বিতর্ক চলছিল তখন তিনি লেনিনের সারিতে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানান। তিনি ৪ এপ্রিল বলশেভিকদের সভায় লেনিনের পর সোভিয়েতের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদানকে সমর্থন করেন। অক্টোবর বিপ্লবের পর তিনি লেখক বক্তা ও রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নারী পত্রিকা 'রাবোৎনিৎসা'য় কাজ করেন। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rabotnitsa

১৯১৯ সালে অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন এর সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নরওয়েতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন এবং মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কল্লোনতাই সোভিয়েত মন্ত্রীসভায় বৈদেশিক পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে বুদ্ধিজীবী তাত্ত্বিক নেতা। যার প্রতিফলন ঘটে তার বিভিন্ন লেখালেখি, বক্তৃতা ও বিবৃতিতে। তিনি নারীদের সমস্যা, শিশুদের সমস্যাসহ যুদ্ধের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক রচনা করেন। তিনি রুশ সমাজের নিপীড়িত নারীদের জন্য গুরুত্ব সহকারে কাজ করে গিয়েছেন। তিনি তার তীক্ষ্ণ লেখনীর মাধ্যমে বুর্জোয়া নারীবাদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালান এবং কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে লুকিয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেন। কল্লোনতাই নারীদের যৌনমুক্তির প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক সংগ্রাম চালান। নারী-পুরুষের অবাধ যৌন সম্পর্কের পক্ষে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও তিনি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন সমাজের আমূল রূপান্তর ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ছাড়া অবাধ যৌন সম্পর্ক নারীর জন্য নিপীড়ন ডেকে আনতে বাধ্য। তিনি নারী সমস্যার উপর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কেন্দ্রীয় নারী বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কল্লোনতাই প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত। বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা নারীমুক্তির নামে গলাবাজি করলেও তারা যা পারেনি তা মানব জাতির সামনে প্রথম দেখিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কল্লোনতাই এর জীবনী ভিত্তিক দু’টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। লেনিনের উন্নততর লাইন ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কল্লোনতাই এর বিভিন্ন সময়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- ১৯০৩ সালে বলশেভিক-মেনশেভিক বিভক্তি হওয়ার সময় বলশেভিকদের সঠিক লাইনে না দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেন তিনি। অবশ্য ১৯০৪ সালে তিনি বলশেভিকদের সাথে যোগদান করেন। পুনরায় ১৯০৬ সালে দুমায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বলশেভিকদের ত্যাগ করেন। অক্টোবর বিপ্লবের পর তিনি দ্বিতীয় সর্বরাশিয়া সোভিয়েতগুলোর সম্মেলনে নতুন সোভিয়েত সরকারের সমাজ কল্যাণ কমিশার পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু ব্রেষ্টলিৎভস্ক চুক্তির বিরোধিতা করে এবং ফিনল্যান্ড ইস্যুকে কেন্দ্র করে তিনি পদত্যাগ করেন। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Brest-Litovsk

তিনি ১৯০৫ সালে ট্রটস্কীপন্থীদের সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]