১৯৬৫ সালে কী সম্ভাবনার নির্দেশ দিচ্ছে? (৫ নং দলিল)



কিছু কমরেড আছেন যারা সশস্ত্র সংগ্রামের কথা শুনলে আতংকিত হয়ে ওঠেন এবং হঠকারিতার ভূত দেখতে থাকেন। তারা পার্টির ৭ম কংগ্রেসের গৃহীত প্রোগ্রাম অর্থাৎ strategic document [রণনীতিগত দলিল] গৃহীত হওয়ার সাথে সাথেই বিপ্লবী পার্টি গড়ার কাজ শেষ হয়েছে বলে মনে করেন। তারা পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত আন্দোলন সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব নেওয়া থেকেই এই সিদ্ধান্তে এসে পোঁছান যেন ৭ম কংগ্রেসে বিপ্লবের বর্তমান স্তর ও শ্রেণী বিন্যাস ছাড়াও এই যুগের কৌশলও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। তাদের কথা থেকে মনে হয় যেন শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলনই হলো এই যুগের প্রধান সংগ্রাম কৌশল। ক্রুশ্চেভের শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর কৌশল তারা প্রকাশ্যে না বললেও যা বলতে চান তা হলো প্রায় সেই কথাই। তারা বলতে চান যে, ভারতে বিপ্লবের সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে নেই- কাজেই বর্তমানে আমাদের শান্তিপূর্ণ পথেই চলতে হবে। বিশ্বব্যাপী শোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যুগে প্রকাশ্যভাবে তারা শোধনবাদী সিদ্ধান্তগুলো বলতে পারছেন না, কিন্তু যারাই সশস্ত্র সংঘর্ষের কথা বলছে তাদের হঠকারী, পুলিশের লোক ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করছেন। অথচ সরকার কাশ্মীরের গণ আন্দোলনকে বাদ দিলেও কম করে ৩০০ লোককে হত্যা করেছে গত আট মাসে। বন্দীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক সহস্র এবং দু’একটি রাজ্য গণ বিক্ষোভে আলোড়িত হয়ে উঠেছে। এইসব বিক্ষোভকারীদের সামনে আমরা কি কার্যক্রম রাখছি? কিছুই না। আর অন্যদিকে স্বপ্ন দেখছি আমাদের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলন গড়ে উঠবে। এটা হচ্ছে শোধনবাদের এক নির্লজ্জ নিদর্শন। একথা আজও আমাদের মাথায় ঢুকছে না যে, শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলন আমরা আজকের যুগে গড়ে তুলতে পারিনা, কারণ শাসকশ্রেণী সে রকম কোনো সুযোগ আমাদের দেবে না এবং দিচ্ছেও না। ট্রাম ভাড়া প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে আমাদের এই শিক্ষাই নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করছি না, আমরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বুঝছি না যে এ যুগে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। তার মানে এই নয় যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন এ যুগে একেবারেই অচল। সব যুগেই সব রকম আন্দোলন চালাতে হয়, কিন্তু প্রধান আন্দোলনের ধরণ নির্ভর করে শাসকশ্রেণীর উপর। আমাদের যুগে বর্তমান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, সরকার প্রতিটি আন্দোলনের মোকাবিলা করছে হিংস্র আক্রমণ করে। কাজেই জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের। তাই আজ গণ আন্দোলনের স্বার্থে শ্রমিকশ্রেণী, সংগ্রামী কৃষকশ্রেণী ও প্রত্যেকটি সংগ্রামী জনসাধারণকে আহ্বান জানাতে হবে- 
১। সশস্ত্র হও। 
২। সংঘর্ষের জন্য সশস্ত্র ইউনিট তৈরী কর। 
৩। প্রত্যেকটি সশস্ত্র ইউনিটকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত কর। 

এই আওয়াজ না দেওয়ার অর্থ নিরস্ত্র জনতাকে নির্বিচারে হত্যার মুখে ঠেলে দেওয়া। শাসকশ্রেণী তাই চায়, কারণ এই ভাবেই তারা সংগ্রামী জনতার মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারবে। বিক্ষুদ্ধ জনতা আজ আক্রমণ করে রেলওয়ে, ষ্টেশন, থানা ইত্যাদি। অজস্র বিক্ষোভ ফেটে পড়ে সরকারী বাড়ীগুলির উপর নয়তো বাস, ট্রাম বা ট্রেনের উপর। এ যেন সেই লুডাইটদের বিক্ষোভ, যন্ত্রের বিরুদ্ধে। বিপ্লবীদের সচেতন নেতৃত্ব দিতে হবে। আঘাত হানো ঘৃণিত আমলাদের বিরুদ্ধে, পুলিশ কর্মচারীর বিরুদ্ধে, মিলিটারী অফিসারদের বিরুদ্ধে। জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে- দমননীতি থানা করে না করে থানার দারোগাবাবু, আক্রমণ পরিচালনা করে সরকারী বাড়ী বা যানবাহন নয়, সরকারী দমনযন্ত্রের মানুষ এবং সেই মানুষের বিরুদ্ধেই আমাদের আক্রমণ। শ্রমিকশ্রেণী ও বিপ্লবী জনতাকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে যে শুধু আঘাত করার জন্য আঘাত করো না, যাকে আঘাত করবে তাকে শেষ করবে। কারণ শুধু আঘাত করলে প্রতিক্রিয়া বিভাগ প্রতিশোধ নেবে, কিন্তু খতম করলে সরকারী দমনযন্ত্রের প্রত্যেকটি মানুষ আতংকিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে কমরেড মাও সে তুঙ এর শিক্ষা "শত্রুর অস্ত্রাগার আমাদের অস্ত্রাগার।" সেই অস্ত্রাগার গড়ে তোলার জন্য শ্রমিকশ্রেণীকে অগ্রণী হতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে গ্রামের কৃষককে। আর এই সশস্ত্র ইউনিটগুলিই ভবিষ্যৎ গেরিলা বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে। এই সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে তারাই গ্রামাঞ্চলে সংগ্রামের জন্য দৃঢ় জায়গা (Base area) গড়ে তুলতে পারবে। একমাত্র এই পদ্ধতিতেই আমরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার কাজে নামতে পারবো। শ্রমিকশ্রেণী ও বিপ্লবী শ্রেণীগুলির মধ্যে এই সংগ্রামী ইউনিট তৈরী করার মধ্য দিয়ে আমরা সেই বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে পারবো যে পার্টি বিপ্লবী মার্কসবাদী-লেনিনবাদের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারবে এবং আগামী যুগের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সরকার জনসাধারণের খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না। কাজেই জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে, কাজেই ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়াশীল ধনিকশ্রেণীর স্বার্থেই ভারত সরকার পাকিস্তান আক্রমণ করছে। এই যুদ্ধের পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বযুদ্ধের পরিকল্পনাও কাজ করছে। পাকিস্তান আক্রমণ করে শাসকশ্রেণী আবার বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের জোয়ার সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু এবার ভারতবর্ষ যে আক্রমণকারী সেটা দিবালোকের মত স্পষ্ট। কাজেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরাজয়ের ফলে দ্রুত জনসাধারণের মধ্যে সরকার বিরোধী সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠবে। কাজেই মার্কসবাদীরা আজ চায় যে ভারতীয় আক্রমণকারী সৈন্যবাহিনী পরাজিত হোক। এই পরাজয় নতুন গণবিক্ষোভ সৃষ্টি করবে। শুধু পরাজিত হোক এই কামনা করাই নয়, সাথে সাথে মার্কসবাদীদের সচেষ্ট হতে হবে যাতে এই পরাজয় আসন্ন হয়ে উঠে। কাশ্মীরের গণবিক্ষোভ যে পথে অগ্রসর হচ্ছে সেই পথে ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি প্রদেশে বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে হবে। ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে সংকট সমাধান করতে চাইছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সমাধান করার জন্য আমাদের লেনিন নির্ধারিত পথে অগ্রসর হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত কর, এ আওয়াজের তাৎপর্য আমাদের বুঝতে হবে। ভারতবর্ষে বিপ্লব অনিবার্যভাবে গৃহযুদ্ধের রূপ নেবে এই সত্য যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখলের কৌশলই একমাত্র কৌশল হতে পারে। চীনের মহান নেতা কমরেড মাও সে তুঙ যে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন সেই একই কৌশল ভারতবর্ষের মার্কসবাদীদের নিতে হবে। এই বছরের অভিজ্ঞতা থেকে কৃষক দেখেছে যে সরকার দরিদ্র কৃষকদের খাদ্যের কোনো দায়িত্ব নিলো না বরং যখন কৃষক সাধারণ কোনো আন্দোলনের পথ নিলো তখনই নেমে আসলো সরকারী দমনযন্ত্র, উপরন্তু পাকিস্তান আক্রমণ করে কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো আরো বোঝা। কাজেই দরিদ্র কৃষকদের প্রস্তুত হতে হবে আগামী বৎসরের জন্য। মাঠের ফসল হাতছাড়া হলে তাদের আগামী বছর অনাহারে মরতে হবে। কাজেই এখন প্রস্তুত হোন ফসল দখল রাখার সংগ্রাম কিভাবে করা যায়।

১। গ্রামে গ্রামে সশস্ত্র দল গঠন করুন।

২। এই দলগুলি যাতে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করুন এবং অস্ত্রশস্ত্র রাখার গোপন জায়গা ঠিক করুন।

৩। ফসল লুকিয়ে রাখার গোপন জায়গা তৈরী করুন। আমাদের গত যুগে ফসল লুকিয়ে রাখার কোনো স্থায়ী বন্দোবস্ত আমরা করিনি। কাজেই বেশীর ভাগ ফসলই নষ্ট হয়েছে অথবা শত্রু কবলিত হয়েছে। কাজেই ফসল লুকিয়ে রাখার পাকা ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় লুকানো যায়? পৃথিবীর সব দেশেই যেখানে কৃষক লড়াই করে সেখানে ফসল লুকাতে হয়। কৃষকের পক্ষে ফসল লুকানোর জায়গা একমাত্র মাটির তলাতেই হতে পারে। প্রত্যেক এলাকায় প্রত্যেকটি কৃষককে ফসল মাটির তলায় লুকিয়ে রাখার জায়গা তৈরী করতে হবে, তাছাড়া ফসল কোনোমতেই শত্রুর হাত থেকে বাঁচানো যায় না।

৪। সশস্ত্র ইউনিট ছাড়াও কৃষকদের ছোট ছোট দল তৈরী করতে হবে, পাহারা দেওয়া ও যোগাযোগ রক্ষা প্রভৃতি কাজ করার জন্য।

৫। প্রত্যেকটি ইউনিটকে রাজনৈতিক শিক্ষা দিতে হবে এবং প্রত্যেকটি ইউনিটকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে যে একমাত্র রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনই এই সংগ্রামকে ব্যাপকতর করে তুলতে পারে এবং কৃষকের সংগ্রামী মনোবল বাড়াতে পারে। এখনও ফসল তোলার ২/৩ মাস দেরী আছে, এই সময়ের মধ্যে কৃষক অঞ্চলের পার্টি ইউনিটগুলোকে এই সব কাজ চালিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি চালাতে হবে এবং গোপন কাজ করার কৌশল আয়ত্বে আনতে হবে। আসুন কমরেড, আগামী দিনের সশস্ত্র সংগ্রামের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমরা দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হই।

[এইটুকু লেখার পর চারু মজুমদার ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হন। এই লেখা যখন প্রায় শেষের মুখে তখন ভারতবর্ষের বামপন্থী রাজনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তনের জন্য দলিলটা একটু অন্যভাবে লিখবেন ভেবেছিলেন তবে তিনি সে সুযোগ পাননি, তবে মৌখিকভাবে তিনি যা বলেছিলেন তা হচ্ছে-

"তথাকথিত যে সমস্ত মার্কসবাদী নেতা ও পত্রিকা সরাসরিভাবে দেশরক্ষার জন্য গগণভেদী আওয়াজ তুলছেন তারা মার্কসবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। এদের বিরুদ্ধে আমাদের তত্ত্বগত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে তো হবেই সাথে সাথে জঙ্গী কাজের মাধ্যমে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবীদের মধ্যে সংগ্রামের নতুন ভরসা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং এই একটি জায়গায় একটি অগ্নিস্ফূলিঙ্গই সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবের দাবানলের সৃষ্টি করবে, প্রশস্ত হবে এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখলের পথ, আসন্ন হয়ে উঠবে ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব।"]

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]