হাব্বা খাতুন
কাশ্মীরে অষ্টম শতাব্দীতে মুসলিমরা অভিযান চালালেও হিমালয় তাদের সফল হতে দেয়নি। এর ৫০০ বছর পর অঞ্চলটিতে একটি প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটে লাদাখের বৌদ্ধদের প্রধান রিঞ্চানার মাধ্যমে। তিনি কাশ্মীরে আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন এবং একজন সুফির প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তার নাম হয় বুলবুল শাহ। সেসময় তুর্কি বহিরাগতরা কাশ্মীরের শাসকের অভিজাত গার্ড হিসেবে কাজ করতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rinchan
রিঞ্চানার মৃত্যুর পর এসব তুর্কিদের নেতা শাহ মীর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুসলিম রাজবংশের ভিত স্থাপন করেন যারা ৭০০ বছর রাজত্ব করেছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Shah_Mir
জাইনুল আবিদীন এর রাজত্বের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ কাশ্মীরি অমুসলিম রয়ে যায়। পনেরশ' শতকের শেষ নাগাদ তার রাজত্বের শেষভাগে এসে অধিকাংশ কাশ্মীরি ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি ইরান ও মধ্য এশিয়া ভ্রমণ করেন তার প্রজাদের বই বাঁধানো, কাঠ খোদাইয়ের কাজ, কার্পেট ও শাল বানানো শেখানোর উদ্দেশ্যে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zayn_al-Abidin_the_Great
জাইনুল আবিদীন এর মৃত্যুর পর তার রাজবংশের পতন শুরু হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে মুঘলরা কাশ্মীর জয় করে। স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কাশ্মীরের ছবি আঁকিয়ে ও লিপিকাররা উপত্যকা ছেড়ে দিল্লি ও লাহোর চলে যায় মুঘল দরবারে কাজ খুঁজতে।
সুলতান ইউসুফ শাহ এর স্ত্রীর নাম ছিল জুনি। তিনি ছিলেন সান্দাহার গ্রামের কিষাণী। তার কণ্ঠের সুফি রহস্যে মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাকে বিয়ে করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Habba_Khatoon
সুলতানের তত্ত্বাবধানে তিনি ফারসি ভাষা শিখেছিলেন এবং তারপর নিজেই গান লিখতে শুরু করেছিলেন। একদিন তার সভাসদ নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পাশের মাঠ থেকে জুনির কণ্ঠ শুনে বিমোহিত হয়ে যান ইউসুফ শাহ। তিনি জুনিকে তার দরবারে নিয়ে যান এবং রাজি করিয়ে ফেলেন বিয়ের জন্য। জুনি বিয়ের পর হাব্বা খাতুন [প্রেমিকা] নাম গ্রহণ করেন। তিনি কাশ্মীরি ভাষাকে সাহিত্যিক রূপ দেন এবং এর সাথে পারস্য ও ভারতের সংগীত শৈলীর সমন্বয়কে উৎসাহিত করেন। হাব্বা নারীদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন নিজেদের মতো করে সাজগোজ করার। এজন্য মৌলবাদীরা তার উপর রাগান্বিত ছিল। তিনি এসব মৌলবাদীদের ভণ্ডামিকে বিদ্রুপ করতেন এবং ইসলামের সাথে মরমী ধারার মিশ্রণকে রক্ষা করে চলতেন। নিজেকে তুলনা করতেন এমন এক ফুলের সাথে যা জন্ম নেয় উর্বর মাটিতে এবং যাকে কখনোই উপড়ে ফেলা যায় না। ১৮৫৩ সালে সম্রাট আকবর তার সেনাপতিকে পাঠালেন কাশ্মীর দখলে। ইউসুফ শাহ লড়াই না করেই আত্মসমর্পণ করেন। বিনিময়ের দাবি করেন তাকে সিংহাসনে বহাল রাখতে হবে এবং তার নাম মুদ্রায় খোদাই করা থাকবে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠায় মুঘলরা। অভিজাত কাশ্মীরিরা ইউসুফ শাহ এর উপর রাগান্বিত হয়ে তার ছেলে ইয়াকুব শাহকে সিংহাসনে বসায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yakub_Shah_Chak
এই দুর্বল ও অসংযমী যুবক সুন্নি ও শিয়া আলেমদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়। এই সুযোগে আকবর কাশ্মীর নিজের দখলে আনেন।
দশম শতাব্দীর দুই ক্ষমতাধর রানী সুগন্ধা আর দিদ্দা কাশ্মীরের শাসক হিসেবে সিংহাসনের অধিকারী হয়েছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sugandha
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Didda
কিন্তু হাব্বাকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেয় মুঘলরা। প্রথমদিকে তিনি সুফিদের কাছে আশ্রয় পেলেও পরে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। মুঘলদের শাসনে অত্যাচারিত কাশ্মীরিদের দুর্দশা নিয়ে রচিত তার গানগুলো গাইতে থাকেন। তিনি কোথায় ও কখন মারা যান সেই ব্যাপারে কিছু জানা না গেলেও গত শতাব্দীর মাঝামাঝি আবিষ্কৃত একটি কবরকে তার কবর হিসেবে ধারণা করা হয়।
উল্লেখ্য, "যদি এ ধরণীতে থেকে থাকে কোথাও সুখের স্বর্গ তবে সেটা এখানেই, এখানেই, এখানেই" কথাটি জাহাঙ্গীরের নয়। এটি একটি জনপ্রিয় পারস্য ভাষার শ্লোক যা তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন। আঠারো শতকের দিকে কাশ্মীরের অভিজাত সম্প্রদায় আহমদ শাহ দুররানিকে কাশ্মীর দখলের আহবান জানায়। ১৭৫২ সালে দুররানি কাশ্মীরে এসে মুঘলদের দ্বিগুণ কর জনগণের উপর আরোপ করেন এবং সংখ্যালঘু শিয়াদের উপর অত্যাচার করতে থাকেন।
হাব্বার রচিত একটি গানের লাইন-
"কে তাকে বলে দেবে যে কোথায় থাকতাম আমি?
কেন আমাকে সে ফেলে গেলো এমন এক যন্ত্রণায়?
আমি অসহায়, ভরপুর তার জন্য আকুল আকাঙ্খায়।
আমার জানালা দিয়ে দেখেছিল সে একনজর আমায়,
সে সুন্দর ঠিক যেন আমার কানের দুল,
অস্থির করে ফেলেছে সে আমার মন।
আমি অসহায়, ভরপুর তার জন্য আকুল আকাঙ্খায়।
সে নজর বুলায় আমার উপর ছাদের ফাঁক দিয়ে,
পাখির মতো গায় গান যেন চেয়ে থাকি তার দিকে,
তারপর শান্ত পায়ে হারায় আমার দৃষ্টিসীমা হতে,
আমি অসহায়, ভরপুর তার জন্য আকুল আকাঙ্খায়।
সে চেয়েছিল আমার পানে যখন গিয়েছিলাম আমি পানি তুলে আনতে,
আমি যেন শুকিয়ে যাচ্ছিলাম একটি লাল গোলাপের মতো,
আমার দেহমনে জ্বলছিল তখন প্রেমেরই আগুন,
আমি অসহায়, ভরপুর তার জন্য আকুল আকাঙ্খায়।
ভোরের চাঁদনিতে সে তাকিয়েছিল আমারই পানে,
আটকে রেখেছিল আমায় আচ্ছন্নের মতো করে।
কেন সে ঝুঁকে গেলো এতটা নিচে?
আমি অসহায়, ভরপুর তার জন্য আকুল আকাঙ্খায়।"
Comments